অমরত্বের সন্ধানে

লেখক - চন্দ্রানী ভট্টাচার্য

                                      

---ও আমার দেলুন-রে - - - - কথা বলছিস না কেন বাবা! চোখ খোল বাবা, চোখ খোল, দেখ তোর জন্য ইয়ানজিয়াও *১ তৈরী করেছি। সেই কবে থেকে বলছিস মচিন *২, করে দাও না ইয়ানজিয়াও খাব, আর আজ করেছি যখন, তখন কেন শুয়ে আছিস বাবা? ওঠ, উঠে বস।
                  শরৎ-সুন্দরী তার আকাশনীলের আঁচল সাদা পেঁজা তুলোয় উড়িয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচি বনভূমির উদ্ভিদকূল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে সৃষ্টি করে চলেছে অরণ্যের আদিমতম সঙ্গীতের সুর। গ্রামের মধ্যিখানে অবস্থিত চার-পাঁচ ফুট উচ্চতার ধূসর বাদামি বর্ণের পর পর বেশ কয়েকটি বাসউড বৃক্ষ তাদের লালচে সবুজ মসৃণ শাখায় হিল্লোল তুলেছে। দূর থেকে দেখলে চোখে পড়বে অপূর্ব এক দৃশ্য, সাদা আর হলুদ রঙের ফুলেরা মেলা বসিয়েছে। কাছে গেলে দেখা যাবে মোটা ল্যাজ বিশিষ্ট নধরকান্তি কাঠবিড়ালির দল 'কিচ''কিচ' শব্দে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতে করতে বৃক্ষের এই শাখা থেকে ওই শাখায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমগ্র প্রকৃতিই যেন জেনে গেছে আজ শরৎ পূর্ণিমার উৎসব। কিন্তু এই আনন্দের লয়টা কেটে যাচ্ছে, থমকে যাচ্ছে দেলুনদের কুঁড়ে ঘরের ভাঙা দরজায় এসে।

                       মাটি,পাথর, বাঁশ দিয়ে নির্মিত জীর্ণ কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় মৃত ছেলের বরফকঠিন শরীরটা জড়িয়ে ধরে একনাগাড়ে বিলাপ করে চলেছিল ক্ষীণ জীবী, ফ্যাকাশে চেহারার টাও। একটু ভালো করে লক্ষ করলেই দেখতে পাওয়া যাবে পায়ের পাতার উপর চাপ দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসতে তার শরীরে অবশিষ্ট, নামমাত্র রক্তটুকু জমাট বেঁধেছে মুখে এসে। চীনের আর পাঁচটা মেয়ের দায়িত্বশীল অভিভাবকের মত তার পিতা-মাতাও মেয়েকে বিয়ের বাজারে সুলক্ষনা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সেই কোন ছোটবেলাতেই পায়ের পাতা মুড়িয়ে পিছিনদিকে বেঁধে দিয়েছিলেন, যাতে মেয়েমানুষের পা বেশি বাড়তে না পারে এবং মেয়ে সতীলক্ষী হয়ে ওঠে। আর এইকারণেই স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে হতে পায়ের পাতাদুটি বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ছেলের শোক শারীরিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারছে না, মুখটা সন্তান শোকের সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক যন্ত্রণায় বারংবার কুঁকড়ে যাচ্ছে।

                    দেলুনের ছোট পাঁচ ভাইবোন অসহায়ের মত তাকিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। সর্ব কনিষ্ঠ দু'বছরের  চুন উসখুস উসখুস করছে,মৃত্যুর অভিঘাত তাকে কাবু করতে পারেনি। বেচারার কাছে এই মুহূর্তে খিদে মেটানোর প্রয়োজনটাই সবথেকে জরুরী। তার মনের ইচ্ছা  মচিন-এর চোখকে ফাঁকি দিয়ে খড় আর পাথরে ছাওয়া দুহাতের নামমাত্র রান্নাঘরে ঢুকে দুপুরে মচিন-এর হাতে তৈরী চাউমিন আর ইয়ানজিয়াও খাওয়ার। কিন্তু বুঝতে পারছে না, কেন গগ*৩ ওইভাবে শুয়ে আছে!তাই গুটি গুটি পায়ে অর্গে*৪ লিয়ানের গা ঘেঁষে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা মুখে পুরে মনের সুখে চুষতে চুষতে, বাঁ হাত দিয়ে জামার নীচের অংশটা টানতে থাকে। এগারো বছরের লিয়ানের চোখের জল এতক্ষণ ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে, খিদেটাও বেশ চাগার দিয়ে উঠেছে। সকাল থেকে পরিশ্রম তো কম হয়নি, নদী থেকে জল আনা, বাবার সঙ্গে ক্ষেতে জন খাটতে যাওয়া, এই সময়ই তো নতুন ফসল কাটা হয়। গ্রামের সংখ্যগরিষ্ঠ প্রজারিই  নিজস্ব জমি নেই,তাই বড় জমিদার বা ভূস্বামীর জমিতেই নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে হয় ওদের মত ভূমিহীনদের। এছাড়া জঙ্গল থেকে আজ রান্নার জন্য কাঠও তো ওকেই কেটে আনতে হয়েছে। কিন্তু সেইসব কাজ করতে একটুও কষ্ট হয়নি, কেন হবে! গগ আর সে দুজনেই তো এই কাজগুলো একসঙ্গেই করত। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই গগ-র শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, পেট ব্যথা, মাথা ব্যাথা, জ্বর তো ছিলই। বৈদ্য এসে পাঁচন দিয়ে গেল, তাতেও তো কমল না! বরং আজ সকাল থেকেই রক্ত বমি করতে করতে দুপুরে ওর বাড়ি ফেরার আগেই গগ মরে গেল।

                        এখনও লিয়ানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে,আর খুব ভয়ও করছে।

----আচ্ছা গগ-র মত আমিও মরে যাবে না তো? আমার গায়ের চামড়াতেও তো লাল লাল দাগ দেখা দিয়েছে, হাতে-পায়ের নিচে চামড়া শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে, ঠিক যেমনটা গগ বা গ্রামের অনেকেরই হয়েছে বা  হয়েছিল।

নিজের অজান্তেই বুকটা কেঁপে ওঠে লিয়ানের, আর এমন সময় ছোট্ট চুনের জামায় টান দেওয়া তাকে দুশ্চিন্তার রাজ্য থেকে বের করে আনে। নিজেকে অন্যমনস্ক করতেই হয়ত চুনকে কোলে তুলে নেয়। চুন নিজের লালঝোলে মাখা কচি, নরম ডানহাতটা দিয়ে লিয়ানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে  আধো আধো কণ্ঠে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করে, ---অর্গে, গগ উত্চে না কেন? আমার যে পেটুতা কোঁ কোঁক কোচ্ছে। খিদে পেচে তো.....

         লিয়ানের  অনেকক্ষন আগেই শুকিয়ে যাওয়া কান্নাটা এবার চোখের বাঁধ অতিক্রম করে বেরিয়ে পড়ে। একটা এগারো বছরের ছেলে, একটা দু'বছরের শিশুর কাছ থেকে জীবনের রূঢ়তম পাঠ নেয়---মৃত্যুর থেকেও নিষ্ঠুর পেটের জ্বালা। যে দুঃখ মানেনা, শোক জানে না, লোকলৌকিকতার মুখোশের তলায় চাপা পড়ে থাকতে পারেনা। ক্ষুদার লেলিহান শিখা সব ভালোমন্দকে গ্রাস করেনেয়।

  চুনের কথা শুনতে পেয়ে এবার তাদের বাবা কিয়ান দুজন প্রতিবেশিনীকে চোখের ইশারায় ডেকে স্ত্রীর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, তাকে শক্ত হতেই হবে। আর কতক্ষণ মৃতছেলের দেহ আগলে বসে থাকবে! এরপর রাত নামবে, দেহ সৎকার করা যাবে না। আজ উৎসবের দিন, জমিদার চাইবেন না কোনো অর্বাচীন প্রজার মৃত্যু গ্রামের আনন্দের পরিবেশটা নষ্ট করুক। কিয়ান কাছে গিয়ে টাও-এর কোল থেকে সরিয়ে নেয় দেলুনকে, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবেশিনী দুজন ঝাপটে ধরে টাও-কে। টাও পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
-----ওগো..... ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেওনা। ও যে আমায় প্রথম মোচিন বলে ডেকেছিল। ও সোনা রে আমার জন্যই তোকে জিয়াংমু*৫ নিয়ে নিল।

                   দু'হাত দিয়ে বুক চাপড়ে বিলাপ করতে থাকা টাওকে সামলানোর জন্য প্রতিবেশিনী ইয়ান বলে, -----কেন তুমি নিজেকে এইভাবে দুষছ! তুমি তো মা; মা কখনও তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়!

----হয় হয়। তুমি জানো না, আমি, এই আমি দায়ী দেলুনের মৃত্যুর জন্য। আজ চাউ বানাতে গিয়ে কিছুতেই তাদের লম্বা রাখতে পারছিলাম না, খালি ভেঙে  যাচ্ছিল। তখনই আমি জানি কারোর না কারোর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে।

                ঘটনাটার কথা জানতে পেরে অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপস্থিত গ্রামবাসীরা সবাই শিউরে ওঠে। তারা বিশ্বাস করে চাউ যদি একহাত সমান লম্বা না হয় তাহলে তা পরিবারে অমঙ্গল ডেকে আনে, পরিবারের সদস্যদের আয়ু হ্রাস করে। সবাই যখন এই অমঙ্গলজনক ঘটনাটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই বাইরে একটা শোরগোল শোনা যায়। বেশকিছু অশ্বের ক্ষুরধ্বনি জটলাটার মধ্যে চঞ্চলতার সৃষ্টি করে। দেখতে না দেখতেই সেইস্থলে এসে উপস্থিত হন রাজ দেহরক্ষীদের দ্বারা অভিজাত পরিচ্ছদে সজ্জিত এক ব্যক্তি। যে কেউ দেখলেই বলে দেবে এই ব্যক্তি সাধারণ কেউ নন, হাঁটাচলায় দৃঢ়তা এবং চোখেমুখে প্রাজ্ঞাতা এক অদ্ভুত দীপ্তির বলয় রচনা করেছে।
                                                                   --------------------------

          ঝইংঝো, সং পর্বর্তশ্রেণীর কোলে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম।নদী, জলপ্রপাত, বনভূমি দ্বারা সুশোভিত গ্রামটি প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ।হলুদ নদীর দক্ষিন তীর বরাবর অবস্থিত সমুদ্রতল থেকে দেরহাজার মিটার উঁচু সং পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জুনজি। নদী অববাহিকায় অবস্থিত ঝইংঝো-তেও আজ  ছুটির দিন; নববর্ষের পর চীনা সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মধ্য শরতের পূর্ণিমা উৎসব। অনবরত যুদ্ধের ভ্রুকুটি, মৃত্যু,দারিদ্রতা, দুঃখ,কষ্টের হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাধারণ প্রজাদের মুক্তি দেয় এই পূর্ণিমা উৎসব।

                         শরতের আকাশের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে থাকা ওয়েই-কে  যে কেউ লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে তার অন্তর্দৃষ্টি এখন অন্য কোথাও। পূর্ব হান রাজবংশের শাসনাধীনে ফাংশিহি*৬-দের মধ্যে অন্যতম ওয়েই বোয়াং। ---- ’তার মত জ্যোতিষী, জাদুকর আর কেউ সমগ্র চীন দেশে আছে কিনা সন্দেহ!'- নিজের মনেই প্রশ্ন করে লিং মা, ওয়েই বোয়াং-এর প্রধান সহায়ক। সে বেশ বুঝতে পারছে আজ ঝাংওয়াও-র*৭ মনটা ভালো নেই। আর কেউ জানুক, না জানুক লিং মা-তো জানে তার প্রভুর মনটা কত উদার। ঐ ছেলেটার মৃত্যু যদিও লিং মা-র কাছে কোনো বড় ব্যাপার নয়। এদের জন্মই তো মৃত্যুর জন্য। এই হাঘরে-হাভাতেদের মরণ নিয়ে অত মাথাঘামানোর কি যে আছে কে জানে!

             আসলে মাস্টার সেই যে দেলুনদের কুঁড়ে থেকে ফিরে জমিদারের বাড়িতে এসে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন তারপর থেকে না পোশাক পরিবর্তন করেছেন, না খেয়েছেন, না কোনো কথা বলেছেন কারোর সাথে। লিং মা জানে এইসব মুহূর্তে কিছুতেই মাস্টারকে বিরক্ত করা যাবে না। বেচারার খুব ইচ্ছা ছিল আজ রাতে উৎসবে যোগ দিয়ে মনের সুখে পোটাজহ*৮ পান করে একটু সুন্দরীদের নিয়ে আসঙ্গসুখ লাভ করবে,ওমা কোথায় কি! এখন শুধু শুকন মুখে প্রভুকে পাহারা দাও। উৎসব বলে তো আর কর্তব্যে অবহেলা করতে পারে না।

                     সেইমুহূর্তে ওয়েই বোয়াং তাকিয়ে ছিলেন বটে  পূর্ণ শশীর দিকে কিন্তু তার চোখের সামনে ছিল দেলুনের মৃত মুখটি। সারাটা শরীর ফ্যাকাশে, খসখসে মোটা ত্বক,  তাতে লাল লাল দাগ, পা-হাতের ত্বক শক্ত-কালো হয়ে ফেটে গেছে! কেন? শুধু দেলুন নয়,ওর ভাই লিয়ান এবং গ্রামের অনেকের শরীরেই এমন লক্ষণ দেখা গেছে! গ্রামের গবাদি পশুদের গর্ভপাত ঘটছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে;কেন?

             এদিকে সম্রাট এক অদ্ভুত খেয়ালে মগ্ন। অমৃতের সন্ধানে বদ্ধপরিকর।উত্তরোত্তর ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন অমৃতের সন্ধানের জন্য। একজন বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক রূপে তিনি এই সত্য সম্পর্কে অবগত, দেহ মাত্রই নশ্বর। জন্মিলে মরিতে হবেই। তবে ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ শাসককে, কে বোঝাবে এই কথা! সম্রাটের স্থির বিশ্বাস হাউ ই-কে অমরত্ব লাভের জন্য দেবতারা যে ঔষধি দিয়েছিলেন  তা আবার তৈরি করা সম্ভব।

        ওয়েই মাথা দুই পাশে নেতিবাচকভাবে নাড়ান। নিজের মনেই প্রশ্ন করেন,

----একেই কি বলে সমাপতন! না হলে আজই উৎসবের দিনে তিনি কেন ঝইংঝো-তে! হ্যাঁ একথা ঠিক বিগত কয়েকবছর যাবৎ এইঅঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে অজানা রোগে মানুষ ও পশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছিল। ওয়েই জানেন এই অঞ্চলের খনিজসম্পদের প্রাচুর্যের কথা। কোথায় তার মনে হয়েছিল প্ৰকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মৃত্যুর বীজ। তাই সম্রাটের ক্রমবর্ধমান তাগাদার হাত থেকে কিছুদিন মুক্তির উদ্দেশ্যেই এখানে এসে হাজির হন। কিন্তু এসেই সন্তানহারা মাতৃহৃদয়ের হাহাকার তাকে অশান্ত করে তুলেছে। এর পূর্বে যে মৃত্যু দেখেননি তা তো নয়! তাহলে আজ হৃদয় এমন ব্যাকুল কেন!এটা কিসের ইঙ্গিত?

               যে চীনা উপকথা অনুযায়ী লোক বিশ্বাস করে এই বিশেষ দিনে পূর্ণ গোলাকৃতির মুনকেক বা ইয়ানজিয়াও রান্না করে চুলায় রেখে দিলে হাউ ই পত্নী চ্যাং তা গ্রহণ করে সেই পরিবারকে দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ প্রদান করেন, প্রিয়জনের বিচ্ছেদের আঘাত থেকে রক্ষা করেন।

               যদি উপকথাই সত্যি হয় তাহলে সেই উৎসবের দিনেই কেন দেলুন-এর মত সহজ সরল পল্লী বালক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে? কেন চ্যাং-এর অভিশাপ নেমে আসবে এই দরিদ্র পরিবার গুলোর উপর? ওয়েই নিজের মনেই হেসে ওঠেন,বলেন,

----মৃত্যুর থেকে বড় সত্য আর কিছু নেই। অমরত্ব অভিশাপ। তাই তো পরম প্রেমিক স্বামী হাউ ই কে ছেড়ে চ্যাং নিজেই অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন। যিনি নিজে অভিশপ্ত তিনি অন্য কাউকে আশীর্বাদ দেবেন কি করে!  তবে দেলুনের মত  কিশোরদের অকালে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। আমাকে এর কারণ খুঁজে বের করতেই হবে।

           ওয়েই-এর চিন্তার জাল ছিন্ন হয় জু কংশি এবং চুনিউ শুটং-এর আগমনে। এরা দুজনেই বয়সে অনুজ হলেও জ্ঞানী এবং বন্ধু স্থানীয়। নিজের মনের কথা সম্পূর্ণভাবে এদের কাছেই উন্মোচন করতে পারেন।

---ঝাংওয়াও.........

           জু-এর ডাকে পিছনে ফিরে তাকান ওয়েই। তার দৃষ্টি ঘোলাটে। পথের ক্লান্তি তো আছেই তার উপরে গ্রাস করেছে এই অজানা মৃত্যুপ্রকোপের বিষাদ।

---মাস্টার অপরাধ নেবেন না, এবার একটু বিশ্রাম নিন;কিছু মুখে দিন।

               চুনিউ-র কথায় ওয়েই অন্যমনস্কভাবে একটু হাসেন। ততক্ষণে আকাশ সেজে উঠেছে কংমিং লন্ঠনের আলোয়।সেইদিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওয়েই-এর দৃষ্টি। তাইত, সামরিক কৌশলবিদ, যুদ্ধবিশারদ ঝুঝ লিয়াং, যাকে ঋষি তুল্য প্রজ্ঞার জন্য কংমিং বলে অভিহিত করা হত, তিনি যখন এই ফিনিন বা চীনা লণ্ঠন আবিষ্কার করেন তখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পরিবেষ্টিত বিরোধী শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার লাভ করা। তিনি নিজের পরিধানকৃত টুপির অনুকরণে এই লণ্ঠন তৈরী করে তার গায়ে বার্তা লিখে নিজের সৈন্য শিবিরের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। তখন কি তিনি জানতেন, এই  লণ্ঠন উৎসবে-অনুষ্ঠানে চীনের আকাশকে আলোকিত করে তুলবে! ওয়েই নিজের মনের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে ফেলেছেন। তার লক্ষ অমরত্বের খোঁজ নয়, হবে মৃত্যুর খোঁজ। তিনি ভারমুক্ত ভাবে বললেন,

----কাল প্রত্যুষেই আমরা ঝইংঝো থেকে পিত নদীর অববাহিকা ধরে সং পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। যে গুহার কথা দেলুনের ভাই লিয়ান বলল আমরা সেখানেই যাব। সঙ্গে বেশি লোকজন নেবার দরকার নেই, শুধু দেখো কয়েকটা কুকুর যাতে সঙ্গে থাকে।
                                                          ----------------------------------
আজ উত্তরে হাওয়াটা বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে এবার এখান থেকে বাস তুলতে হবে। গতকাল রাতেই খানিকটা তুষারপাত হয়েছে। এতখানি বেলা হলেও সূর্যের দেখা নেই। বাতাসের শব্দ আর সারা রাতের পাতায় জমা বরফ গলা এক ফোঁটা, এক ফোঁটা করে জল পড়ার অতি মৃদু টুপ টাপ শব্দ অদ্ভুত এক আছন্নতার জাল বুনে চলেছে। অস্থিরভাবে গুহার বাইরে পায়চারী করছিলেন ওয়েই। প্রায় চারমাস হতে চলল এই পার্বত্য প্রাকৃতিক গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এসেছিলেন তা তো পেয়েছেনই, আরও অতিরিক্ত কিছু পেয়েছেন। সমস্যা সেটাকে নিয়েই। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না আদৌ এর কোনো প্রয়োজনীয়তা মানব জীবনে আছে কিনা!

              এই সময় 'ভৌ ভৌ'-ডাকে তাকিয়ে দেখেন তাদের সঙ্গে আনা পাঁচটা কুকুরের মধ্যে অবশিষ্টটি জুল জুলে চোখে তারই দিকে তাকিয়ে ডাকছে। কুকুরটিকে দেখে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা পাপবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। অবলা প্রাণীটি কি অবলীলায় এখনও তারই জাত ভাইদের হত্যাকারীকে বিশ্বাস করে চলেছে। কুকুরটি এগিয়ে এসে ওয়েই-এর পায়ের কাছে মাথা ঘষতে থাকে। নিজের অজান্তেই দুফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ে মাটিতে। ওয়েই কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। মনে মনে বলেন,

---বিজ্ঞানের সাধনায় তোদের প্রাণের অবদান আমরা কোনোদিন অস্বীকার করতে পারব না, তবে এই কথাও ঠিক প্রকাশ্যে স্বীকার করেও নেব না।
               অবলা  সারমেয়টি কি বোঝে সেই জানে, আদুরে একটা কুঁই কুঁই শব্দ করে ওয়েই-এর গায়ের কাছে ঘেঁষে আসে, তিনি একটু ঝুঁকে কুকুরটির মাথায় হাত দিয়ে কানের কাছে মুখটি এনে বলেন,

---ভয় নেই, তোকে আর প্রাণ দিতে হবে না।

               ওয়েই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দূরের পর্বতশৃঙ্গের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেন,ফিরে যান প্রায় চারমাস আগে।

              সং পর্বতে ঢালে অবস্থিত পশুচারণ ভূমি থেকে কিছুটা উপরে এই প্রাকৃতিক গুহা।আশেপাশের গ্রামের রাখাল বালকরা এখানেই পশুদের নিয়ে আসত।দেলুনের ভাই লিয়ানের কথা অনুযায়ী পাঁচজন সহায়ক, একজন পাঁচক, পাঁচটি কুকুর এবং তারা তিনজন এখানে এসে উপস্থিত হন।

             সেইদিন লিয়ান-এর কাছে ওয়েই জানতে চেয়েছিলেন,

------তোমরা কি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের চারণভূমিতে যাও?

                 কারণ ওয়েই-এর বৈজ্ঞানিক সত্তা বলছিল এর জন্য দায়ী রিয়েলগার।

            একটুও সময় নষ্ট না করে লিয়ান  জানিয়েছিল, ----আমরা যে কয়জন গবাদিপশুদের নিয়ে ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলে গেছিলাম তাদেরিই হাতে-পায়ে-গায়ে এমনসব দাগ দেখা দিয়েছে। আমার দাদার মতোই এর আগে একই উপসর্গ নিয়ে অনেকেই মারা যায়। বমি, পেটে ব্যাথা, জ্বর বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকমের সমস্যা। এই দেখুন না আমার হাতের পাতা, পায়ের পাতা কেমন কালো হয়ে ফেটে যাচ্ছে।

               এতটা শুনেই ওয়েই নিশ্চিত হয়েছিলেন এটা কোনোকিছুর বিষক্রিয়ার ফল। যা খুব ধীরে ধীরে এদের শরীরে জাল বিস্তার করছে। যাদের শরীর নিজস্ব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে তারা বেঁচে যাচ্ছে আর যারা পারছে না........

         একটা দীর্ঘশ্বাস  অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল ওয়েই-এর। প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন, লিয়ান-রা ওই অঞ্চল থেকে কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করেছে কিনা?

          লিয়ান নিজের মাথার রুক্ষ চুলগুলো টানতে টানতে বলেছিল, -----শিয়েনসাং*৯, ঐ সময় তো প্রচুর ড্রাগন ফল হয়। আমরা সবাই 'হং-মাও-ডন' আর 'হ-লং-গ'-র গাছ থেকে পেরে পেরে  খেয়েছি!

          ওয়েই নিজের অভিজ্ঞতার দ্বারা অবগত যে টক স্বাদের, গায়ে লম্বা লম্বা রোঁয়া, লাল বা সবুজ রঙের রাম্বুতান বা 'হং-মাও-ডন' এবং লাল রঙের বীজ যুক্ত মসৃণ ত্বকের নাশপাতি র মত 'হ-লং-গ'-র, যেটা পরিপক্ক হলে কলার মত করেই খেতে হয় এদের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না! তাহলে?

                   সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেন এখানে আসার পর। এই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। জু কংশি এবং চুনিউ-কে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েই তিনি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই  বুঝতে পেরেছিলেন, মাত্রাতিরিক্ত স্ফটিকাকৃতি রিয়েলগারের উপস্থিতি এই অঞ্চলটির মাটি আর জলকে বিষাক্ত করে তুলেছে। নিজের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা তিনি জানেন পৃথিবীর ভূত্বকের গঠনগত উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান হল আর্সেনিক। প্রকৃতিতে আর্সেনিক কে মুক্ত মৌল হিসাবে পাওয়া যায় না। আর্সেনিক প্রধানত অক্সিজেন, ক্লোরিন ও সালফার প্রভৃতির সাথে সংযুক্ত হয়ে অক্সাইড, সালফাইড, হাইড্রেড ও আর্সেনেট অজৈব যৌগ রূপে অবস্থান করে। তবে মূলত তিনটি খনিজের মধ্যে আর্সেনিক সবচেয়ে বেশি পরিমানে থাকে, এগুলি হল - রিয়েলগার, সালফাইড ও আয়রন। যে সব শিলায় লৌহের পরিমান বেশি থাকে সেখানে আর্সেনিকের উপস্থিতি বেশি হয়। এই পার্বত্য অঞ্চল আগ্নেও শিলা দ্বারা গঠিত হওয়ায় এখানে আকরিক লৌহের ভাগ বেশি।এই শিলা মধ্যস্থ আর্সেনিক 'হানসুইসেং*১০' বা ভূগর্ভস্থ শিলা স্তরের সাথে যুক্ত হয়ে ভৌমজলকে দূষিত করে তুলছে। বিষক্রিয়ার ক্ষমতা এতো বেশি যে বহুযুগ পূর্ব থেকেই বিষাক্ত রিয়েলগার বা 'রুবি সালফার'বা 'আর্সেনিক',আগাছা, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর, সাপ মারতে, পশুর চামড়া ছাড়াতে ব্যবহার করা হয়। তবে কি এই আর্সেনিকই ধীরে ধীরে এদের মৃত্যু ঘটাচ্ছে!

                 এই ধারণা কতটা সত্যি তা প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। তাই একের পর এক এই চারমাস যাবৎ বিভিন্ন মাত্রায় খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে রিয়েলগার প্রয়োগ করা হয়েছিল চারটি কুকুরের উপর। মাত্রার তারতম্যের ভেদে সারমেয় গুলির কোনটা দ্রুত প্রাণ ত্যাগ করেছে, আবার কোনটা প্রাণান্তকর যন্ত্রণাভোগ করে চোখ বুঝেছে। তবে নিজেদের জীবন দিয়ে ওরা এই আর্সেনিক দূষণের লক্ষণ মানব শরীরে কেমন হতে পারে তা জানিয়ে গেছে। ওয়েই রাজঘোষকদের দ্বারা সং পর্বতের কোলে অবস্থিত গ্রামগুলিকে সচেতন করে দিয়েছেন- যাতে তারা নির্দিষ্ট এই অঞ্চলের ফল এবং জল গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। যদিও ওয়েই এটাও জানেন আর্সেনিক দূষণ এইভাবে নিবারণ করা সম্ভব নয়। তারজন্য চাই পরিশ্রুত বিশুদ্ধ জল সরবরাহের উপযুক্ত ব্যবস্থা।

           রিয়েলগার নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে ছিলেন সেই খোঁজে তিনি সাফল্য লাভ করেছেন। কিন্তু সেই খোঁজ করতে গিয়ে কি তিনি শয়তান-কে জাগিয়ে তুললেন? সম্রাট নির্দেশ দিয়েছিলেন অমৃতের সন্ধানের, আর তিনি কি স্বয়ং মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানালেন? অস্থিরভাবে পদচারণা করছিলেন ওয়েই। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশার পর্দা ভারী হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাওয়ার গতি পাল্লা দিয়ে  বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর দু-তিন দিনের মধ্যেই এই স্থান থেকে শিবির তুলতে হবে।

--কিন্তু.....

         কিন্তু ভেবেই নিজেকে শক্ত করেন, বোঝান তিনি নিমিত্ত মাত্র। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অজানা বিপুল কর্মকান্ডে কতটুকুই বা সন্ধান পেয়েছে মানব, এই অসীম রহস্যের!তিনি সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বশতঃ প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই শক্তিকেই জাগিয়ে তুলেছেন মাত্র। বৈজ্ঞানিক হিসাবে এটাই তার কর্তব্য। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষ তাদের কর্মের দ্বারা ঠিক করবে তার এই আবিষ্কার আশীর্বাদ না  অভিশাপ। ধীরে ধীরে পা বাড়ান গুহার দিকে।

             গুহায় প্রবেশ করে দেখেন জু কংশি এবং চুনিউ উঠে বসেছে,এখন অনেকটাই সুস্থ। শরীর, মুখের বিভিন্ন স্থান পুড়ে গেলেও প্রাণের ঝুঁকি আর নেই। আজ থেকে কুড়িদিন আগে হঠাৎই ওয়েই কি মনে হওয়াতে রিয়েলগর-কে তিনশ কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে গলিয়ে সালফারের সঙ্গে মিশিয়ে একটা পরীক্ষা করেন। রিয়েলগার গলে সালফারের সঙ্গে মিশতেই নীলাভ শিখায় তীব্র আলো জ্বলে উঠে ধোঁয়া নির্গত করতে শুরু করে। এমন একটা অদ্ভুত ফল তিনি আশা করেননি। বেশ উপভোগ করলেন এই পরীক্ষা।এরপর কখনো উইলো, কখনো পাইন গাছের কাঠকয়লার সাথে সালফার, পটাসিয়াম নাইট্রেট  অল্প অল্প পরিমাণে মিশিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন। সব পরিমাণ ঠিকঠাক হলে আগুন চিড়িক চিড়িক করে ছড়িয়ে জ্বলে উঠত। ঠিক যেন অজস্র তারা এদিক ওদিক জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে। আর্সেনিক নিয়ে দীর্ঘদিন পরীক্ষায় যে স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল এই গবেষণায় সেটা কেটে যায়।

               জু কংশি এবং চুনিউ- র উৎসাহে ওয়েই উপাদানের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি করতে থাকেন। সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখছিলেন। কিন্তু আজ থেকে সাত দিন আগে সেই মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি করে দিয়েছিলেন যে গুহার ভিতরেই একটা ছোটো খাটো বিস্ফোরণ ঘটে যায়। জু কংশি এবং চুনিউ মারাত্মকভাবে আহত হন, অল্পের জন্য তিনিও রক্ষা পান। তিনজনেই এই মারাত্মক বিস্ফোরণের কবল থেকে প্রাণ বেঁচে যান। ওয়েই বুঝতে পারেন তিনি নিজের অজান্তেই হয়ত শয়তানকে জাগিয়ে তুললেন।

(*১ইয়ানজিয়াও বা Yuanxiao, যাকে আবার টাংইউয়ানও বলা হয়। এটি 'চাইনিজ মুন ফেস্টিভেল'-র একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। ইয়ানজিয়াও তৈরি করা হয় আঠালো চালের আটা দিয়ে যাতে বিভিন্ন ধরণের পুর দেওয়া হয়। অঞ্চলভেদে এবং ধনী-দরিদ্র  শ্রেণীভেদে তেল, চিনি, তিল, মিষ্টি শিমের মন্ড, গোলাপের পাঁপড়ি, পদ্মবীজ,ডিমের কুসুম, মাংসের মন্ডের পুর দেওয়া হয়। এটি একরকমের ডাম্পলিং, আকারে গোল,একে 'মুনকেক'ও বলে। উৎসবের সময় এটি খাদ্যতালিকায় থাকার অর্থ হলো, পরিবারের পুনর্মিলন,সুখ, সমৃদ্ধি এবং সম্প্রীতির প্রতীক।

*২ মা/মচিন -Mǔqīn

*৩ বড়ভাই /গ গ-Gēgē

*৪ মেজ দাদা/অর্গে-Èr gē

*৫  জিয়াংমু /Xiwangmu চীনা ধর্মবিশ্বাসে সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী দেবী। জীবন, মৃত্যু, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

* ফাংশিহি/Fang shi -চীনা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। যাদেরকে আ্যলকেমিস্ট, জ্যোতিষী, ভূ-বিদ, চিকিৎসক,জাদুকর, সন্ন্যাসী, এবং আরো নানান নামে অভিহিত করা হত।

*৭ প্রভু/ঝাংওয়াও-Zhǎngwò

*৮ মদ/ পোটাজহ-Pútáojiǔ

*9 মহামান্য  / শিয়েনসাং-Xiānshēng

*10 আ্যকুইফার হল ভূগর্ভস্থ সেই শিলাস্তর যেখানা ভৌম জল সঞ্চিত থাকে / aquifer - Hánshuǐ céng

                                                                  ---------------------
আমার কথা:

বিশ্বসভ্যতায় চীনদেশের অবদান অসংখ্য। তার মধ্যে কাগজ, মুদ্রণ বা ছাপা, দিকনির্দেশ যন্ত্র বা কম্পাস এবং গানপাউডারের উদ্ভাবন মানবসভ্যতাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। এই অমূল্য আবিষ্কারগুলির মধ্যে আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে বারুদের আবিষ্কারের কাহিনী।
                         হিমালয় পর্বতমালার সীমান্ত ধরে ছুটে চলা পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত চীনকে ঘিরে আছে গোবি ও তাকলামাকান নামক ভয়ঙ্কর দুটো মরুভূমি এবং বিপদসংকুল পামির গ্রন্থি। চীনের দক্ষিণে হলুদ সাগর এবং পূর্বে চীন সাগর, যা প্রকৃত পক্ষে প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ। প্রকৃতিমাতা যেন সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই সযত্নে চীন-কে রাখতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর তাই তো বহুকাল যাবৎ চীনের অধিবাসীদের সঙ্গে অবশিষ্ট পৃথিবীর কোনো যোগাযোগ ছিলনা।

               দৈবানুগ্রহে বিশ্বাসী স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল চীনে।এগারো হাজার বছর পূর্বের চীন পর্যায়ক্রমে শাসিত হয়েছিল জিয়া, স্যাং, চৌ বা ঝৌ, কিন, হান, সং ,গান এবং সর্বশেষ কিং রাজবংশের দ্বারা। প্রাচীনকাল থেকেই চীন একটি যুদ্ধ রত দেশ। বিভিন্ন সময়ে প্রাদেশিক শাসকরা কেন্দ্রীয় শক্তিকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছে। এই পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সবসময় শাসকরা সামরিক গবেষণায় উৎসাহ প্রদান করে গেছেন।

          ১৪৭-১৬৭খ্রিস্টাব্দে ওয়েই বোয়াং বারুদের আবিষ্কার করলেও প্রথম ঐতিহাসিকভাবে এর উল্লেখ পাওয়া যায় ৩০০ খ্রিস্টাব্দে জে হুং নামক এক চীনা বিজ্ঞানীর রচনায়।তিনি বিধ্বংসী বারুদের প্রস্তুত প্রণালী লিপিবদ্ধ করেন। জানা যায় সালফার, সল্টপিটার, কয়লার মিশ্রণে সেটি তৈরি করেছিলেন। প্রাণিজ সার থেকে বিশেষ উপায়ে চীনারা সল্টপিটার তৈরি করতো তখন। বারুদে আগুন লাগলে তা দ্রুত পুড়তে থাকত। এটা থেকে নির্গত গ্যাস বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঢেকে ফেলত এবং এর ফলে বড় রকমের বিস্ফোরণ ঘটে যেত।

           শুরুর দিকে এই বারুদ ব্যবহার করে চীনারা আকাশে বাজির উৎসবে মেতে উঠত। এর মাধ্যমে তারা অশুভ আত্মা দূর করতে সচেষ্ট হত। পরে অবশ্য পরীক্ষামূলক ভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে  শত্রু শিবিরকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে তীরের মাধ্যমে বারুদ পূর্ণ বস্ত্র নিক্ষেপ করা হতো।

              ৭০০ খ্রিস্টাব্দে তাং সাম্রাজ্যের বিজ্ঞানীরা সঠিক অনুপাতে উপাদান মিশিয়ে বারুদ তৈরি করা শুরু করেন। তখনও সম্রাটের নির্দেশে বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে বাজি পোড়ানোর উদ্দেশ্যেই বারুদ ব্যবহার করা হতো। বারুদ ব্যবহার করে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব, এই ধারণা আসতে চীনের লেগে যায় আরো দু’শত বছর। ৯০৪ খ্রিস্টাব্দে গংশু বান বা লু বান নির্মিত  কাঠের উড়ন্ত পাখির( ঘুড়ি)সাহায্যে বারুদ ভরে তাতে আগুন লাগিয়ে অতর্কিতে অতিদ্রুত বেগে সেটা শত্রুর দিকে নিক্ষেপ করত চীনা সামরিক বাহিনী। এছাড়া বাঁশের ফাঁকা অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বারুদের গোলা প্রবেশ করিয়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকার কামানও আবিষ্কার করেছিলো তারা।

                     চীনারা বারুদের সাহায্যে একের পর এক যুদ্ধ জয় করতে থাকে। চীনা সম্রাটরা আন্তরিকভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যেন বারুদের রহস্য  বিশ্বের কাছে উন্মোচিত না হয়। কিন্তু ১১০০ সালের শেষদিকে বারুদ চীনের ভূখণ্ড পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল মঙ্গোলদের হাত ধরে।

                 চীনারা মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বারুদ ব্যবহার করেছিলো। এই বিধ্বংসী অস্ত্র  মঙ্গোলদের কৌতূহলী করে তোলে এবং অচিরেই  তারা বারুদ রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়। মূলত মঙ্গোলদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিই পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল  বলে ধারণা করা হয়। চীনাদের বারুদ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত রেশম পথ দিয়ে ভারতবর্ষ এবং মধ্যপ্রাচ্য পাড়ি দিয়ে ইউরোপের ভূখণ্ডে  গিয়ে পদার্পণ করেছিল।

         এইভাবে অমরত্ব লাভের উদ্দেশ্যে সম্রাটের খেয়ালে একদা ওয়েই বোয়াং যে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন তা একদিন পৃথিবীর যুদ্ধের সংজ্ঞাটাই বদলে দিল। দেশে দেশে সামরিক যুদ্ধ কৌশলে  আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে, যা এখন পর্যন্ত চলমান।

*ওয়েই বোয়াং ঐতিহাসিক চরিত্র। তার  সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় নি। যে টুকু  তথ্য পাওয়া যায় শেনজিয়ান ঝুয়ানএর 'বায়োগ্রাফিজ অফ দ্য ডিভাইন ইমর্টালস'-এ। ওয়েই বোয়াং ছিলেন ১৪৬-১৬৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব হান বংশের শাসনকালের একজন বিখ্যাত আ্যলকেমিস্ট, ভূতত্ববিদ, চিকিৎসক। তার প্রধান দুই শিষ্য ছিলেন,জু কংশি এবং চুনিউ শুটং। মূলত চুনিউ শুটুং-এর উদ্যোগে ওয়েই বোয়াং-এর গবেষণা মূলক মূল্যবান কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করা হয়। বারুদের অবিষ্কর্তা ওয়েই বোয়াং-কেই মনে করা হয়। তাদের তিন জনের রচিত গ্রন্থটির নাম ' ক্যানটং কিউ' বা 'দ্য কিংশিপ অফ দ্য থ্রি'। গ্রন্থটির তিনটি অংশ রয়েছে, ঐতিহাসিক গবেষকগণ অনুমান করেন ওয়েই, জু এবং চুনিউ প্রত্যেকেই একটি করে অংশ লিখেছেন।

         ওয়েই গোপনে তার লিখিত  পুস্তকটি কিংঝো-এর বাসিন্দা জু কংশি-র কাছে প্রেরণ করেছিলেন, যিনি তার নাম গোপন রেখে এটির উপর মন্তব্য লিখে রাখেন। পরবর্তী হানসম্রাট হুয়ানের সময় এটি আবার গোপনে  চুনিউ শুটং-এর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। তারপরেই  'ক্যানটং কি' (Cantong qi )বিশ্বের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

**বারুদের প্রধান উপাদান সল্টপিটার বা শোরার রাসায়নিক নাম পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3)। দেখতে সাদা হওয়ার কারণে আরবরা একে বলত 'চীনের তুষার'।

***নাইট্রেট নাম শুনেই বুঝতে পারা যায় এখানে নাইট্রোজেনের একটি ভুমিকা রয়েছে। পটাশিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে কাঠ-কয়লা আর গন্ধক মেশালে তৈরি হয়ে যাবে বারুদ।

**** চীনা উপকথা অনুযায়ী বীর হাউ ই ,সূর্য ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য পুরস্কার স্বরূপ দেবতাদের কাছ থেকে অমরত্বের বর লাভ করেন, লাভ করেন একটি বিশেষ ঔষধি।কিন্তু যেহেতু সেই ঔষধ একজনের মতোই ছিল তাই প্রিয়তমা পত্নী চ্যাং-কে ব্যাতিত  তিনি তা সেবন না করে ঘরেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। একদিন তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছাত্র ফেং মেং বাড়িতে এসে চ্যাং-কে আক্রমণ করে ঔষুধটি হস্তগত করতে উদ্যত হয়। চ্যাং জানতেন লড়াই করে ফেং মেং-কে পরাজিত করতে পারবেন না। এদিকে তার মত শয়তান অমরত্ব লাভ করলে পৃথিবীর সমূহ বিপদ। তাই উপায় না পেয়ে তিনি নিজেই সেই ওষুধ পান করেন এবং পৃথিবীতে বসবাসের অধিকার হারিয়ে চাঁদে আশ্রয় নেন। সভ্যতাকে রক্ষা করতে গিয়ে অমরত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে হাউ ই-র প্রিয়তমা চ্যাং আজও চাঁদ থেকে তার স্বামী-র বাসভূমিকে দেখে চলেছেন এবং বছরে মধ্য শরতের পূর্ণ পূর্ণিমায় পৃথিবীতে একবারের জন্য ফিরে আসতে পারেন। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী এই বিশেষ দিনে পূর্ণ গোলাকৃতির মুনকেক বা ইয়ানজিয়াও রান্না করে চুলায় রেখে দিলে চ্যাং তা গ্রহণ করে সেই পরিবারকে দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ প্রদান করেন, প্রিয়জনের বিচ্ছেদের আঘাত থেকে রক্ষা করেন।।

                                                  

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb