অমানবিক

লেখক - ডাঃ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

                                             

- শোনো বিশু, কাল সকালে তুমি পোশাক পরে, রেডি হয়ে থাকবে। তোমাকে তুলে, কোম্পানিতে ফেরত দিতে হবে। ওদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। রিপ্লেস করলে ভালো। বলেছিল রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি কিম্বা মানিব্যাক গ্যারান্টি। হয় অন্য কেউ... নইলে তোমার মত গৃহ-সহায়িকা কাউকে ছাড়াই... বুঝেছ বৈশাখী?

ওকে তুমি তুমি বলে আর একদম শেষে, বৈশাখীর ভালো নামটা কঠিন গলায় উচ্চারণ করে, ব্যাপারটা যে ভারি গুরুত্বপূর্ণ বুঝিয়ে দিল সুকান্তি।

কথায় বলে, সুখের চাইতে সোয়াস্তি ভালো। সুকান্তির হয়েছে সেই দশা। বাড়িতে সেধে আসা জাঙ্ক-হ্যান্ডবিলে দেওয়া ঠিকানায় যোগাযোগের পর বৈশাখীর আগমন সুকান্তির এই আবাসনে। মানে ফ্ল্যাটে।

ভালোই চলছিল প্রথম দিকটায়। নেবার আগে ওরা বারবার করে জিজ্ঞেস করেছিল কী রকম কী কাজের জন্য দরকার।
তা বলেওছিল সুকান্তি। ঘরোয়া টুকিটাকি কাজ। দিনে রান্নার চাপ নেই। সকালে ওই ব্রেকফাস্টটা। সুকান্তির খাবার নিয়ে ঝামেলা কোনওকালেই ছিল না। স্ত্রী আর মেয়ে, যখন ছিল তখনও না। এখন তো আরওই না।
সকালে দু-পিস স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি। দুপুরের লাঞ্চ ইন্সটিটিউটেই। ক্যান্টিনে। আর রাত্রে প্রায় কিছুই খায় না একাহারী প্রফেসর সুকান্তি। আগে যদিও বা খেত বউ রেবা আর মেয়ে বিশুদ্ধার উৎপাতে, ওরা চলে যাবার পর অভ্যেসটাই চলে গেছে এক রকম। কাজেই খাওয়ার ব্যাপারটা তত বড়ো কিছু না।
কিন্তু, তবু একটা গৃহ সহায়িকা দরকার ছিল। বিছানা আর বইপত্র গুছিয়ে রাখা। ঘরদোরটা পরিষ্কার রাখা। কিন্তু কাউকে তারও চেয়ে বেশি দরকার ছিল দমচাপা একাকীত্বটা কাটানোর জন্য।

সুকান্তি বরাবরই ঘরকুনো মানুষ। বাইরে বেরুনো, 'দেখব এবার জগৎটাকে' টাইপের কোনও বাসনাই ওর কোনও কালে ছিল না। সেটা ছিল রেবা আর বিশুদ্ধার। মা মেয়ের। তারা আক্ষরিক অর্থেই যদ্দিন বেঁচে ছিল শুষে নিত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অপার সৌন্দর্য। কোথায় না যেত। যেখান থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা শতাংশের হিসেবেই একশোর কম, মানে সবাই ফেরে না, সেই রকম সার্টিফায়েড জায়গাতেও বুক ফুলিয়ে চলে যেত মা আর মেয়ে। ফিরে এসে ওকে আওয়াজ দিত,
- এই দ্যাখো গো। গেছি, ফিরেও এসেছি। তোমার মত ঘরের কোণে মাথা গুঁজে থাকিনি।
সুকান্তি ওদের শুধরানো দূরের কথা, সামান্যতম বাধাও দেয়নি কোনওদিন। মানুষের ব্যক্তিগত চলাফেরার স্বাধীনতাকে ও এতটাই মর্যাদা দিত।
শেষ যাত্রায় আল্পসে প্লেন ক্র‍্যাশে যখন দুজনেই একসঙ্গে চলে গেল, বুকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়া যাকে বলে তেমনটা কিছু হয়নি।

ওরা প্রত্যেকবার ফিরে এসে সেন্ট্রাল ডেটা ব্যাঙ্কের লকারে নিজেদের ভার্চুয়াল স্মৃতি কপি করে রাখত।  কেন এই খেয়াল কে জানে। হয় তো পরে ভ্রমণ সমগ্র টাইপের কিছু বার করবে ভেবেছিল।
সেই লকারের ডিজিটাল চাবি সুকান্তির কাছে রাখা। ইচ্ছে হলেই ডেটা ব্যাঙ্কের লকার খুলে সেখান থেকে রেবা আর বিশুদ্ধার স্মৃতির উষ্ণতা খুঁজে নেয়। নতুন কোনও স্মৃতি যদিও জমা পড়বে না সে'খানে, কিন্তু পুরোনো স্মৃতিও তো কম কিছু নয়।

এখন নতুন আইনে রোবটদের অধিকার নিয়ে অনেক ধারা উপধারা।
এই বৈশাখীকে দেবার আগেও সে কী জটিলতা।  কেন সহায়িকাই চাই, সহায়ক চলবে না কেন, এই সব নানান প্রশ্ন পরিষ্কার করতে ওর নিজের সাইকো-অ্যানালিসিস অবধি করাতে হল।
এখন রোবোটিক এথিক্স মানে রোবোটদের এথিকাল রাইটস নিয়ে অনেক কথা চারি পাশে। সুকান্তি প্রমাণ করতে পেরেছে, বউ মেয়ে চলে যাবার পর, যাকে বলে মানসিক শান্তি, সেটা পাবার জন্য এই ফেমিনাইন টাচটুকু ও চাইতে পারে।

ওরাই প্রোগ্রাম করে দিয়েছে। হুবহু তেরো চোদ্দো বছরের এক মেয়ে। কোম্পানির দেওয়া নাম বৈশাখী। বাড়ি আসার পর সুকান্তি ওর ডাকনাম দিয়েছে। বিশু বলে ডাকবে ওকে। নিজের মেয়েকে টুকি বলে ডাকত। দু অক্ষরের নামই ভালো।
এই নতুন মাত্রার রোবটদের যুক্তিবোধের সঙ্গে কিছু অন্য জিনিসও জুড়ে দিয়েছে ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি। এরা নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে তর্কও করতে পারে।

আসলে মানুষেরা যদিও এদের প্রভু, কিন্তু অস্বীকার করে লাভ নেই, মানুষেরা বেশ যুক্তিহীন আচরণ করে। মাঝে মাঝে নয়। বেশির ভাগ সময়েই। তাদেরকে যুক্তির রাস্তায় ফিরিয়ে আনা, সেও তো সহায়কেরই কাজ। যুক্তিহীন কাজ করতে থাকা মানুষকে শুধরে দেয় না, বাড়ির অন্য মানুষেরা? এও সেই রকমেরই।

টুকিও তো বেঁচে থাকতে শুধরে দিত। কাজেই ডেলিভারি নেবার সময়, বৈশাখীর এই গুণটা জেনে ওর ভালোই লেগেছিল। মানে এই তর্ক করার ক্ষমতাটা।

কিন্তু বাড়ি এনে বুঝল, মেয়ে মানে যন্ত্র মানে এই বৈশাখী অল্প তার্কিক না, বিশাল তার্কিক। প্রথমেই তার ডাক নাম শুনে মুখ বাঁকালো।
- ডাকনাম বিশু?কেমন ছেলে ছেলে নাম না? আমি নেটে সার্চ করে পাচ্ছি, এই নামে এক ডাকাত ছিল আর মস্ত এক পাগলও ছিল রক্তকরবীতে। কিন্তু দুজনই ছেলে। আমার বিশু নামটা পছন্দ হয়নি বলে দিলাম।
- তা বললে তো হবে না। আমার দু-অক্ষরের ডাকনামই পছন্দ।
- হতে পারে কিন্তু ব্যাপারটা অযৌক্তিক। তোমার মরে যাওয়া মেয়ের নাম কী ছিল?
প্রায় জেরার সুরে জিজ্ঞেস করে যন্ত্র বালিকা।
একটা ব্যথার তন্ত্রী ঝনঝন করে বেজে ওঠে। দুঃখ আর রাগ মেশা ভাঙা গলায় সুকান্তি বলে,
- তার ভালো নাম ছিল বিশুদ্ধা। কেন ওর নাম দিয়ে কী হবে। ওর ডাক নাম ছিল টুকি।
- ওঃ তবে ঠিক আছে, ওই বিশুদ্ধা থেকেই বিশু বানিয়েছ তবে! তাই সই। বিশুই হলাম। আর হ্যাঁ, শোনো, আমি কিন্তু তোমাকে পাপা বলে ডাকব বলে রাখলাম।

এই শুরু। তর্কের, আর অবাধ্যতারও। প্রথম প্রথম মন্দ লাগছিল না। কিন্তু ক্রমশই মাত্রা ছাড়াচ্ছিল অপছন্দের ব্যাপারটা। সুকান্তির প্রাইভেট স্পেসে এনক্রোচ করার ব্যাপারটা। সে নিজে আগের জীবনে, বাড়ির লোকেদের ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকত। তারাও ওকে ঘাঁটাত না যথা সম্ভব। সেই অভ্যেস ঘা খেল যন্ত্র বালিকার খবরদারিতে।
প্রথমে শুরু হল অদ্ভুত ভাবে। ওর ইনস্টিটিউটে যাবার যে ব্রিফকেস, অবাক হয়ে দেখল, একদিন তার একপাশে টিফিন বাক্সে হাতে করা রুটি আর আলুভাজা। আর ছোট্ট একটা চিরকুট। তাতে লেখা,
- বিকেলে অল্প খিদে পাবে। খেয়ে নিয়ো পাপা।
চড়াৎ করে মাথা গরম হবার মত ব্যাপার। সে আপন ভোলা মানুষ হতে পারে। কিন্তু নিয়মনিষ্ঠ। তার নিজের নিয়মে হাত দেওয়া সে মোটেই সহ্য করতে রাজি না।
বাড়ি ফিরে বিশুকে ডেকে এই অনিয়মের জন্য কৈফিয়ত তলব করল। তার্কিক মেয়ে যা হিসেব দিল, তাতে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল সুকান্তির।
সুকান্তির ওজন এত। তার বিএমআর এত। সকালে ক্যালোরি ইনটেক এত। লাঞ্চে এত। কাজেই তার স্টমাকের অ্যাসিড সিক্রিশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকেলে তার ক্যালোরি রিকোয়ারমেন্ট হওয়া উচিত এত।
- কাজেই ওই রুটি আলুভাজা বিকেলে, বুঝেছ পাপা?

অকাট্য যুক্তি। হিসেবে ভুল নেই। পরাজিত সুকান্তি মানল বটে। কিন্তু তর্কে হারতে তার ভালো লাগে না।

এবং এই অশান্তি তার বাড়তেই থাকে। প্রাইভেট স্পেসে এনক্রোচমেন্টের এই অশান্তি। এই অনধিকার প্রবেশের অশান্তি। কোনওদিন দেখে, তার ডেস্কটপ খুলে আগের দিনের কাজ যেটা ক্লান্তিতে শেষ করতে পারেনি সেটা একেবারে উপসংহার অবধি লিখে রেখেছে নন্দিনী। রাগে ফুটতে ফুটতে ভাবে, শেষটা ঠিক এই রকম নাও তো হতে পারত, সে নিজে লিখলে। কিন্তু এটাও ঠিক, শেষটা অন্য কী রকম যে হতে পারত, অনেক ভেবেও সে তা বার করতে পারে না।
চূড়ান্ত ঘটনা ঘটল গত পরশু। সুকান্তি সেই আবিষ্কারটা করল, ডেটা ব্যাঙ্কের ডিজিটাল লকারের চাবি খুলেই। বৈশাখীর যেহেতু তার ঘর দুয়ার ডেস্কটপ সবেরই অ্যাক্সেস আছে, সে ডিজিটাল লকারেরও চাবি খুলতে পারে। সুকান্তির স্ত্রী আর মেয়ের সব লুকোনো স্মৃতি সম্পদ সে সব কিছু ঘেঁটে দেখেছে। দেখেছে, তা দেখুক গে! অমার্জনীয় যা করেছে, লকারে সে নতুন ফোল্ডার বানিয়ে গুছিয়ে রাখছে নিজের স্মৃতিও। এত বড় সাহস। রোবট, তার ওই তুচ্ছ যান্ত্রিক স্মৃতি গুছিয়ে রাখছে একান্ত মানবিক স্মৃতি ভাণ্ডারের পাশে।
নাঃ, এ অসহ্য। গতকাল রাত্রেই বৈশাখীকে ডেকে সুকান্তি জানিয়ে দিয়েছে, রোবটের যা করার কথা নয় সেই কাজ করেছে সে। কাজেই তাকে ছাঁটাই করা হবে। ছাঁটাই মানে কোম্পানিতে ফেরত দেওয়া হবে, বেয়াদবির অভিযোগে।
বৈশাখী তখনও তর্ক করতে কসুর করেনি। সুকান্তির যা চূড়ান্ত অপছন্দ মুখে মুখে কথা অবধি বলেছে। সেই আদ্যিকালের ল অফ রোবোটিকসের তিনটে ধারার একটাও যে সে ভাঙেনি প্রমাণ করে ছেড়েছে।
সেই যে, আসিমভ বলেছিলেন,
প্রথম আইন
একটি রোবট কোনও মানুষকে আঘাত করতে পারে না বা নিছক নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেও কোনও মানুষের ক্ষতি হবে এমন পরিস্থিতি হতে দেয় না।
দ্বিতীয় আইন
একটি রোবটকে অবশ্যই মানুষের দেওয়া আদেশগুলি মান্য করতে হবে যদি তা প্রথম আইনটিকে না ভাঙে।
তৃতীয় আইন
কোনও রোবটকে অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে যতক্ষণ এইরকম সুরক্ষা প্রথম বা দ্বিতীয় আইনের সাথে বিরোধী না হয়।

সত্যিই তো। একটাও আইন বৈশাখী ভাঙেনি। প্রথম আইনটিকে ভাঙেনি তো বটেই। তাই সুকান্তির ভালোর জন্যই সে রুটি আলুভাজা বানিয়েছে। আর সেই জন্যেই দ্বিতীয় আইন মোতাবেক সে সুকান্তির আদেশ মানেনি। আর সুকান্তির ডেটাব্যাঙ্কে সে নিজের স্মৃতি মানে নিজের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছে, কারণ তাতে প্রথম আর দ্বিতীয় আইন মোটেই ভাঙে না।

এই সব অকাট্য যুক্তিতর্ক সুকান্তিকে মোটেই নিরস্ত করতে পারেনি। কাজেই সে আজ বৈশাখীকে সমস্ত বেয়াদবি সমেত ফেরত দেবে। হয় রিপ্লেসমেন্ট নইলে মানিব্যাক গ্যারান্টি।

করুণ মুখে যন্ত্র বালিকা ঢুকে গেল রিসেপশনের গেট পেরিয়ে কোম্পানি-সার্ভিসের অশেষ অন্ধকারে। যাবার সময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে অসহায় চাহনিটুকু ছুঁড়ে দিয়ে গেল।
কিন্তু সুকান্তি, যে কিনা নিজের বউ মেয়ে মারা যাবার পরেও নিজের ডিপার্টমেন্টে এসেছে গেছে নিয়মিত, কাজে ঢিলে দেয়নি এক দিনও, সে এত সহজে এই যান্ত্রিক ছলাকলায় ঘাবড়াবে না, জানা কথাই।
রিসেপশনে থাকা ছেলেটাকে কড়া গলায় হাতের কাগজগুলোর ফটোকপি দিয়ে মনে করিয়ে দিল,
- আগামীকাল বিকেলে আসব। হয় রিপ্লেসমেন্ট, নয় মানিব্যাক। কোনও এদিক ওদিক যেন না হয়!

কাজেই পরের দিন আবার গেল সুকান্তি। ইন্টারকমে সেই ছোকরাই কাকে যেন কী সব বলল। খানিক পরে ট্রলিতে করে নিশ্চল যে মূর্তিটি বেরিয়ে এল, তাকে দেখে পিত্তি জ্বলে গেল সুকান্তির। এবং প্রবল সন্দেহ হল রিসেপশনে বসা ছেলেটাও রোবট নয় তো? সেই জন্যেই কি বাতিল যোগ্য একটা রোবোটের জন্য এত মায়া তার? গতকাল এত করে বুঝিয়ে গেল সমস্যাটা কী, আর ও নিজে কী চায় সেটাও। যাকে বলে কাস্টমার রিকোয়ারমেন্ট। সেই সবে পাত্তা না দিয়ে বৈশাখীকেই ফেরত দেবার সাহস পায় কী করে এরা?

- না না, শুনুন মিস্টার, আপনারা কিন্তু আমাকে কনজিউমার কোর্টে যেতে বাধ্য করছেন! একে আমি কিছুতেই নিয়ে যাব না।

অতীব মধুর হেসে রিসেপশনের ছেলেটি বলল,
- স্যার, রিপ্লেস নয়, নতুন কিছু ইন্সটলও করে দিয়েছে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারেরা। এবার নিয়ে গিয়ে দেখুন। নইলে গ্যারান্টি তো আছেই।
বলেই সুকান্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে এক মহিলা অ্যটেন্ডেন্টকে ডাকিয়ে আনল।
- রিখিয়া, একে চেঞ্জিং রুমে নিয়ে গিয়ে, পোশাক খুলে ব্যাটারি সেট করে দাও। স্যার নিয়ে যাবেন।

খানিক বাদে বেরিয়ে এল জ্যান্ত বৈশাখী।
কী আর করা। বেজার মুখে তাকেই নিয়ে বাড়ি ফিরল বেচারা সুকান্তি। টাকাটা মনে হয় জলেই গেল। এক গাদা টাকা।

আর পরের দিন থেকেই পুরোনো যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়ে গেল।
ফের শুরু সেই ব্রিফকেসে টিফিন দেওয়া, ডিজি-লকারে নতুন ফোল্ডারে নিজের স্মৃতি জমানো। তার পাপা যে কত অসাবধানী আর বেখেয়ালি তার খতিয়ান।

একদিনেই তিতি বিরক্ত হয়ে গেল সুকান্তি। ইচ্ছে করছে আছড়ে ভাঙে মেশিনটাকে। নিজেকে আটকালো। রোবোটিক এথিক্সে সেটা বড়সড় অপরাধ হয়ে যাবে। নিজের পয়সায় কেনা হলেও। ভাঙতে হলে, ডিসম্যান্টল করতে হলে নির্দিষ্ট এজেন্সি তা করবে। আইন যন্ত্রের প্রতিও কোনও নিষ্ঠুরতা সহ্য করবে না।

বাধ্য হয়েই ফের ফোন লাগালো। মেইলও করল খুব কড়া ভাষায়, উইথ সিসি টু কনজিউমার কোর্ট। সুকান্তি নিজেও যে খুব সোজা লোক নয় বুঝিয়েই ছাড়বে।

ফোন ধরেছে, গলা শুনেই বোঝা গেল, সেই চেনা ছোকরাই।
যথেষ্ট ঝাঁঝ মিশিয়ে তাকে তেতো কথাগুলো শোনাল সুকান্তি।

মাখন মাখানো গলায় সেই ট্রেনিং পাওয়া ছেলে বলে,
- সে কী স্যার আবারও?
- তা ছাড়া কী? সেই একই রিপিটিশন আগের বিরক্তিকর কাজের। আগে তাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনত। এবারে ফেরার পর নতুন গুণ হয়েছে। বকুনির পরে দাঁড়ায় না। কোথায় আড়ালে চলে যায়। নির্লজ্জ বেহায়া একটা মেশিন। এই তো, এক্ষুনি... বকুনি খেয়ে উধাও।

এই অবধি বলে নিজেই একটু ধন্দে পড়ে যায় সুকান্তি। মেশিনের হায়া? লজ্জাবোধ?
কোম্পানির সেই ছেলে ওপাশ থেকে বলে চলেছে,
- আড়ালে চলে যায় বলছেন? খুঁজে দেখুন তো আড়ালে গিয়ে সে কী করছে! সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার বলেছে চেঞ্জ করেছে। ওইটেই হয় তো চেঞ্জ। হ্যাঁ, স্যার, চিন্তা করবেন না। ডিসস্যাটিসফায়েড হলে আমাদের কোম্পানি তো আছেই।

তার কথা শুনে সুকান্তি এখন খুঁজতে বেরিয়েছে। সত্যিই তো, কোথায় গেল? কী করছে বিশু আড়ালে গিয়ে?
এঘরে নেই, ওঘরে নেই। স্টাডিতে তো সে নিজেই ছিল এতক্ষণ।
শেষে খুঁজে পাওয়া গেল উত্তরের ব্যালকনিতে। দূরে দিগন্তের আউটলাইনে পাহাড়ের সিল্যুয়েট দেখা যায়। সেই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুকান্তির সাড়া পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল যন্ত্র মেয়ে। দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। টলটলে জল নেমে এসেছে দুই গালেও। বিবর্ণ কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে জমা মেঘের মত অভিমান।

সুকান্তির সব বিরক্তি ধুয়েমুছে গেল। সত্যিই সে বকুনি আর অবহেলা দিয়ে যুক্তিহীন অন্যায় করেছে এই মেয়ের সঙ্গে।

একটা যুক্তিহীন কাজ করলে যে আর একটা যুক্তিহীন কাজ করা যাবে না তা তো না। রোবোটের সেই অধিকার নেই। মানুষের আছে।

কাজেই সুকান্তি আর একটা যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। যন্ত্রের ঠোঁট বিবর্ণ হয় না, সে জানে। কোনও যুক্তিতেই হয় না। তবু আজ সে অফিস ফেরতা বিশুর জন্য একটা লিপস্টিক কিনে আনবে। চলে যাওয়া কন্যা টুকিও লিপস্টিক লাগাতে পছন্দ করত খুব।

                                             

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb