আলোর জন্ম

লেখক - পঞ্চানন মণ্ডল

                                              

কেউ যদি আপনাকে বলে সূর্যে আলো তৈরি হয়ে পৃথিবীতে আসতে ১০,০০০ থেকে ১,৭০,০০০ বছর সময় নেয়! তা আপনি কি বিশ্বাস করবেন?যে বলবে তাকে কি পুরো পাগল বলবেন না!এমন সব অবিশ্বাস্য তথ্য ছাত্রদের বলেন প্রফেসর অর্ধেন্দু পাত্র।ছাত্রদের এ পি স্যার। আড়ালে কেউ অর্ধপাগল স্যার বলেও ডাকে। আর বলবেই না বা কেন?একটা মফস্বল কলেজের ফিজিক্সের স্যার। কিন্তু অণুপরমাণু থেকে শুরু করে চন্দ্র,সূর্য ,গ্রহনক্ষত্র ,গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে ব্লাকহোলে এমনকি প্যারালাল বিশ্বেও তাঁর অবাধ বিচরণ! একবার ক্লাসে ঢুকলেই ছাত্রদের মাথার পোকা পুরো নাড়িয়ে দেয়। ক্লাসে ঢুকলে যে ক্লাস থেকে বেরোতে হয়, সে খেয়াল থাকে না।শুধু তাই নয়, যারা একটু পড়াশোনায় ভালো , অজানাকে জানতে একটু আগ্রহী তাদের পুরো পিছনে পড়ে থাকে! এই তো সেদিন, প্রত্যয় প্রাকটিক্যাল কপি কবে জমা করতে হবে জানতে স্যারের রুমে গিয়েছিল। স্যার পুরো যাকে বলে পাকড়াও করে ফেলেছে। 

প্রত্যয়কে দেখে স্যারের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন

 - 'বলতো প্রত্যয় ,সূর্যে তৈরি হওয়া আলো পৃথিবীতে আসতে কত সময় লাগে?'

প্রত্যয় মনে মনে ভাবলো আজ কপালে দুঃখ আছে। সে একটু মাথা চুলকে বলল 

-"স্যার মনে হয় আলো আসতে লাগে মাত্র  ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় লাগে "

স্যার একটু শান্ত হয়ে বলল- "কেন তোমার এমন মনে হলো?"

প্রত্যয় -(একটু ভেবে নিয়ে)মাধ্যমিকে পড়েছিলাম স্যার। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার। আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার। তাহলে ভাগ করলে পাব!! স্যার অনেক বড় ভাগ ক্যালকুলেটর দিন।

স্যার - না না! ক্যালকুলেটর লাগবে না ।ওটাই হবে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড।

প্রত্যয় - তাহলে আমি ঠিক বলেছি স্যার? তাহলে এবার আসি?

স্যার -আরে কি আসি আসি বলছ?আর তোমার উওর ঠিক,তোমায় কখন বললাম ? তুমি জাস্ট ভাবতেই পারবে না কত সময় লাগে। তুমি যা উত্তর দিয়েছো তা অনেকেই বলে । বলা যায় তা অর্ধসত্য!

প্রত্যয় - তাহলে স্যার, উত্তরটা কি হবে?

স্যার -১০,০০০ থেকে প্রায় ১,৭০,০০০ বছর ! 

প্রত্যয় - মানে!! সেকেন্ড নয়! মিনিট নয়! ঘন্টা নয়! এতো বছর!স্যার আমরা কি তাহলে  সূর্য থেকে আরো দূরে চলে এসেছি? নাকি  আলোর বেগ অনেক কমে গেছে? 

-না না সেসব কিছুই হয় নি। তবে এটাও সত্যি অত বছরই সময় লাগে। সেটা আলোর জন্মের রহস্যের জন্য ! সেটা বলার আগে তোমাকে আরেকটি প্রশ্ন করি। 

-আবার প্রশ্ন স্যার!

-আরে শোনোই না। বলতো ,এখন পর্যন্ত তোমার আমার জানার মধ্যে একমাত্র গ্রহ হিসেবে পৃথিবী প্রাণের অস্তিত্ত্ব নিয়ে মহাবিশ্বে টিকে আছে। এর জন্য সবার আগে তুমি  কাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে। 

-এতো সোজা প্রশ্ন ! কেন, সুয্যি মামাকে জানাবো স্যার !

- তা ঠিক। সূর্যের কাছে আমরা চির ঋণী। কারণ বলে শেষ করা যাবে না। তবে এর মধ্যে সবার আগে থাকবে আলো। হয়তো প্রাণ সূর্যের আলোহীন অঞ্চলে তৈরি হয়েছে (মহাসাগরের তলদেশে তৈরি হয়েছে), কিন্তু প্রাণের ব্যাপক বৈচিত্র্যের ব্যাপারটা আলো ছাড়া কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। "আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা " আলো ছাড়া আমরা ভাবতেই পারি না । আচ্ছা কখনো ভেবেছো , কিভাবে এই আলো সূর্যে তৈরি হয়? কিভাবেই বা এই আলো পৃথিবীতে আসে?

- সূর্য এক জলন্ত অগ্নিপিন্ড। নিজে পুড়ে ছারখার হয়ে আমাদের আলো দিচ্ছে!

- তা দিচ্ছে বটে! তবে ব্যাপারটা অত সহজে নয়। আলোর জন্মরহস্য পুরোটাই সত্যি বড়ো রহস্যময়।

-স্যার কি সেই রহস্য?

- বলব, সব বলব। তবে তোমাকে একা নয়। ক্লাসের সব ছাত্রকে একসঙ্গে বলব। আগামীকাল তোমাদের ক্লাসেই উন্মোচিত হবে সূর্যের আলোর জন্মরহস্য।

পরের দিনের ক্লাস।এ পি স্যার ক্লাসে ঢুকলেন।প্রতিদিনের মতো সবাই একটু চাপে আছে। কাকে হঠাৎ কি প্রশ্ন করেন! তবে এটা ঠিক স্যার এতো সুন্দর করে গল্পচ্ছলে পড়ান কেউ স্যারের ক্লাস কাটে না। এমনিতেই স্যার সবার খুব প্রিয়, খুব বন্ধুসুলভ, স্নেহবতসল । তবে ওই একটাই সমস্যা পড়ানোর সময়ের কোনো তালজ্ঞান নেই। থাক এসব কথা। স্যার প্রত্যয়কে নিজের ডেক্সের কাছে ডেকে নিয়ে নিয়ে গতদিনের কথপোকথন সবার সামনে পুনঃদৃশ্যমান করলেন। সবাই সেই রহস্য জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রইল ।

স্যার শুরু করলেন। এই যে আমি বললাম সূর্যে আলো তৈরি হয়ে তা পৃথিবীতে আসতে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১,৭০,০০০ বছর সময় নেয়! তা সঠিক কিনা তা জানতে নিউক্লিয়ার ফিউশন বা পরমাণু সংযোজন সম্বন্ধে পুরোনো পড়া একটু ঝালিয়ে নিলে সুবিধা হবে।সোজা কথায়  কয়েকটি ছোট পরমাণু মিলে একটি বড় পরমাণু তৈরি হওয়া। শুনতে খুব সাধারণ বিক্রিয়া মনে হলেও, এর ফলাফল ব্যাপক।তোমরা তো সবাই হাইড্রোজেন বোমার নাম শুনেছো। পরমানু বোমার থেকেও অনেক গুণ শক্তিশালী। হাইড্রোজেন বোমার যে চরম ভয়াবহতা, সেটা এই নিউক্লিয়ার ফিউশনেরই ফলাফল! আর অদ্ভুত হলেও সত্য এটাই সূর্যের থেকে প্রাপ্ত আলো এই নিউক্লিয়ার ফিউশনেরই ফসল !

সুদীপ - স্যার নিউক্লিয়ার ফিউশনে এমন কী হয় যার কারণে আলোক কণা/ফোটন তৈরি হয়? 

স্যার - ঠিক বলেছো। এই আলো মানে ফোটন কণা।আর এগুলো সূর্যে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ফিউশনে। এটা যেভাবে হয় তার মূল সমীকরণ অনেক জটিল। তার চেয়ে এসো আমরা সহজভাবে  এগোই।

বলোতো - পরমাণু কী দিয়ে তৈরি? 

অরূপ - স্যার নিউক্লিয়াস। তাতে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন আর তাকে ঘিরে ইলেকট্রন । 

স্যার -ঠিক। যেহেতু “নিউক্লিয়ার ফিউশন" নিয়ে কথা বলছি , ইলেকট্রনকে পরবর্তী আলোচনায় আমরা অগ্রাহ্য করব।

তোমরা জানলে অবাক অবে সূর্যের মোট ভরের প্রায় ৭৫ ভাগ হাইড্রোজেন। সূর্যে ক্রমাগত এই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে ফিউশন (মানে সংযোজন ) হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী পরমাণু হিলিয়াম তৈরি করে। তার আগে কেউ কি বলতে পারবে সমস্থানিক বা আইসোটোপ কি?

প্রত্যয় - স্যার সমস্থানিক হচ্ছে একই মৌলিক পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা যেখানে নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা সমান থাকে, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা আলাদা।

স্যার - বাহ! তোমরা জানো হাইড্রোজনের তিনটি সমস্থানিক থাকে।প্রোটিয়াম- যেখানে নিউট্রন সংখ্যা শূন্য,

ডিউটেরিয়াম - নিউট্রন সংখ্যা ১,

ট্রিটিয়াম- নিউট্রন সংখ্যা ২, আর প্রতিটি হাইড্রোজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ১ মানে একটি করে প্রোটন থাকে। আর প্রোটিয়াম মানেই একটি প্রোটন।

যাই হোক, সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশনের আরেকটা নাম আছে। প্রোটন-প্রোটন শৃঙ্খল বিক্রিয়া , সহজ ভাষায় দুইটি  পরমাণুর প্রোটনগুলো মিলে গিয়ে নতুন ভরের একটি পরমাণু তৈরি করে। তবে এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। প্রোটন  ধনাত্মক আধানযুক্ত থাকে। সাধারণভাবে  দুইটি প্রোটন তাহলে পরস্পরকে বিকর্ষণ করার কথা। সেখানে ফিউশন হওয়ার প্রশ্নই আসে না! এটাই সত্যি।কিন্তু সূর্যে ঘটে উল্টো ঘটনা!

সুদীপ - কেন স্যার? 

স্যার - আমাদের  মনে রাখতে হবে, আমাদের সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮ ভাগই সূর্যের দখলে। এই  ব্যাপক ভরের কারণে সূর্যের মহাকর্ষ বল (Gravity) অবিশ্বাস্য রকম বেশি । পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেশি। এই মারাত্মক মহাকর্ষ বলই দুটো বিকর্ষণকারী প্রোটনকে ফিউশন করতে বা যুক্ত হতে বাধ্য করে!

এখন যদি একটি প্রোটিয়াম ও একটি ডিউটেরিয়াম ফিউশন করে তাহলে কী হবে? আমরা আগেই জেনেছি, ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন থাকে।(স্যার এখন চক ডাস্টার নিয়ে ব্লাকবোর্ডের সামনে) জাস্ট মনে করো, এই প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে ধরে রাখতে ডিউটেরিয়ামের মোট শক্তির প্রয়োজন হয় ৩ জুল (Joule, শক্তির একক)।

যেহেতু প্রোটিয়ামে কোন নিউট্রন থাকে না, শুধু একটি প্রোটন থাকে, তাই প্রোটিয়ামের কোন শক্তির প্রয়োজন নেই নিউট্রন এবং প্রোটনকে একসাথে ধরে রাখার জন্য। তাই শক্তির পরিমাণ এখানে শূন্য! তাহলে প্রোটিয়াম এবং ডিউটেরিয়ামের মোট শক্তির পরিমাণ ৩ জুল। এখন এই দুইটি পরমাণু মিলে গেলে তৈরি হয় হিলিয়াম-৩। যার নিউক্লিয়াসে থাকে দুইটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন।

হিলিয়াম-৩ এ প্রোটনের পরিমাণ ডিউটেরিয়ামের তুলনায় বেড়ে যাওয়াতে নিউক্লিয়াসের আভ্যন্তরীণ শক্তির পরিমাণ হ্রাস পাবে । ধরে নিই, সেটার পরিমাণ ২ জুল। কিন্তু ফিউশন হওয়ার পূর্বে মোট শক্তি ছিল ৩ জুল। তাহলে বাকি এক জুল শক্তি  ফিউশন হওয়ার পর কোথায় গেল?

এবার হয়তো বুঝতে পেরেছ ! এই বাকি থেকে যাওয়া এক জুলই শক্তির রূপান্তরের সূত্র অনুযায়ী রেডিয়েশনের মাধ্যমে আলোককণা হিসেবে বেরিয়ে আসে!

ঠিক এই প্রক্রিয়াটাই ক্রমাগত চলছে সূর্যের একদম ভেতরের স্তরে, যাকে বলা হয় Core Of Sun মানে সূর্যের কেন্দ্র। যা দখল করে আছে সূর্যের মোট ব্যাসার্ধের এক চতুর্থাংশ। আর এই স্তরের তাপমাত্রাটি কল্পনাতীত, ১৫ মিলিয়ন কেলভিন!

অগ্নিভ - স্যার এতো তাপমাত্রা! ওখানে গিয়ে মাপল কে? 

স্যার - হাঁ,  এতো তাপমাত্রা। আর ওখানে গিয়ে মাপার দরকার নেই। সোলার প্রোব দিয়ে আর অঙ্ক কষে বের করা হয়েছে। সে গল্প অন্য একদিন হবে। হাঁ যা বলছিলাম, তৈরি হওয়ার পরে আলোক কণা মানে ফোটন চাইলেই কিন্তু  সরাসরি এসে পড়তে পারে না  সূর্যের উপরিভাগে।তাকে পার করে আসতে হয় আরো দুটি স্তর রেডিয়েটিভ জোন এবং কনভেক্টিভ (সঞ্চালন) জোন। (স্যার কালার চক দিয়ে বোর্ডে ছবি এঁকে ফেলেছেন) এই রেডিয়েটিভ জোনে আলোক কণা ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হয়, শোষিত হয়, আবার পুনরায় বিক্ষিপ্ত হয়। তারপর সঞ্চালন জোনের মাধ্যমে সূর্যের উপরিভাগ, অর্থাৎ ফটোস্ফিয়ারে আসে। তৈরি হওয়ার পর থেকে এই ফটোস্ফিয়ারে আসার পুরো সময়টা অভাবনীয়, যা আমি আগেই বলেছি,  দশ হাজার থেকে প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার বছর! রেডিয়েটিভ জোনে ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই এর প্রধান কারণ।ব্যাপার কি বোঝা গেল?

ছাত্ররা - এতো খুব দারুণ ব্যাপার স্যার।

স্যার - দারুণ তো বটে! এবার এই ফটোস্ফিয়ার থেকে আরো দুইটি পাতলা স্তর ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনা পেরিয়ে, শূন্যের মধ্যে দিয়ে আলো তার স্বাভাবিক বেগে পৃথিবীতে এসে পড়ে মাত্র ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের কাছাকাছি সময়ে। তার মানে যে আলো তোমাদেরকে দিনে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে,তোমাদের আলোকোজ্জ্বল দিন উপহার দিচ্ছে, তা হাজার হাজার বছর পুরোনো আলো! সে হাজারো বাধা পেরিয়ে ছুটে এসেছে সূর্যের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর দিকে,সবাইকে আলোর রোশনাই দিতে ! আমাদের ভূবনকে আলোয় ভরিয়ে দিতে।

                                              

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb