স্টিফেন হকিংয়ের ব্ল্যাক বোর্ড

লেখক - ড. জয়শ্রী পট্টনায়ক

                                         

লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামে শুরু হয়েছে স্টিফেন হকিংয়ের অফিস ঘরের ব্যাবহার সামগ্রীর প্রদর্শনী । হলঘরে সাজানো রয়েছে তাঁর ব্যবহিত কলম, নোটবুক থেকে শুরু করে পড়াশোনার নানান উপাদান। তবে দর্শকদের সব থেকে বেশী নজর কেড়েছে ঘরের মাঝখানে রাখা তাঁর ঢাউস ব্ল্যাক বোর্ড আর পাশে সেই বিখ্যাত হুইল চেয়ার। মনে হচ্ছে বিশ্ব বরন্য বিজ্ঞানী হকিং তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী হুইল চেয়ারে বসে বোর্ডে কিছু লিখছেন।   

ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে বিদ্দজ্জনদের ভিড় একটু বেশি। ৪০ বছর ধরে রহস্যে মোড়া হকিং এর একান্ত ব্যক্তিগত ঢাউস ব্ল্যাক বোর্ড দেখার সৌভাগ্য হয়নি কোন বিজ্ঞানী, গবেষক, বা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছাত্রীদের। সবার কৌতূহল, কি লেখা আছে ঐ বোর্ডে?   কি নেই তাতে! অসংখ্য হিজিবিজি। বহু অসমাপ্ত গাণিতিক সমীকরণ, যার জট খুলতে পারলে হয়ত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মহাকাশের অনেক অজানা তথ্য। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড আর প্রাণের বৈচিত্র্য নিয়ে স্টিফেন হকিং এর মনের গভীরে কী প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল, তার হদিস পেতে জ্ঞানীগুণীরা ঝুঁকে পড়েছেন অসমাপ্ত গাণিতিক সমীকরণ গুলোর উপরে। তবে কি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কোন জট খুলতে পেরেছিলেন তিনি! যে সব রহস্যের জট খুলতে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা হাবুডুবু খাছেন, তার সমাধান কী এই হিজিবিজির মধ্যে লুকিয়ে আছে?   

বোর্ডের এক কোনায় আঁকা এক ভিনগ্রহী। নাকটা শামুকের মতো। মুখে খোঁচা খোঁচা লোম। সামনে এক লম্বা সিঁড়ি। যেন এইমাত্র শূন্য থেকে সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নেমে এল। কেন বোর্ডের এক কোনায় চকে আঁকা বিচিত্র দর্শন এই ভিনগ্রহী?  পাশে লেখা জটিল কিছু শব্দ। কী বলতে চেয়েছিলেন হকিং ঐ শব্দ গুলোর মাধ্যমে? আছে কী আরো প্রাণের হদিশ এই বিশ্বের আনাচে কানাচে?         

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। মহাকাশে উড়ে গেল হাবলের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী জেমস ওয়েব মহাকাশ টেলিস্কোপ । অ্যামেরিকান, ইউরোপিয়ান ও কানাডিয়ান মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কোটিকোটি ডলারের প্রোজেক্ট। উৎক্ষেপণের ছয় মাস পর এটি প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ শুরু করেছে। ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূর ভিনদেশী গ্রহ নক্ষত্রর মুলুক থেকে নতুন কি তথ্য পাঠাবে টেলিস্কোপ, তাই ভেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বুক ঢিপঢিপ! লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে টেলিস্কোপ-এর পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ ও বিশ্বতত্ত্ব  সংক্রান্ত এক আলোচনায় যোগ দিতে এসেছেন পৃথিবীর তাবড় তাবড়  জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।  উপস্থিত চোদ্দটা দেশের বিজ্ঞানীদের মনে অনেক প্রশ্ন।  মোটামুটি বলতে গেলে বিগব্যাং ও ব্ল্যাকহোল নিয়ে জানতে সবাই অধীর। তবে  ভিনগ্রহে প্রাণ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁরা পৃথিবীর মত অন্য গ্রহের সন্ধান পেতে আগ্রহী। সে গ্রহের আবহাওায় অক্সিজেন, মিথেন কিংবা কার্বন ডাই অক্সাইড থাকলে বলা যাবে ওখানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে  জটিল কিছু  জিজ্ঞাসা নিয়ে ভারতবর্ষের ইসরো থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোমা দত্ত যোগ দিয়েছেন লন্ডনের এই আলোচনা সভায়। উনি ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেসট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ভিন গ্রহে প্রাণের উৎস নিয়ে গবেষণা করেন।   

আলোচনা সভার উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে এই টেলিস্কোপের প্রধান বিজ্ঞানী নোবেলজয়ী জ্যোতিঃপদার্থবিদ জন ক্রমওয়েল ম্যাথার জানালেন --

  • জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ  টেলিস্কোপ। মহাশূন্যের ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূর থেকে এর পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির অতীত বর্তমান অর্থাৎ বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পরবর্তী ঘটনা গুলো জানতে পারব। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সূর্যের চেয়ে কোটি কোটি গুণ ভারি ব্ল্যাক হোল তৈরি হল কি করে --- সেই সন্ধান ও করতে পারি।   ভিনদেশী গ্রহ নক্ষত্রর মুলুকে বিভিন্ন মৌল ও জৈব অনুর গ্যাসের আবরণের আড়ালে এতদিন কি কি রদবদল ঘটেছে বা ঘটছে তা জানাতে পারবে এই টেলিস্কোপ।  অর্থাৎ গ্যালাক্সির বিবর্তন প্রক্রিয়া আরো স্পষ্ট  হবে আমাদের কাছে।    
  • কি ভাবে? দয়া করে একটু বিশদে বলুন ---

বিজ্ঞানীদের অনুরোধে তিনি  টেলিস্কোপের ছবি দেখিয়ে বলেন-     

  • প্রায় সব তথ্য পাওয়া যাবে আলো মারফত এবং প্রয়োজনীয় আলো সনাক্ত করতে এই টেলিস্কোপে রয়েছে ১৮ টি ষড়ভুজাকৃতি আয়নার সমষ্টি।  ফুল যেমন পাপড়ি মেলে ফোটে, তেমনি ঐ আয়না গুলো পাশাপাশি ধাপে ধাপে খুলে সাড়ে ছয় মিটার ব্যাসের বিশাল আয়না হয়ে দাঁড়াবে মহাশূন্যে পৌঁছে। এর  দ্বারা মহাকাশের থ্রিডি তথ্য পাওয়া যাবে ও ছবির প্রতিটি প্রিক্সেলের পেছনে একটি স্পেকট্রাম লুকিয়ে থাকবে। এই স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করলে মহাশূন্যের অনেক জটিল রহস্যের দ্বার খুলে যাবে।  

সোমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে। নজর গোলগোল চোখের ভিনগ্রহীর দিকে। পাশে লেখা জটিল শব্দগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ যেন চোখ পিটপিট করলো ভিনগ্রহীর।  

এটা কি হল? সোমা ভালো করে চোখ কচলে আবার তাকালো-  

মিটিমিটি হেঁসে ভিনগ্রহী বলে উঠলো-

  • ভাবছ তো আমি কে? আমি এক্স-৯০।  

সোমা হতভম্ব হলেও কানে ঢুকছে এক্স-৯০ র কথা --     

  • এসেছি ইলেক্ট্রা থেকে, যে গ্রহাণুটি রয়েছে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝখানের গ্রহাণুপুঞ্জে--------  

ততক্ষণে সোমা খানিকটা ধাতস্থ। মনে পড়ে গেল, এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ লক্ষ গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সদ্য আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রাই তিনটি চাঁদ যুক্ত প্রথম গ্রহাণু। 

  • এক্স-৯০, তুমি পৃথিবীতে এলে কী করে?      
  • কিছুদিন আগে, বৃহস্পতি গ্রহে তীব্র আলোর দ্যুতি ধরা পড়লো যখন তোমাদের টেলিস্কোপে, সেই আলোর পথ ধরে আমরা পৃথিবীতে নেমে এলাম।  জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন এটা পৃথিবী থেকে দেখা বৃহস্পতির অষ্টম আলোর ঝলক। তাঁদের ধারণা, কোন মহাজাগতিক বস্তু এসে আছড়ে পড়ে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বৃহস্পতিতে, তাই এই তীব্র আলো।      
  • কিন্তু কেন এলে পৃথিবীতে? ---সোমার প্রশ্ন   
  • কারণ পৃথিবী আর মানুষের বাসযোগ্য থাকছে না।  ধীরেধীরে এই গ্রহে মানব জাতি লুপ্ত হয়ে যাবে যেভাবে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। 
  • তোমরা বাঁচতে পারবে পৃথিবীর পরিবেশে?       
  • কেন নয়!  আসলে পৃথিবীতে মানুষ বৃহস্পতির জন্য বেঁচে আছে এতদিন। বৃহস্পতি তার তীব্র অভিকর্ষ বল দিয়ে বিশাল মহাকাশ ঝড়ঝাপটা সামলে তোমাদের প্রাণ বাঁচাচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এত দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে এখানে যে, মানব সভ্যতা আগামী ৪০০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জলস্থলের যাবতীয় বাস্তুতন্ত্রের আমুল পরিবর্তন ঘটছে।  ঘনঘন ভয়ঙ্কর দাবানল, ঝড়, খরা, ও বন্যায় তোমাদের জীবন বিপর্যস্ত।  এরপর তাপপ্রবাহ এবং শৈত্যপ্রবাহর তীব্রতা এতটাই অকল্পনীয় ভাবে বেড়ে যাবে যে পৃথিবী আর তোমাদের বাসযোগ্য থাকবে না।    

সোমা স্তব্ধ। সত্যি তো! যে হারে পৃথিবীর উত্তাপ বাড়ছে, সবুজ কমছে এবং নিরন্তর ক্ষয় হচ্ছে ওজোন স্তর, তাতে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখাটা অসম্ভব। এমন ভাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে, বিশ্ব জুড়ে নদীগুলির অববাহিকা শুকিয়ে কৃষি জমি অনুর্বর করে দেবে। দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে অনেক স্থলভাগ কে ডুবিয়ে দেবে। খাদ্য সংকট দেখা যাবে। বার বার সতর্ক করা হলেও অধিকাংশ দেশ তা কার্যত অগ্রাহ্য করছে। এমন ভাবে চলতে থাকলে ক্রমে ক্রমে এই নীলাভ গ্রহটি মানুষের কাছে হয়ে উঠবে অ-বাসযোগ্য।  

কতক্ষণ এ ধরণের কথোপকথন চলছিলো খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে পেলো মিউজিয়াম রক্ষীদের ডাকে………  

  • ম্যাডাম, মিউজিয়াম বন্ধের সময় হয়ে গেছে, -----   

তাহলে পুরো দুপুরটা ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কেটে গেলো! চোখ গেল বোর্ডে আঁকা ভিনগ্রহীর দিকে। না, চোখ পিটপিট করছে না আর!     

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমার মনে পড়ল আজ সকালে কনফারেন্স-এ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘এলিয়েন (Alien) ও পৃথিবী’। তবে কী মস্তিস্কে ধরে রাখা সেই আলোচনার বিষয়বস্তুর প্রতিফলন ঘটল স্টিফেন হকিং –এর ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে?   না কি সত্যি ভিনগ্রহীর দেখা পেয়েছিল সে…............!!!

                                                          

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb