‘বুনসেন বার্নার’-এর বুনসেনের কথা

লেখক - ইন্দ্রনীল মজুমদার

                                                       
রসায়নবিদ্যার তথা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে ল্যাবরেটরীর ‘বুনসেন বার্নার’ বা ‘বুনসেন দীপ’ নামক যন্ত্রটি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, এই দীপের আবিষ্কর্তা হলেন জনপ্রিয় বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। তাহলে প্রশ্ন আসে যে ‘বুনসেন বার্নার (Bunsen burner)’ বা ‘বুনসেন দীপ’ কেন বলা হয়? আসলে এই দীপটি ব্যবহার করতেন বিজ্ঞানী রবার্ট উইলহেল্ম বুনসেন। হয়তো, দীপটিকে বেশিই ভালবাসতেন আর তাই হয়তো বেশি বেশি করে ব্যবহার করতেন। আর কি সৌভাগ্য! তাঁর নামানুসারেই ওই দীপটির নাম রাখা হয় ‘বুনসেন দীপ’ বা ‘বুনসেন বার্নার’। তাহলে, কি শুধুমাত্র ওই দীপটির নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়েছে বলেই কি তিনি এত স্মরণীয়? বিজ্ঞান জগতে তাঁর আর অন্য কোনও অবদান নেই? আছে, আছে আর সেগুলোর সম্বন্ধে আমরা আজ আলোচনা করব।

এই বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিজ্ঞানী ১৮১১ সালের ৩০শে মার্চ জার্মানির গোটিনজেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন যাকে বলে সাধারণের ভাষায় ‘গোয়ার গোবিন্দ’ ছেলে। তাঁর গোঁয়ার্তুমি ও একগুঁয়েমি নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষকদের। কিন্তু এই একগুঁয়েমি থাকা সত্ত্বেও তাঁর একটি ভালো গুণ ছিল আর তা হল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা ও নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করা। এই দুই কাজে তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আর, এই যন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করা ও যন্ত্র তৈরির কৌশল শেখা তাঁর মধ্যে যন্ত্রের প্রতি এবং আশেপাশের সমস্ত কিছুর কার্যবিবরণীর প্রতি এক অদম্য কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। আর এই কৌতুহলই তাঁকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট ঘটায়। আর এই আকর্ষণের ফলে বা আসক্তির ফলে ছেলেবেলায় তিনিই রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, গণিত মণিকবিদ্যা এবং শরীরবিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের শাখায় পারদর্শিতা লাভ করেন। আর এই পারদর্শিতা ও অধ্যাবসায়ের ফলে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যখন ছাত্র ছিলেন তখন তিনি পদার্থবিদ্যার আলোক এবং তাপবিদ্যা– এই দুই শাখার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। সেই আকর্ষণ এতটাই যে সারাজীবন তিনি এই দুই শাখার বিভিন্ন রহস্য উদঘাটন করার ব্যাপারে ব্যয় করেন।

তখন মনে করা হত যে বিদেশ থেকে না ঘুরে আসলে শিক্ষা বুঝি সম্পূর্ণ হয় না। তাই তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার পর বিদেশ ভ্রমণে যান এবং দীর্ঘ দুই বছর ধরে বিশ্বের নানা দেশে ঘুরে, নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করলেন। তারপর তিনি দেশে ফিরে আসলেন এবং তাঁর জন্মশহর গোটিনজেনে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। এর পাশাপাশি চলে গবেষণা। ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৭– এই তিন বছর তিনি গবেষণা করেন জৈব যৌগ (organic compound)-এর ধর্ম সেই যৌগের মূলক (radical)-এর যে ধর্ম তার ওপর নির্ভর করে। এই বিষয়ে গবেষণা করে তিনি অনেক প্রমাণও পেয়েছিলেন। ওইসময়, এ বিষয়ের গবেষণার পাশাপাশি তিনি আর্সেনিক নিয়েও নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। রসায়নবিদ্যায় বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তু নিয়ে গবেষণা অনেক সময় বিপদও ডেকে আনতে পারে, কেননা সব রাসায়নিক বস্তু তো আর নিরাপদ নয়। এই আর্সেনিকের বিষক্রিয়া মারাত্মক আর তার বিষক্রিয়ার ফলে বুনসেন প্রায় মারা যেতে বসছিলেন। ১৮৩৬ সালে গবেষণাগারে ঘটে এক মারাত্মক বিস্ফোরণ। আর এই বিস্ফোরণের ফলেই বুনসেন তাঁর এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। এতকিছুর পরেও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েননি, এইসব দুর্ঘটনায় বিন্দুমাত্র ভেঙে না পড়ে গবেষণার দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে তিনি সফলতা লাভ করেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে সোদক ফেরিক অক্সাইড নামক যৌগ আর্সেনিকের বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পারে।

১৮৩৬ সালেই বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে জার্মানির ক্যাসেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী উলারের জায়গায় তিনি পদলাভ করেন। এর বছর পাঁচেক পর, ১৮৪১ সালে তিনি মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ব্রেসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। ওই বছরই তিনি এক উন্নত মানের তড়িৎকোষ প্রস্তুত করেন যা ‘বুনসেন সেল (Bunsen cell)’ বা ‘বুনসেন তড়িৎকোষ’ নামে পরিচিত। ১৮৪৪ সালে তিনি আলো বা যেকোনো তড়িৎচৌম্বকীয় বিকিরণের শক্তি মাপার যন্ত্র ‘ফটোমিটার (Photometer)’ তৈরি করেন। আর এই যন্ত্রের ফলে তাঁর নিত্যসঙ্গী বুনসেন দীপের দীপনমাত্রা মাপতে পেরেছিলেন।

তাপবিদ্যার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণের দরুণ তিনি ১৮৪৬ সালে আইসল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকে প্রচুর (প্রায় শতাধিক) গ্যাস ও উষ্ণ প্রস্রবণের জল সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন নানারকম বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। ১৮৫২ সালে তিনি হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। জৈব রসায়ন এবং বিশ্লেষণ রসায়নবিদ্যার তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত এক দিকপাল ব্যক্তি। অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরাও আসতেন তাঁর কাছে পাঠ নিতে। ১৮৫৫ সালে বিজ্ঞানী ম্যাথিসেন-এর সাথে একত্রে গবেষণা করে ধাতব লিথিয়াম নিষ্কাশনের কাজে সফলতা পান। ১৮৫৯ সালে বিজ্ঞানী কার্শফ-এর সাথে একত্রে কাজ করে তিনি ‘স্পেকট্রোস্কোপ (spectroscope)’ নামক একটি যন্ত্র তৈরি করেন যা দিয়ে আলোর প্রতিসরণ ঘটিয়ে আলোর উপদান বিভিন্ন রঙে ভাগ করা গেছে। এ যন্ত্র দ্বারা যেকোনো মৌলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা যায়। যাই হোক, তার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬০ সালে বুনসেন ও কার্শফের তৈরি এই ‘স্পেকট্রোস্কপ’ যন্ত্র দিয়েই বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুনসেন ‘সিজিয়াম (Caesium)’ ও ‘রুবিডিয়াম (Rubidium)’ নামক দুই নতুন মৌল আবিষ্কার করেন। রসায়নাগারে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রবণ ব্যবহৃত হয়। আর এইসব দ্রবণের ফলে অপরিষ্কার হয় রসায়নাগারগুলি। অপরিষ্কার রসায়নাগার কিন্তু রাসায়নবিদদের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর। এইসব কথাগুলো মাথায় রেখেই হয়তো বুনসেন ১৮৬৮ সালে ‘ফিল্টার পাম্প (Filter pump)’ আবিষ্কার করেন যা দিয়ে রসায়নাগার পরিষ্কার করার ব্যবস্থা সম্ভব হয়। রাসায়নিক মৌলগুলোর মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium) বেশ উল্লেখযোগ্য। বুনসেন এই ম্যাগনেসিয়াম যাতে বেশি করে উৎপাদন করা যায় তার উপায় বার করেন। গলিত ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ ঘটিয়ে তিনি ক্রোমিয়াম (Chromium) ও ম্যাঙ্গানিজ (Manganese) নামক দুই মৌল নিষ্কাশন করেন।

সেই যে ১৮৫২ সালে হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন, তারপর আর কোনোদিন অধ্যাপনার পদ ত্যাগ করেননি। আজীবন তিনি করেছেন অধ্যাপনার কাজ, গবেষণার কাজ। অকৃতদার থেকে জীবন-যাপন করেছেন। ছাত্ররাই তাঁর হয়ে উঠেছে সন্তানতুল্য। সেই ছোটবেলা থেকে তৈরি হওয়া বিজ্ঞানের প্রতি অদম্য কৌতুহল ও বিস্ময়ের ফলে তিনি সারাজীবন নানান আবিষ্কার করে গেছেন। তাঁর আবিষ্কারগুলি মানুষের তথা সমাজের উপকার সাধনের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদেরও গবেষণা ও আবিষ্কারের পথকে আরও সুগম করে তুলেছে। ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদের কাছে আশার আলো ও পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন রবার্ট উইলহেল্ম বুনছেন। ১৬ই আগস্ট, ১৮৯৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।  ছেড়ে চলে যান বললে বোধহয় ভুল হয়, কেননা বিভিন্ন রাসায়নিক মৌল যেমন ম্যাগনেসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ও তাঁর আবিস্কৃত দুটি মৌল সিজিয়াম ও রুবিডিয়াম; বিজ্ঞানের অপরিহার্য যন্ত্র যেমন ফটোমিটার, স্পেকট্রোস্কপ, ফিল্টার পাম্প ইত্যাদির সাথে আবার জৈব রসায়ন, আলোকবিদ্যা ও তাপবিদ্যার সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। চারিদিকে যখন শোনা যায় জলে আর্সেনিক দূষণের প্রকোপের কথা তখন মনে হয় তাঁর সেই আর্সেনিকের বিষক্রিয়া প্রতিরোধের আবিষ্কারের উপায়ের কথা। আর সবচেয়ে বোধহয় তিনি আমাদের মাঝে জড়িয়ে আছেন তাঁর আবিষ্কৃত ‘বুনসেন সেল’ এবং বিজ্ঞানী ফ্যারাডে কতৃক আবিষ্কৃত বুনসেনের নামে নামাঙ্কিত ‘বুনসেন বার্নার’-এর সাথে।

রবার্ট উইলহেল্ম বুনসেন যেন এক অনুপ্রেরণা– বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো বটেই এমনকি সমাজের সবার জন্যেও। তা হল, প্রতিবন্ধকতাকেও জয় করে বিজ্ঞানের একের পর এক আবিষ্কার করে যাওয়া। তাঁর জয় বিজ্ঞানের জয়, সমাজের জয়।

                                                 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb