মঙ্গল অভিযান

লেখক - কৃশানু রায়

সায়েন্টিফিলিয়া আয়োজিত কল্পবিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় অন্যতম দ্বিতীয় স্থানাধিকারী

                                                   

মার্শিয়ান ইতিহাসের উত্তর পর্বে পড়েছিলাম, এই গ্রহটি লাল ছিল। কিউরিওসিটির বদান্যতায়  আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম এই লাল গ্রহের ব্যাপারে। আয়রন অক্সাইডে ঢাকা এই  অনুর্বর গ্রহ এখন আস্তে আস্তে লাল থেকে নীলে পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন মঙ্গলের জনসংখ্যা ১২০০ কোটি।                    
পৃথিবী আর বাসযোগ্য নেই। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে সৃষ্ট সুনামি, খামখেয়ালি ঝড়, ওজোন স্তরের  হ্রাস ও গাছপালার অতিরিক্ত হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আইস এজ এনে ফেলেছে আরো একবার।
এসব আকাশকুসুম ভাবছি আর এই এরেশিও অবলংগাটার গতিপথে অবস্থিত ঘূর্ণায়মান স্পেস কোয়ার্টারে বসে পুরনো নথি ঘাঁটছিলাম, আমাদের বংশের রেজিস্টার্ড ওয়েব স্পেসে। হঠাৎ একটা ম্যানুস্ক্রিপ্টে চোখ আটকে গেল। লেখাটি যার ,তার বর্ণনা পড়ে জানতে পারলাম তিনি আমাদের এই বংশের কোন এক পূর্বপুরুষ। এটা ২৯২১ খ্রিষ্টাব্দ। আর এই এরিসিও  অবলংগাটা হচ্ছে মঙ্গলের  সর্বনিম্ন অরবিট, যেখানে মানুষ বাস করতে পারে।
যাকগে , যে কথা বলছিলাম ,যে ভদ্রলোকের ম্যানুস্ক্রিপ্ট আমি পেয়েছি তিনি ছিলেন সেই চারজন অভিযাত্রী দলের মধ্যে একজন , নাম সপ্তাংশু রায়। যারা প্রথম মঙ্গলে পদার্পণ করে ইতিহাস রচনা করেছিলেন ও মানব সভ্যতা কে সেই বারের মতো রক্ষা করার পথ দেখিয়েছিলেন। 
ম্যানুস্ক্রিপ্টটা একটি ডায়েরি আকারে লেখা। সারারাত জেগে পড়লাম পুরোটা। প্রচন্ড রোমাঞ্চিত হলাম। দুপুরে আবার পড়লাম খুঁটিয়ে। যতবারই পড়ি অবাক হতে হয়। এই অভিযান যদি না হতো, তাহলে মানব সভ্যতা বলে আর কিছু থাকত না। ডায়েরিটা যেমন ভাবে লেখা, ঠিক তেমনভাবে তুলে ধরছি।

 মঙ্গল অভিযান - এক স্বপ্নপূরণ   
  লেখক-সপ্তাংশু রায়।
১১.০২.২০৭৯
১১.৩০ পিএম
আজ স্পেস xeta-য় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঘোষণা হল চার অভিযাত্রীর নাম, যারা মঙ্গল অভিযানে অন্তর্ভুক্ত হলো।
তাদের মধ্যে আমিও একজন। আমি পেশায় একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘ চব্বিশ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন ফিল্ডে কাজ করে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে স্নাতকোত্তর করি। এরপর এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংএ ডিগ্রি নেওয়ার পর স্পেস xeta-য় জয়েন করি । স্পেস xeta-য় আজ দশ বছর ধরে তোড়জোড় চলছে এই দিনটির জন্য। আজ ঘোষণা হল সেই স্বপ্ন পূরণের উড়ানের । আজ থেকে চব্বিশ দিন পর ক্লিওপেট্রা আইল্যান্ড (যেটা সমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত স্থলভাগ থেকে ১৮০ কিমি  দূরে অবস্থিত) থেকে লঞ্চ হবে আমাদের রকেট বুষ্টি। 
বুষ্টির ওজন ছিল ৬৬ টন। দরজায় নক্ হচ্ছে , যায়…
 
০৭.০৩.২০৭৯
১১.০৪ পিএম (পৃথিবীর সময়)
এখন আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে কয়েকশো মাইল দূরে। আজ সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় আমাদের বুষ্টি লঞ্চ হয়েছে। এতদুর থেকে মুগ্ধ হয়ে আমরা তাকিয়ে আছি নীল গ্রহটির দিকে। আমরা বলতে আমি, পাইলট রবার্ট, সায়েন্টিস্ট ক্রিস্টোফার, এবং চিকিৎসক উইলিয়াম।
আমরা পরস্পরকে চিনেছি এই দেড় বছরে। একসাথে ট্রেনিং করেছি, প্ল্যান করেছি ও অনেকটা সময় কাটিয়েছি। আরো অনেকটা সময় কাটাতে হবে একসাথে। আমরা যখন প্রথম xeta-য় ট্রেনিং ক্যাম্পে আসি, সবমিলিয়ে ছিল একশো জন। এরপর ছাঁটাই পর্ব চলেছে এক বছর ধরে। যার মধ্যে আমাদের চার জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত পর্বের জন্য।
  
০৯.০৩.২০৭৯
১১.৩২ পিএম (পৃথিবীর সময়)
এতক্ষণে আমাদের মাইলোমিটার দেখাচ্ছে আমরা ৮৪০০০০ মাইল এসেছি ১৭৫০০ মাইল প্রতি ঘন্টা গতিতে।
এখনো ২৪ কোটি মাইল পেরোতে হবে।চাঁদকে পেছনে ফেলে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বুষ্টি।
 
২৪.০৬.২০৭৯
১১.৪৫ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
মাইলোমিটার দেখাচ্ছে আমরা বারো কোটি পঁচাশি লক্ষ মাইল পেরিয়ে এসেছি। অর্থাৎ আর অর্ধেক যাত্রাপথ বাকি।
অনেকদিন ডায়েরি লেখা হয়নি তার প্রথম কারণ আমি ডায়েরি লেখাতে অভ্যস্ত নই। দ্বিতীয়তঃ অনেকগুলি ঘটনা ঘটেছে।
মিটিওরাইট,একটি ক্ষুদ্র পোস্টাল স্ট্যাম্প সাইজ এর বস্তু প্রায় ৪০ হাজার মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে ধেয়ে এসেছিল বুষ্টির দিকে।যদি এটা বুষ্টি কে আঘাত করতো, তাহলে স্পেসশিপে ছিদ্র ঘটিয়ে, প্রচুর চাপের অভাব সৃষ্টি করতে পারত।
যদিও আমাদের হাইটেক লেজার স্ক্যানার এদের ডিটেক্ট করে ভ্যাপোরাইজ করে দিয়েছিল।
 
২২.০৭.২০৭৯
১১.৪৯ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
উল্লেখযোগ্য ঘটনা কিছু নেই, তাই কিছু তথ্য লিখে রাখি।
পৃথিবীর গ্রাভিটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের দেহ সম্পূর্ণরূপে তৈরি।
কিন্তু গুরুত্বহীনতার কারণে আমাদের হার্টকে কম কাজ করতে হয়, ফলে তা দুর্বল হয়ে যায়।
হাড় ও মাসেলের ড্যামেজ হয়, ও ড্যামেজ থেকে ক্ষয় শুরু হয়, যখন মানুষ দীর্ঘকাল মহাশূন্যে অতিবাহিত করে।অ্যাস্ট্রোনটরা কয়েক ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায় যখন তারা মহাশূন্যে থাকে, কারণ তাদের স্পাইনাল কলাম বাড়তে থাকে। আবার যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তারা।
অ্যাস্ট্রোনট এক পারসেন্ট হারের ওজন ক্ষয়  করতে থাকে প্রতি মাসে, যখন তারা মহাশূন্যে থাকে।
এই ক্ষতির থেকে বাঁচার জন্য , আমাদের প্রতিদিন এক ঘণ্টা ট্রেডমিলে কাটাতে হচ্ছে।
অনেকক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে বড় বড় মিশন থেকে ফিরে আসার পর।
 
১১.০৮.২০৭৯
১১.৪২ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
সবথেকে কঠিন হয়ে উঠেছিল সাইকোলজিকাল বেরিয়ারটা  পার করা।নয় মাস একটা ছোট ক্যাপসুলে বসে কাটানোটা হচ্ছে একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ।নানান রকম চিন্তা আসতে শুরু করেছে।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কোনদিনও বুঝি আর পৃথিবীতে ফেরা হবেনা।
সেই বিকেলের এগ রোল, গোধূলির শঙ্খ ধ্বনি, কাদামাখা ফুটবল আর লাইভ কনসার্ট এগুলো কোনটাই বুঝি আর দেখা হবে না কখনো। একচুল এদিক ওদিক হলেই মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু সর্বক্ষণ ওতপেতে বসে আছে। পরক্ষনেই মনে হয় এগারোশো কোটি জনসংখ্যার আশা,আবেগ এবং শুভকামনা নিয়ে ঠিক উতরে যাব এই পরীক্ষায়।
আমাদের কাঁধে এখন কঠিন গুরুদায়িত্ব।
 
১৩.০৯.২০৭৯
১১.৩৫ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
বুষ্টির স্পেশালিটি হলো স্পিনিং সেন্ট্রিফিউগাল কন্ট্রোল কেবিন।সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স কৃত্রিম গ্র্যাভিটি তৈরি করে ও আমাদের সিলিন্ডারের দেওয়ালের দিকে ঠেলে দেয়।
এইজন্য বুষ্টি কে বলা হয় “দা স্পিনিং শিপ”। রোটেটিং ক্যাবিনেট অনেকটাই বড় ও সমানভাবে ভাগ করা আছে প্রত্যেকটি কেবিন স্পেসে যাতে সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে,তা না হলে আমাদের সিসিকনেস হত অথবা এমন অবস্থার পরিবর্তন হতো যা একেবারেই কাম্য নয়।
পৃথিবীর রেডিয়েশন বেল্ট থেকে আসা প্রচুর পরিমাণে রেডিয়েশনের ফলে আমাদের অকালবার্ধক্য ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও ছিল পুরোমাত্রায়, কিন্তু বুষ্টির রেডিয়েশন সিল্ড আমাদেরকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।
 
২৩.০৮.২০৭৯
১১.৪৬ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
আমরাও সময় কাটাতে ছবি আঁকি, গান শুনি, ওয়েব সার্ফ করি, বিভিন্ন খেলা খেলি নিজেদের মধ্যে, অংক কষি যাতে ব্রেন ডাল না হয়ে যায়।
ভালোবাসার মানুষ ও প্রিয়জনদের সাথে কথা বলি।আস্তে আস্তে যত মঙ্গলের দিকে এগোতে লাগলাম ম্যাসেজ ততো পৃথিবীতে পৌঁছতে দেরি করতে লাগলো। যা প্রথমদিকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৪ মিনিট, তাই আরো বেড়ে গেল অনেকটা।
আমরা যারা পৃথিবীতে বসে সেকেন্ডে মেসেজের রিপ্লাই পেয়ে অভ্যস্ত, তারা রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গেলাম এতো দেরি দেখে।
 
২৮.০৯.২০৭৯
১১.৫৬ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। বুষ্টি, অত্যাধুনিকতম স্পেসশিপ, সেও ম্যালফাংশন করছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার স্মার্টি রেড অ্যালার্ট দেখাচ্ছে। আমাদের চারজনের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রায় ৫ ঘণ্টা পর বুষ্টি নিজস্ব কক্ষপথে ফিরে এলো।    
  
০১.১১.২০৭৯
১১.৪৯ পিএম (পৃথিবীর সময়) 
আমরা আস্তে আস্তে লাল গ্রহ কে বড় আকারে দেখতে পাচ্ছি। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম, ঠিক এই সময়ে বুষ্টির রকেট ফায়ার করতে শুরু করল। যাকে উল্টো থ্রাস্ট বলে।
যার ফলে আমাদের গতি অনেকখানি হ্রাস পেল।
যার পরিণামে আমরা আস্তে আস্তে মঙ্গলের অরবিটে ঢুকে পড়লাম। অরবিটে থাকাকালীন আমরা মঙ্গল কে দেখলাম আরো ভালোভাবে। ফাঁকা লাল মরুভূমি, দিগন্তবিস্তৃত বিশাল দৈত্যাকার উঁচু পর্বত শ্রেণী, গভীর খাদ, যেগুলি পৃথিবীর তুলনায় অনেক অনেক বড়। আরো দেখলাম বিশাল ধুলোর ঝড়। তার মধ্যে কিছু কিছু এত বড় যা এই বিশাল লাল গ্রহ কে গিলে ফেলতে পারে।
 
০৪.১১.২০৭৯
১১.৫৫ পিএম (পৃথিবীর সময়)
যখন আমরা সঠিকভাবে ওরবিটে ঘুরতে শুরু করলাম, তখন আমরা আমাদের পুরনো ক্যাপসুল ছেড়ে মার্স ক্যাপসুলে ঢুকে পড়লাম।যখন আমাদের ক্যাপসুল মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ঢুকে পড়ল, তাপমাত্রা হঠাৎ নাটকীয় ভাবে বেড়ে গেল, বোঝা গেল বুষ্টির সারফেস থার্মোমিটার এর দিকে তাকিয়ে।কিন্তু হিট শিল্ড আমাদের এই বায়োবীয় ঘর্ষণজনিত তাপমাত্রা থেকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করল।
  
০৫.০৯.২০৭৯
১১.৩২ পিএম (পৃথিবীর সময়)
মঙ্গল ক্যাপসুল (বুষ্টির অবশিষ্টাংশ) তার রেট্রো রকেট লঞ্চ করায়, স্পিড অনেকখানি কমিয়ে, আমাদের সুন্দরভাবে মঙ্গলে জমিতে অবতরণ করালো।এরপর আমাদের বুক দুরুদুরু করার পালা। আমরা মানবীয় ইতিহাসে অগ্রগামী ভূমিকা রচনা করতে চলেছিলাম।  এরপর ক্রিস্টোফার তার পা, প্রথমবার লাল মাটিতে রেখেছিল। সেই ঐতিহাসিক পদচিহ্ন গুলো রাখা থাকবে কোন এক মিউজিয়ামে।
 
অবশিষ্টাংশ
 
আমরা ঠিক চার মাস বারো দিন কাটিয়েছিলাম লালগ্রহে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পৃথিবীর সাথে ঠিকঠাক এলাইনমেন্ট পাওয়া যাচ্ছিল রিটার্ন ফিরে আসার জন্য।ওই চার মাসে আমরা চষে ফেলেছিলাম যতদূর হেঁটে যাওয়া যায় সেই লাল মাটির উপর।
এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলাম অনেক, মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণে থেকে শুরু করে জলের খোঁজ।
আণুবীক্ষণিক জীবনের খোঁজ এবং সোলার প্যানেল পাতার কাজ।বরফ গুলিকে ড্রিল করে খোঁজ চালিয়েছিলাম পরিশুদ্ধ পানীয়র।অক্সিজেনের এবং জ্বালানির জন্য হাইড্রোজেনেরও।রাতে ফিরে এসে থাকতাম ক্যাপসুলেই। 
মিশন শেষ হওয়ার পর আমরা পাড়ি দিলাম পৃথিবীর পথে।এরপর মঙ্গল ক্যাপসুল পুনরায় যুক্ত হলো বুষ্টির সাথে ওরবিটে।তারপর আবার নয়মাসে যাত্রা শেষে ফিরলাম পৃথিবীতে।যখন ফিরলাম সমুদ্রে ল্যান্ডিং হলো। মানুষজন আমাদের হিরো বানিয়ে সেলিব্রেট করলো।এটাই ছিল আমাদের ইতিহাস রচনার প্রথম ধাপ।
 …………………………
  
ডায়েরি এখানেই শেষ, আজ মার্স মিউজিয়ামের ওয়েব সাইটে দেখলাম সেই ঐতিহাসিক পদচিহ্ন গুলো। যার মধ্যে একটা ছিল আমারই পূর্বপুরুষের, ভাবতেও গর্ব হয়।

                                                

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb