চোখের বাহার

লেখক - ডঃ শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

                                        

দুই চোখ দিয়ে আমরা চারপাশটা যেমন করে দেখি, সবাই কিন্তু সেইভাবে দেখতে পায় না। যেমন, যদি তুমি গরু হতে, মানে, ধরো, রেগে যেও না, ধরো, এখন তুমি একটা গরু। মাঠে মুখ নীচু করে ঘাস খাচ্ছ। মুখ তুলে চাইলে চারপাশটা তুমি কিভাবে দেখবে? তুমি, একটা মানুষে যতটা জায়গা জুড়ে একবারে দেখতে পায় তার চাইতে অনেক অনেকটা বেশি দেখতে পাবে। যাকে ক্যামেরার ভাষায় বলে 'প্যানোরামিক ভিউ', ঠিক তেমনি। অবাক হচ্ছ? আরে, খেয়াল কর, এখন তোমার চোখ দুটো নাকের দুপাশে অনেক দূরে দূরে আছে যে! এতে করে সুবিধা হচ্ছে এই যে, দূরের অনেকটা জায়গা জুড়ে নজরদারি চালিয়ে আসন্ন বিপদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচা যায়। খেয়াল করে দেখবে, বেশিরভাগ মেরুদণ্ডী তৃণভোজী প্রাণীর চোখদুটো এইরকম কায়দা করে নির্দিষ্ট জায়গাতে বসানো। তবে মুশকিল হচ্ছে, দুপাশে একেবারে গা-ঘেঁষে কেউ থাকলে তাকে তারা দেখতে পায় না। এ ছাড়া চোখের পেশির তেমন জোর নেই বলে দিনের বেলাতেও এনারা চট করে কোনো কিছু ঠাহর করতে পারেন না, সময় লাগে।

জলের তলায় থেকে মাছ জলের উপরে কতটা দেখতে পায়? জলের উপর থেকে আসা আলোর বেগ জলের মধ্যে ঢুকে পাল্টে যায়। সেই কারণে জলের ভিতরে ডুবে যদি জলের উপরে তাকাও, একশো আশি ডিগ্রি নজরে না এসে একশো ডিগ্রির কাছাকাছি জায়গা দেখতে পাবে। মাছেও তাই দেখে বটে, তবে খুব স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পায় না। জলের উপরে বসে তুমি যদি রঙচঙে পোশাক পরে ছিপ ফেলে ভালোমানুষের মত বসে থাক, তবেই সে তোমায় খানিক নজরে আনতে পারবে। বেশিরভাগ মাছের আসল দরকার জলের ভিতরে নজরদারি চালানো। একেবারে খুব কাছের জিনিস হলে সেটায় ফোকাস করতে ওদের সুবিধে হয়। তবে এ সব‌ই জলের ভিতরে একটু উপরের দিকে, যতদূর সূর্যের আলো ঢুকতে পারে, ততদূরের জলজ প্রাণীদের ব্যাপারস্যাপার। যত গভীরে যাওয়া যায় আলো তত‌ই কমে আসে। তাই একেবারে নীচের দিকে চির আঁধারের রাজ্যের মাছেদের আর চোখে দেখারই দরকার পড়ে না। কেউ কেউ তো বিলকুল অন্ধ!

চোখে দেখার জন্য তার ভিতরে শুধু আলো ঢুকলে চলে না, আলোটা কি রঙের তাও বোঝা চাই বৈকি। যে কোনো চোখ-ওয়ালা প্রাণী আলো-আঁধারের তারতম্য বোঝে চোখের মধ্যে থাকা একরকম ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা কোষের মাধ্যমে, যাকে বলে 'রড কোষ'। আর রঙের ফারাক বুঝতে দরকার হয় আধখানা মোচার মত দেখতে একরকম কোষ, যার কেতাবি নাম হচ্ছে 'কোন্ কোষ'। আমাদের চোখে এক রকমের রড কোষ আর তিন রকমের কোন্ কোষ থাকে: সবুজ, নীল আর লাল রঙ বোঝার। বাদবাকি রঙগুলো এই তিন রকম কোন্ কোষ মিলেমিশে কাজ করে ফুটিয়ে তোলে। মাছের চোখ‌ও অনেকটা এইরকম।

বেশিরভাগ মাছের চোখের তারা গোলাকার হলেও কাটলফিশ বলে একরকম মাছ আছে যাদের চোখের তারা ইংরেজি ডব্লু অক্ষরের মত। এরা ঠিক মাছ নয়, অক্টোপাসদের মাসতুতো বা পিসতুতো ভাই-বোন। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত প্রবাল-প্রাচীরের ফাঁকে-ফোঁকরে এদের অনেক প্রজাতি রাজত্ব করে। অন্য মাছেদের মত কাটলফিশের চোখে নানা রঙ বোঝার মত  নেই। তাদের চোখে কেবল এক রকম কোন্ কোষ আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাটলফিশের সেই ডব্লু আকারের উদ্ভট তারার গুণে সে যা কিছু দেখে সেসব কিছুকে ঘিরে একটা অন্যরকম রামধনু-আলোর ছটা দেখতে পায় সারাক্ষণ। সে রামধনুতে বেনীআসহকলা নেই বটে, তবে বর্ণান্ধ হয়েও হয়ত সে এমন রঙ দেখতে পায়, যা আমরা কল্পনাই করতে পারি না। আলো-ছায়ার সামান্যতম হেরফেরকে সে এক অন্যরকম কালার-কোডে পরিণত করে ফেলেছে! এছাড়াও এই কাটলফিশ তার দু'চোখের মণি আমাদের মত‌ই স্বাধীনভাবে যখন যেদিকে ইচ্ছে ঘোরাতে পারে। কাটলফিশের চোখে একটা জলের ভিতরে একটা চিংড়িকে কেমন দেখতে লাগবে, তার ছবি দেয়া র‌ইল নীচে।

এদিকে, পাখিদের কালো পুঁতির মত খুদে খুদে চোখ দেখে তাচ্ছিল্য করার কিছু নেই। কথায় বলে, 'পাখির চোখ'! এদের চোখ আমাদের চাইতেও আরো সরেস। রড কোষ তো একরকম থাকেই, তার সাথে চার রকমের কোন্ কোষ আর এক রকমের কোষ থাকে যাদের অনেকটা বালি-ঘড়ির মত দেখতে। এর সাথে আবার ক্রিপ্টোক্রোম নামে একরকম প্রোটিনের অণু থাকে যা তাদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র শনাক্ত করতে সাহায্য করে। কম্পাসের সাহায্য ছাড়াই পরিযায়ী পাখিগুলো যে প্রতি বছর রাস্তা চিনে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে পাড়ি জমায় সেটা এই প্রোটিনের কল্যাণেই সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন এই চৌম্বক-সংবেদী প্রোটিনগুলো নীল আলোয় কাজ করে আরো ভালো। অনেক পাখির চোখের আরেকটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গাড়ির সামনের কাচে যেমন ওয়াইপার থাকে, তেমনি চোখের মণির বাইরে একটা অতিরিক্ত স্বচ্ছ পর্দা থাকে। আমাদের মত চোখের পাতা না ফেলে এরা সেই পর্দা একবার ফেলে, একবার গুটোয়। পুরাণের গল্পের দেব-দেবীর মত 'তৃতীয় চক্ষু', আর কি!

যে তেচোখো মাছে মশার লার্ভা খেয়ে আজকাল খুব নামডাক করেছে, তার কিন্তু সত্যিই তিনটে চোখ নেই। আর সব মাছেদের মত দুটো চোখের সাথে মাথায় রূপোলী বা সাদা রঙের একটা ফোঁটা দেয়া আছে। তাই দেখে হয়ত কেউ একে তিনচোখো বা তেচোখো বা তেচোখা ভেবে থাকবে। তবে সত্যিই যদি দুয়ের বেশি চোখ-ওয়ালা মাছ দেখতে চাও তো মেক্সিকো কি হন্ডুরাসের একটু কাদাটে জল দেখে নামতে হবে। জলের উপরের তলেই অ্যানাব্লেপস্ নামে একরকম চার চোখ-ওয়ালা মাছ দেখতে পাবে। এখানেও একটু ফাঁকি আছে! আসলে ওদের মাথায় দুপাশে একটা করে চোখ‌ই আছে, কিন্তু প্রতিটা চোখের দুটো অংশ আছে। একটা অংশ জলের উপরের দিকে তাগ করে রাখা, শিকার ধরে খাবার জন্য। আরেকটা অংশ জলের নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজে অন্য প্রাণীর শিকার হবার হাত থেকে বাঁচতে! শুধু কি তাই, এরা লেন্স ইচ্ছেমত পুরু বা পাতলা করে ফোকাস বাড়ায় বা কমায়। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, চোখটার উপরের অংশের রেটিনা সবুজ আলোর প্রতি বেশি সংবেদনশীল আর নীচের অংশের রেটিনা হলুদ আলোর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। পণ্ডিতেরা মনে করেন, এর ফলে ঘোলা জলে নজরদারি চালাতে ওদের বেশি সুবিধে।

প্রাণীদের চোখের বাহারের গল্প একবার শুরু করলে শেষ করা মুশকিল। মাকড়সা, ফড়িং, মাছি ইত্যাদি পতঙ্গের পুঞ্জাক্ষি চোখ তো লক্ষ লক্ষ ডিজে বাক্স একজায়গায় করলে যেরকম দেখতে লাগে সেইরকম দেখতে লাগে। অথবা ঠিক যেন মাইক্রোস্কোপিক স্পেস-টেলিস্কোপ! ঐ অজস্র চক্ষু দিয়ে তারা যে কিভাবে কি দেখে তার পাত্তা পাওয়া সত্যিই অসম্ভব। তবে সবরকম পুঞ্জাক্ষিদের ছাপিয়ে গেছে সমুদ্রের তলায় পাওয়া মেন্টিস শ্রিম্প নামে একরকম চিংড়ি-জাতীয় জীবের চোখ। চোখ না বলে একে বলা উচিত মহাচক্ষু বা 'বিশালাক্ষি'! কিরকম জানতে চাও? রঙচ‌ঙ বা আলো-আঁধার বুঝতে মানুষের যে চার রকমের কোষ দরকার সে তো আগেই লিখেছি। আর ওদিকে পাখিদের লাগে ছয়রকম কোষ। মেন্টিস শ্রিম্পের ক্ষেত্রে ঐ কোষ হচ্ছে ষোল রকমের!!! এক পুঞ্জাক্ষিতে রক্ষে নাই, ষোল কোষ দোসর! ব্যাটারা যে ঐ দিয়ে কী দেখে আর কী দেখে না, তার ইয়ত্তা নেই। হুঁ হুঁ বাবা! এদের সাথে কখনো লুকোচুরি খেলতে যেও না! দৃশ্যমান আলো তো বটেই, এমনকি অতিবেগুনী রশ্মি পর্যন্ত দেখতে পায় ব্যাটারা। তুমি ভাবছ, এ আর এমন কি! কিছু কিছু পোকা, কোনো কোনো পাখি, মায় বল্গাহরিণের চোখে পর্যন্ত অতিবেগুনী রশ্মি বোঝার মত কোষ থাকে। তবে সমুদ্রের মেঝেয় চলাফেরা করা এই মেন্টিসরা এই ব্যাপারে এদের গুণে গুণে দশ গোল দিয়েছে। মেন্টিসরা অন্তত পাঁচ রকম কম্পাঙ্কের অতিবেগুনী রশ্মি দেখতে পায়! এছাড়াও এরা এমন এরকমের পোলারাইজড আলো পর্যন্ত দেখতে পায় যা ইহজগতে আর কোনো প্রাণীর চোখেই ধরা পড়ে না!!!

চোখের বাহার শেষ করি পাথরের চোখের কথা বলে। না না, এ মানুষের ব্যবহার করা পাথরের চোখ নয়, না-মানুষের কথা! পুরাণের গল্পের মুনি-ঋষিরা যেমন তপস্যা করতে করতে গায়ে উইঢিপি গজিয়ে যেত আর ঢিপির মধ্যে থেকে চোখের মণিদুটো কেবল বেরিয়ে তাকিয়ে থাকত জুলজুল করে, ঠিক তেমনি সমুদ্রের তলায় কাইটন নামের একটা প্রাণী তার চোখের ব্যবস্থা করেছে। যাতে সে কারো শিকার না হয়ে যায়, তার জন্য সে নিজের দেহে দস্তুরমত মজবুত বর্ম এঁটেছে। আর সেটা করতে গিয়ে তারা ভেবে পায় নি চোখ বাইরের কোথায় রাখবে! চোখ হচ্ছে নরম-সরম জিনিস, তাকে আর কত বর্ম দিয়ে ঢাকা যায়! আবার ঢাকলেও দেখা যায় না! বিবর্তনের রাস্তায় অনেক হেঁটে এদিক-সেদিক দেখে শেষমেশ তারা চোখের লেন্সটাই বানিয়ে নিয়েছে অ্যারাগোনাইট নামের একরকম খনিজ দিয়ে। আমাদের চকে যা আছে, অ্যারাগোনাইটেও তাই আছে, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। এখন পণ্ডিতেরা আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন ঐ পাথুরে লেন্স দিয়ে কাইটনরা আলো-ছায়ার তফাৎ কাজ চালানো গোছের বুঝে নিতে পারে। কিন্তু নিয়েই যে কি করবে, সেটা বোঝা দায়, কারণ সেই দেখার তথ্য বোঝার মত মাথাই তো ওদের আসলে কিছুই নেই! এইরকম প্রায় একশো চোখ, যাদের বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন 'ইস্থেটেস', তারা গোটা গায়ের বর্ম জুড়ে প্রাচীন মুনিদের চোখের মত জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। এদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় একটা ছিল, নাম তার ট্রিলোবাইট আর তার‌ও এইরকম পাথরের চোখ ছিল। এদের ফসিল ঘেঁটেঘুঁটে পণ্ডিতেরা বোঝার চেষ্টা করছেন কেন এবং কোন্ পরিস্থিতি তাদের এই উদ্ভট চোখ বানাতে বাধ্য করেছিল। তাঁরা যতদিনে সে রহস্য ভেদ করবেন, ততদিনে হয়ত তোমরাই আরো অনেক বাহারি চোখের প্রাণীর কথা জেনে ফেলবে!

                                      

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb