সময়ের তালা

লেখক - রাজকুমার রায়চৌধুরী

                                                 
                                                                              ১      

ঘনশ্যাম পাঠক কে যাঁরা  অল্পই চেনেন তাঁদের অনেকেই বলবেন লোকটা খ্যাপাটে এবং শয়তান। আবার কারুর কারুর মতে উনি অনেক মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত। তবে প্রায় প্রত্যেকে স্বীকার করবে যে লোকটা প্রতিভাবান  কিন্তু মদোমাতাল ৷  তবে ঘনশ্যামকে একজনই খুব ভাল করে চেনেন। তিনি হলেন নামকরা ক্রিমিনাল  কনসালট্যান্ট নন্দদুলাল তরফদার ৷ নন্দদুলাল উকিল হলেও নিজেকে ক্রিমিনাল কনসালট্যান্ট বলেন তার কারণ কোর্টে অপরাধীদের হয়ে সওয়াল করা ছাড়াও অনেক নামকরা ক্রিমিনালদের উপদেস্টা হিসেবে পরিচিত ৷  ইংরাজীতে যাকে  স্ক্রুপল বলে বা নৈতিকতা বোধ এসব  ব্যাপারে তরফদারের  কোন দিনই কোন মাথা ব্যথা ছিল না ৷ কোলকাতা এবং মুম্বাই এর  সি আই ডি বিভাগের সন্দেহ যে তিনি ক্রিমিনালদের অস্ত্র সরবরাহ করেন ৷অবশ্য একাধিক বার তরফদারের বাড়ি এবং  বউবাজারে ওনার অফিস তল্লাশী করে সন্দেহজনক এমন কিছু পাওয়া যায়নি যাতে ওনাকে গ্রেফতার করা যেতে পারে ৷পুলিশের সন্দেহের একটা বড়  কারণ হল তরফদার অনেক খুনের মামলায় অভিযুক্ত অনেক আসামী কে ছাড়িয়েছেন এইযুক্তি দেখিয়ে যে   মৃত ব্যক্তির  মৃত্যুর কারণ বা মৃত্যুর অস্ত্র  কি ছিল পুলিশ আদালতে প্রমাণ করতে পারে নি ৷

পুলিশের সন্দেহ ঘনশ্যাম বাবুর উপরেও ৷কিন্তু ঘনশ্যামের ল্যাবরেটরি থেকে পুলিশ সন্দেহ জনক কিছু খুঁজে পায়নি৷ পুলিশের কাছে  ঘনশ্যাম একটা পাগলা বিজ্ঞানী মাত্র ৷ তরফদার ওনার বাড়িতে মাঝে মাঝে যান শুধু এই কারণে কাউকে থানায় ডেকে আনা যায় না ৷ তা ছাড়া তরফদার একটা দুঁদে উকিল। ক্রিমিনাল আইন একেবারে গুলে খেয়েছেন ৷ ওনার অফিসে পাচঁ জন সহকারী উকিল আছেন যাঁরা দেশের সেরা আইন কলেজ ও ইউনিভার্সিটি থেকে পাস  করে  এসেছেন ৷ এ ছাড়া লোক'টার নানা  বিষয়ে গভীর জ্ঞান আছে ৷ একবার গোমেস নামে একজন খ্রীস্টান কে  খুনের সন্দেহে ধরা হয়েছিল ৷ আদালতে অর্থোডক্স চার্চের উপর তরফদারের জ্ঞান দেখে জজসাহেবও হতভম্ব হয়ে যান ৷

                                                                              ২

২০৩১ এর জুলাই মাসের শেষ শনিবার ৷ তরফদার বিকেল বেলায় ঘনশ্যাম বাবুর বাড়িতে গেছেন ৷ ঘনশ্যাম বাবুরই একটি আবিষ্কার নিউরো গান টা ফেরত দিতে ৷ এটি আসলে একটি অতি উন্নত ধরনের লেসার গান ৷ বাজারে এখন পয়সা দিলে লেসার গান ব্ল্যাক মার্কেটে পাওয়া যায় ৷

পুলিস এবং ক্রিমিনালরাই এখন এই গানের ব্যবহার করে ৷ কিন্তু যে সমস্ত প্রোটো টাইপ বাজারে আছে সে গুলির ওজন ও সাইজ এত বেশী যে  কোট বা ওভারকোটের পকেটে লুকোনো যায়না ৷ঘনশ্যামের আবিষ্কৃত নিউরো গান চেক গ্লক পিস্তলের মত ৷ কোটের পকেটে অনায়াসে ঢুকে যায় ৷ আর এটা একটা ট্র্যান্সফরমারের কাজ করে ৷ অর্থাৎ নিমেষের মধ্যে  এটাকে একটা খেলনা রোবটে  পরিণত করা যায় ৷ এই অস্ত্রটি তরফদার মাঝে মাঝে  ধার করেন ৷ শহরের নাম করা মাফিয়া লিডাররা আবার তরফদার বাবুর কাছ থেকে মোটা টাকায় এটা ধার নেন ৷ কনসালট্যান্ট হিসেবে এর ব্যবহার করার পদ্ধতিও তরফদার  শিখিয়ে দেন ৷ এই অস্ত্রটি  দিয়ে কখন কাকে হত্যা করা হবে  তরফদার জানেন না বা জানতে চান না ৷

মোডাস অপারেন্ডি  হল অস্ত্রটা তরফদারের অফিসের লোক হাওড়া  বা শেয়ালদা স্টেশনের বা  স্প্ল্যানেডের কোন লকারে রেখে আসে ৷ এখন প্রায় সমস্ত বড় স্টেশনে  ও এয়ার পোর্টের কাছে  অনেক লকার  থাকে ৷ ঘন্টা বেসিসে ভাড়া নেওয়া যায় ৷ নির্দিষ্ট লকার থেকে ক্রিমিনালের লোক এসে গানটা নিয়ে যায় ৷ কাজ হয়ে গেলে আর একটা লকারে ওটা রেখে যায় ৷ সকালে   যখন   স্টেশনে প্রচুর ভীড় থাকে তখন তরফদারের লোক দ্বিতীয় লকার থেকে অস্ত্রটি নিয়ে ক্যুরিয়র সার্ভিসে তরফদারের বাড়িতে পাঠায় ৷ পরে সুযোগ মত তরফদার ঘনশ্যামের ল্যাবে অস্ত্রটি ফেরত আনেন ৷ এর পরে অস্ত্রটি ঘনশ্যাম কোথায় লুকিয়ে রাখেন তরফদার নিজেও তা জানেন না বা জানার চেস্টাও করেন না ৷ এসব ব্যাপারে অজ্ঞ থাকাই শ্রেয় ৷  তরফদারের  ছোট খাট চেহারা ৷ হাইট মেরে কেটে পাঁচ ফুট দু ইন্চি হবে৷ তবে পোষাক আশাক   খুব দামি। চোখে আরমানি ফ্রেমের চশমা ,গোঁফ দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো ।

ঘনশ্যাম  বাবু ছ ফুটের উপর লম্বা ৷ রোগা চেহারা ৷ মুখে আচার্য  প্রফুল্ল চন্দ্রের মত গোঁফ দাড়ি৷  তরফদার যখন ঘনশ্যামের বাড়িতে পৌঁছন তখন ঘনশ্যামবাবু একটা বিরাট সোফাচেয়ারে বসে ঢুলছিলেন ৷ ল্যাবের বাইরে খুবই ক্ষুদ্র একটা সিসি টিভি ক্যামেরা বসানো৷

 ঘনশ্যামের হাতে সবসময় একটা রিমোট থাকে ৷ এটা একই সঙ্গে টিভি ' এসি ও ফ্রীজের রিমোট ৷ এছাড়া ও এটা স্মার্ট ফোন ও পেন ড্রাইভারের  কাজ করে ৷

2025 সালের পর থেকে টিভির ব্যবহার কমে আসছিল ৷ এখন একটা স্ক্রীন কিনলেই হল ৷ কেবলের দরকার হয় না৷ রিমোট ব্যবহার করে বাড়িতে বসেই যে কোন চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখা যায় ৷

তরফদার ল্যাবে ঢুকেই  কোটটা খুলে ফেললেন ৷ ল্যাবে যদিও এসি আছে কিন্তু ঘনশ্যামবাবুর সর্দির ধাত আছে বলে এসির তাপমাত্রা সব সময় পঁচিশই থাকে ৷

তরফদার ঘনশ্যাম বাবুকে দেখে  বুঝতে পারলন বেশ কয়েক পাত্র মদিরা পান হয়ে গেছে ৷ কোটটা টাঙ্গাবার জন্য  তরফদার একটা হুক খুঁজতে লাগলেন কিন্তু কোথাও একটা হুক বা পেরেক দেখতে  পেলেন না ৷ ঘনশ্যাম বাবুর ল্যাবটাকে একটা হাইব্রীড ল্যাব বলা যেতে পারে৷

আসলে এটা একই সঙ্গে ল্যাব ও বেডরুম ৷ প্রায় দুহাজার স্কোয়ার ফুট এই ল্যাবটা প্রথম দর্শনে একটা কেমিক্যাল ল্যাব মনে হবে ৷ ভিতরে ঢুকলেই বাঁদিকে দেখা যাবে একটা লম্বা বেন্চ৷ বারোটা টেস্টটিউব , বক যন্ত্র  ছাড়াও সোফা সিফন ও অনেক  শিশি এবং বোতল এবং দুটি বুনসেন বার্ণারও আছে ৷ বিশাল একটা ওয়াটার পিউরি ফায়ারের মত জলের পাত্র ৷ তলায় একটা সরু ট্যাপ ৷ সারি সারি মদের বোতল ৷ বোতলের গায়ে সব নাম করা ওয়াইনের ব্র্যান্ডের লেবেল ৷ তরফদার  জানেন ওগুলোতে কোন বিদেশী ওয়াইন নেই ৷ যা আছে তাহল ঘনশ্যামবাবুর  হাতে তৈরী মদ ৷ কোনটা  কুমড়ো কোনটা গাজর ইত্যাদি থেকে তৈরী ৷ বিভিন্ন ফল থেকে তৈরী মদ ও আছে ৷ তবে ঘনশ্যামবাবু নিজের ফরমূলায় তৈরী ককটেলই  পান  করতে  পছন্দ করেন ৷ আর একটি দেয়ালের গায়ে লাগানো বেন্চের যন্রপাতি দেখে মনে হবে এটা ইলেকট্রনিক্স ল্যাব ৷ এই বেন্চেরও পাশের দেয়ালে একটা বিশাল জেনারেটর এবং পাশে আর একটা  ছোট জেনারেটর ৷ প্রায় বারোটা প্লাগ পয়েন্ট ৷ ওখান থেকে সাপের মত কতকগুলি  তার আর কেবল বেন্চের তলায় বিভিন্ন যন্রের গায়ে লাগানো ৷ এর পাশে আর একটা জেনারেটর ৷

এটা অবশ্য অনেক ছোট। মদের বোতল গুলি যে বেন্চে লাগানো আছে তার তলায় দুটো লকার দেখতে পেলেন তরফদার আগে দেখলেও অতটা খেয়াল করেন নি৷ কারণ লকার দুটো  সব সময়  বন্ধ থাকতো। দুটো লকারই মেটালের। একটা অনেকটা খোলা দেখে  তরফদার  কোটটা ভাঁজ করে লকার টা তে রাখতেই লকার টা বন্ধ হয়ে গেল ৷ইতিমধ্যে ঘনশ্যাম বাবুর নেশা ছুটে গেছে ৷

তরফদার ওনার লকারে কোট রেখেছে দেখে উনি প্রায় আর্তনাদ করে বললেন

" ওটা কালকেই  গামা রে দিয়ে পেন্ট করিয়েছি ৷

আমাকে না বলে লকারে কিছু রাখবেনা "

" গামা রে ! ঘনশ্যাম বাবু মরে যাব না তো"

"আরে না না ৷ দেখনা ওই টেবিলে একটা গাইগার কাউন্টার আছে, ওটার থেকেই বুঝতে পারি গামারের ডোজ বিপজ্জনক হবে কিনা "

 "কিন্তু আমার কোট "

তরফদারের কথা শুনে ঘনশ্যাম বললেন

" ওটা তে সময়ের তালা দেওয়া আছে ৷ আমার মনে হয় এই লকার আবিষ্কারের জন্যই আমার নোবেলপ্রাইজ পাওয়া উচিৎ ৷ কিন্তু পাগলা বিজ্ঞানী কে আর পাত্তা দেয়। "
“যাই হোক ওই যে সবুজ বোতলটা দেখছো ওটাতে আমার বানানো একটা ককটেল আছে ৷ এক কাপ  ককটেল দাও ৷ ওটা না খেলে আমার মাথা খোলে না " তরফদার এক কাপ ককটেল টা দেওয়ার পর দুচুমুকেই ঘনশ্যাম কাপ শেষ করলেন ৷

" দাঁড়াও এবার সময়ের তালাটা খুলি ৷ এক  মিনিট লাগবে ৷ তোমরা যেমন ঘড়িতে আলার্ম সেট করো আমার রিমোটে সে রকম ভাবেই সময়ের তালা কাজ করে "

এর পর ঘনশ্যাম বাবু  রিমোট টা নিয়ে  অনেক ক্ষণ খুট খাট করলেন ৷ঠিক

এক মিনিট পর লকার টা খুলে গেল ৷ তরফদার দৌড়ে গিয়ে নিজের কোট খুঁজতে গেলেন ৷ কিন্তু লকারের মধ্যে শুধু একটা খুব ছোট সবুজ বলের মত একটা বস্তু দেখা যাচ্ছে ৷

তরফদার প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বললেন "আমার কোট  কোথায়?" ঘনশ্যাম বাবু কোন কথা না বলে রিমোটের দুটো বোতাম টিপলেন ৷ তরফদার থ হয়ে দেখলেন বলটা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল ৷

প্রায় পাঁচ মিনিট পরে  উনি দেখলেন ওনার ভাঁজ করা কোটটা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে ৷ তরফদার প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কোটটা নিয়ে গায়ে চড়ালেন ৷ যতই গরম লাগুক এটা আর হাত ছাড়া করবেন না ৷

ঘনশ্যাম বললেন " কি বিশ্বাস হল তো ৷ সময় তালা বল টাইম লকার বল আমি বানাতে পারি।"
" কিন্তু এটা তো ম্যাজিকের মত লাগছে  কি করে এটা সম্ভব হল?"

" কোন দিন একটা চিনির কিউব জলের মধ্যে ফেলে দিয়ে দেখেছো ৷ দেখবে চিনির কিউব টা আস্তে আস্তে জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ৷ কিছুক্ষণ পরে চিনির কোন চিহ্ন পাবেনা। "                                              
 " দেখেছি কিন্তু কি হচ্ছে বুঝতে পারিনি৷"

তরফদারের কথা শুনে  ঘনশ্যাম একটু  হেসে বললেন " স্কুলের ছেলেরা ও এটা জানে ৷ সারা জীবন

দাগী আসামীদের জামিনের ব্যবস্থা করে জীবন কাটালে ৷ এসব কথা ভাববার সময় কোথায় ৷ শোন প্রথম কারণ হল গ্রাভিটি ৷ আর চিনির মলিকিউল খুব ছোট ৷ জলের মলিকিউলের মধ্যে  জায়গা করে নিতে কোন অসুবিধেই হবেনা ৷ আমি স্পেস টাইমের  ফোর ডায়মেনসনের মধ্যে একটা ফাঁক তৈরী করতে পেরেছি যাতে যে কোন জিনিস দ্রবীভূত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে ৷ এখনো ব্যাপারটা পারফেক্ট করতে পারিনি বলে সবুজ বলটা দেখতে পারছ" ৷

 " বুঝেছি এভাবেই পুলিস এলে আপনি নিউরো গানটা ভ্যানিশ করে দেন ৷ কিন্তু লকারের থেকে   সাইজে অনেক বড় জিনিস কে কি ভাবে লুকোবেন "

 " কি করে হয় এখনি দেখতে পাবে ৷

এই  লকার টার সাইজ  4ফুট বাই 3ফুট বাই 3 ফুট ৷ সামনের দেওয়ালের বেন্চের নীচে একটা ছোট মই আছে ছফুট লম্বা চার ফুট চওড়া ৷ ওটা নিয়ে এসো। "

ঘনশ্যাম বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগলেন যেটুকু অংশ উনি ঢোকাচ্ছেন তা  ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে ৷

পাঁচ মিনিটের পর পুরো মইটা লকারের  মধ্যে মিশিয়ে গেল ৷ শুধু একটা প্রায় এক ইন্চি ব্যাসের একটা ধূসর রঙ্গের বল মইটার চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেল ৷ ঘনশ্যাম  বাবু শুধু বললেন যে আজ আর ওটা বার করা যাবে না ৷ তরফদার বললেন কাল উনি একটা বড় স্যুটকেস নিয়ে আসবেন, ওটা লকারে ঢোকাতে হবে। এর জন্য দশহাজার ক্রেডিট দেবেন ৷ আর নিউরো গান ধার নেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার ক্রেডিট এখনই ট্রানসফার করে দিচ্ছেন ৷ প্রায় সমস্ত দেশে বিট কয়েন নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পরে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে ক্রেডিট সিস্টেম চালু হয়েছে৷ এর একটা সুবিধে হল যে কোন সময়ে সারা বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশে ক্রেডিট ভাঙ্গিয়ে যে কোন কারেন্সী নগদে পাওয়া যায় ৷ অবশ্য শেয়ার মার্কেটে শেয়ারের মতই এর  দাম  উঠা নামা করে ৷

তরফদার চলে যাওয়ার পর ঘনশ্যাম ইলেকট্রনিক্স টেবিলের উপর কতকগুলো যন্রপাতি পরীক্ষা করে দেখলেন সব ঠিক আছে কিনা ৷

সব যন্রই ওনার নিজের হাতে তৈরী ৷ কিন্তু পারফেক্ট লকার বা সময়ের তালা এখনো উনি তৈরী করতে পারেন নি ৷ ওনার ধারণা কোনদিনই এটা সম্ভব হবে না ৷ এর মূলে আছে টাইম এবং স্পেস উভয় ক্ষেত্রেই  হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তাবাদ ৷

কিন্তু এই সমস্যা  সমাধানের জন্য অন্তত দুটো ককটেল খাওয়া দরকার ৷

                                                                               ৩

পরদিন প্রায়  বিধ্বস্ত অবস্থায় তরফদারকে ঢুকতে দেখে ঘনশ্যাম ভাবলেন আজকে নিশ্চয় কোন কেসে  হেরেছে ৷ অবশ্য তরফদারের হাতে একটা বড় স্যুটকেস দেখে বুঝলেন আজকে তরফদার বেশ কিছু টাকা পেয়েছেন ৷ তরফদার বিয়ে করেন নি কিন্তু একাধিক  ঘনিষ্ট বান্ধবী আছে ৷ তাদের জন্যেও বেশ খরচ করতে হয় ৷ তরফদারের মাঝে মাঝে মনে হয় ঘনশ্যাম বাবুকে বলেন এদের মধ্যে দুজনকে টাইম লকারে রেখে  অনির্দিস্ট কালের জন্য সময়ের তালা দিয়ে বন্দী করে রাখতে ৷ কিন্তু ঘনশ্যাম বাবু ধোয়া তুলসী পাতা না হলেও কোন মানুষ কে টাইম লকারে বন্দি করে রাখবেন না ৷  কিন্তু তরফদার যা বলল শুনে ঘনশ্যাম খুব একটা অবাক না হলেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন ৷ তরফদার  দুটো কঠিন কেসে অভিযুক্তদের জামিন আদায় ফকরেছে ৷ একটা কেস ছিল এক গৃহ বধু আর তার প্রেমিকের বিরুদ্ধে মেয়েটির স্বামীর হত্যার অভিযোগ ৷ পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছে সে কোলকাতাতেই ছিল না ৷ খুনী টি তরফদারের পুরোন  ক্লায়েন্ট ৷ আর একটা ছিল জালিয়াতির কেস ৷ এক্ষেত্রেও অভিযুক্ত পুরোনো পাপী ৷ এর বিরুদ্ধে এর আগে অনেক কেস থাকলেও তরফদার জজকে বোঝাতে সক্ষম হন যে জামিন অযোগ্য কোন ধারায় পুলিস কোন কেস আনতে পারেনি ৷

" তোমার স্যুটকেসে কি আছে "

 "অনেক টাকা ৷ এটা ওই লকারে রাখতে হবে ৷আর আমাকে ও "

ঘনশ্যাম এবার সত্যিই অবাক হলেন ৷" তোমাকে লকারে রাখতে হবে কেন ?

" আরে এই স্যুটকেসে যে টাকা আছে সবটাই জালিয়াতির টাকা ৷

 পাউন্ডে প্রায় কুড়ি হাজারের মত ৷ আর পুলিশ পুরো ব্যাপার টা বুঝতে পেরেছে ৷ আমি

বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি এখানে এসেছি ৷ ঘনশ্যাম বাবু একথা শুনে দাড়ি চুলকোতে লাগলেন ৷

এটা ওনাকে গভীর চিন্তা করতে সাহায্য করে ৷                                                                    
"আরে অত কি ভাবছেন ৷তাড়াতাড়ি করুন ৷ এখনি পুলিস আসবে ৷”                                                       
" শোন তোমাকে আমি অন্য একটা লকারে রাখব ৷এটা আমি কোনদিন ব্যবহার করিনি তবে টাইম লক করতে কোন অসুবিধে হবেনা "

" তবে তাই করুন ৷ যাই করুন তাড়াতাড়ি করুন "                                                            
ঘনশ্যাম বাবু তরফদারের স্যুটকেস কে প্রথম লকারে রেখে ওটার খোলার সময় রাখলেন চব্বিশ ঘন্টা। দ্বিতীয় লকারটা ঘনশ্যাম বাবু খোলার সঙ্গে সঙ্গে তরফদার নিজেই ওটার মধ্যে ঢুকে গেলেন ৷ঘনশ্যাম বাবু কোন প্রাণীকেই এর আগে টাইম লকারে রাখেননি ৷

দ্বিতীয় লকারে ওনার গবেষণার কিছু কাগজ পত্র আছে ৷ উনি এটার সময় লক করলেনআট ঘন্টায় ৷ লকার দুটো বন্ধ করে ঘনশ্যাম বাবু ওনার বানানো একটা নতুন ককটেল একটা বিশেষ কাপে ঢেলে চেয়ারে সবে বসেছেন তখনি দরজায় প্রবল ধাক্কা ৷ ঘনশ্যাম বাবু রিমোটে দেখতে পেলেন পুলিসের এক বিশাল বাহিনী৷ সঙ্গে সাদা পোষাকে কিছু লোক৷ এর মধ্যে দুজন মহিলা ৷ ঘনশ্যাম বাবু নিশ্চিত যে এরা  ফরেনসিকের লোক ৷ রিমোটের সাহায্যে দরজা খুলতেই প্রায় হুড় মুড়িয়ে নজন ব্যক্তি ঘরে ঢুকে পড়ল ৷ এদের মধ্যে বেশ লম্বা পুলিসের ইউনিফর্ম পরা একজন লোক ঘনশ্যাম বাবুর হাত থেকে রিমোট টা ছিনিয়ে নিয়ে বলল " আপনি এখান থেকে নড়বেন না "

ঘনশ্যাম বাবু  বুঝতে পারলেন এই হচ্ছে পুলিস বাহিনীর লীডার ৷ পুলিসের বড় কর্তা ৷ তবে লোকটার

বুদ্ধি আছে ৷ রিমোটটা  নিয়ে আনাড়ীর মত বোতাম না টিপে ফরেনসিকের এক মহিলার হাতে রিমোট টা

দিয়ে বলল " মিস মল্লিক এটা ভাল করে দেখুন তো। "                                                           
একজন ফরেনসিকের লোকের হাতে একটা মাঝারী সাইজের বাক্স ৷ ঘনশ্যাম বাবু আন্দাজ করলেন আড়াই ফুট বাই দুফুট বাই দুফুট হবে নিশ্চয় ফরেনসিকের কিছু যন্রপাতি আছে ৷ পুলিসের লোকজন যখন তন্নতন্ন করে ঘনশ্যামবাবুর ল্যাব সার্চ করছিল তখন মিস মল্লিক রিমোট টার নানান বোতাম টিপে বোঝার চেস্টা করছিলেন এটা কি ভাবে কাজ করে ৷ ঘনশ্যাম নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন ৷ মিস মল্লিক যত দক্ষ ফরেনসিক বিজ্ঞানীই হোক না কেন রিমোটের পুরো রহস্য বার করতে পারবেন না ৷ মিস মল্লিক হাল ছেড়ে দিয়ে ঘনশ্যাম বাবুর কাছে আসেন ৷"                                                                    
“এই রিমোট দিয়ে কি কি যন্র আপনি কন্ট্রোল করেন "

ঘনশ্যাম বাবু দেখিয়ে দেন যে টিভি, এসি, সিসিটিভি এবং  ইচ্ছে করলে ল্যাপটপও উনি কন্ট্রোল করতে পারেন ৷ তাছাড়া বাড়িতে ঢোকার দরজাও এটার সাহায্যে খোলা ও বন্ধ করা যায় ৷ মিস মল্লিক হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টান " আপনি দেখছি একটা কেমিক্যাল ল্যাবও বানিয়েছেন ৷ কিসের রিসার্চ করেন ৷"                     
মারকারী কেমিস্ট্রি৷ একশ বছরেরও বেশী আগে স্যর পি সি রায় ও তাঁর ছাত্ররা যে সব মারকারী কম্পাউন্ড নিয়ে কাজ করতেন ওই গুলোই আমার রিসার্চের বিষয় ৷ এটা আমার একটা হবি বলতে পারেন। " আর ইলেকট্রনিক্স ল্যাব ?"                                                                                          মিস মল্লিক  ইলেকট্রনিক্সের ওপরে খুব বেশী জানেন না মনে হল ৷ " আমি আপাততঃ একটা স্পাই ক্যামেরা ও সিসিটিভি ক্যামেরার একটা হাইব্রীড বানানোর চেস্টা করছি ৷ একটা জামার বোতামে বা কলমে এটা লাগানো যাবে এবং অন্তত কুড়ি কিলোমিটার দূরে থাকা কোন  অডিও ও ভিডিও সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডেড ৷”

“এটা আপনাদের পুলিসের খুব কাজে লাগবে। " লোকেদের বিশেষ করে মেয়েদের সুরক্ষার কাজে লাগবে "

" আপনি তো দেখছি একজন জিনিয়াস " খানিকটা ঠাট্টার সুরে ই মিস মল্লিক বললেন।

ইতিমধ্যে একটি পুলিস এসে দোতলার ঘরের চাবি নিয়ে গেছে ৷ ঘনশ্যাম জানেন ওখানে বই ছাড়া কিছুই পাবেনা ৷ বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যার উপর কোন বই নেই ওখানে ৷ আর আছে সাহিত্য ও কল্গ বিজ্ঞানের উপর বেশ কিছু বই ৷ একটা জিনিস উনি বুঝতে পারছেন না খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মত কি ওরা খুঁজছে ৷ নিশ্চয়ই তরফদার কে নয় ৷ হয়ত স্যুটকেসটা বা পাউন্ড গুলো৷ পুলিসের বড় কর্তার মত লোকটা এবার ওনার সামনে একটা  চেয়ার টেনে এসে বসল ৷

লোকটা বুদ্ধিমান বলতেই হবে সব চেয়ে ইমপর্টান্ট প্রশ্ন টা সার্চ শেষ হওয়ার পরের মুহূর্তের জন্য রেখে দিয়েছিল৷

" তরফদার বাবু কোথায়?"

"এখন কোথায় বলতে পারবনা৷ তবে আপনারা আসার কিছু আগে এখানে এসেছিলেন।”

" কি কারণে  এসেছিল "

" দেখুন ও মাঝে মাঝে এখানে আসে এটাতো আপনারা জানেন। আজকে দুটো কেস জিতেছে আমাকে জানাতে এসেছিল ৷"

" আপনার সঙ্গে ওঁর আলাপ হল কি করে?”

" ও একটা কেসে আমাকে সাহায্য করেছিল ৷ ইনফ্যাক্ট ওই আমার উকিল ছিল ৷ ওর কেসে কোন

বিজ্ঞানের ব্যাপার স্যাপার থাকলে আমার পরামর্শ নিত। "

ঘনশ্যামবাবুর সঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বড় কর্তার চোখ চার দিকে ঘুরছিল ৷ হঠাৎ বললেন, “আমরা আপনার ল্যাব আর উপরের ঘরে সব সার্চ করিয়েছি। কিন্তু ওই টেবিলে দুটো লকার আছে কিন্তু চাবির কোন সিস্টেম নেই, অথচ খোলা যাচ্ছেনা ৷”

 লকার দুটোর তলায় দেখবেন ছোট দুটো বোতাম আছে ৷ টিপলেই লকার খুলে যাবে " ঘনশ্যাম বাবু ভাবলেন ,ভাগ্যিস টাইম লকার হলেও মেকানিক্যাল উপায়ে ওগুলো খোলার ব্যবস্থা করে ছিলেন ৷ বড় কর্তা নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বোতাম টিপে লকির দুটো খুললেন ৷ ফাঁকা দেখলেও ভিতরে প্রথমে হাত ঢুকিয়ে পরে টর্চ ফেলে  সার্চ করলেন ৷ কিছুই পেলেন না ৷ ফিরে এসে আবার ঘনশ্যাম বাবুকে প্রশ্ন করলেন "তরফদার যখন এসেছিল হাতে কোন স্যুটকেস ছিল ?”

 "হ্যাঁ ৷ ছিল ৷ তবে উকিলদের হতে যেরকম স্যুটকেস থাকে সেরকম ৷ সাইজ ছিল মাঝারী।"                 
বড় কর্তা আর কথা না বাড়িয়ে দল বল নিয়ে বিদায় নিলেন ৷

যাবার আগে বলে গেলেন " তরফদারের কোন খোঁজ পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন ৷ লোকটা অপরাধীদের হয়ে কেস করতে করতে নিজেই একটা অপরাধী হয়ে গেছে ৷ এবার আর আমাদের জাল কেটে পালাতে  পারবেনা ৷ আর একটা কথা লাইসেন্স ছাড়া মদ বানানো বে আইনি ৷ বেশী বানাবেন না"

                                                                               ৪

পুলিস বাহিনী বিদায়  নেবার পর প্রায় সাত ঘন্টা কেটে গেছে ৷

একটা হলুদ ককটেল দু পাত্র পান করে ঘনশ্যাম বাবু ঝিমোচ্ছিলেন ৷হঠাৎ খেয়াল হল স্পেস টাইমের ফাঁক  থেকে  তরফদারকে বার করার সময় হয়ে গেছে ৷

রিমোটে একটা লাল আলো সেই সংকেতই দিচ্ছে ৷ এই লাল আলোর সংকেত একমাত্র দ্বিতীয় লকারেই লাগানো ৷ ঘনশ্যাম বাবু রিমোটে দ্বিতীয় লকারের সময়ের তালা খোলার বোতাম গুলো একটা বিশেষ সিকুয়েন্সে টিপতেই দ্বিতীয় লকারটা খুলে গেল ৷ কিন্তু লকার টা ফাঁকা৷ ছোট সবুজ বলটাও দেখা যাচ্ছেনা। ঘনশ্যাম বাবুর মনে হল ওনার নেশাটা একটু বেশী হয়ে গেছে৷                                                      
পাঁচ মিনিট লকারটা খোলা  থাকার পরও তরফদারের কোন চিহ্নই দেখা গেল না ৷

ঘনশ্যাম ভাবলেন এর আগে কোন জীবিত বা মৃত প্রাণীকে উনি লকারের  স্পেস টাইমে আটকে রাখেননি।

হয়তা এই জন্যই কিছু গন্ডগোল হচ্ছে ৷ উনি লকার টা আবার বন্ধ করলেন ৷ সময়ের তালা লক করলেন এক মিনিটের জন্য ৷ ঠিক এক মিনিট পরে লকার খুললেন ৷ একই অবস্থা ৷ লকার একদম ফাঁকা ৷এরপর ঘনশ্যাম বাবু পাগলের মতন লকার খুলতে আর বন্ধ করতে লাগলেন ৷ কি মনে হল প্রথম লকারটা বার কয়েক খুললেন আর বন্ধ করলেন ৷

কিন্তু সেটাও ফাঁকা ৷আর স্যুটকেস খোলার সময় ও এখন হয়নি ৷

ঘনশ্যামবাবু বুঝতে পারলেন  স্পেস টাইমের জাল থেকে তরফদার হয়ত বেরোতে পারবেন না।

ঘনশ্যাম বাবু  স্যুটকেসের লকার থেকে স্যুটকেস টা আর বার করবেন না ঠিক করলেন ৷ একটা নির্দিষ্ট

সময়ের পরে ওটাও চিরকালের জন্য চার ডাইমেনশনে আটকে থাকবে ৷

হয়ত কোন এক সময়ে তরফদার স্যুটকেসটা ফেরত পাবেন কিন্তু সেটা কোন  স্পেস টাইমে ঘনশ্যাম বাবু  কোন দিনই জানতে পারবেন না৷

                                                 

অনুপ্রেরণাঃ টাইম লকার,

লেখক লুইস প্যাজেট ( হেনরী কাটনার , 1915-1958,সি এল মুর , 1911-1987  )

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb