বনাগ্নির তত্ত্ব-তালাশ

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

                                                 

বর্তমান বছরের জুলাই মাসের একেবারে শেষভাগ। তুরস্কের ভুমধ্যসাগরীয় উপকূল। আশপাশের বনাঞ্চলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। প্রবীণ আর অভিজ্ঞরা সকলেই জানেন যেকোনো ধোঁয়ার পেছনেই থাকে আগুনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। অনুসন্ধানে জানা গেল ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের বনাঞ্চল পুড়ছে। আর ক্রমেই লেলিহান শিখা বিস্তার করে চলেছে সেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। 

সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতা মুলক ব্যবস্থা হিসেবে যা করার তা করা হতে লাগল। যেমন আশপাশের লোকালয় বসতিশূন্য করার উদ্যোগ আর অগ্নিনির্বাপণের কাজ। কিন্তু পাশেই যে সাগরের প্রশস্ত ময়দান আর বাতাসের আনন্দে খেলা করার মাঠ। আগুনের সঙ্গে বাতাসের সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে মধুর। আগুন দেখলেই সে ছুটে আসে আর তাকে বাড়িয়ে তোলে। এক্ষেত্রেও হল না তার ব্যতিক্রম। অতএব আগুনের নেভার লক্ষণ নেই। শুধু বেড়েই যায় আর বেড়েই যায়। 

পিছিয়ে আসা যাক মাত্র দুটি বছর। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি। বিশাল অগ্নিকান্ড গ্রাস করল অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলকে। আর সেই সঙ্গে বন থেকে বেরিয়ে এসে গ্রাস করল স্বাভাবিক জনজীবন। জীবন আর সম্পত্তিহানি ছাড়াও রয়েছে বিশাল পরিমাণ জীবজন্তুর জীবন হানি আর ফসল আর কৃষি জমি আর শিল্পের নাশ। এককথায় হতভম্ব মানব সভ্যতার শুধু থমকে যাওয়াই নয় বরং উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে আসা। 

পিছিয়ে আসা যাক আরও কয়েক হাজার বছর আগে আর থমকে থেমে যাওয়া যাক  মহাভারতের যুগে। একটা কাহিনীর উত্থাপন করে ভীত পাঠকের দৃষ্টি একটু অন্য দিকে আনার চেষ্টা করা যাক। রাজা শ্বেতকী যজ্ঞপ্রিয় বলে খ্যাত ছিলেন অর্থাৎ সময়ে অসময়ে যজ্ঞ করতে তিনি খুব ভালবাসতেন। কিন্তু সেই যজ্ঞ বেশির ভাগ সময়ে ফল দান করতে অপারগ ছিল।  এদিকে বিরামহীন নিস্ফল যজ্ঞে বিরক্ত মুনিঋষির দল যখন আর যজ্ঞ করতে চাইল না, তখন রাজা শ্বেতকী মহেশ্বরের ধ্যান করতে লাগলেন। মহাদেব সন্তুষ্ট হতে তাঁর কাছে রাজা বিরতিহীন যজ্ঞের বর প্রার্থনা করলেন। কিন্তু শিবের পক্ষে তা সম্ভব নয় বলেও তাকে দুর্বাসা মুনির সাহায্য নিতে বলেন। দুর্বাসাও মহা সমারোহে প্রায় এক যুগ ধরে নিস্ফল যজ্ঞ করে যেতে লাগলেন। যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হতে লাগল ঘড়া ঘড়া ঘি। দুর্বাসার তাতে কী। লাগে ঘি দেবে রাজা শ্বেতকী। 

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই যজ্ঞের ঘি হজম করা অগ্নিদেবের পক্ষেও সম্ভব হল না।  আক্রান্ত হলেন অগ্নিমান্দ্যে আর জর্জরিত হতে হতে অগ্নিদেব আমিষ ভোজনের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। বিশাল খান্ডববন দহন করে তার মধ্যেকার জীবজন্তুর মাংস খেতে উদ্যত হলেন। কিন্তু স্বয়ং ইন্দ্রদেবের সুরক্ষায় ছিল সেই বন। তিনি নিশ্চিত বাধা দেবেন এই কাজে। তাছাড়াও বাধা আসতে পারে সেই বনের পশুপাখি বা কীটপতঙ্গদের তরফ থেকে। তারাই তো এই বনের স্থায়ী বাসিন্দা। এ কাজ সহজ নয় বরং দুরুহ। 

অগ্নি্দেব তখন চললেন পান্ডবদের কাছে সাহায্যের আবেদনে। পান্ডবরা রাজি হয়েও বলল, ইন্দ্রদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করার এত অস্ত্র তো আমাদের কোথায়? আপনি যদি যোগাড় করে দেন তো আমরা রাজি। অগ্নিদেব তখন বরুণদেবের কাছ থেকে অর্জুনের জন্যে গান্ডীব ধনু আর কপিধ্বজ রথ এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্যে গরুড়ধ্বজ রথ, পাঞ্চজন্য শাঁখ, কৌমোদকী গদা আর সুদর্শন চক্র চেয়ে এনে আর তাঁদের এগুলি প্রদান করে তাঁদের এই খান্ডবদহনে সম্মত করালেন। অবশেষে খান্ডবদহন হল। বিশাল এই বন পুড়ে গেল। মানে পোড়ান হল। পুড়ল বনের পশুপাখী, কীটপতঙ্গ। যারা বেঁচে পালিয়ে আসছিল তাদের ওপরে নির্ভুল লক্ষে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল কৃষ্ণার্জুনের বাণ। ছয়জন বাঁচল তাদের মধ্যে একজন হল ময়দানব। ইনি ছিলেন এক বিখ্যাত বাস্তুকার যাকে পরবর্তীকালে কাজে লাগান হয়েছিল পান্ডবদের নতুন রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণে। 

মহাভারতের এই ঘটনাটি বলছে একটি বিশাল বন পুড়িয়ে দেওয়া হল আর তাঁর ফলশ্রুতিতে বিশাল পরিমাণ জীবজন্তু, পাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মানুষের কথা না বলা হলেও এ ধারণা আমরা করে নিতেই পারি যে তার মধ্যে মানুষও ছিল কারণ বনে কিছু বনবাসী বা যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে বা থাকতেই পারে। এটি কিন্তু ইচ্ছাকৃত দাবানল সৃষ্টির একটি উদাহরণ অবশ্যই। তবে দাবানলের মত প্রাকৃতিক ঘটনার সৃষ্টিতে প্রকৃতি বেশি করে দায়ী এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে না। তেমনই দৃষ্টান্তের কার্পণ্য নেই ইচ্ছাকৃত দাবানল সৃষ্টির ঘটনায়। প্রকৃতির যেকোনো ঘটনাই মানুষ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। ভাল লোকে ভাল কাজে আর দুষ্ট লোকে করে খারাপ কাজে। 

এবার আসা যাক গত আগস্ট মাসের সাম্প্রতিক আমাজনের দাবানলের ঘটনায়।  মারাত্মক রকমের উৎকণ্ঠিত সারা বিশ্ববাসী। এত বিশাল জায়গার বিস্তার নিয়ে বিশাল পরিমাণ বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড আগে কখনও হয় নি। ব্রাজিলের অন্তর্গত আমাজনের দীর্ঘ বনাঞ্চলে গত বছরে প্রায় ৭৫ হাজারের বেশি অগ্নিকান্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বাধিক ঘটতে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের পর থেকে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের কথা তো আগেই বলেছি। বহু লোকালয় পুড়েছে, ঘটেছে প্রাণহানি। বহু লোক হয়েছে আশ্রয়হারা। এখানে ওখানে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বারনাবতের। 

দাবানল প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। অসংখ্য কারণের মধ্যে এর প্রধান কারণ হল শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল বনাঞ্চলের শীর্ষে অর্থাৎ সামিয়ানায় (Canopy) বায়ুপ্রবাহে গাছের শুকনো ডালপালা আর পাতায় পাতায় ঘর্ষণ। এই ঘর্ষণ সৃষ্টি করে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর শুষ্ক পাতা আর ডাল এই স্ফুলিঙ্গকে আগুনের রূপ দেয়। বনে তো পাশাপাশি তো হাজার হাজার গাছ। এই গাছগুলির মাধ্যমে পরিবহন পদ্ধতিতে আগুন এগিয়ে যেতেই থাকে ক্রমশ। অর্থাৎ গাছ থেকে গাছে আগুন লেগে যাওয়া। বনভূমিতে  বজ্রপাতের ফলেও এটা ঘটতে পারে। বায়ুপ্রবাহে এই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।  লোকবসতিহীন এই বনগভীরে নির্বাপন অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। তাই এই আগুন অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বনভূমিকে ক্রমশ গ্রাস করতেই থাকে। বনাঞ্চল ভস্মীভূত করার পর তা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজে। আগুন ক্রমে যখন বিশাল চেহারা নিয়ে লোকালয়ের দিকে ধাবিত হয় তখন তা লোকালয়কেও ধ্বংস করে সাংঘাতিক ভাবে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়ন আর বৃষ্টিপাতের ক্রমহ্রাস প্রকৃতির এই কাজে আরও সহায়ক তা বলাই বাহুল্য। অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী এই দুটি বিষয়ের ওপর খুব জোর দিচ্ছেন। কেন সেটা বুঝতে হবে। 

আমরা জানি একটি ভিজে বা স্যাঁতস্যাঁতে কাঠ, কাগজ বা পাতা অথবা অন্য যে কোনও বস্তু সহজে জ্বলে না। অনেক দেরিতে জ্বলে। একটি জিনিস আগুনে দিলেই কিন্তু দাহ্য হলেও তাতে আগুন নাও লাগতে পারে। জলে ভিজে একটা কাগজ একেবারেই জ্বলবে না। অল্প ভিজে হলে জ্বলবে তবে দেরিতে। এইভাবে শুষ্কতার মাত্রা যত বেশি হবে তত তাড়াতাড়ি সে জ্বলবে। যে কোনও বস্তুর দহনাংক (Burning Point) বলে একটি জিনিস আছে। সেটি হল যে তাপমাত্রায় এটি জ্বলবে। এই দহনাংক কিন্তু ভিন্ন বস্তুর ভিন্ন। একটি পাতলা কাগজ যত তাড়াতাড়ি জ্বলে একটি মোটা কাগজ তত তাড়াতাড়ি নয়। যেকোনো বস্তুকে বাইরের আবহাওয়ায় রেখে দিলে সেই তাপমাত্রা সে গ্রহণ করে। বাইরের তাপমাত্রা যত বেশি হবে সেটি তত তাড়াতাড়ি জ্বলে যাবে। কারণ উচ্চ তাপমাত্রায় থাকার জন্যে সে তো তার দহনাংকের দিকে বেশ কিছুটা এগিয়েই গেছে। তাই ভূগোলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি গাছপাতা ইত্যাদিকে দহনাংকের দিকে অনেকটা এগিয়ে রাখতে সাহায্য করে। 

ভিজে কাঠ কিন্তু শুকনো কাঠের থেকে দেরিতে জ্বলে। কারণ ভিজে কাঠে যে জল থাকে আগুনের উত্তাপ প্রথমে সেই জল বাষ্পে পরিণত করে তারপর তার উত্তাপ বাড়ায়। যতক্ষণ এতে কিছু পরিমাণ জল থেকে যাচ্ছে ততক্ষণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি হয় না। অর্থাৎ ভিজে কাঠকে তাঁর দহনাংকে পৌছে দিতে অনেক বেশি উত্তাপ দিতে হয় আর তাতে সময় লেগে যায়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টিহীন প্রকৃতি কিভাবে দাবানলের সহায়ক হয়। অতএব এই দুটি কারণ দাবানলের পক্ষে যথেষ্ঠ কারণ এটা বোঝা গেল।  

প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও আছে আরও অসংখ্য মনুষ্যসৃষ্ট অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত কারণ। সে বিষয়ে অনেকেই বিভিন্ন ভাবে অবগত আছেন। সেগুলির পুনরুল্লেখে এই প্রবন্ধকে দীর্ঘায়িত না করলেও চলে। এবার আমরা প্রবন্ধের শিরোনাম অর্থাৎ বনাগ্নি বা দাবানলের পরবর্তী ফলাফল নিয়ে আলোচনায় এগোই। 

অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত যে ধরণেরই হোক দাবানলের অবশ্যই কিছু ফলাফল আছে। যে কোনও ক্রিয়ারই যেমন প্রতিক্রিয়া থাকে তেমনই দাবানলেরও প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রতিক্রিয়া না বলে একে অভিঘাত বলাই ঠিক। কিছু ফল বিষময় হলেও কিছু অমৃতময় হতে পারে। যদিও অমৃতময় ফলের থেকে বিষময় ফলগুলির সংখ্যা আর প্রভাব অনেক বেশি আর দীর্ঘস্থায়ী। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফলগুলির আবার কিছু তাৎক্ষণিক আর কিছু সুদূরপ্রসারী হতে পারে। 

দাবানলের ফলাফল (effects of forest fire):

দাবানলের ফলগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার প্রথমে আসবে দাবানলে উৎপন্ন পদার্থগুলির প্রসঙ্গ। প্রাকৃতিক বা মনুষ্যকৃত যে কোনো ধরণের হোক, বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায় দাবানল একটি দহন। আর দহনে সর্বদাই ইন্ধন ভস্মীভূত বা রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তিত হয়। ইন্ধন বা জ্বালানী বলতে আমরা সাধারণত বুঝি কাঠ, কয়লা, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি। তবে দাবানলে ইন্ধন বলতে বনের শুকনো গাছপাতা ছাড়া আর কী থাকবে? গাছপাতার মূল উপাদান হল কার্বন। একশ ভাগ কাঠে উপাদান হিসেবে শতকরা পরিমাণ হল এই রকমঃ

১। কার্বন হল প্রায় ৫০ ভাগ, 

২। অক্সিজেন ৪২ ভাগ

৩। হাইড্রোজেন ৬ ভাগ

৪। নাইট্রোজেন ১ ভাগ

৫। অন্যান্য উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, ক্লোরিন, সিলিকন, ফসফরাস ইত্যাদি মিলিয়ে ভাগ। 

সুতরাং এটা ভাবা খুব সহজ যে দাবানলে এই সমস্ত পদার্থগুলির রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটবে আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের অক্সাইড উৎপন্ন হবে। কারণ যে কোনও দহনের অর্থই হল অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া। দাবানলে বিশাল সংখ্যায় গাছ পুড়লে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে গ্যাসটি উৎপন্ন হবে সেটি হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাছাড়াও থাকবে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, কাঠে উপস্থিত বিভিন্ন ধাতু ও অধাতুর অক্সাইড ছাড়াও উৎপন্ন হবে জলীয় বাষ্প। কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতির দুটো কারণ। প্রথম কার্বনের অপূর্ণ অক্সিডেশন আর দ্বিতীয় হল অতিরিক্ত কার্বনের সংস্পর্শে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিজারণ। বনে যখন আগুন লাগে তখন অন্যান্য উৎপন্ন গ্যাসের সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইডও পথ খোঁজে বাইরে বেরোবার। কিন্তু গাছের ভীড়ে আর অন্যান্য গ্যাসের আধিক্য থাকার ফলে এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছের পোড়া দেহের চারকোলের সান্নিধ্যে বিজারিত হয়ে কার্বন-মনোক্সাইডে পরিণত হয়। 

C+O2= CO2 (কার্বনের জারণ)

CO2+C= 2CO (কার্বন-ডাই=অক্সাইডের বিজারণ)। 

শুধু গাছপালাতেই নয় যে কোনও জীবজন্তু, পাখি, কীটপতঙ্গের দেহের মূল আর সর্বাধিক উপাদান আবার কার্বন। একটি বনে তো শুধু গাছপালাই থাকে না। থাকে অনেক পশুপাখি আর পোকামাকড়। এদের দেহ যখন ভস্মীভূত হয় তখনও বেশি পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হয়। ফ্যাট, প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদির দহনের মূল পরপ্রাপ্তি কার্বন-ডাই আর মনোক্সাইড হলেও এর সঙ্গে থাকে নাইট্রোজেন আর সালফারের বিভিন্ন অক্সাইড। থাকে বিভিন্ন ধাতুর অক্সাইড যারা উচ্চ তাপমাত্রার কারণে গ্যাসীয় অবস্থায় উন্নীত হয়। হাইড্রোকার্বনগুলিও পুনরায় দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি করে কার্বন-ডাই বা মনোক্সাইড। হাইড্রোকার্বনগুলির দহনে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সঙ্গেও উৎপাদিত হবে জলীয় বাষ্প। অর্থাৎ গ্যাস আর গ্যাস,  গ্যাসের প্রায় ছড়াছড়ি। তাছাড়াও ভস্মাবশেষে থাকবে প্রচুর পরিমাণ পোড়া কার্বন যেগুলি খুব হালকা হওয়ায় বাতাসের সঙ্গে উড়তে থাকে আর দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক যেমন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে তেমনি চাষের জমির ওপর পড়ে তাকে করে তোলে অনুর্বর।  

আগুন থাকলেই ধোঁয়া থাকবেই আর ধোঁয়াতে থাকবে ধুলো, বালি আর পোড়া বা আধপোড়া কার্বনের গুঁড়োর সঙ্গে অন্য ধাতু বা অধাতুগুলির না পোড়া গুঁড়ো। 

দাবানলে উৎপন্ন গ্যাসীয় পদার্থঃ

এটা নিশ্চয় খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে উৎপন্ন গ্যাসগুলির মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হল সর্ববৃহৎ। সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড, জলীয় বাষ্প, নাইট্রোজেনের কয়েকটি অক্সাইড, মিথেন। এ ছাড়াও কাল কার্বন বা ব্ল্যাক কার্বন, আর কিছু অন্যান্য পদার্থ। 

পরিবেশের ওপর প্রভাব (effects on environment):

দাবানলে সৃষ্ট গ্যাসগুলির মধ্যে দুটি অর্থাৎ জলীয় বাষ্প এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড হল গ্রীন হাউস গ্যাস। গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণ আবশ্যিকভাবে ঘটায়। অর্থাৎ বাতাসের উত্তাপ বৃদ্ধি ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়।  মনে রাখতে হবে দাবানল কিন্তু বিশাল একটা জায়গা জুড়ে হয়। অনিয়ন্ত্রিত থাকার জন্যে দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। আর বাস্তব ক্ষেত্রেও আমরা কিন্তু তাই দেখি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর আগুন যেন নিভতেই চায় না। কার্বন-ডাই-অক্সাইড আবার ভারি গ্যাস তাই তাই এটি বায়ুমন্ডলের নিচের দিকেই অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারেই থাকবে। তবে দীর্ঘদিনের দাবানলে এই গ্যাস কিন্তু ট্রপোস্ফিয়ারের সীমা ছাড়িয়ে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারেও চলে আসতে পারে। দাবানলে জলবায়ুতেও পরিবর্তন আসতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে তাপপ্রবাহ চলতে থাকার কারণে খরা ও অনাবৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়। আবহাওয়ার অনিয়মিয়তা চলতে পারে।

স্বাস্থ্যে প্রভাব (effects on health):

দাবানলে পরিবেশ দূষণ সাংঘাতিকভাবে হয়। আর যে কোনও পরিবেশ দূষণ সর্বদাই স্বাস্থ্যের ওপর গভীর আর সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেলে। বিশ্বের ঘটমান ক্রমউষ্ণায়নের সঙ্গে দাবানলের মত বিশাল মাপের অগ্নিকান্ড পরিবেশের ওপর যে বিরাট মাপের প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। এটা যেন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়ার’ মত বিপজ্জনক এক ঘটনা।  প্রাকৃতিক জিনিস প্রাকৃতিক সীমায় থাকে সে কিন্তু ভৌগোলিক সীমানা মানে না। দাবানলে উৎপন্ন ক্ষতিকারক গ্যাসগুলির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাই তারা দ্রুত বা ধীরগতিতে ধেয়ে যাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। এক দেশ থেকে এক দেশে। তাই দাবানলের সন্নিকটের বাসিন্দাদের যেমন দ্রুত বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে তেমনি দূরের বাসিন্দাদের থাকে ধীর বিষক্রিয়াজনিত স্বাস্থ্যাবনতির সম্ভাবনা থেকেই যেতে পারে। 

কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবঃ 

স্বাভাবিক বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড থাকে না। দহনের ফলে নিকটস্থ বাতাসে তৈরি হয়। কিন্তু অধিক স্থায়িত্ব এর নেই। প্রচন্ড অক্সিজেন আগ্রহের ফলে (oxygen affinity) তা বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অর্থাৎ এক স্থানে উৎপন্ন কার্বন মনোক্সাইড ছড়িয়ে বেশি দূরে যেতে পারে না। কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া খুব দ্রুত। মানুষ বা জীব বাতাস থেকে এই গ্যাসটি গ্রহণ করতে বাধ্য হলে তীব্র অক্সিজেন আগ্রহের জন্যে সে রক্তের মধ্যে থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে রক্তের অক্সিজেন সমৃদ্ধ অক্সিহিমোগ্লোবিনকে কার্বক্সিহিমোগ্লোবিনে রূপান্তরিত করে। ফলে রক্তে সাংঘাতিক অক্সিজেন ঘাটতির জন্যে কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে অংশে অক্সিজেন ঘাটতি হয় সেই স্থান সায়ানোসিসের ফলে সম্পূর্ণ নীল হয়ে যায়। রক্তে আশি শতাংশের অতিরিক্ত কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন থাকলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটতে পারে। আর পরিমাণ তার চেয়ে কম থাকলে শরীর অসুস্থ হয়। শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা ও মাথাব্যথা, বমি ও গা বমি লক্ষণগুলি দেখা দেয়। অনেক বেশি থাকলে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় আর ফলে বিভ্রান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, ভ্রান্তি-দর্শন, হৃদয়ের গতি বৃদ্ধি হয়, ফুসফুস আক্রান্ত হয়। এইভাবে গ্যাসটির শতাংশিক মাত্রার বৃদ্ধি মানুষটিকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। 

কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিষক্রিয়াঃ  

কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসটি কিন্তু মোটেই বিষাক্ত নয়। কার্বন মনোক্সাইডের মত এটি মোটেই মস্তিষ্কেও তার বিশেষ কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু এই গ্যাসটি অত্যন্ত ভারি। যে কোনও বড় অগ্নুৎপাত  দাবানল, আগ্নেয়গিরি, চাষের জমিতে বজ্রপাতের ফলে বিশাল অগ্নিকান্ডে উৎপাদন ছাড়াও পুরোন মজা অর্থাৎ শুকনো কুয়ো, ফাঁকা স্যানিটারি চেম্বার, ভূগর্ভের প্রকোষ্ঠ ইত্যাদিতে এই ভারি গ্যাসটি সঞ্চিত থাকতে পারে ও থাকে।  

তাহলেও শরীরে এর মারাত্মক প্রভাব তবে কি? কারণ এই গ্যাস অত্যন্ত ভারি অর্থাৎ ঘনত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এটি বাতাসের অক্সিজেনকে রুদ্ধ করে দেয় ফলে অক্সিজেনের অভাব ঘটে। তাই এটি মূলত শ্বাসরোধী (asphyxiant) হিসেবে কাজ করে। আমাদের ফুসফুস প্রতি মুহূর্তে বাতাস থেকে যে অক্সিজেন গ্রহণ করছে তা হার্ট পাম্প করে ধমনীর পথে পৌছে দিচ্ছে কোষে কোষে। গৃহীত খাদ্য আর এই অক্সিজেন মিলিয়ে সংঘটিত হচ্ছে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া তাকে আমরা বলি মেটাবলিজম। মেটাবলিজমে অক্সিজেন ব্যবহৃত হয় আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড পড়ে থাকে বিক্রিয়া-ফল (metabolic end product) হিসেবে। এটি শিরার মধ্যে দিয়ে হার্ট হয়ে প্রবেশ করে ফুসফুসে আর বাইরে বেরিয়ে যায়।

তাহলে এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আসলে শরীরের বর্জ পদার্থ অর্থাৎ আবর্জনা। আবর্জনা ঘরে পুষতে হলে মানুষের শরীর যেমন অসুস্থ হয় এক্ষেত্রেও তেমন হতে বাধ্য।  

এজমা ও অন্যান্য ব্রংকিয়াল ব্যাধির বৃদ্ধিঃ

দাবানলে উপস্থিত প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড যেমন ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় তেমনি অগ্নিকান্ডের ফলে বায়ুতে উপস্থিত ধুলো, ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা নানা কঠিন দ্রব্য যেমন পোড়া বা আধপোড়া কার্বন ছাড়াও সেলুলোজ (গাছ বা কাঠের একটি আবশ্যিক উপাদান) বাধ্যতামূলক ভাবে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ঢুকে যায়। ফলে ফুসফুস ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রগুলি একদিকে যেমন আংশিক অবরুদ্ধ হওয়ার প্রয়াস পায় তেমনি ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগও। ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া ছাড়াও ব্রংকিয়াল এজমার ঘোর সম্ভাবনা থেকে যায়। সেলুলোজ হল তুলো জাতীয় পদার্থ যা রোগগ্রস্ত ফুসফুসের চটচটে শ্লেষ্যায় আটকে হাঁপানির সম্ভাবনা দ্রুততর করে। 

বনভূমির ক্ষতি (effects on forest soil): 

বনভূমিতে অর্থাৎ বনের মাটিতে গাছের জন্ম, বৃদ্ধি আর স্থায়িত্বের জন্যে দায়ী ধাতব ও অধাতব মৌলিক পদার্থগুলি হল এই রকমঃ

নাইট্রোজেনঃ প্রোটিন ও আমিনো এসিডের জন্ম দেয়।

ফসফোরাসঃ নিউক্লেয়িক এসিড ও এ-টি-পি (adenosine triphosphate)।

পটাশিয়ামঃ উদ্ভিদের দেহ অভ্যন্তরস্থ রাসায়নিক বিক্রিয়া সমূহে প্রয়োজনীয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। 

ক্যালসিয়ামঃ উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর গঠনে আবশ্যিক।

ম্যাগনেশিয়ামঃ ক্লোরোফিলের অংশ হিসেবে উপস্থিত থাকে।

সালফারঃ এমিনো এসিড সৃষ্টিতে।

দাবানলের প্রচন্ড উত্তাপে এই অত্যন্ত আবশ্যিক পদার্থগুলির কিছুর জারণ ঘটে আর অক্সাইড হিসেবে নির্গত হয় এবং অন্য পদার্থের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে ভিন্ন পদার্থে পরিণত হয় যা গাছের কোনও কাজে লাগে না। কিছু ভস্মীভূত হয়। তাই এর ফলে বনভূমির মাটি তার উর্বরতা হারায় অর্থাৎ নতুন করে গাছ সৃষ্টিতে বাধা ও বিলম্ব ঘটে। অর্থাৎ বনভূমির বিনাশ ঘটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ বনভূমির সংকোচন আর জমির উর্বরতা হ্রাস। উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পুনচক্রিকরণের জন্যে সার্বিক ভাবে দায়ী। অর্থাৎ বিভিন্ন কারণে বাতাসে উৎপন্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছের উপস্থিতির কারণে ঠিক তেমব ভাবেই থেকে যায়।  দাবানলে বনভূমির ব্যাপক সংকোচন প্রকৃতির এই স্বাভাবিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুনচক্রিকরণ সাংঘাতিক ভাবে ব্যহত হয়। অর্থাৎ দহনে অক্সিজেন শোষিত হয় শুধু কিন্তু আর ফিরে আসে না। প্রকৃতি বছরের পর বছর ধরে নিজের প্রচেষ্টায় যে বন সৃষ্টি করে দাবানল মাত্র কয়েক দিনেই তা বিনষ্ট করতে পারে। 

ইকো সিস্টেমে ব্যাঘাত (disturbance in echo system):

দাবানল একটি বিশাল পরিমাণ অগ্নিকান্ড। দাবানলে শুধু বনের গাছপালাই নয়, ধ্বংস হয় পশুপাখী আর নানা কীটপতঙ্গ। এমন কি মাটির মধ্যেকার কীটেরাও মৃত্যুবরণ করে। আমরা জানি এই সব পশুপাখী আর কীটপতঙ্গরা কি ভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। যে কোনও ইকো সিস্টেম ব্যাহত হলেই তা মানুষের জীবনযাত্রায় স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রভাব ফেলে। সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না। 

শেষের কথাঃ

ইচ্ছাকৃত হোক বা হোক সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, একটি দাবানল মানব সভ্যতায় যে প্রভাব ফেলে তা কিন্তু বিশাল মাপের। তবে আশার কথা এই যে, যেকোনও সমস্যাই তার সমাধান খোঁজার অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রাকৃতিক ঘটনা বলেই যে মানুষ চুপ করে বসে আছে তা নয়। তবে এই বিষয়ে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে যাতে। কি ভাবে দাবানলের আগাম আভাষ পাওয়া যায় বা তার প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে। যে কোনও দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার থেকেও কাজের হল সেই দুর্ঘটনা না হতে দেওয়া। আমাদের অবশ্যই সাগ্রহে অপেক্ষা করতে হবে আগামী দিন কি ছবি দেখায় তার জন্যে।  

                                                   

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb