আয়নার মতো

লেখক - ডঃ শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                 

পণ্ডিতেরা অঙ্ক কষে জানিয়েছেন, চৌদ্দো বিলিয়ন বছর আগে যে বিগ ব্যাং হয়েছিল, তাতে একটা নয়, একটা নয়, দুপিস ব্রহ্মাণ্ড, মানে দুটো ডিম জন্ম নিয়েছিল, যার একটা আরেকটার আয়নার প্রতিবিম্বের মতো। একটায় ম্যাটার মানে পদার্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অন্যটায় অ্যান্টিম্যাটার মানে প্রতিপদার্থ বিস্তৃত। এইভাবে হিসেব কষলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু গড়মিল ব্যাখ্যা করা যায়। অঙ্কের হিসেব এও জানাচ্ছে যে, একটা ডিমে সময় যে রাস্তায় চলছে, অন্য ডিমটাতে ঠিক তার উল্টো রাস্তায় সময় হাঁটছে। সোজাসুজি বললে, এই ডিমের অতীতকাল হলো ঐ ডিমের ভবিষ্যতকাল এবং ভাইসিভার্সা!

এই অব্দি শুনে কারো মাথা যদি না গুলিয়ে থাকে, তবে তিনি নীচের গপ্পোটি পড়তে পারেন, নেমন্তন্ন রইলো। যেহেতু কেউ এসব হতে দেখেনি, সবই থিয়োরি, তাই কল্পনায় জি এস টি নেই! বাকি মালের দায়িত্ব আরোহীর, চলুন, বাবুনদের দুনিয়াটা ঘুরে আসি…

আয়নার মতো

“প্রাচীন প্রবাদে যা লেখা ছিল সেইমতো কাজ করলে আজ এই অবস্থা দেখতে হতো না”, বললো চাকুম।

বিলি বললো, “আমার অতো ধৈর্য্য নেই তুই তো জানিস, তাড়াতাড়ি কাজটা সারতে গিয়ে এরকম হয়ে যাবে আমি বুঝতে পারিনি।“

দেখতে দেখতে চাকুম আর বিলির চোখের সামনে বড়ো আলোর ফুলকিটা দুভাগে ভাগ হয়ে দুপাশে দুটো দিকে ছড়াতে শুরু করলো। কুচি কুচি আলো, তার থেকে আরো কুচি আলোর কণাগুলো জ্বলতে জ্বলতে গ্যাসে ঘরটাকে ভরিয়ে ফেললো। ঘরের বাইরে থেকে সেই অগ্নিকাণ্ড দেখে বিলির দাদু ছুটে এলো, এই বুঝি ঘর পুড়ে যায়।

বাবুনরা সব দুর্ধর্ষ অঙ্ক আর বিজ্ঞান-জানা জাত, বিলির দাদু সেইসব বিজ্ঞানীদের একজন। অবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে বেশী দেরি করলেন না। আলোটা তখন বেশ ডাম্বেলের মতো ফুলে উঠেছে। সময় তৈরী করার যন্ত্রটা থেকে শক্তির গুলি ছুঁড়ে দিলেন আলোর ডাম্বেলের ঠিক মাঝখানের দিকে। দুপাশের গরমটা অনেকটা কেটে গেল আর আলো যেন আরো কুচি কুচি হয়ে জালের মতো ছড়িয়ে গেল! কী দারুণই না দেখতে লাগছিল সেই দুইপাশের ডাম্বেলের অংশদুটোকে, যেন হীরের শিরা উপশিরা দুপাশে ছড়িয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।

বিলি জিজ্ঞেস করলো, “ওরা কী জ্যান্ত, দাদু?”

দাদু বললেন, “সে অনেক পরের ব্যাপার ভাই, দয়া করে আর আলোর পিন্ডিটাকে চটকিয়ো না, এমনিতেই সময়ের ঘাটতি হয়ে গেছে দুদিকে। তুমি কেন দেখতে গেলে, দেখতে গেলে বা মাপতে গেলে এসব ছোটো জিনিসের ধর্ম পাল্টে যায়, প্রাচীন প্রবাদ পড়ো নি? কী গোলমালটাই না পাকালে এখন!“

চাকুম জানতে চাইলো, “দাদু, আমরা কি সাংঘাতিক কিছু গণ্ডগোল পাকিয়েছি?”

দাদু বললো, “সে আর বলতে, বড়ো আলোর ভেতরে যে দুরকম আলোর দানা রেখেছিলাম কাল, তোমরা তাদের নিয়ে খেলছিলে ঠিক ছিল, কিন্তু যেই খুঁচিয়ে দেখতে গেলে, তখনি ওরা রেগে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট বাঁধিয়েছিল। ঠিকসময় দেখে আমি সময়টা মুচড়ে না দিলে সব ছারখার হয়ে যেত! এখন দুপাশে দুরকম দানা, একটার উল্টো ধর্ম আরেকটার। আর সময়টা একটা আরেকটার উল্টো।“

বিলি খুবই চঞ্চল, এতো কম বয়স, এর মধ্যেই সে শুধু সময় তৈরী করাটাই নয়, সময় মাপাও শিখে গেছে। একটা দিকের সময় আরেকটার উল্টো শুনে তার ভারী কৌতূহল হলো। ফস্ করে জামার ভেতর থেকে ঘড়িটা বার করে সে ডাম্বেলের একটা দিকে ঢুকিয়ে দিল। দাদু আর চাকুম হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই কাজ শেষ! বিলি দেখে নিয়েছে, ঘড়ির কাঁটা দুদিকে দুরকম ভাবে ঘোরে, একটা আরেকটার উল্টো।

ফল মিললো হাতে নাতে, বাবুনদের জগতে মাপামাপি নিষিদ্ধ, মাপলেই হিসেব গোলমাল হয়ে যায়, যা হবার তা হয় না, যা হবার নয় তাই হয়! লোকে অন্যদিকে তাকিয়ে জিনিস পাকড়ায় আর কাজ করে। এখন ডাম্বেলটা চিরে পুরো দুটো বল হয়ে গেল। কোন যোগসূত্র রইলো না দুটো বলের মধ্যে।

“যেদিন আলোর ফুলকি, কুচোর কুচো, তস্যকুচো ফুলকির কণাগুলো ঠাণ্ডা হবে, সেদিন জিনিস হয়ে যাবে তারা। সেই জিনিসগুলোর মধ্যে টানাটানি, ঠেলাঠেলি চলবে, হয়তো কোনোদিন চাকুম আর বিলির স্বপ্নের মতো সেইসব কণাগুলোয় আণুবীক্ষণিক কিছু প্রাণ জন্মাবে, তাদেরও বিবর্তন হবে, তাদের মধ্যে কেউ হবে শ্রেষ্ঠ জীব, খুব হামবড়াই দেখাবে তারা!” দাদু বলছিলেন।

শুনে চাকুম আর বিলি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলো। হি: হি:, চোখে যাদের দেখা যায় না তারা আবার বড়াই করবে!

দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এতো হাসছো, হয়তো আমাদেরকেও কেউ ভাবে আণুবীক্ষণিক জীব!”

“কিন্তু তুমি যাই বলো দাদু”, বিলি বললো, “ওরা কোনোদিনো টের পাবে না, ওদেরই মতো একটা আরো জগত আছে, যেটা বিলির ভুলে তৈরী হয়েছে, উল্টো, আয়নার মতো!”

দাদু আর চাকুম একসাথে বলে ওঠে, “ঠিক বলেছো বিলি, পুরো আয়নার মতো!” সেই সমবেত স্বরে আয়নার মতো বলদুটো একটা আরেকটার দিকে চমকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।

                                                 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb