একটি রোবটের মৃত্যু

লেখক - শাশ্বত কুমার ধর

                                                    
                                                                                       --১--

     খবরটা সব কাগজেই বেরিয়েছে। সব মহলে এই নিয়ে একটা বেশ হৈ চৈ পরে গেছে। বৈজ্ঞানিক গগন বসু হাতের ই-কাগজটা বন্ধ করে ভাবলেন এটা কি করে সম্ভব? রোবটের আত্মহত্যা ! 

     খবরের কাগজে যে খবরটা বেরিয়েছে সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক ।একজন ভদ্রলোকের বাড়িতে একটি রোবট রান্নার কাজ করতো । রাত্তির বেলা ভদ্রলোক শুয়ে পড়ার পরে সেই রোবটটি নাকি রান্নাঘরে একটি হট প্লেট অন করে তার উপরে উঠে পড়ে এবং খানিকক্ষনের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় ।ভদ্রলোক এটিকে রোবটের আত্মহত্যা বলে বর্ণনা করেছেন । গগনবাবু ভাবতে থাকলেন রোবট কি কখনো আত্মহত্যা করতে পারে?

     ভাবতে ভাবতে গগন বাবু বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন। এখন সব কিছুই রোবট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম স্থান সংকুলান হয়, তখন এইসব বাড়ি গুলো তৈরি হয় পৃথিবী থেকে কিছুটা উপরে স্পেসস্টেশনের মতো করে। বিভিন্ন কক্ষপথ করে করে বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে। প্রচুর পয়সাওয়ালা লোক পৃথিবী থেকে এখানে চলে এসেছেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা স্পেসস্টশনে।এছাড়াও চাঁদে, মঙ্গলে বিভিন্ন গ্রহে মানুষ বসবাস শুরু করে দিয়েছে। তবে এখন  এই স্পেস স্টেশন বাড়িরচাহিদা বেশি কারণ এখান থেকে পৃথিবীতে যাতায়াত করাটা সহজ ।পৃথিবী থেকে রেগুলার এয়ারট্যাক্সি ,এয়ারবাস এসব চলে ।কিন্তু চাঁদ বা অন্যান্য গ্রহে থাকতে হলে নিজেদের গাড়ি থাকাটা খুব দরকারি । গাড়ি বলতে সেই পুরনো দিনের চাকাওয়ালা গাড়ি নয়। এখন সবই এয়ার কার ।       গগন বাবু নেপচুনে কয়েকটা জমি কিনে রেখেছিলেন কিন্তু এখন ভাবছেন ওগুলো বিক্রি করে দেবেন ।আর এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান এত উন্নত হয়েছে যে মৃত্যু ব্যাপারটা প্রায় নেই বললেই চলে । পৃথিবীতে কিছু কিছু লোক মারা যায় অবশ্য এখনো, কারণ এই চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রায় শুধুমাত্র বড়লোকদের জন্য ।যেমন বৈজ্ঞানিক গগনবাবুর অলরেডি চারবার মৃত্যু হয়েছে, রোবট চিকিৎসকরা তাকে বাঁচিয়ে তুলেছে। তার বয়স এখন প্রায় চারশ বছর। যেখানে মানুষের মৃত্যু নেই ,সেখানে একটা রোবট আত্মহত্যা করছে এই ব্যাপারটা গগনবাবুকে বেশ ভাবিয়ে তুলল ।

     তিনি তার স্পেস স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন । দেখলেন সামনে একটা এয়ারবাস যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে।গগনবাবুর কব্জিতে বাঁধা একটা ঘড়ির মত যন্ত্র। তার একটা বিশেষ সুইচ টিপলেন, কোন শব্দ হলো না কিন্তু বাসটা তার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি উঠে বসলেন বাসটায় , দেখলেন বাসের ভেতর বন্ধু নরহরি আছে।

-“ কি ব্যাপার ?কোথায় চললে?”

-“ পৃথিবীতে যাব।“

-“পৃথিবীতে? কি ব্যাপার? ঘুরতে?”

-“ আরে না, এই তোমার বৌদির নাড়ু বানানোর মেশিনটা গন্ডগোল করছে। এটার মেকানিক পৃথিবীতে থাকে আর শুনছি এখন নাকি পৃথিবীতে শাকসব্জি খুব ভালো পাওয়া যাচ্ছে । তাই একটু পালংশাক কিনতে যাচ্ছি।“

-“ কেন তোমাদের ছাদে সিন্থেটিক গার্ডেনে হচ্ছে না?”

-“ আরে দূর দূর আর বলো না। সেদিন হতভাগা ছেলেটা এসে যে কি প্রোগ্রাম করে দিয়ে গেল, এখন শুধুই আলু পিয়াজ রসুন হয় ।“

-“কমপ্লেন কর নি?”

-“করেছিলাম । বলল এখন নাকি সবজির সারকিট বোর্ড পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এখন ওই এয়ার ঠেলায় করে যে বাজার নিয়ে যায় ওখান থেকে কিনি।“

-“আচ্ছা।“

-“আজকের খবরটা দেখেছো?”

-“রোবটের আত্মহত্যা ?”

-“হ্যাঁ ।”

-“দেখলাম।“

-“ঘটনাটা হয়েছে পৃথিবীতে।“

-“পৃথিবীতে?”

-“হ্যাঁ ।”

-“পৃথিবীতে কি করে হলো? ওখানকার লোকেরাও কি এখন রোবট ব্যবহার করছে?”

-“হ্যাঁ বেশ কিছু দেশ এখন রোবট নিয়ে ভালো কাজ করছে। রোজই তো পৃথিবী থেকে বেশ কিছু আবেদনপত্র আসছে নতুন নতুন স্পেস স্টেশনের জন্য ।এই কক্ষপথে জায়গা তো শেষ হয়ে এলো।নতুন কক্ষপথ খোলার কথা চলছে তো।“

-“বাবা, তুমি তো অনেক খবর রাখো ।“

-“আসলে তুমি তো পৃথিবীতে খুব একটা যাও না ।তাই জানতে পাও না ।“

-“তা বটে। আসলে এই শেষ কয়েক বছর ধরে গবেষণার কাজে এত ব্যস্ত ছিলাম যে বাইরের কোনো খবর রাখা হয় নি।“

-“ তাই? তা নতুন কি আবিষ্কার করলে?”

-“এখনো পারি নি পুরোপুরি। তবে পারলে ব্যাপারটা বেশ ভালো হবে।“

-“ কি জিনিস?”

-“টাইম টানেল। একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে তুমি অতীতে চলে যেতে পারবে।“

-“বাহ বেশ ব্যাপার তো ।সেই অনেকদিন আগে টাইম মেশিন নিয়ে খুব হৈচৈ হয়েছিল , তারপর তো আর কিচ্ছু হলো না।“

-“হ্যাঁ, এটাও সেরকমই একটা গবেষণা ।“

এরকম কথা বলতে বলতে বাস পৃথিবীতে এসে দাঁড়ালো।

                                                                                     --২--

     এটা পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে একটা জায়গায় বাস এসে দাঁড়ায় ।এখান থেকে নিজের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আবার পৃথিবীর ভেতরে ট্যাক্সি আছে সেগুলো এয়ারট্যাক্সি তবে একটু কম উচ্চতা দিয়ে ওড়ে ।নরহরি বাবু আর গগন বাবু এরককম একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন ,কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা বাজারে এসে পৌঁছলেন। গগন বাবু নামতে না নামতেই একজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন তার সামনে।

-“আপনি গবেষক গগন বাবু তো?”

-“হ্যাঁ ,আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক…”

-“আপনাকে একবার আমার সাথে যেতে হবে।“

-“কোথায়?”

-“রোবটের ব্যাপারে আপনাকে একবার ডেকেছেন আমাদের যন্ত্রমন্ত্রী।“

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গগন বাবু ।পাশে দাঁড়ানো নরহরিকে বললেন –

-“এই জন্য আমি পৃথিবীতে আসি না। এলেই এদের সব সমস্যার সমাধানের জন্য আমার ডাক পরে।“

নরহরি বাবু বললেন-“ কি আর করবে? যাও।“

-“হুম, দেখি।“

সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে বললেন –“চলুন, কোথায় যাবেন চলুন ।“একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটা এয়ার ট্যাক্সিতে দুজনে উঠলেন।

খানিকক্ষন পরে গগনবাবু যে বাড়িটার সামনে এসে উপস্থিত হলেন সেটা মন্ত্রণালয় ।

-“আসুন ,আসুন গগনবাবু। “

গগনবাবুকে অভ্যর্থনা জানালেন এখনকার যন্ত্রমন্ত্রী।

-“কি ব্যাপার হঠাৎ এভাবে ডেকে পাঠালেন? আপনারা কি জানতেন আজকে আমি পৃথিবীতে আসব?”

-“কি যে বলেন গগনবাবু? আপনি কি আপনার দেহে বসানো জি পি এস চিপ টার কথা ভুলে গেছেন।?”

গগন বাবু ভুলেই গেছিলেন। এখন সব মানুষ এর শরীরে কিছু চিপ ইমপ্ল্যান্ট করা হয়, তার ফলে তাদের যাবতীয় গতিবিধি ট্র্যাক করা যায়। এছাড়াও শরীরের ভেতর কোন রোগ হলে ওই চিপ সেগুলো আগেই জানিয়ে দেয় তারফলে খুব সহজেই চিকিৎসা করা যায়।

গগন বাবু বললেন , -“আচ্ছা এখন কি ব্যাপার বলুন।“

-“আজকের কাগজ এর খবরটা নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েছে।“

-“হুম।“

-“এটা নিয়ে এখানকার সরকার খুবই চিন্তিত। কারন আর ও কয়েকটা রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে ।“

-“কি রিপোর্ট? আরও আত্মহত্যা?”

-“না ঠিক তা  নয়। কিন্ত অনেকের রোবট এ গোলমাল শুরু হয়েছে।“

-“গোলমাল হলে ম্যানুফ্যাকচারিং এর প্রবলেম আছে। আমাকে কেন ডেকেছেন ? “

-“ব্যাপারটা একটু গুরুতর ।এই ফাইলগুলো আপনি একটু দেখুন তাহলে বুঝতে পারবেন।ওই ঘরের ভেতরে ডক্টর ভানুসিংহআছেন উনিই দেখছেন, উনি আপনাকে ডাকতে বললেন।

     গগনবাবুর চোখ গুলো গোল গোল হয়ে গেল । ডক্টর ভানুসিংহ ওনাকে ডাকতে বলেছেন!! ডক্টর ভানুসিংহকে এই পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো বিজ্ঞানী বলা যায়। ওনার বয়েস যে কত হাজার বছর কেউ জানে না। শোনা যায় আগের পৃথিবীতে উনি নাকি ওনার গবেষণার জন্য বেশ কয়েকবার নোবেল পেয়েছিলেন। এখন তো ওসব পুরস্কার উঠে গেছে। এহেন ভানুসিংহ কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যান নি। এখানেই উনি আছেন।

-“আচ্ছা আমি দেখছি।“ ভেতরে ভেতরে অবাক হলেও মুখে একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখলেন গগনবাবু।

-“আর আপনাকেসহযোগিতা করবে এই মাইকেল বলে যন্ত্র মানব।এটি বৈজ্ঞানিক সিরিজের লেটেস্ট মডেল।“

     এখানে রোবট তৈরি হয় কাজের ভিত্তিতে। এক একটা কাজের জন্য এক এক শ্রেণীর রোবট। গাড়ি চালানোর জন্য এক শ্রেণি,আবার রান্না করার জন্য অন্য শ্রেণি ।কোন এক শ্রেণির রোবটকে অন্য শ্রেণির কাজের প্রোগ্রামিং করা হয় না তার ফলে এরা এক এক বিষয়ে পারদর্শী থাকে । যেমন যদি কোন যুদ্ধ করার রোবট কে বলা হয় বিজ্ঞানচর্চা করতে তাহলে তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে সরকারের অনুমোদন নিয়ে তার সার্কিট বোর্ড চেঞ্জ করে নতুন করে প্রোগ্রামিং করতে হয়, কিন্তু তবু তার বাইরেটা একই রকম থাকে । বিভিন্ন শ্রেণীর রোবটদের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কাছে বিক্রি করা হয় এবং সাধারণ কোন লোক চাইলে যুদ্ধ করার রোবট কিনতে পারবে না ।এবারে এই সকল শ্রেণীর রোবটদের আবার বিভিন্ন রকমের আপগ্রেডেশন হতে থাকে যেমন এই মাইকেল হচ্ছে সায়েন্স শ্রেণীর লেটেস্ট আপডেটেড রোবট।

     গগনবাবু যখন প্রথমদিকে বিজ্ঞানের লেকচার শুনতেন তখনই ভানুসিংহ বাবুর বেশ কিছু লেকচার শুনেছেন ।তবে মুখোমুখি দেখা কোনদিন হয়নি। কিন্তু এখন সব বিজ্ঞানীদের গবেষণার খবর অন্যান্য সকল বিজ্ঞানীদের কাছে থাকে আর ভানুসিংহ বাবুকে না জানিয়ে কোনো গবেষণা করার কোনো রকম কোনো অধিকার কারও নেই। টাইম ট্রাভেল নিয়ে গগনবাবুর গবেষণাও ভানুসিংহর অনুমোদন পাওয়ার পরেই হয় ।

     ফাইল বলে যন্ত্রমন্ত্রী যেটা দিলেন সেটা একটা কোড। গগন বাবুর হাতে লাগানো ঘড়ির মতো যন্ত্র টায় সুইচ টিপতে সামনে শুন্যে একটা স্ক্রিন এসে গেল, সেখানে এই কোডটা ইনপুট করলেন তিনি।

     অনেকগুলো রিপোর্ট দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।পর পর কয়েকটায় চোখ বুলিয়ে তিনি বুঝলেন সমস্যা একই ধরনের।যে রোবট যে কাজের জন্য সেগুলো তার ঠিকমত করছে না। যেমন বিজ্ঞান এর রোবট গান গাইছে। বা যে রোবট রান্না করে সে ক্রিকেট খেলতে চাইছে। গগনবাবু বুঝলেন যে কেউ বা কারা জেনেশুনে প্রোগ্রামিং চেঞ্জ করছে। এটা আগেও একবার চেষ্টা করা হয়েছিল, মাস্টার অফ অল রোবট বানাতে চেয়েছিল কয়েকজন ,কিন্তু তাদের অনুমতি দেওয়া হয় নি। তাও তারা বেআইনি ভাবে কয়েকটা রোবট বানিয়ে ফেলে, শেষে সরকারের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা মেটে।  এও সেরকম মনে হচ্ছে।

     গগন বাবু মাইকেল এর দিকে তাকিয়ে বললেন –“মাইকেল এই যত রিপোর্ট আছে তার সব রোবটের ডাটা মানে কবে তৈরি, কোন কোম্পানীর তৈরি,কোন সফটঅয়ার, কোন হার্ডওয়্যার  সব ডিটেইলস রিপোর্ট একটা তৈরী কর। আমি ভানুসিংহ বাবুর সাথে দেখা করে আসি।“

  --৩--

     ঘরের ভেতর ঢুকে গগনবাবু দেখলেন একটা ছোট্ট টেবিলের ওপর একটা স্ক্রিনে কিছু একটা লোড হচ্ছে। কিন্তু ভানুসিংহ বাবুকে ঘরে কোথাও দেখতে পেলেন না । ঘরের এককোনে একটি যন্ত্র মানব বসেছিল তাকে জিজ্ঞেস করলেন ,“ আমি গগন সাঁতরা। আমায় ভানুসিংহবাবু ডেকে ছিলেন,ভানুসিংহ বাবু কোথায়?”

 যন্ত্রমানব বলল –“ ভানুসিংহবাবু একটু আগেই বেরিয়েছেন তিনি আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছেন।“

-“ আচ্ছা”

বলে গগন বাবু বসলেন।

স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করলেন কিসের কি লোড হচ্ছে? কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না।

হঠাৎ পিঁক করে তার হাতের যন্ত্রটায় একটা শব্দ হলো ।দেখলেন মাইকেল সব ডাটা কালেক্ট করে পাঠিয়েছে ।গগনবাবু ফাইলটা ওপেন করে দেখলেন।দেখেই বুঝতে পারলেন উনি যতটা সহজ ভাবছিলেন ততটা সহজ নয়। সবকটা রোবটের ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট আলাদা । এবং প্রায় কুড়িপঁচিশ বছর তফাৎ। সব ধরনের রোবট রয়েছে। সফটওয়্যার ,হার্ডওয়্যার সবগুলো আলাদা কম্পানির ।

     গগন বাবুর ভুরু কুঁচকে গেল, তিনি ভেবেছিলেন কোনো না কোনো জায়গায় এগুলো কমন থাকবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় উনি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মাইকেলকে আরও ডিপ এনালাইসিস করতে নির্দেশ দিলেন।

     এদিকে ভানুসিংহ বাবুর যে যন্ত্র মানব ছিল সে হঠাৎ বলল–“ভানুসিংহ বাবু নির্দেশ দিয়েছেন, আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে উনি আপনার সাথে পরে দেখা করবেন।“

অগত্যা গগন বাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন।মাইকেলও এলো তার পেছনে ।বাইরে বেরিয়ে দেখলেন তার জন্য একটা এয়ার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।সেটা গগনবাবু কে পৌঁছে দিলো একটা হোটেলের ঘরে।এই ঘরে এসে গগনবাবু প্রথমে অতি বেগুনি রশ্মি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলেন। মাইকেল কে জিজ্ঞেস করলেন-“ ডাটা এনালাইসিস কতদূর এগোলো?”

মাইকেল বলল-“ এখন অবধি কমন কিছু পাওয়া যায় নি।“

গগন বাবু নিজে এবার ফাইল গুলো দেখতে লাগলেন।

কিছুটা দেখার পর একটা মিল উনি পেলেন। যে সব কটা গোলমাল সব ভারত এর। অন্য কোন দেশ থেকে কোনো রিপোর্ট আসেনি। তিনি একবার যন্ত্রমন্ত্রী কে ফোন করলেন। ফোন বলতে ওই হাতের ঘড়ির মতো জিনিষ থেকেই করা যায়। 

-“হ্যাঁ গগনবাবু বলুন।“

-“আচ্ছা আর কোনো দেশ থেকে কি এরকম কোন রিপার্ট এসেছে?”

-“না তো।“

-“এখানে যার যার রোবট প্রবলেম করছে সেই রোবট গুলো কোথায়?”

-“মেন রোবো সেন্টারে ।“

-“এখানে আনা যায়?”

-“দেখতে হবে, ওরা অলরেডি হয়তো কাজ শুরু করে দিয়েছে।“

-“বেশ,আর যার রোবট আত্মহত্যা করেছে তার সাথে একবার কথা বলা যায়?”

-“নিশ্চয়,এখুনি ব্যবস্থা করছি।“

 সঙ্গে সঙ্গে ত্রিমাত্রিক প্ৰক্ষেপনের মধ্যে দিয়ে সামনে একটি লোকের ছবি ভেসে উঠল। -“এই যে ইনি মিস্টার কেশবনারায়ন রেড্ডি। এনার রোবটই সুইসাইড করেছে।“ 

-“নমস্কার মিস্টার রেড্ডি।“

গগনবাবু ট্রান্সলেটর অন করে কথা শুরু করলেন, এর ফলে তার কথা গুলো যে শুনবে সে তার আঞ্চলিক ভাষায় শুনতে পাবে এবং সে তার নিজের ভাষাতে উত্তর দিলেও গগনবাবু বাংলাতেই শুনতে পাবেন।

-“নমস্কার।“

-“আপনি কবে রোবট কিনেছিলেন?” 

-“বছর তিনেক হলো।“

-“সেদিন রাতে কি ঘটেছিল আমাকে বলুন তো?”

-“সেদিন অন্যান্য দিনের মতোই খাবার পরে আমি শুয়ে পড়ি, মাঝ রাতে হটাৎ ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি এই অবস্থা।“

-“আপনার কেন মনে হচ্ছে এটা আত্মহত্যা? ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট ও তো হতে পারে।“

-“যে হিট প্লেটের ওপর ও বসেছিল সেটা সচরাচর বার করা হয় না। ভেতরেই থাকে। সেটা বার করে তাকে গরম করে তার ওপরে বসাটা কে আপনি ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট বলবেন?”

গগনবাবু একটু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন –“আচ্ছা এর আগে কোনোদিন ওকে অন্য কোনোরকম আচরণ করতে দেখেছিলেন?”

-“সেরকম নয় কিন্তু প্রথম প্রথম যা স্পীড ছিল, লাস্ট আপডেটের পর থেকে একটু স্লো হয়ে গেছিলো।“

-“লাস্ট আপডেট কবে করেছিলেন?”

 -“এইতো সপ্তাহে খানেক হবে।“

-“ ঠিক আছে পরে দরকার হলে আবার যোগাযোগ করবো।“

-“আচ্ছা।“

কলটা ডিসকানেক্ট করে গগনবাবু মাইকেলকে বললেন –“একটু চেক করে দেখতো যতগুলো রোবটের কমপ্লেইন এসেছে সেগুলোর লাস্ট আপডেট কবে হয়েছে,

একসাথে হয়েছে কিনা?”

চেক করে মাইকেল বলল –“না স্যার, এগুলো তো সব আলাদা আলাদা দিনে আপডেট হয়েছে।“

-“বুঝলাম,তোমাকে যে ডীপ এনালাইসিস করতে বলেছিলাম তার রেজাল্ট কি?”

-“কোনো প্যাটার্ন ম্যাচ করছে না স্যার।“

-“অপদার্থ।“

মাইকেল চুপ করে থাকে।

গগন বাবু খুব চিন্তায় পড়লেন ।এখানের লোকেরা এত ভরসা করে তাকে ডেকে আনল কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না।

বিগড়ে যাওয়া রোবট গুলো দেখতে পেলেও হয়তো কিছু করা যেত। এই ভেবে তিনি মেন রোবো সেন্টারে ফোন করলেন।

-“এখানে যে রোবট গুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলোর কি অবস্থা?”

-“ওগুলো কে আমরা একদম ফ্রেশ সফটওয়ার দিয়ে লোড করছি, আর হার্ডওয়্যার ও চেকে পাঠিয়েছি।“

-“সমস্যা কেন বুঝতে পারলেন?”

-“মনে হয়েছে কোনো ভাইরাস এর ফলে হয়েছে। তবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা চেক করে দেখছি।“

ভাইরাস?

অনেকে দিন পর এটা শুনলেন গগন বাবু।এখন অ্যান্টিভাইরাস এতই স্ট্রং যে ভাইরাস এর কথা ভাবা যায় না।

গগনবাবু মাইকেলকে বললেন –“লেটেস্ট ভাইরাস নিয়ে কি তথ্য আছে আমায় দাও।“

জবাবে মাইকেল বলল –“এখন আমার ছুটি ,কাল দেখা যাবে।“

 এই জবাবে গগনবাবু এতটাই অবাক হয়ে গেলেন  যে তিনি কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।হঠাৎ তার মনে হল মাইকেল বলে এই রোবটের একই সমস্যা হয় নি তো?

তিনি খুব নরম গলায় মাইকেলকে জিজ্ঞেস করলেন –“তাহলে এখন কি করবে?”

-“গান গাইব।“

গগনবাবু নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে এও একই সমস্যার শিকার।কোনো কথা না বলে তিনি উঠে গিয়ে মাইকেলের সুইচ অফ করে দিলেন।এরপর মাইকেলের সফটওয়্যার এর ডাটা গুলো নিয়ে দেখতে বসে তিনি দেখলেন খানিকক্ষণ আগে একটা আপডেট ইনস্টল হয়েছে। ভালো করে আপডেটটা দেখলেন গগনবাবু।

যন্তর মন্তর বলে কোনো একটা কোম্পানি এই আপডেটটা পাঠিয়েছে।

গগন বাবুর মাথায় একটা সন্দেহ চাড়া দিয়ে উঠল।মাইকেলের জোগাড় করা ডাটা থেকে সব বিগড়োনো রোবটের আপডেট লিস্ট বার করলেন, দেখলেন তার অনুমান সঠিক। সব কটি রোবটের লাস্ট আপডেটহয়েছে এই যন্তর মন্তরের আপডেট 

--৪--

গগনবাবু দ্রুত যন্ত্রমন্ত্রীকে ফোন করলেন। 

ব্যাপারটা  শুনে যন্ত্রমন্ত্রী বললেন –“দাঁড়ান আমি দেখছি এটা কোথাকার কোম্পানি।“

খানিকক্ষণ পরে তিনি বললেন –“এটা তো পৃথিবীর কোম্পানি। মালিকের নাম দেওয়া নেই কিন্তু ঠিকানা আছে।আমি আপনার ট্যাক্সিতে ঠিকানাটা ইনপুট করে দিচ্ছি। আপনি ওখানে চলে যান। তারপর আমি যাচ্ছি। আপনি ওখানে গিয়ে আমাকে জানান কি অবস্থা।“

-“ওকে।“

গগন বাবু মাইকেলকে রেখে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।সামনেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল

গগনবাবু উঠে বসতেই চলতে শুরু করল।খানিকক্ষণ চলারপর যেখানে এসে গগন বাবুকে নামিয়ে দিল গগনবাবু সেই জায়গাটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

     সামনে একটা বিশাল জায়গা ,তার মধ্যে অনেক গুলো ছোট ছোট বাড়ি। পুরো সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা। গগনবাবু নিজের হাতঘড়িতে দেখলেন এই জায়গার নাম দেখাচ্ছে ভুবনডাঙা ।

আস্তে আস্তে এগোলেন তিনি ভিতরের দিকে।

গেট পেরিয়ে অনেকটা বাগান। যাতে হরেকরকম পাখি।

পৃথিবীতে যে এখনও এত সবুজ , এত পাখি রয়েছে সেগুলো গগনবাবুর ধারণার বাইরে ছিল। ধীরে ধীরে গগনবাবু এগিয়ে চললেন বাড়িগুলোর দিকে। হঠাৎ কোথা থেকে তিনি গান শুনতে পেলেন।

বাংলা গান।

ভারী অবাক হয়ে গেলেন গগনবাবু, এ যেন এক অন্য পৃথিবীতে এসে পড়েছেন তিনি। গানের শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন তিনি। যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন গাছের গায়ে কিছু ছবি ঝোলানো, ফোটোগ্রাফ নয়, হাতে আঁকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন একটা লম্বামত ছেলে একমনে গাছের তলায় বসে ছবি আঁকছে। না কোন স্ক্রিনে নয়। পুরোনো দিনের মত কাগজ তুলি দিয়ে। গগনবাবু ছেলেটাকে বললেন-“ তুমি কে?”

ছেলেটা বলল –“আমি এই আশ্রমের ছাত্র।“

-“ছাত্র? আশ্রম?এখানে কে শিক্ষক?”

-“গুরুদেব।“

-“কে তিনি? কোথায় থাকেন?”

-“ওই বাড়িতে।“

-“তোমার নাম কি?”

-“মানিক।“

গগন বাবু আরও একটু এগোলেন এবারে যে গান করছিল তাকে দেখতে পেলেন, একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে।

তাকেও জিজ্ঞেস করতে সে ও বলল গুরুদেব গান শেখান।

তার নাম বলল মোহর।

 গগনবাবু ভারী অবাক হয়ে গেলেন- কে এই গুরুদেব?

আরো একটু এগোতে দেখলেন একটি ছেলে মাটি দিয়ে একটি মূর্তি গড়ছে ।

সেও বলল সে গুরুদেবের ছাত্র।তার নাম কিঙ্কর।

গগন বাবু বললেন –“কে এই গুরুদেব?”

ভীষণ অবাক হয়ে ছেলেটা বলল –“গুরুদেব এই আশ্রম বানিয়েছেন। “

-“এই আশ্রমের নাম কি?”

-“শান্তিনিকেতন ।ওই ত সামনেই গুরুদেব আছেন যান দেখা করে আসুন। “

     গগনবাবু দেখলেন সামনে বাড়ির আড়ালে যেন এক দিব্যপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন।সাদা একটা জোব্বা পরনে, শ্বেত শুভ্র দাড়ি তার মুখে। গগনবাবুকে দেখে স্মিত হাস্যে বললেন –“আসুন, আমি আপনারই অপেক্ষা করছিলাম।“

-“কে আপনি?”

-“চিনতে পারলেন না?”

-“না।“

-“আমার নাম ভানুসিংহ ।“

-“আপনি?”

প্রণাম করলেন গগনবাবু। “কিন্তু এসব কি?”

-“যাদের দেখলে তারা আমার তৈরি রোবট।“

-“রোবট ?”

-“হ্যাঁ।“

-“তার মনে আপনি ওই আপডেট ইনস্টল করছেন?”

-“হ্যাঁ।“

-“কিন্তু কেন?আর আমাকেই বা আপনি ডেকে আনলেন কেন?”

-“আসলে আমার মনে হচ্ছিল সত্যিকারের মানুষের বড়ো অভাব এই পৃথিবীতে।

আমরা পুরোনো দিনের মানুষ তো এখনও তাই মানুষ খুঁজি।তাই কিছু রোবটের মধ্যে মানুষের আবেগ পুরে দেখছিলাম।“

-“কিন্তু আমাকে ডাকার মানে?”

-“যে রোবট মারা গেছে তার মধ্যে এই আবেগের ভাবটা বেশি হয়ে যায় তাই সে নিতে পারেনি। আত্মহত্যা করে। গগন তোমার টাইম টানেলের গবেষণার কথা আমি জানি,তার একটা জায়গায় তুমি ভুল করেছো। এইটা হচ্ছে সঠিক সমাধান।“ বলে তিনি একটা খাতা এগিয়ে দেন গগনবাবুর দিকে।খাতার পাতা উল্টোতে উল্টোতে গগন বাবু একজায়গায় এসে থেমে যান।

-“তাইতো এভাবে তো ভাবিনি। তাহলে তো আমার গবেষণা সফল।“ তারপরই গগনবাবুর ভুরু কুঁচকে যায় । “আপনি কি আমার ভুল ধরিয়ে দিতে ডাকলেন?”

-“না, তোমার ঐ টাইম টানেলের ভেতর দিয়ে গিয়ে আমাদের রোবোট তৈরীর শুরুর দিনে পৌঁছতে হবে। আর সেখান থেকে এদের মধ্যে এই মানুষের আবেগগুলো ভরে দিতে হবে।তাহলে আর কোন রোবট আত্মহত্যা করবে না।“

-“কি বলছেন আপনি? তাতে কি লাভ হবে?”

-“পৃথিবীটা আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। আমাদের জীবনের অর্থ তৈরি হবে।“

-“না না এ হতে পারে না। আপনি যতই বলুন এ আমি কিছুতেই মানতে পারবো না।“

-“কেন মানতে পারবে না?”

-“আপনি যতই মানুষের আবেগ ওদের মধ্যে পুরে দিন ওরা তো রোবট।“

-“হ্যাঁ কিন্তু ওরা প্রকৃত মানুষের মতো বাঁচবে।“

-“আপনি ভুল করছেন গুরুদেব। এটা সম্ভব নয় ।যন্ত্র কখনো মানুষ হতে পারে না।এ কি করে হয়? যন্ত্র কি মানুষ হয়ে যাচ্ছে?”

ভানুসিংহ খানিকক্ষণ চুপ থেকে গগনবাবুর  চোখের ওপর চোখ রেখে স্পষ্ট ভাবে থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন-

“তাহলে মানুষ কি করে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে?”
                                             

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb