সুয্যিদেবের ভাইবোন

লেখক - সাগ্নিক সিনহা

                                     

মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা ভাই বা বোন থাকলে বেশ ভালো হতো। কি আর বলবো, সিঙ্গল চাইল্ড হওয়ার অনেক ঝামেলা, মশাই। বাড়িতে যা কিছু হারায়, যা কিছু গণ্ডগোল হয় সবই নাকি আমার জন্য! একটু যে কারোর ঘাড়ে দোষ চাপাবো তার উপায়ই নেই !

অন্ধকার অসীম মহাশূন্যের বাসিন্দা নক্ষত্রদেরও বোধহয় এরকম দুঃখ টুঃখ হয়, বুঝলেন !

যাহ্, সেটা আবার কেন ?

এই দেখুন, আসল কথাটাই এখনও বলে উঠতে পারলাম না, শিরোনাম দেখে এখনও ভাবছেন ব্যাপারটা কি? আজকের গল্পটা সত্যি সত্যিই মহাজাগতিক ভাইবোনদের নিয়ে।

আচ্ছা, "জমজ তারা"দের নাম শুনেছেন? না শুনে থাকলেও বিশেষ অসুবিধা নেই, নামটা দেখেই বুঝেছেন, দুটো তারা একইসাথে একটা স্থির বিন্দুর চারদিকে জোট বেঁধে করে ঘুরলে, তাদের বিজ্ঞানীরা জমজ তারা বা binary stars নাম দেন। একইসাথে খুব কাছাকাছি কক্ষে ঘুরতে থাকে বলে এদের বেশিরভাগ সময় পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপে দেখেও বোঝা যায়না যে আসলে দুটি নক্ষত্র জোট পাকিয়ে আছে সেখানে। তাহলে উপায়?

আসলে বেশিরভাগ জমজ নক্ষত্রের আবিষ্কার ঘটেছে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে! নতুন কোনো নক্ষত্রের আনুমানিক ভর আর তার উজ্জ্বলতা, গণনার সাথে ঠিক না মিললে পরীক্ষা করে দেখা হয় সত্যিই সেটি একটিই নক্ষত্র নাকি লুকিয়ে থাকা বাইনারী সিস্টেম?

 দেখা যায়, বাইনারী সিস্টেমের নক্ষত্রদুটির একজনের কক্ষপথ আরেকজনকে কেটে বেরোতে পারে , আবার দুজনে মিলেমিশে সমান্তরাল দুই কক্ষপথে ঘুরে চলতেও পারে। যেটাই হোক না কেন এদের আসল কক্ষপথ একদম নিশ্চিত ভাবে এখনও বলা যায়না।

ছোটখাটো কোনো গ্রহ উপগ্রহ তো নয়, এক একটা এরকম তারার একবার গোটা এক পাক ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় কয়েক মিলিয়ন বছর, ভাবুন একবার ! তবে, আমরাও কম যাই না, সোজাসুজি মাপা যায়না বলে বিজ্ঞানীরা স্পেকট্রোস্কোপি আর অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির indirect পদ্ধতি ব্যবহার করে, অঙ্ক কষে ঠিকই জেনে ফেলেছেন এদের হাল হকিকত।

মহাকাশ গবেষণায় এরা বেশ নতুন সদস্য, যথেষ্ট কাজ চলছে binary star দের নিয়ে, কিভাবে এরা একে অন্যকে এবং সেই সাথে ওদের চারপাশে মহাকাশকে (আর মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্য জিনিসগুলোকেও) প্রভাবিত করে, সেটাই মূল জিজ্ঞাসার বিষয়।

বাইনারী স্টারদের ব্যাপারটা দেখে মনে প্রশ্ন আসছিল, এরকম ঠিক দুটো দুটো করেই নক্ষত্র একসাথে থাকে কেন? এদের সৃষ্টিই বা হয়েছে কেমন করে! ব্যাখ্যাটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছেও এখনও পুরোটা স্পষ্ট না, তবে দুটি সম্ভাব্য থিয়োরি দিয়েছেন তাঁরা।

প্রথম থিয়োরি অনুযায়ী, একটি বড় নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি ঘুরতে ঘুরতে কোনো ছোটো নক্ষত্র চলে এলে, বড়ো তারার প্রবল মহাকর্ষের টান ছাড়িয়ে আর পালাতে পারেনা ছোটো তারাটি, দুজনে একইসাথে ঘুরতে থাকে একটি বাইনারী সিস্টেম তৈরি করে।

তবে এরকম সিস্টেমের সংখ্যা মহাবিশ্বে খুব কম। বরং দ্বিতীয় থিয়োরি মেনেই আমাদের চোখে দৃশ্যমান মহাশূন্যের বেশিরভাগ জমজ নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছে।

এই তত্ত্বে বলা হয়, নক্ষত্র সৃষ্টির সূচনাকালে, প্রবল বেগে ঘুরতে থাকা মহাজাগতিক গ্যাস আর ধূলিকণার মেঘ (এই মেঘ শুধু নামেই মেঘ, এর বিস্তৃতি প্রায় কয়েক বিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইলও হতে পারে!)  মাঝখান থেকে ভেঙে আলাদা হয়ে যায়, দুটি অংশ দুদিকে ছিটকে যায়। তারপর সেই মেঘ ঘনীভূত হয়েই তৈরি হয় দুটি নক্ষত্র, যাদের গতিপ্রকৃতি একরকম নাও হতে পারে, তবে উৎপত্তি কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা।

আমাদের চেনা জানা সমস্ত তারাদের সাথেই আরেকটা করে জুড়িদার পাওয়া না গেলেও, গোটা মহাবিশ্বে এরকম জমজ তারাদের সংখ্যা'টাও কিন্তু কম না। সেই 1650 সালে উর্সুলা মেজর নক্ষত্রপুঞ্জে প্রথম এদের দেখা মেলে, তারপর থেকে খোঁজ চলছেই। আঠারো শতকে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল তো একাই প্রায় 700র উপর জমজ তারা খুঁজে বার করে ফেলেছিলেন! ভদ্রলোকের ধৈর্য্য ছিল বটে! (বাইনারী স্টারদের খুঁজে বার করা এখন বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে কিছুটা সহজ হয়ে এলেও সেই যুগে কিন্তু শুধু নিজের চোখে দেখা ঔজ্বল্যের পরিমাপ আর খাতায় কলমে অঙ্ক কষে দেখাই ছিল একমাত্র ভরসা !)

আর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তে আবিষ্কৃত সমস্ত binary star দের মোট সংখ্যা হচ্ছে প্রায় 141,000 জোড়া ! ( তথ্যসূত্র : Washington doule star database, june 2017, US naval observatory ) সংখ্যাটা হাঁ করিয়ে দেওয়ার মতই, তবে মহাবিশ্বে মোট তারাদের সংখ্যার কাছে ( 200 বিলিয়ন ট্রিলিয়ন) একেবারেই নগন্য। যদিও সেভাবে কাজকর্ম হয়েছে এদের মধ্যে মাত্র কয়েক হাজারকে নিয়ে।

প্রকৃতিগত ভাবে বাইনারী স্টারদের দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। প্রথমতঃ, "আবদ্ধ কক্ষ জমজ" অর্থাৎ এখানে জমজ তারাদুটির সৃষ্টি হয়েছে খুব কাছাকাছি জায়গায়, আর দূরত্ব ভীষণ কম হওয়ার কারণেই অনেকসময় এদের মধ্যে গ্যাস ও অন্যান্য পদার্থের দেওয়া নেওয়া চলতে থাকে। ফলে, স্টার সিস্টেমের মোট ভর একই থাকলে কি হবে, তার সদস্যদের ভর আর আয়তন বদলাচ্ছে মাঝেমাঝেই!

এখন এভাবে চলতে চলতে দুটি তারার মধ্যে কোনো একটি যদি খুব বেশি বড়ো আর ভারী হয়ে ওঠে, তাহলে সেই তারা'র প্রবল শক্তিধর মহাকর্ষ বল স্বাভাবিক নিয়মেই গিলে নিতে পারে ছোটো তারা'টাকে, একসাথে মিলে মিশে তৈরি হয় একটিমাত্র বড়সড় নক্ষত্র।

দ্বিতীয়ত:, "বিক্ষিপ্ত কক্ষ জমজ"। নাম শুনলেই বোঝা যায়, এদের সৃষ্টি হয়েছে একে অন্যের থেকে অনেক দূরে। একইসাথে ঘোরার কারণে বাইনারী সিস্টেম তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে এদের কক্ষপথের মাঝে লক্ষ কোটি মাইলের দূরত্ব, তাই আগেরটার মতো আদান প্রদানের একেবারেই সম্ভাবনা থাকেনা।

এই দু ধরনের বাইরেও আরও বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বেশ কয়েক ধরনের জমজ নক্ষত্র আছে আমাদের এই অসীম মহাজগতের অন্ধকারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে,

  1. ভিসুয়াল বাইনারী - দুটি তারার মাঝে দূরত্ব বেশি থাকায় টেলিস্কোপ দিয়েই আলাদা আলাদা ভাবে বোঝা যায় এদের
     
  2. স্পেকট্রোস্কোপিক বাইনারী - ভীষণ কাছাকাছি হওয়ায় টেলিস্কোপে দেখে এদের আলাদা করা যায়না। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং অন্যান্য গণনার দরকার পড়ে। এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
     
  3. এক্লিপসিং বাইনারী - এদের কক্ষপথ দুটি এমনভাবে সাজানো যাতে পৃথিবীর সামনে অনেকসময় একই রেখায় হাজির হয় দুজনে, অনেকটা গ্রহণ হওয়ার মতো।
     
  4. অ্যাস্ট্রমেট্রিক বাইনারী - সিস্টেমের একটি তারার উজ্জ্বলতা অস্বাভাবিক কম, প্রায় মৃত নক্ষত্র। তাই দেখলে মনে হয় কেবল একটিই তারা ঘুরে চলেছে একটা ফাঁকা জায়গার চারপাশে।
     
  5. ডাবল স্টারস - নকল ভাইবোন, এদের চোখে দেখে একেবারে গায়ে ঘেঁষা লাগলে কি হবে, আদপে বাইনারী সিস্টেম না। মহাশূন্যে এই নক্ষত্রদের মাঝে অনেক ছাড়াছাড়ি।

এতটা যদি পড়েই ফেলেন, আপনার ধৈর্য্যের কিন্তু প্রশংসা করতেই হচ্ছে, সত্যি !

তা, এইবার কথা হচ্ছে, এসব হাবিজাবি জেনে লাভ টা কি? মহাকাশে তো এরকম অনেক কিছুই আছে, অজস্র অচেনা জ্যোতিষ্ক আর তাদের অদ্ভুত জগৎ! আমাদের তাতে কি এসে যায় ?

হুঁ, কথাটা মন্দ না। বাইনারী স্টারদের নিয়ে পড়ার সময় আমারও যে এটা মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু হঠাৎ একটা কথা নজরে আসতেই মনে হল, এসে যায় তো! সত্যিই এসে যায় আমাদের! কিছুটা সেকারণেই লিখতে গেলাম এদের নিয়ে। কিন্তু কি সেটা?

গুগল করলে দেখতে পাবেন, আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বাইনারী সিস্টেম বলতে সেই আলফা সেন্ট্যুরি কনস্টেলেশনের পিঠোপিঠি দুই নক্ষত্র, "আলফা সেন্ট্যুরি এ" আর "আলফা সেন্ট্যুরি বি"। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি তাই? আর এইযে আমাদের রোজ আলো দেন সূয্যি দেব, তাঁর কোনো জমজ ভাইবোন নেই? নেই আরেকটা সূর্য ? থাকলে তো দেখতেই পেতাম আমরা তাই না? অবশ্য আমরা যা দেখতে পাইনি তার কোনো অস্তিত্ব নেই এ কথা এই গড পার্টিকলের যুগে এসে আর বলা যায় কি!

প্রশ্নটা উঠেছিল অনেকদিন আগে। সেই 1980 সালের আশেপাশে, একদল বিজ্ঞানী দাবি করলেন সূর্যের সাথে সাথেই আমাদের চোখের আড়ালে রয়েছে তার এক জমজ ভাই, " নেমেসিস"। প্রাণের সৃষ্টির পর থেকে মোটামুটি প্রতি 26 মিলিয়ন বছরে একবার করে mass extinction ঘটে পৃথিবীতে ( প্রাকৃতিক কোনো শক্তির হাতে বিশাল জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, যেমন উল্কার আঘাতে ডাইনোসর'দের মৃত্যু), তার পিছনেও নাকি এই "নেমেসিস" এর গুপ্ত প্রভাব আছে। তত্ত্বটা হঠাৎ শুনলে গাঁজাখুরি লাগতেই পারে, তবে পুরোপুরি না মানলেও একেবারে  উড়িয়ে দিলেন না জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

ধরা হয়েছিল, নেমেসিস যদি থেকেও থাকে, সে সূর্যের মত জ্বলজ্বলে সক্রিয় নক্ষত্র হতেই পারেনা, কারণ এত কাছে আরও একটি সূর্য থাকলে এতদিনে ধরা পড়বেনা, এটা অসম্ভব! তাহলে! তাহলে অবশ্যই নেমেসিস মৃত, হয়তো কোনো রেড বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ রূপে আত্মগোপন করে আছে আমাদেরই সৌরজগতের অনাবিষ্কৃত এক কোণায়! কিন্তু সেটা কোথায় ?

2010 সাল। নাসায় জোরকদমে চলছে WISE অর্থাৎ Wide-field Infrared Survey Explorer প্রোজেক্ট, উদ্দেশ্য একটাই - সৌরজগতের মধ্যে এবং বাইরে থাকা সমস্ত brown dwarf কে খুঁজে চিহ্নিত করা। একইসাথে চলছিল TMASS অর্থাৎ Two micron all sky survey নামের বিশাল আরেকটি প্রোজেক্ট। কয়েক বছর পর দুটি গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করেই পাওয়া গেল অনেক নাম না জানা মৃত, হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র, দৃশ্যমান মহাশূন্যের একটা বিশাল অনাবিষ্কৃত প্রান্তর সমীক্ষা করে বানানো হল মহাকাশের কার্যকরী মানচিত্র। সবই হল, কিন্তু নেমেসিস - এর খোঁজ যে মিলল না!

 NASA র খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ডক্টর ডেভিড মরিসন এক টক শোয়ে বলেই বসলেন, "নেমেসিস বলে কিছু নেই! থাকলে এত শক্তিশালী তিন তিনটে টেলিস্কোপের নজর এড়িয়ে পালাবে কোথায়! নেমেসিস নেহাতই এক মরীচিকা।"

বিজ্ঞানীরা ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ। একবার কিছু মাথায় ঢুকলে তার শেষ না দেখে ছাড়েন না তাঁরা। তাই সবকিছু নেগেটিভ আসার পরেও সূর্যের জমজ ভাইয়ের খোঁজ কিন্তু থামলো না!

2017 সাল। হাওয়াই আর নিউ মেক্সিকোর দুই বিশাল রেডিও টেলিস্কোপের সার্ভে চলছিল গত কিছু বছর ধরেই। তার ফলাফল প্রকাশ পেতেই হইচই পড়ে গেল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে! গবেষণাপত্রে গাণিতিক যুক্তি সহ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে এক নতুন মডেল,

"মহাবিশ্বে সমস্ত নক্ষত্রের জন্ম হয় জোড়ায় জোড়ায়, একমাত্র এভাবেই নক্ষত্রের উৎপত্তি সম্ভব। তাই বর্তমান বা অতীতের সমস্ত নক্ষত্রই কখনও না কখনও কোনো বাইনারী সিস্টেমের অংশ ছিল, অবশ্যই"। সার্ভে রেজাল্টেও মিলল তারই সপক্ষে অজস্র প্রমাণ!

তাহলে! দূরবীনে চোখ রাখলে মহাবিশ্বের বেশিরভাগ নক্ষত্রই যে একা একা! নক্ষত্রপুঞ্জ তৈরি করলেও সেখানে নক্ষত্রেরা থাকে স্বতন্ত্র ভাবেই!

এরও সমাধান পাওয়া গেল। সার্ভে রেজাল্টে পরিষ্কার দেখা গেল যে, বহুদিন আগে তৈরি হওয়া বাইনারী সিস্টেমের তারাদের মাঝের দূরত্ব অনেক অনেক বেশি হলেও সদ্যোজাত সিস্টেমগুলোতে জন্মের পরমুহুর্তে তারা'দের মাঝে তেমন একটা ব্যবধান নেই। তার মানে, সময়ের সাথে যে বাড়ছে অপসৃয়মান মহাশূন্যের ব্যাপ্তি ( expanding multiverse), তার সাথে তাল মিলিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই দূরে চলে যাচ্ছে জমজ ভাই বোনেরা! আজকের বাইনারী সিস্টেম হিসেবে দেখছি যাদের, আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পরে এরাও আর অবশিষ্ট থাকবে না ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া এনট্রপির সূত্র মেনে।

এটাই তো হওয়ার কথা, তাই নয় কি? সম্ভাবনা ছিল এতদিন, সপক্ষে এরকম জোরালো প্রমাণ পাওয়ার আবার বেঁচে উঠল নেমেসিস এর দাবি!

খুঁজে না পাওয়া গেলেও, প্রায় চল্লিশ বছর পর শেষপর্যন্ত এটা মেনে নেওয়া হল যে আমাদের সারাদিনের সঙ্গী, আমাদের পৃথিবীবাসীর জীবন আর সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা সূর্যেরও একসময় এক জমজ ভাই (বা বোন, কে জানে!) ছিল। নেমেসিস!

তবে এলিয়েন গ্রহগুলির মতো পৃথিবীর আকাশে একসাথে দুটি সূর্য দেখা সম্ভব ছিলনা কোনোকালেই ! কি করেই বা হবে, গণনা অনুযায়ী সৃষ্টির পরেই নেমেসিস আর সূর্যের মাঝে ব্যবধান ছিল অন্তত 150 বিলিয়ন কিলোমিটার! রাতের আকাশে অনেক দূরে, ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল এক মিটমিটে আলোর বিন্দু হয়েই ধরা দিত সূয্যিদেবের সহোদর।  তারপর, সম্ভবত দূরে সরতে সরতে কয়েক বিলিয়ন বছর আগেই আমাদের সৌরজগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছে মহাকাশের অতল কোনো গহবরে!

গল্পটা আপাতত এখানেই শেষ হতে পারতো, একটা আশা আর আলতো সম্ভাবনার রেশ রেখে। কিন্তু তখনও চমকের বাকি ছিল।

আমাদের সৌরজগতের শেষ সীমানা বলে ধরা হয় যাকে, সেই উর্ট ক্লাউড নিয়ে গবেষণা করছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমীর সিরাজ এবং অন্যান্যরা।

উর্ট ক্লাউড হচ্ছে এককথায় বলতে গেলে মহাকালের ডাস্টবিন। স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলা কক্ষভ্রষ্ট গ্রহাণু, ধূমকেতু বা তাদের ধ্বংসাবশেষ কোনোভাবে এসে জমতে থাকে এখানে, মহাশূন্যের অস্বাভাবিক ঠান্ডায় বরফের পুরু আস্তরণে ঢাকা পড়ে যায় উপরিভাগ। প্রায় 100 বিলিয়ন অজস্র ছোটছোট এরকম জিনিস নিয়েই তৈরি হয়েছে উর্ট ক্লাউড, চারিদিক থেকে বিশাল এক বাউন্ডারি লাইনের মতো করে ঘিরে রেখেছে সৌরজগতের ময়দান'কে।

কিন্তু জমা হওয়া এইসব জিনিসগুলো আসে কোত্থেকে? কিভাবেই বা এসে পৌঁছায় ঠিক ওই জায়গাতেই? উর্ট ক্লাউডের সৃষ্টির রহস্য এইসব খুঁজতেই গবেষণা করছিলেন সিরাজ এবং তার দল।

Astrophysical journal letters পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ঊর্ট ক্লাউড সৃষ্টির কারণ হতে পারে সূর্যের টানে পাশের সৌরজগৎ থেকে গ্রহানুপুঞ্জের ছিটকে আসা। তবে তার চেয়েও শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে, উর্ট ক্লাউডের এই পাথরের টুকরোগুলো কোনো এক কালে আসলে আমাদেরই সৌরজগতের ভিতরের দিকের অংশ ছিল, কেন্দ্রের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াতো নিজের কক্ষে। তারপর কোনো বিশাল গ্রহের  (giant planet)সাথে সংঘর্ষে হয়ত ছিটকে গিয়ে পড়েছে বাউন্ডারি লাইনে। কিন্তু এভাবে দেখলে আবার আরেক উটকো ঝামেলা এসে জুড়ে যায় ঘাড়ে, উর্ট ক্লাউড তৈরির জন্য যে বিশাল আকারের এক দানব গ্রহের উপস্থিতি থাকা দরকার, সেটা তাহলে কই? বৃহস্পতি এই মডেলে খাপ খায় না, তাই কল্পনা করা হল নেপচুনের চেয়েও বড়ো এক "প্ল্যানেট 9", এক অজানা দৈত্যাকার গ্রহ, যা নাকি একসময় ছিল আমাদের আশেপাশেই! এমনকি এখনও অনেক সৌরজাগতিক ঘটনার পিছনেই তার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় বলে মনে করেন অনেকে।

সমস্যাটা বুঝছেন? একটা রহস্য সমাধান করতে গিয়ে মাথামুন্ডু কিছু তো বোঝা যাচ্ছে না, উল্টে আরো নতুন নতুন কল্পনা আর নতুন সব থিয়োরি চলে আসছে, আরো বেড়ে যাচ্ছে রহস্য!

ঠিক এই কারণে সীরাজ তাঁর পেপারে অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, সমাধানে পৌঁছাতে গেলে একমাত্র রাস্তা একটাই, অধুনালুপ্ত নেমেসিসের প্রাচীন অস্তিত্ব মেনে নেওয়া! এইটুকু ধরে নিতে পারলেই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায় বাকি সমস্ত কল্পনা, আনুমানিক থিয়োরি আর রহস্যগুলো। সমাধানটা সোজা। কারণ, সাধারণ নক্ষত্রের তুলনায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, বাইনারী সিস্টেমগুলোর প্রবল মহাকর্ষ বল চারপাশের শূন্যস্থান থেকে টেনে নিয়ে আসতে পারে অনেক কিছু, সেটা প্ল্যানেট 9 এর মত দানব হোক বা উর্ট ক্লাউডের বাসিন্দা ছোট্ট গ্রহাণু! ব্যাস, এতে শুধু একটা না, তিন তিনটে unsolved mystery মিলে যাচ্ছে একই সাথে, একটা সত্যি হলেই বাকিগুলোও তার থেকে প্রমাণ করা যায় সত্যি হিসেবে! দারুন না?

সিরাজের কথাগুলো দিয়েই শেষ করব এই লেখা,

"প্ল্যানেট 9 আছে কি নেই তার সরাসরি প্রমাণ আমরা দিতে পারবো না, তবে উর্ট ক্লাউড নিয়ে কাজ করার পর তার অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। শুধু এটুকু বলা যায় নেমেসিস যে আছে, সেই ধারণাকেই আরো জোরালো করেছে আমাদের গবেষণা। সূর্যের উৎপত্তির প্রথম 100 মিলিয়ন বছরের মধ্যেই birth cluster ( যে উত্তপ্ত গ্যাস আর ধুলোর মেঘ থেকে নক্ষত্র জন্মায়) থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল নেমেসিস, ছিটকে পড়ে সৌরজগতের থেকে অনেক অনেক দূরে, এরপরের কথা আমরা কিছুই জানিনা এখনও।

তবে আমাদের কাজ এখনও চলছে, আমাদের নিজেদের এবং পুরোনো অন্যান্য সমস্ত গবেষণার তথ্য আবার খুঁটিয়ে দেখছি আমরা, আমাদের স্থির বিশ্বাস এই বিশাল মহাকাশের কোথাও না কোথাও অন্য নক্ষত্রপুঞ্জের ভিড়ে তাকে একবার অন্তত দেখা গেছেই! বারবার চোখ এড়িয়েছে দুর্ভাগ্যক্রমে, তবে এইবার আমরা তাকে খুঁজে বার করবই"

সিরাজ এখনও আশা রাখছেন, এই 2021 সালেই চিলির বরফে ঢাকা পাহাড়ে তৈরি হয়েছে নতুন এক অবজারভেটরি, সৌরজগৎ এবং তার বাইরের dwarf planet আর বিভিন্ন নক্ষত্রদের হালহকিকত জানাই তার কাজ। তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় তিনি। অপেক্ষায় যে আমরাও!

কেন? প্ল্যানেট নাইন নাহয় দুষ্টু ছেলে, বিশাল শরীর নিয়ে শুধু এদিক ওদিক করে বেড়ায় গ্রহ নক্ষত্রের স্বাভাবিক গতিবিধি। কিন্তু নেমেসিস? নামটা যতই ভিলেনমার্কা হোক, আমাদের প্রিয় সূয্যি মামার হারিয়ে যাওয়া ভাই বোন কে দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি?

                                          

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb