পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

লেখক - রাকেশ শীল

                                        

টানা পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর আজ সম্পূর্ণ হল টাইম মেশিনটা। এতদিন জন আর  অনিমেষ দুই বন্ধু মিলে গোপনে এটাকে তৈরি করছিল। আজ এটা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অর্ধ সফলতার হাসির ছাপ দেখা যাচ্ছে দুজনের মুখে। মেশিনটা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলেও এটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা একবার দেখা দরকার। জন বলল, ' আচ্ছা অনিমেষ এতদিনের পরিশ্রম কি বৃথা যাবে?'

' দেখি.....না কি হয়। আচ্ছা তুই একবার ওই রিয়েক্টরটাকে চালু করে দিয়ে আয় তো,' বলল অনিমেষ।

একটা বড় বৃত্তাকার রিয়াক্টর আর তার ঠিক সামনেই আছে মেশিনটা। মেশিনটা দেখতে একটা বড় গোলাকার রিং এর মতো আর তার নিচে অর্থাৎ মেঝের দিকে একটা ছোট প্লাটফর্ম। যেখানে পাওয়ার অন করে দাঁড়ালেই মেশিন তার কাজ শুরু করে দেবে। জন এগিয়ে গেল ওই রিয়েক্টরটার দিকে। রিয়েক্টরটাকে চালু করতেই যান্ত্রিক শব্দের সাথে সাথে চালু হয়ে গেল মেশিনটা। জন বলল, ' হ্যাঁ এবার...? চালু করলাম কিন্তু প্রথমে কি দিয়ে পরীক্ষা করবি?'

-কি দিয়ে আবার ওই খরগোশটাকে দিয়ে। ওটাকে ওখানে রেখে একটা নির্দিষ্ট সময় সেট করে পাওয়ার অন করে রান করিয়ে দেব, আর তারপর যখন ও ফিরে আসবে তখন ওর মধ্যে আচরণের কোনো পরিবর্তন হলে বুঝব মেশিন কাজ করছে।

অনিমেষের কথা শুনে জন বলল, ' আচ্ছা তাহলে আমি ওটাকে নিয়ে আসছি তুই রেডি থাক।'

অনিমেষ কম্পিউটারের প্রোগ্রামটা অন করে অপেক্ষা করতে থাকলো। ওদিকে জন খাঁচা সমেত খরগোশটাকে এনে রাখলো ওই প্ল্যাটফর্মটার ওপর। জন বলল, ' নে এবার চালু কর মেশিনটা। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তবে কিছু একটা হবেই।'

-আচ্ছা আমি এখানে দু'বছর আগের একটা সময় সেট করে দিচ্ছি, আর অবস্থানটা এই একই জায়গায় রাখছি।

বলে অনিমেষ মেশিনের পাওয়ারটাকে অন করে দিল। মেশিনের পাওয়ার অন করার সাথে সাথেই মেশিন থেকে চোখ ঝলসানো আলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। যেন মনে হচ্ছে কোন গোলাকার অগ্নিপিণ্ড খুবই কাছে এসে গেছে আর তার সাথে মেশিনের জোরালো শব্দের কম্পনে কেপে উঠছে গোটা ল্যাবরেটরিটা। জন চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ' এবার রান করে দে.......'

রান করার সাথে সাথেই চোখ ঝলসানো আলো আর জোরালো শব্দ সমেত খাঁচা শুদ্ধ খরগোশ উধাও হয়ে গেল। অনিমেষ আর জন বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে দুজনের দিকে।

প্রায় আধঘন্টা পর খরগোশটা ফিরে এলো ওই স্থানে। জন আর অনিমেষ ছুটে গেল ওটার দিকে। শান্ত খরগোশটা খাঁচার মধ্যে এখন ছটফট করছে। মনে হচ্ছে যেন সে কিছু একটা দেখেছে। জন বলে উঠল, ' অনিমেষ দেখো খরগোশটার মধ্যে কেমন পরিবর্তন এসেছে। মনে হচ্ছে ও কিছু একটা দেখেছে তাই...........'

অনিমেষ আনন্দ ভরা একগাল হাসি নিয়ে বললো, ' তাহলে বন্ধু এখন আমাদের প্রথম যাত্রা কোথায়? আর কোন সময়কাল হবে?'

' ফিউচার...!! আমরা ফিউচার এর দর্শন করব বন্ধু। একশো বছর পর আমাদের এখানকার অবস্থা দেখব বন্ধু,' বলল জন।

-তাহলে শুভ কাজে দেরি কেন? আমি এখানে টাইম চেঞ্জ করে অটোমুডে রেখে দিচ্ছি, সময় হলেই মেশিন অটোমেটিক রান হয়ে যাবে।

অনিমেষের কথা শেষ হতেই জন বলল, ' আচ্ছা এখন আমাদের পৃথিবীর বয়স প্রায়- ফোর পয়েন্ট ফিফ্টিফোর বিলিয়নিয়ার ইয়ার, আর  আরো একশো বছর পর কি পৃথিবীর অবস্থা এরকমই থাকবে?'

' সেটা টাইম মেশিনে ভ্রমণ করলেই বুঝতে পারবে,' বলল অনিমেষ।

মেশিনটাকে অটোমুডে রেখে দুজনে দুজনের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে পরল প্লাটফর্মের উপর। এক অজানা ভয়ে দুজনের হৃদস্পন্দনের গতি একটু বেড়ে গেছে। আস্তে আস্তে জ্বলে উঠলো সেই উজ্জ্বল চোখ ঝলসানো আলোটা আর তার সাথে কানফাটানো একটা শব্দ। তারপর আর কিছু মনে নেই তাদের।

নিস্তব্ধ জনমানবশূন্য একটি পরিবেশ। কোথাও কোন প্রাণীর বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। সমভূমি আর শিলাখণ্ড ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। যেখানে ভারতের বিখ্যাত নদীগুলি বয়ে যেত প্রবল উল্লাসের স্রোতে সেখানে এখন বয়ে যাচ্ছে লাল রক্তের মতো উত্তপ্ত লাভার স্রোত। ছাই আর ধোঁয়ায় ধূসর হয়ে উঠেছে চারিদিক। আকাশের রং গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে সমভূমি আর তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে লাভার স্রোত।

কতগুলো ভাঙ্গা পাথরের পাশে পড়ে আছে দুটি ছেলে। আস্তে আস্তে চোখ খুললো দুজন। দুজন উঠে দাঁড়িয়ে অবুঝ শিশুর মতো চারদিক হাঁ করে দেখছে। এ কোথায় এসেছে তারা, তারা কি ভুল স্থানে চলে এসেছে নাকি তাদের মেশিন গন্ডগোল করেছে?

' হ্যাঁরে অনিমেষ, কি হলো বলতো? এ কোথায় এলাম আমরা?' বলল জন।

-মনে হচ্ছে আমাদের টাইম মেশিনটা গন্ডগোল করেছে। আমরা হয়তো একশো বছর পরের পৃথিবীতে না এসে দশ লক্ষ বছরের আগের পৃথিবীতে এসে পড়েছি।

অনিমেষের কথা শেষ হতেই গাঢ় অন্ধকারে ভরা আকাশে বিন্দুর মতো একটি আলো জ্বলে উঠলো। আলোক বিন্দুটি ধীরে ধীরে ক্রমশ বড় হচ্ছে।  জন আর অনিমেষ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিন্দুটির দিকে। যুদ্ধবিমান এর মত একটা ছোট্ট স্পেসশিপ নেমে দাঁড়ালো তাদের সামনে। জন আর অনিমেষ একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার তাকাল স্পেসশিপটার দিকে। কিছুক্ষণ পর স্পেসশিপ থেকে বন্দুকের মতো অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল দুটো ছেলে। ছেলে দুটো একবার নিজেদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে অবাক ও বিস্ময়  দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমেষ আর জনের দিকে। জন আর অনিমেষ এবার বুঝতে পেরেছে যে তাদের টাইম মেশিনটা কোনো গণ্ডগোল করেনি তারা ঠিক সময়কালেই এসেছে। ছেলেদুটো তাদের হাতের অস্ত্রটা তাক করল জন আর অনিমেষের দিকে। ছেলে দুটো একই সঙ্গে বলে উঠল, ' তোমরা কারা?'

দুটি ছেলের মধ্যে একজন বলে উঠল, ' নিশ্চয়ই তোমরা কোন অন্য গ্রহের বাসিন্দা আর এখন আমাদের দেখে আমাদের মতো ছদ্মবেশ নিয়েছো।'

অনিমেষ বলল, ' না...না...তোমরা ভুল বুঝছো, আমরা অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা নই। আমরা এই গ্রহেরই বাসিন্দা। তবে আমরা তোমাদের অতীত থেকে এসেছি, আমরা তোমাদের একশো বছর আগের সময়কালের অতীত।'

একটি ছেলে বলে উঠলো, ' তা কি করে হয়? অবশ্য এটা হওয়া সম্ভব কারণ একশো বছর আগে আমরা দুই বন্ধু গোপনে টাইম মেশিন বানাই আর সেটা সারা রাস্ট্র হয়ে যায়। শুধুমাত্র পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যই আমরা বিভিন্ন কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে আরো অনেক মেশিন তৈরি করি।' 

' আচ্ছা এই ব্যাপার.....,' বলল জন।

কপালের ঘামটা হাত দিয়ে মুছে নিয়ে অনিমেষ বলল, ' আচ্ছা এখন এই পৃথিবীর এরকম অবস্থার সম্বন্ধে কিছু বলতে পারো? এর এরকম দশা কি করে হলো?'  

দুটি ছেলের মধ্যে অনিমেষের মতো দেখতে ছেলেটি তার হাত থেকে অস্ত্রটা কোমরের বেল্টে আটকে বলতে আরম্ভ করলো, ' আজ থেকে একশো বছর আগে আমি আর জন এই স্থানে গোপনে একটা টাইম মেশিন বানাই। প্রথমেই যে সময়টার যাত্রা করি সেটা এই একশো বছর পরের সময়ের। সেখানে এরম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দেখা হয় আমাদের ভবিষ্যতের সাথে। তারা পৃথিবীর এমন পরিস্থিতির কথা জানায়।

মহাবিশ্বে সবকিছুই গতিশীল, কোনো কিছুই থেমে থাকে না। তেমনি মৃত্যুও থেমে থাকে না। জন্মের পর মৃত্যু হয় আর মৃত্যুর পর জন্ম। জন্ম হলে মৃত্যু হবে আর এটাই বাস্তব। এই মহাবিশ্বের এমন কোন বস্তু নেই যার জন্ম হয়ে মৃত্যু  হয়নি। তেমনি পৃথিবীর বয়স বেড়ে চলেছে আর তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সূর্যের বয়সও। একশো বছর আগে সূর্যের বয়স ছিল প্রায়- ফোর পয়েন্ট সিক্স জিরো থ্রি বিলিয়ন ইয়ার। আস্তে আস্তে সূর্যের বয়স বাড়তে থাকে আর মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে সূর্য। এক সময় এক বিশাল এক্সপ্লোশন হয় আর তার প্রভাবে ছিটকে যায় তার চারপাশের ঘুরতে থাকা গ্রহ গুলো। সেই গ্রহ গুলোর মধ্যে একটি হল পৃথিবী, যে সেই প্রকাণ্ড এক্সপ্লোশনে ছিটকে যায় সৌরজগতের একস্থানে। আর সূর্যের ধ্বংসের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায় আমাদের সৌর পরিবার। আমরা আগের থেকেই জানতাম এরকমটা হতে চলেছে। তাই আমরা কিছু দেশ মিলে এই পৃথিবী আগে থেকেই ত্যাগ করি। এখন আমাদের সৌরজগৎ থেকে অনেকটা দূরে মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের পৃথিবীর দশটি দেশের শিপ। প্রত্যেকটা দেশের দশটা করে শিপ আছে ওখানে। শুধুমাত্র জ্ঞানী ও কর্মরত মানুষদের নেওয়া হয়েছে ওখানে পৃথিবীবাসীদের বংশ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এখন আমরা অন্য গ্রহে বাসস্থানের পরিকল্পনায় আছি। ভেবেছিলাম পুরনো কিছু স্মৃতি থেকে যাবে হয়তো আমাদের এই একশো বছরের পূর্বের স্থানে, তাই এসেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য ভালো তোমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। এবার তোমরা ফিরে যাও বর্তমান সময়ে। আর প্রস্তুত থাকতে বল পৃথিবীবাসিকে।'

কিছুটা দূরে একটি ছোট্ট আলোকবিন্দু হতে বড় বৃত্তাকার একটি চোখ ঝলসানো আলো তৈরি হল। অনিমেষ আর জন তাদের ভবিষ্যতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল আলোক বৃত্তটার দিকে। দুজন বৃত্তটির ভেতর প্রবেশ করতেই বৃত্তটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

                                                                 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb