রবিবারের আড্ডায় টিটিন

লেখক - ডঃ দীপঙ্কর বসু

                                            

ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। শীতটা এখনও তেমন ভাবে জাঁকিয়ে বসে নি। সে দিনও আমরা সবাই উপস্থিত হয়েছি পরাণ দার চায়ের দোকান কাম রেস্টুরেন্টে আমাদের রবিবারের আড্ডায়। সবাই মানে  গোবিন্দ বাবু, অমল ত্রিপাঠি, অপূর্ব বাবু, দেবাশীস বাবু, সমীরণ বাবু আর এই আড্ডার মহিলা সদস্যা থিটা। তখনও দেখা নেই আসরের মধ্যমণি নকা মামার। আড্ডা তাই এখনও জমে ওঠে নি। নানা একথা  সেকথা চলার সময় সাহিত্যিক গোবিন্দ বাবু যিনি কিছুদিন হল স্থানীয় একটি স্কুল কমিটির সম্পাদক হয়েছেন, একটা সবজান্তা গোছের ভাব নিয়ে বললেন, “এখনকার পড়াশোনার যা অবস্থা তা আর কি বলব মশাই, সেদিন স্কুলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ইংরেজিতে সবচেয়ে বড় শব্দ কি, তা কেউ বলতে পারলো না।”

এমন অপমান শিক্ষক হয়ে মেনে নেবেন এমন বান্দা অপূর্ব বাবু নন। রেগে গিয়ে বললেন, “আপনি বলুন তো কি হবে?”

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে অপূর্ব বাবুর  দিকে তাকিয়ে গোবিন্দবাবু বললেন,বেশ, “আপনিও যখন জানেন না তখন বলেই দিচ্ছি। শব্দটা হল – Deinstitutionalization। শব্দটিতে ২২ টি লেটার অর্থাৎ অক্ষর আছে।”

অপূর্ব বাবু যেন এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, “আপনার হয়তো জানা নেই Counterrevolutionaries শব্দটিও ২২ টি অক্ষর দিয়ে তৈরি।”

আসরে সাধারণত চুপচাপ থেকে সবার কথা শোনেন অমল বাবু। বিনম্র ভাবে বললেন, “আমি যতদূর জানি সবচেয়ে বড় শব্দ -Pseudopseudohypoparathyroidism।”

বেশ কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় যখন ভাবছি যাক্‌ ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হল তখনই উদয় হল নকা মামার। এসেই সকলের জন্য চা আর স্পেশ্যাল বেগুনি আর পেঁয়াজির অর্ডার দিয়ে বসলেন চেয়ারে। তারপর আমার কাছ থেকে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। আমরা যখন হতবম্ব হয়ে মনে মনে বিশ্লেষন করছি এই হাসির পিছনের কারণ কি! তখনই হাসির কারণ খোলসা করলেন নকা মামা।

“এর থেকেও অনেক অনেক বড় শব্দ আছে ইংরেজিতে। শুনে আমরা যখন সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি তখন মামা বললেন শব্দটি কিন্তু একটি নাম।”

দেবাশীষ বাবু বললেন, তাহলে এটি নিশ্চয় কোন দক্ষিণ ভারতীয়র নাম হবে। ওদের নামগুলি বেশ বড় হয়।

মুচকি হেসে মামা বললেন, “নামটি কত শব্দের হতে পারে বলে মনে হয় আপনাদের?”

পঞ্চাশ থেকে একশো পর্যন্ত বিভিন্ন সংখ্যা বললেন বিভিন্ন জন।

“সংখ্যাটি এদের ১০০ গুণের থেকেও অনেক অনেক বেশি, বললেন নকা মামা।”

আমরা যখন হতবাক হয়ে এ ওর দিকে তাকাচ্ছি তখনই ভ্রূটাকে একটু নাচিয়ে মামা বললেন, “নামটি ১৮৯৮১৯ অক্ষর দিয়ে তৈরি। নামটি দিয়েছেন I UPAC অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ্‌ পিওর এন্ড অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি।”

ড্যাবড্যাবে অবাক করা চাহুনিতে গোবিন্দ বাবু বললেন, “এটা মানুষরা উচ্চারণ করবে কি করে মামা?” “আরে সেটাই তো সমস্যা। রাসায়নিক এই যৌগটির I UPAC প্রদত্ত নাম উচ্চারণ করতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশী।”

শুনে তো সকলের আক্কেল গুড়ুম। সমীরণবাবুর মুখটা হাঁ হয়ে আর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে এমন আকার নিল দেখে মনে হল ভিরমি না লাগে!

আমাদের আশ্বস্ত করে মামা বললেন, “ঘাবড়ে যাবেন না বিজ্ঞানীরা এর সমাধানে এমন যৌগটির একটি সুন্দর ডাক নামেরও ব্যবস্থা করেছেন। কথাটি বলে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় চুমুক দিতে যাবেন, পরাণ দা আর থামাতে পারলেন না নিজেকে

“চা খাইবেন মশাই পরে, অখনে বইল্যা ফ্যালেন নামটি কি হইবে?”

দ্বিতীয় চুমুক তখনকার মত বন্ধ রেখে মামা বললেন –‘টিটিন’। তারপরে হেসে বললেন, “ছোটদের কাছে জনপ্রিয় ‘টিনটিন’ নয় কিন্তু। এই টিটিন নামটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘টাইটান’ থেকে। বিরাট আকারের দেবদেবী বা কোন কিছুকে বোঝাতে গ্রীকরা এই শব্দটি ব্যবহার করে।”

নানা খটমট জিনিস শোনার পরে টিটিন নামটি আমাদের সকলের কাছে যেন দক্ষিণের বাতাস নিয়ে এল। সুযোগ পেয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক অপূর্ব বাবু বললেন, “বিজ্ঞানীদের তাহলে রসবোধও আছে।” আমাদের এই রবিবারের আড্ডায় সবচেয়ে কমবয়সী একমাত্র মহিলা সদস্য থিটা জিজ্ঞাসা করলেন, “মামা, নামটি যখন এত বড়,রাসায়নিক সংকেতও নিশ্চয় অনেক বড় হবে!”

“ঠিক বলেছো, এর পরখী সংকেত হল C169723 H270464 N45688 O52243 S912 । অর্থাৎ এই যৌগটিতে আছে ১৬৯৭২৩টি কার্বন পরমাণু, ২৭০৪৬৪টি হাইড্রোজেন পরমাণু ,৪৫৬৮৮টি নাইট্রোজেন পরমাণু, ৫২২৪৩টি অক্সিজেন পরমাণু আর ৯১২টি সালফার পরমাণু।”

শুনে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম। সমীরণ বাবু বললেন," পরাণ বাবু শীগগির এক কাপ চা দিন, মাথাটা কেমন ঘুরছে।”

বেশ মজা পেয়েছেন এমন ভাবে মিচকি মিচকি হাসির ভঙ্গিমায় মামা বললেন, “আরেকটি জিনিস বলি, পৃথিবীতে কোন ভাষাতেই এর থেকে বড় শব্দ বা নাম নেই।”

‘আচ্ছা মামা, এটি কি ধরণের যৌগ’ জিজ্ঞাসা অপূর্ব বাবুর। এটি একটি প্রোটিন।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রোটিনদের মধ্যে টিটিনই সবচেয়ে বড় প্রোটিন। বিভিন্ন  বিন্যাসের টিটিনের মধ্যে ২৭০০০ থেকে ৩৩০০০ অ্যামিনো  অ্যাসিড আছে। একটি ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। হৃদপিন্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন যৌগ ‘নভেক্স ৩’ তে ৫৬০৪টি অ্যামিনো  অ্যাসিড আছে। শরীরের বিভিন্ন রেখাঙ্কিত পেশিতে বিভিন্ন গঠনের এই টিটিনদের দেখতে পাওয়া যায়। আরেকটা কথা বলি- পেশিতে যেসব প্রোটিন আছে তার মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে টিটিনের স্থান আছে তিন নম্বরে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় ৫০০গ্রামের মত টিটিন আছে।”

আদালতে সওয়াল করছেন এমন ভঙ্গিতে গোবিন্দ বাবু যিনি ‘ঢোল গোবিন্দ’নামে সাহিত্যের জগত দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রশ্ন করলেন, “তা আপনার এই ‘টিনটিন না টিটিন’ এর কাজটা কি? না কি শরীরটাই আছে, কাজে লবডঙ্কা।”

প্রশ্নের ধরণে মামা খানিকটা ক্ষুণ্ণ হলেও শিষ্টাচার বজায় রেখে বললেন, “এক মাইক্রো মিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যের এই টিটিন আমাদের শরীরের পেশির নিষ্ক্রিয় স্থিতিস্থাপকতার জন্য দায়ী। সাধারণভাবে এতে ২৪৪টি প্রোটিনের আলাদা পরিসর আছে যা অসংগঠিত পেপটাইড অনুক্রম দ্বারা যুক্ত।”

বিষয়টা সকলের পক্ষে জটিল হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “মামা,এই কাজের ব্যাপারটা একটু সহজ ভাবে বললে ভালো হয়।”

মুচকি হেসে নকা মামা বললেন, “আসলে এটি একটি আনবিক স্প্রিং যা পেশিতন্তুকে প্রয়োজনে প্রসারিত এবং পরে তা অবমুক্ত হলে আগেকার অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। ভাঁজে থাকা প্রোটিনের পরিসর গুলো প্রসারিত হওয়ার সময় খুলে যায় আর টান অপসারিত হলে আবার আগের মত ভাঁজ হয়ে যায়।” অনুসন্ধায়ী মনের মানুষ বিজ্ঞানের শিক্ষক অপূর্ব বাবু মামার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা মামা, পেশীর দুর্বলতার সঙ্গে কি এই টিটিনের কোন সম্পর্ক আছে?”

“হ্যাঁ, পেশীর এক ধরণের সমস্যা আছে যার উদ্ভব হয় এই প্রোটিনের পরিবর্তনের ফলে। এটি হয়  টিটিন জিনের হেরফের হওয়ার কারণে। পেশীর এই সমস্যাকে বলে ‘টিটিন মায়োপ্যাথি’।”

অবাক দৃষ্টিতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তা, “মামা মায়োপ্যাথি ব্যাপারটা কি?”

মুচকি হেসে মামা বললেন, “এটি পেশীর এক ধরণের রোগ যা হলে পেশীর তন্তুগুলি ঠিক মত কাজ করে না আর তার ফলে পেশী দুর্বল হয়ে যায়। পেশীর দুর্বলতাজনিত আরেকটি রোগের নাম ‘টিটিন ডিস্ট্রোফি’। টিটিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত জিন TTN এর মিউটেশন থেকে এই রোগের উৎপত্তি। এই রোগ হলে হৃদপিন্ডের পেশী দুর্বল এবং বড় হয়ে যায়। তবে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত কম।”

সুযোগ পেয়ে  গোবিন্দবাবু টিপ্পনি করে বললেন, “তা মশাই,এমন বদখদ আকৃতির জিনিসটির আবিষ্কর্তাটি কে?”

প্রশ্নটি শুনে মুচকি হেসে ফেললেন মামা। এমনটি যেন গোবিন্দ বাবুর কাছ থেকে আশা করেছিলেন মামা। বললেন, “১৯৫৪ সালে রেইজি  নাতোরি প্রথম পেশিতে একটি স্থিতিস্থাপক বস্তুর উপস্থিতির কথা বলেন। ১৯৭৭ সালে  কোসাক মারুয়ামা ও তাঁর সহযোগীরা স্থিতিস্থাপক প্রোটিনকে পৃথক করতে সমর্থ হন এবং তাঁরা এর নাম দেন কানেক্টিন। এর দু বছর পরে কুয়ান ওয়াং ও তাঁর সহযোগীরা  আরও শুদ্ধ অবস্থায় এটি বের করেন। তাঁরা এর নাম দেন টিটিন।”

এরপর মামা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাঁটা দেড়টা  ছুঁইছুঁই করছে দেখে বললেন, “আজ তাহলে এখানেই থাক , আর কিছু জানার থাকলে অন্য একদিন হবে।”

আমরাও এই কথায় সহমত দেখিয়ে সকলে গাত্রোত্থান করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।

                                                         

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb