ছদ্মবেশী ম্যাজিশিয়ানের গল্প

লেখক - সাগ্নিক সিনহা

                                           

সেই যে কোনকালে গুরুদেব বলে গিয়েছিলেন, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই", কথাটা কিন্তু ভীষণ সত্যি। যদিও রাস্তাঘাটে ছাই পড়ে থাকলে বিশেষ কারণেই সেটা এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কারণ তার নীচে ইয়ে থাকতে পারে; তবে এই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ব্যতিব্যস্ত করার অভ্যেসটা আবার কোথাও কোথাও বড্ড দরকারি।

মানে? কি বিষয় আজকের? ম্যাজিকই করছে কে? হবে, সব হবে! পড়তে থাকুন না, আস্তে আস্তে। বেশিক্ষণ লাগবে না, প্রমিস।

ভাগাভাগি সবসময় সমান হয় না

এই যেমন রবিবারের মাংসর কথাই ভাবুন না, চুপিচুপি একটু বেশি হাতিয়ে নেওয়ার মধ্যে যা মজা আছে না, উফফ্। তবে এর জন্য আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, ব্যাপারটা হল গিয়ে মজ্জাগত, বা বলা ভালো কোষগত।

ইস্কুলে আমাদের শেখানো হয়েছিল, এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণীর রূপান্তরের আসল রহস্য হচ্ছে বিভাজন। কোষবিভাজনের মাধ্যমেই একটি পরিণত, পূর্নবয়স্ক কোষ দুই ভাগে ভেঙে গিয়ে জন্ম দেয় দুটো আলাদা আলাদা নতুন কোষের, যারা আবার বেড়ে ওঠার পর প্রত্যেকে একইভাবে তৈরি করে আরো নতুন কোষ। এভাবে কয়েকটা ধাপের পরেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে মোট কোষের সংখ্যা কয়েক হাজার কিংবা লাখ ছুঁয়ে ফেলে।

 সাধারণভাবে দেখা যায়, একটা কোষ তার ভিতরের যাবতীয় মালমশলা ( পুষ্টিপদার্থ থেকে শুরু করে পরাআণুবীক্ষণিক উপাদানগুলো) সমান সমান পরিমাণে ভাগ করে দেয় নতুন দুই কোষে। শরীরের প্রায় 90% কোষ এই নিয়ম মেনেই চললেও এর কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে।

আমি আমার মতো

এটাই স্টেম সেল বা বীজ কোষদের বক্তব্য। ভ্রূণের দেহের পুরোটাই তৈরি এই স্টেম সেল দিয়ে, এদের থেকেই তৈরি হয় সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চুল, নখ, দাঁত, রক্ত সহ গোটা শরীরটা। স্টেম সেল ঠিক যেন শরীরের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বহুরূপী, ইচ্ছেমত রূপ ধারণ করতে পারে দরকার মতো। ভ্রূণ বেড়ে ওঠার পরেও আমাদের শরীরে থেকে যায় অল্প কিছু স্টেম সেল, ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আর থেকে যায় বলেই, বেশ কিছু সাংঘাতিক রোগে পড়েও বেঁচে যেতে পারি আমরা।

জিনিসটা বেশ অন্যরকম হলেও সেসবের খুঁটিনাটি জানার এখন সময় না, আমরা বরং ভাগ বাঁটোয়ারার দিকেই নজর দিই। স্টেম সেলরা শুরুর দিকে দুই অংশে ভেঙে যায় ঠিকই, কিন্ত ভাগাভাগি করার সময়ই বাধে গোলমাল।

যদি ব্যাপারটা হয় সমানে সমানে তাহলে দুটো নতুন কোষ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এদিকে পরিণতির নিয়ম মেনে তারা যে আর স্টেম সেল থাকছেনা, বিশেষ বিশেষ জিনের প্রকাশ ঘটিয়ে তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ন নতুন কলাকোষ, যা শরীরের বাড়তে থাকা বিভিন্ন জায়গাগুলোয় নতুন টিস্যুর যোগান দেবে। তাহলে এভাবে চলতে থাকলে, একসময় যে ঠিকই ফুরিয়ে আসবে জমিয়ে রাখা স্টেম সেলের ভাঁড়ার। তারপর? কে বানাবে নতুন কলা, তন্তু, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, রক্ত ? কোত্থেকে আসবে আরো নতুন স্টেম সেল?

গোড়ায় গলদ যাকে বলে! এই সমস্যা এড়ানোর জন্য স্টেম সেল বিভাজনের সময় একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়।

নেচার পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে এখানে, নতুন জন্মানো কোষগুলোর একটার মধ্যেই চেপেচুপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কিছু বাড়তি ক্রোমোজোম, যার মধ্যে থাকে সেইসমস্ত জিনগুলো, যারা স্টেম সেলকে দেয় প্লুরিপোটেন্সি (অর্থাৎ কিনা শরীর দরকার মতো চামড়া, নার্ভ, গ্রন্থি, হাড় বা এইরকম যেকোনো ধরনের কলাকোষে পরিণত হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা) ।

আর আরেকটা নতুন কোষ? তাতে থাকে ছিটেফোঁটা, অনেকখানি কম। তাই প্রত্যেকবার তৈরি হয়ে একটা করে সাধারণ কোষ, আর একটা করে স্টেম কোষ, ক্ষতিপূরণ হিসেবে। ব্যস, ভাঁড়ার ফাঁকা হওয়ার ভয় আর রইলো না।

এখন এই একই জিনিষ যদি শরীরের সবজায়গায় কয়েক মিলিয়ন কোষে ঘটতে শুরু করে ? ধরা যাক, হাত পায়ে কোথাও কেটে গিয়েছে, বাজেভাবে ছিঁড়ে গিয়েছে চামড়া। সেখানে ক্ষতস্থান মেরামত করতে খুব তাড়াতাড়ি দরকার অনেক অনেক নতুন ত্বক কলাকোষ, তার জন্য হওয়া চাই দ্রুত কোষ বিভাজন।

কিন্তু এখন যদি এভাবে প্রতিবার মাত্র একটা করে নতুন কোষ পাওয়া যায়, তাহলে? কয়েক লাখ কোষে এই প্রক্রিয়া শুরু হলে শক্তিক্ষয় হচ্ছেই, তার উপর সামান্য একটা ছড়ে যাওয়া ক্ষতস্থান সারিয়ে তোলার জন্য সময় লাগবে কয়েক সপ্তাহ, মাস। কে বলতে পারে? সংক্রমণ বা আবারও আঘাত লাগার ভয় তো আছেই। ঠিক বাস্তবসম্মত নয় তাই তো? কিন্তু শরীরে থাকা খুব অল্পসংখ্যক স্টেম সেলের জন্য এরকম হলে বিশেষ সমস্যা নেই। এমনিতেও তাদের দরকার পড়ে শুধুমাত্র কয়েকটা বিশেষ পরিস্থিতিতেই। যেমন ধরা যায় শুক্রাণু বা ডিম্বাণু তৈরি করা জার্ম সেল'দের কথা, যারা কার্যত অমর। দেহের সমস্ত কোষ মারা যায়, তাদের জায়গা নেয় নতুন কোষ, এক জনন কোষ ছাড়া। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে তাদের জিনসমষ্টি, এককোষী জাইগোট থেকে বহুকোষী দেহ তৈরির পর আবার এককোষী জাইগোট তৈরির চক্র চলতেই থাকে অবিরাম, পূর্বপুরুষের মতো একই কোষীয় উপাদান, একই জিন নিয়েই বেঁচে থাকে উত্তরপুরুষ।

আড়াল থেকে কলকাঠি

মানবদেহ নিজেই একটা রহস্য। এখানে কে ঠিক করে কখন, কোনখানে, কিভাবে হবে কোনো কিছু? স্বাভাবিকভাবেই, উত্তরটা জিন, আর তাকে ধরে রাখে ডিএনএ।

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের শরীরের কোষে কোষে 23 জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ঠেসে রাখা আছে মোট 3×1012 সংখ্যক ডিএনএ, আর এই বিশাল পরিমাণ ডিএনএ আশ্রয় দেয় প্রায় 6×1016 সংখ্যক জিনকে।

সংখ্যাটা বিপুল, কিন্তু হলে কি হবে, হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে সত্যিকারের কাজের কাজ করে মাত্র 20,000 - 25000 জিন। আসলে, প্রায় 6 ফুট লম্বা ডিএনএ ফাইবারের 90 শতাংশই যে অকেজো, ফালতু জঞ্জাল যতসব, স্রেফ নির্দিষ্ট আকার আকৃতি ধরে রাখতে পারে এরা। আর সমস্ত দরকারি জিন এঁটে যায় ওই বাকি 10 শতাংশ সক্রিয় জায়গাতেই।

অন্তত এমনটাই ভাবা হতো, এই কয়েক মাস আগে পর্যন্ত।

হ্যাঁ, অবাক হওয়ার এখনও একটু বাকি আছে অবশ্য।

যেখানে দেখিবে ছাই

সেই যে কবির লাইন লিখেছিলাম প্রথমেই, এইবার তার কারণ বলার সময় এসেছে।

বিজ্ঞানী ইউকিকো ইয়ামাশিতা জীববিদ্যার অধ্যাপনা করেন এমআইটি 'তে, বংশগতি সংক্রান্ত আণবিক কোষীয় জীববিদ্যা তাঁর গবেষণার মূল বিষয়।

গত মাসে প্রকাশিত এক পেপারে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর দীর্ঘ গবেষণার আশ্চর্য ফলাফল, যেখানে প্রমাণ করা হয়েছে, যে কোষের মধ্যে থাকা এই 90% অকেজো ডিএনএ আদপে অকেজো না, হয়তো সক্রিয় জিন বহন করে বংশগতির কাজে সরাসরি নাক গলায় না, কিন্তু এই "জাঙ্ক ডিএনএ" বা অকেজো ডিএনএর সাহায্য ছাড়া শুধু কোষ বিভাজন কেন, ক্রোমোজোম গঠনই অসম্ভব।

জীববিদ্যা আর ব্যতিক্রমের সম্পর্ক ভীষণ গভীর।

ইয়াশামিতার কথায়, "শরীরের প্রতিটা কোষ এতটা বাড়তি ডিএনএ বয়ে নিয়ে চলেছে আবর্জনার মতো, এমনকি প্রত্যেকবার বিভাজনের সময় শক্তি খরচ করে কপিও করছে পুরোটাই একসাথে, এসবই স্রেফ এমনি? অকারনেই? এটা বিশ্বাস করা শক্ত"।

নতুন কোষের জন্মলগ্নে নিউক্লিয়াসের মধ্যে সরু সরু সুতোর মত ছড়িয়ে থাকে তার সমস্ত ডিএনএ, কিন্তু এই অবস্থায় দরকারি জিনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ইতস্তত ভাবে, সঠিক গঠনগত বিন্যাস অর্থাৎ পরপর সাজানো না হলে কাজ করতেই পারেনা এরা। তাই হিস্টোন প্রোটিনের সাহায্যে ঘন করে একসাথে বেঁধে ফেলা হয় ডিএনএ তন্তুকে, মোট 23 জোড়া বান্ডিলে। হুবহু যেভাবে সেলাইয়ের বাক্সে জড়িয়ে রাখা থাকে সুতোর গোলা।

ইয়াশামিতার গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে, এই জট পাকানোর কাজটা করে জাঙ্ক ডিএনএ। তাঁর নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ঠিক যেমন বার কোড দেখে আমরা প্রোডাক্ট কিনি, তেমনই নির্দিষ্ট বিন্যাসের মাধ্যমে জাঙ্ক ডিএনএ বুঝতে সাহায্য করে কোন কোন ডিএনএ ফাইবারগুলো একসাথে কোন প্রোটিনের সাথে জোট বাঁধবে, অর্থাৎ একই বা পরিপূরক গঠনের জাঙ্ক ডিএনএ আছে এমন ফাইবারগুলি কাছাকাছি এসে তৈরি করে এক একটা ক্রোমোজোম।

আমার জঞ্জালই আমার পরিচয়

সেই আঠারো শতকে আবিষ্কারের সময় থেকে অবিরাম গবেষণা সত্ত্বেও কোষের মধ্যে যেন রহস্যের কোনো শেষ নেই। শুধু ক্রোমোজোম গঠনই না, পৃথিবীর বুকে আজকের এই বিশাল জীববৈচিত্র্য তৈরির পিছনেও হাত মূলত জাঙ্ক ডিএনএ'রই।

প্রত্যেক প্রজাতির মোট ক্রোমোজোমের সংখ্যা সবসময় এক এবং সেটা অন্য প্রজাতিদের থেকে আলাদা আলাদা, এটা আমরা সবাই জানি। খুব স্বাভাবিকভাবেই তফাত থাকে জিনোমেও, এক প্রজাতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ন জিন অন্য প্রজাতির প্রাণীর শরীরে সুপ্ত থাকতে পারে, কিংবা আদৌ নাও থাকতে পারে। এটুকু আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে গত শতকেই।

কিন্তু বিজ্ঞানী ইয়াশামিতার গবেষণাপত্র বলছে, জিন সমষ্টির মধ্যে প্রজাতিভেদে বৈচিত্র্য যত না থাকে, তার থেকে কয়েকশোগুণ বেশি বৈচিত্র্য দেখা যায় ডিএনএর এই অকেজো অংশের গঠনবিন্যাসে, অর্থাৎ জাঙ্ক ডিএনএই আমাদের আসল আইডেন্টিটি কার্ড, প্রায় 95 শতাংশ জিনগত মিল থাকা সত্ত্বেও এরাই আমাদের আলাদা করে শিম্পাঞ্জি বা বেবুনের থেকে। বেশিরভাগ হাইব্রিড বা সংকর প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণীকে বাঁচানো যায় না এই জাঙ্ক ডিএনএর বেঁকে বসার জন্যই।

অর্থাৎ, জিনোমে যথেষ্ট মিল আছে এমন খুব কাছাকাছি দুটি প্রজাতির সংকর বানালে যদিও বা হাইব্রিড ডিএনএ তৈরি হয়, তাদের জাঙ্ক অংশের মধ্যে তবুও থেকে যাবে আকাশ পাতাল তফাত, তাই পাঁচমিশালি হাইব্রিড ডিএনএর মধ্যে গোলমাল হয়ে যায় তার স্বতন্ত্র পরিচয়ে, সে চিনতে পারবে না তার জন্য রাখা নির্দিষ্ট হিষ্টোন প্রোটিনকে, তৈরি হবেনা নতুন ক্রোমোজোম, বরং নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসবে আলগা ডিএনএ তন্তু। তারপর? তারপর আর কি, খোদ ডিএনএ নষ্ট হয়ে গেলে কোষের কি বেঁচে থাকা সম্ভব?

প্রকৃতির কাজকর্ম বড় সূক্ষ, একইসাথে সহজ সুন্দর আবার অবিশ্বাস্য জটিল। তাই, এই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যুগেও জীবনের একেবারে গোড়ার কিছু প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে বেগ পেতে হয় আমাদের। বিজ্ঞানের বেশিরভাগ যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে আকস্মিকভাবে, স্বাভাবিক জ্ঞানের বাইরে কোনো অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে। সূত্রটা বোধহয় স্বকীয়তার, চলতি পথের বাইরে নতুন চোখে দেখার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অবাক করা কলকব্জা খুঁজে পাওয়ার রাস্তা। না হলে কি আর জানা যেত, নামেই অকেজো, আন্ডারডগ হয়েও জাঙ্ক ডিএনএই কোষের আসল ম্যাজিশিয়ান!


                                        

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb