সবুজ মানুষ

লেখক - ডাঃ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

                                               

- পারমিশন কি এলো  মাস্ অ্যাপ্লিকেশনের ?

অপু জিজ্ঞেস করল প্রবল উদ্বেগে।

- নাঃ, 

অনু মাথা নাড়ল।  

ই-মেলে জানাবার কথা ছিল। দিল্লির ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফুড সায়েন্সের হেড,  প্রফেসর নটরাজনের কাছে ডিটেইল স্টাডি রিপোর্ট দিয়ে আসা হয়েছে। আজই কনফার্মেশন আসার কথা। যেন ওরা প্রোডাক্ট সাধারণের ওপর অ্যাপ্লাই করতে পারে।

গোপনেই এগোন হচ্ছিল। কিন্তু মিডিয়ায় কী করে যেন লিক হয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি। পার্লামেন্টে মোশন এনেছে বিরোধী পক্ষ। অবিলম্বে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। সরকার একটু প্যাঁচে। কাকে মানে কোন মন্ত্রীকে দিয়ে উত্তর দেওয়াবে ভেবে পাচ্ছে না। খাদ্য দপ্তরেরই নৈতিক দায়িত্ব নেওয়া উচিত। তাদের বিজ্ঞাপন দেখেই অপু আর অনু দুই পাগল মিলে এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ব্যাপার গিয়ে পড়েছে কৃষি আর স্বাস্থ্য দপ্তরের ঘাড়ে। সেই বহু বছর আগে নাসবন্দি নাসবন্দি হট্টগোলে যেমন কাণ্ড হয়েছিল প্রায় তাই শুরু হয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার কমিশন, শিক্ষা দপ্তর সবার ওপরেই ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে।

কেন? খুলে বলা যাক। মাত্র বছর কুড়ি আগে খাদ্য দপ্তর এক প্রতিযোগিতা ডাকে। কী ব্যাপার? দেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে সেই প্রতিযোগিতা। পুরস্কার মূল্য ছিল প্রচুর। 

দেশে উৎসাহীদের মধ্যে সাড়াও পড়েছিল খুব। মোট দুই লক্ষাধিক প্রবন্ধ জমা পড়েছিল। প্রোজেক্ট জমা পড়েছিল লক্ষাধিক। কী ছিল না তার মধ্যে?

সমস্যাটাকে বহুদিক দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছিল বিচিত্র কল্পনার গবেষকেরা। 

উন্নততর উপায়ে চাষ, উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ, পাহাড়ে এমনকি হিমবাহের ওপরে চাষ, সমুদ্রের উপরিতলে চাষ। সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটন আর অন্যান্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ আর সামুদ্রিক প্রাণীকে ব্যাপকতর খাদ্য তালিকায় ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল অনেকে। অর্থাৎ খাদ্যের যোগান বাড়িয়ে খাদ্য সমস্যা মেটানোর কথা ভেবেছিল একদল। উদ্ভিজ্জ খাবারের পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে নতুন পোকামাকড় সরীসৃপ ইত্যাদি প্রাণীজ খাবারের যোগান বাড়ানোকে উপায় হিসেবে ভেবেছিল অনেকেই। তার বিস্তৃত আলোচনা এখন থাক।

দ্বিতীয়দল ভেবেছিল অন্যভাবে। শরীরের বিপাকীয় ব্যবস্থা পালটে দেবার কথা ভেবেছিল তারা। খুব কম ক্যালোরি খাবার গ্রহণ করেও যেন মিটে যায় দৈনন্দিন খাদ্য-চাহিদা এই রকম উপায়ের কথা ভেবেছিল তারা।

তৃতীয় আরেকদল, মোট খাদ্য গ্রহনকারীর সংখ্যা মানে, জনসংখ্যা যেন তেন প্রকারেণ কমাবার কথা ভেবেছিল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যাকরণ থেকে শুরু করে গ্যাসচেম্বার বা ওইরকমের নির্মম গণহত্যার ব্যবস্থা অবধি কোনও উপায় বাদ দেয়নি তারা।

মজার কথা হল, খালি বৈজ্ঞানিকভাবে নয়, একদল কবি জাতীয় প্রাণী অর্থাৎ অদ্ভুত চিন্তা করা মানুষ অবাক কিছু বিকল্প খাবারের কথা ভেবেছিল। যেমন তারা প্রস্তাব দিয়েছিল মানুষেরা জ্যোৎস্নাভুক বা শিশিরভুক হতে পারে কিনা তা' বিবেচনা করে দেখতে। সেই বাতুল প্রস্তাবগুলো পাওয়া মাত্র বাতিল করা হবে বলাই বাহুল্য। 

কিন্তু অতীত ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কার দপ্তর পুরোনো বইপত্র থেকে উদাহরণ দেখিয়ে, বিশেষ করে পওহারি বাবা ইত্যাদিদের কথা বলে, এই বাতিল প্রক্রিয়া আটকে দেয়। রেচক কুম্ভক জাতীয় নানা প্রক্রিয়া আর শিবাম্বু(মানে নিজ মূত্র) পান ও নিজ বর্জ্য গ্রহণ ইত্যাদি করা যেতে পারে, এই সব নানান কথা বলে তারা আপত্তি পেশ করে।

এই রকমের ব্যাপক গোলযোগে প্রতিযোগিতার মূল ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। একমাত্র গোঁয়ার গোবিন্দ চিকিৎসক-বৈজ্ঞানিক দম্পতি অপু ও অনু বসুগোঁসাই সেই পুরস্কার ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে তাদের ভাবনা অনুযায়ী নিজেদের গবেষণা চালিয়ে যায় গত কুড়ি বছর ধরে।

সাফল্য এসেছে এতদিনে। পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছে তো বটেই। এর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে বাণিজ্যিক অথবা রাষ্ট্রীয় প্রয়োগের প্রস্তাব খুব গোপনে রাষ্ট্রের যথাবিহিত দপ্তরে পেশ করা হয়েছে।

এইখান থেকেই আমাদের কাহিনি শুরু। অপু আর অনু মানে আমাদের আলোচ্য দম্পতি তাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতির নাম দিয়েছে "হাই ডেফিনিশন পাওয়ার সাপ্লাই" সংক্ষেপ এইচডিপিএস। 

ভাবলে খুব সহজ অথচ করতে গেলে খুব কঠিন ছিল তাদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্যাপার কিছুই না। মানুষকে গাছ বানিয়ে দেওয়া। গাছ ঠিক নয়, গাছের কাছাকাছি কিছু। যাতে মানুষ নিজেই সালোক সংশ্লেষ করে নিজের খাবার তৈরি করতে পারে। 

মেলানিন প্রতিস্থাপন করে তার বদলে ত্বকের কোষে ক্লোরোফিল ইনকর্পোরেট করার ব্যবস্থা করেছে তারা।

এই বারে, আর কিছু না, রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকো খোলা জায়গায়। খাবার তৈরি হয়ে রক্তে মিশে যাবে। কিন্তু সে তো খালি গ্লুকোজ মানে শর্করা। আর তার থেকে ফ্যাট। বাকিটা মানে প্রোটিন আসবে কোত্থেকে? তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু সময় পা ডুবিয়ে রাখতে হবে পাত্রে রাখা নাইট্রোজেন আর অন্যান্য নিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ দ্রবনে। মানে গাছ যেমন শেকড় দিয়ে শুষে নেয়।

 অসুবিধের কথা বলে আপত্তি করেছিল অনু। সে আবার সাজুনি যুবতী। 

"না না, চামড়ার রঙ বদলে সবুজ হয়ে যাবে, এ আবার কী?" বলেছিল সে। 

তার সহগবেষক বর অপু হেসে বলেছিল, " তুই তাই ভাবছিস বটে, ক'টা দিন কেটে গেলেই দেখবি চোখ সয়ে যাবে। আর খালি পিঠটা সবুজ হবে তো! লিপস্টিক মাস্কারা ঠিকই লাগাতে পারবি।" 

তা' চোখ সয়ে গেছেও ঠিক। কসমেটিক কারণে শুধু মাত্র পিঠের চামড়ায়, নিজেদের শরীরে এই ব্যবস্থা করে নিয়েছে তারা। শুধু নিজেদের নয়, তাদের সন্তানেরা আর গোটাকতক স্বেচ্ছাসেবকও রয়েছে গবেষণার সঙ্গী। সবাই মিলে দুপুর রোদে পিঠ মেলে বসে এই ল্যাবরেটরি কলোনির মানুষজন। আর সন্ধ্যের পর পা ডুবিয়ে রাখে সারজলে।

এই ভাবেই খাদ্য সমস্যার সমাধান একেবারে হাতে কলমে প্রমান করে চলেছে এই মানুষ গাছেরা গত কয়েকবছর।  

কেলেঙ্কারি ঘটেছে, খবরটা লিক হবার পর।   শিক্ষাব্রতীরা আওয়াজ তোলে, মানুষ যত পড়াশুনো করে আর গবেষণা করে তার অধিকাংশটাই উপার্জনের জন্য। আর উপার্জন করা তো খাবার জোগাড়ের জন্যই। ঠিক কি না? খাবার সমস্যা মিটে গেলে জ্ঞানের তপস্যা করবে কেউ?

আবার কিছু সাপোর্টারও আছে অনু অপুদের। তারা বলে খাদ্য সমস্যার সমাধান হলে মানুষ নিশ্চিন্তভাবে যার যা করার ইচ্ছে তাই করতে পারবে। কেউ বিশুদ্ধ জ্ঞানের, অন্য কেউ বিশুদ্ধ গানের, কেউ সাহিত্যের বা অন্য কিছুর। আইনস্টাইন মনের আনন্দে বেহালা বাজাবেন।

সে না হয় হল। কিন্তু অনুমোদন না পেলে তো, কুড়িটা বছর জলাঞ্জলি যাবে! গায়ে রোদ মেখে খাবার জোগাড় কি স্বপ্নই রয়ে যাবে?

সারা দিনে দিল্লির সেই মহামূল্য  ই-মেল আর এলই না। অন্য ই-মেলের নোটিফিকেশনটা কম্পিউটারে এল  মাঝ রাতে। 

এই আবিষ্কারের খবর এই দেশের মানচিত্র ছাড়িয়ে বাইরের দেশেও ঢেউ তুলেছে, এই তথ্য ওরা জানতই। স্টক হোম থেকে এই মাত্র মেল এল, নোবেল কমিটি ওদের দুজনকে বেছে নিয়েছে। অপুকে মেডিসিনের আর অনুকে শান্তির নোবেল প্রাইজ। শান্তির কেন? বাঃ খাবারের জন্যই তো যত অশান্তি, যত মারামারি কাটাকাটি।

অনুকে বলল উচ্ছ্বসিত অপু, "যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।" 

অনুর চোখে তবু জিজ্ঞাসা দেখে পাজিটা মিচকে হেসে বুঝিয়ে বলল, "এ'বার এই দেশেও আপত্তির ব্যাপারটা মিটে যাবে, দেখিস। ইয়ে ওই রবিঠাকুরের বেলাতেও যেমন। নোবেল পাবার পর এ'দেশের লোক বুঝেছিল উনি কবিতাটা ভালোই লিখতেন"।

অনুর মনে পড়ে যায়, গতকালই বরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই বিষয় নিয়ে। অপু বলেছিল, "হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেল বাপু আমাদের। এই আজব আবিষ্কারের নাম তুই যাই দিস, আমি আজ নাম দিলাম, হাড়ে দুব্বো পায়ে শেকড়। এইচডিপিএস!"

                                                    

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb