স্থানাঙ্ক জ্যামিতির জনক রেনে দেকার্ত

লেখক - বিকাশ মণ্ডল

                                                          

ভগ্ন স্বাস্থ্য, রুগ্ন শরীর, তার ওপর কাশি ছিল নিত্য সঙ্গী। স্থানীয়  ডাক্তার তো ভবিষ্যতবাণী করেছিল যে এছেলে শৈশব পার করবে না। কিন্তু ওই যে কথায় আছে –“রাখে হরি, মারে কে?” তা  না হলে যে ছেলের কৈশোর দেখার কথা নয় সে কিনা পরবর্তীকালের  বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক, গণিতজ্ঞ!  কেউ কি তখন স্বপ্নেও ভেবেছিল যে এই ছেলের  হাত ধরে একদিন সৃষ্টি হবে গণিতের একটি নতুন শাখার---যার নাম স্থানাঙ্ক জ্যামিতি(Coordinate Geometry) বা  বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি(Analytical  Geometry)?   হ্যাঁ, ইনিই হলেন সেই জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক, গণিতজ্ঞ রেনে দেকার্ত(Rene Descartes) যিনি  বলেছিলেন ,“ I think, therefore I am.”   

1596 সালের 31 শে মার্চ ফ্রান্সের তোরাইন(Touraine) প্রদেশের হেগ(La Haye) শহরে রেনে দেকার্ত জন্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে যশস্বী রেনের সম্মানে হেগ শহরের নামকরণ হয়  ‘দেকার্ত’ শহর। তিন ভাই-বোনের মধ্যে দেকার্ত ছিলেন কনিষ্ঠ। দেকার্ত যখন একবছরের ছোট্ট শিশু  তখন তাঁর মা জেন ব্রোচার্ড(Jeanne Brochard) ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর পিতা জোয়াকিম(Joachim) দ্বিতীয়বারের জন্য বিয়ে করলে তাঁকে মামার বাড়ি দিদিমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদিও তাঁর আইনজীবী পিতা ছেলের সুশিক্ষার বিষয়ে সর্বদা  চিন্তিত ছিলেন, তবুও  অনুমান করা যায় যে  মাতৃহারা দেকার্তকে পিতৃস্নেহ থেকেও অনেকটাই  বঞ্চিত হতে হয়েছিল।

দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে দেকার্তের স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল বেশ দেরিতে । তাঁর  বয়স যখন প্রায় 10 বছর  তখন  পিতা তাঁকে জেসুইট কলেজের এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে তিনি প্রায় 7-8 বছর পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় স্কুলের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্যান্য ছাত্ররা নিয়ম মেনে সকাল  সকাল শয্যা ত্যাগ করলেও তিনি প্রায়দিনই দেরিতে ঘুম থেকে উঠতেন। এরজন্য অবশ্য, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে কোনদিনই কিছু বলতেন না। বরং  শারীরিক অসুস্থতা যাতে তাঁর পড়াশোনার অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতেন।  এইসময়ে  তিনি ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, ল্যাটিন, গ্রীক ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বিদ্যালয়ের শেষ দুবছর তিনি খুব মনোযোগ সহকারে গণিতশাস্ত্র ও পদার্থবিদ্যা অধ্যায়ন করেন। মেধাবী  ছাত্র ছিলেন দেকার্ত। নানা বিষয়ে ছিল তাঁর কৌতূহল। তবে পিতা চাইতেন ছেলে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করুক। তাই 1614 সালে 18 বছর বয়সে দেকার্ত এই বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করে পিতার ইচ্ছায় পোটিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে(University of Poitiers) আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন এবং দুবছর পর 1616 সালে তিনি ডিপ্লোমা সহ সিভিল আইনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু ওকালতি করে অর্থোপার্জন করার ইচ্ছা তাঁর আদৌ ছিলনা। অর্থোপার্জনের  প্রয়োজনও পড়েনি কোনদিন। কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে যে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন তা দিয়ে তাঁর অবিবাহিত জীবন অনায়াসে কেটেছে। আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হয়নি কোনদিন। তাই পরম  নিশ্চিন্তায় জ্ঞানপিপাসু দেকার্ত  সারা জীবন শুধু জ্ঞান আহরণ করে ও দার্শনিক চিন্তা করে কাটিয়েছেন।

 তিনি আইনজীবী হওয়ার পরিবর্তে পরিব্রাজক হয়ে  প্রায় দুবছর সমগ্র ইউরোপ পরিভ্রমণ  করেন। এরপর 1618 সালে নেদারল্যান্ডের ব্রেদা(Breda) শহরের ‘দ্য ডাচ স্টেটস আর্মি’ তে নিজের নাম লেখান এবং একটি মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন। এই সময় ডাচ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক  আইজ্যাক বিকম্যানের(Isaac Beeckman) সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। 1619 সালে একটি চিঠিতে বিকম্যানের উদ্দেশে  তিনি লেখেন,’’ সত্যি বলতে কী, আপনিই আমাকে আমার অলসতা থেকে বের করে এনেছিলেন  এবং আমাকে এমন জিনিসগুলি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যেগুলো আমি একবার মাত্র শিখেছিলাম এবং প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। যখন আমার মন গুরুতর গাণিতিক বিষয়গুলি থেকে বিচ্যুত হয়েছিল,আপনি আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন।“   বস্তুত বিকম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই তিনি গণিতে নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায় নিজেকে গভীরভাবে নিমগ্ন করেছিলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত “La Geometrie” বইতে দেখিয়েছেন কী করে বীজগাণিতিক পদ্ধতিতে জ্যামিতিক সমস্যার সমাধান করা যায়। আর এটাই ছিল গণিতে তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার। তিনি দেখিয়েছেন কী করে দুটি পরস্পর লম্ব সরলরেখার সাপেক্ষে সমতলের কোন বিন্দুকে খুব সহজেই প্রকাশ করা যায়।

দুটি পরস্পর লম্ব সরলরেখা দুটির মধ্যে অনুভূমিক সরলরেখাটিকে x-অক্ষ এবং উল্লম্ব সরলরেখাটিকে y-অক্ষ বলে। এই দুই অক্ষ থেকে বিন্দুটির দূরত্বদ্বয়কে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে কমা দিয়ে পৃথকভাবে লেখা হয়। যেমন  y-অক্ষ থেকে ও x-অক্ষ থেকে বিন্দুটির দূরত্ব যথাক্রমে 3 একক ও  5 একক হলে বিন্দুটির স্থানাঙ্ক হবে (3, 5) । একে দেকার্তের নামানুসারে কার্তেসীয় স্থানাঙ্কও বলে। ল্যাটিন ভাষায়  ‘দেকার্ত’  কে বলা হয় ‘কার্তেসীয়াস’ এবং সেখান থেকে ‘কার্তেসীয়’  কথাটি এসেছে। এইভাবে যে কোন বক্ররেখার উপরিস্থ বিন্দুর স্থানাঙ্ক নির্ণয় করে দ্বিমাত্রিক সমতলে ওই বক্ররেখার লেখচিত্র আঁকা সম্ভব।

গণিতে তাঁর আরও এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার হল “Rule of sign”। কোনো সংখ্যাকে কয়েকবার নিয়ে গুণ করলে প্রাপ্ত গুণফলকে সংখ্যার ঘাত(power) বলে । কতবার নিয়ে গুণ করা হয়েছে তা বোঝাতে সংখ্যাটিকে কেবল একবার লিখে তার মাথার ওপরে ডানদিকে সেই সংখ্যাটিকে (যতবার নেওয়া হয়েছে) লেখা হয়।

যেমন,  ,     ,  … ইত্যাদি । অর্থাৎ, x-এর n-তম ঘাত বোঝাতে  x এর মাথার ওপরের ডানদিকে n সংখ্যাটিকে লিখলেই হবে। দেকার্ত সর্বপ্রথম কোনো রাশির ঘাতকে এইভাবে প্রকাশ করেছিলেন বলে একে দেকার্তের “Rule of sign” বলে।

দেকার্ত তাঁর জীবনের শেষ কুড়ি বছর হল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে অতিবাহিত করেন। এই সময় তিনি নিজে গণিতচর্চা করতেন এবং ছাত্রদের গণিত শেখাতেন। 1649 সালে সুইডেনের রানী ক্রিশ্চিনার আমন্ত্রণে তিনি স্টকহোমে চলে আসেন। এখানে 1650 সালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান গণিতবিদের জীবনাবসান হয়। 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb