ক্লোরোস্ফিয়ার

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

                                                 

লোকটা কি মাঝি?

কিন্তু এ তো নদী বা ঝিল নয়? এই বদ্ধ পানাপুকুরে নৌকোয় করে পার হবার মত লোক কই? পারাপার করবেই বা কেন? করে লাভই বা কী? ওপারে পড়ে আছে এক বিস্তৃত জঙ্গল। গহন আর দুর্ভেদ্য। বাঘ সিংহ না থাকলেও যারা থাকে তাদের তো পারাপার করার জন্যে নৌকো আর মাঝি লাগে না?

লোকটা কি তবে জেলে?

কিন্তু ডোবা পানা-পুকুরে কী এমন রুই কাতলা মৃগেল বোয়াল আছে যে জাল ফেলে বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরবে? থাকলে আছে বড় জোর শোল, ল্যাটা কী শিঙ্গি মাগুর। কই, বেলে এইসব পাঁক ঘাঁটা মাছ। তাদের জন্যে নৌকো বা জাল কিছুই লাগে না। লাগে পেঁকো জলে ডুবে ডুবে সাঁতার কাটার হিম্মত।

মাঝ দুপুরে কয়েক ঘন্টা একটা আধভাঙ্গা ছিপ নৌকো নিয়ে সারা পানা পুকুরময় টো টো করে ঘুরে বেড়ান আর মাঝে মাঝে আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে নিজের মনে কত কী যেন ভাবা। একটু একটু করে পানা ঢাকা পুকুরে দেখছে তারপরই আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন আকাশ-পুকুর ভাবছে। মাঝে মাঝে আবার হাতের একটা কী দিয়ে যেন কী করছে।

তবে কি লোকটা- হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। একটা বদ্ধ পাগল। সংজ্ঞায় থাকা মানুষ এই সংজ্ঞাই দেবে হয়ত।

একেবারে টগবগে শহরের টুকটুকে এক হাউসিং-এর তিনতলার বাসিন্দা মহারত্ম সেন এক মহা ভাবনায় কাতর হয়ে সোফায় কাত হয়ে গুগুল খুলে বসেছিল। বাতাসের অক্সিজেন আর কার্বন-ডাই -অক্সাইডের হিসেব বারে বারে তার ভুরু কুঁচকে দিচ্ছিল।

আজ সে নিজে একটু ব্যস্ত আছে তাই মাকে পাঠিয়েছিল বাজারে। মা এখন গাড়িটা চালানো বেশ শিখে গেছে। প্রথমটা বেশ একটু ভয় পেয়েছিল। তারপর যখন দেখল লিফট বা সিঁড়ি ছাড়াই তিনতলা থেকে একতলায় নেমে এসে আবার সকলের মাথার ওপর দিয়ে দিব্বি ড্যাংডেঙিয়ে বাজারে চলে যাওয়া যাচ্ছে তখন তো আনন্দ আর ধরে না। বাড়ি ফিরে ছেলেকে অনেক আশীর্বাদ করে বলল, বেঁচে থাক বাবা সুখে থাক। এই ভাঙ্গা হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে হল না। আবার লিফটের খুপরিতে খুচরো পয়সা রাখা ভাঁড়ের মত হাঁসফাঁস করতে হল না। দিব্বি বানিয়েছিস বাবা গাড়িটা।

মায়ের প্রশংসা। বেশ ভালই লাগছিল মহারত্নের। তবে শেষ দিকটা ভাল লাগে নি যখন মা বলল, এত বয়েসেও বিয়ে করলি না এ বড় দোষ কিন্তু তোর। তবে তো তোর সঙ্গে সেই মেয়েটাও কেমন এই গাড়িতে চড়ে বিশ্বভ্রমণ করতে পারত।

-না মা বিশ্বভ্রমণ হবে না এই গাড়িতে। এ বড় জোর তিনঘন্টা উড়তে পারে আকাশে। সৌরশক্তিতে মানে রোদের আলোয় চলে না হলে একে আবার সময় সময় ব্যাটারি চার্জ করতে হত।

আসলে মহারত্নের আবিষ্কৃত এই মহা উড়ন যানে সৌরশক্তি ছাড়া আর কোনও শক্তির দরকার নেই। এর ইঞ্জিন বিশেষ কোনও জটিল কিছু নয়। মা যদিও বলেছিল, তোর এই জটিল যন্ত্রের মাথামুন্ডু কিছু বুঝি না।

মায়ের কথা থাক। যন্ত্রের কথায় আসি। এই যন্ত্রের নিচে কিছু পাখা আছে সেগুলো বাইরের হাওয়া জড় করে রাখে গাড়ির নিচে। তারপর পেছনের খুব সরু একটা ছিদ্র খুলে দেয়। এই পর্যন্তই ইঞ্জিনের কাজ। এরপর বাকি কাজ সব করে প্রকৃতি। সেই ছিদ্র পথে প্রচুর বাতাস বেরিয়ে যাবার সময় সে চাপ দেয় আর গাড়ি এগিয়ে যায়। বেশ খানিকটা জেটের মত। তবে জেটের প্রোপেলারকে যথেষ্ট উত্তপ্ত করতে হয়। কিন্তু এখানে সে সব ব্যাপার স্যাপার নেই।

মা বলল, এসব ব্যাপার স্যাপার আমি বুঝি না বাপু। তোর গাড়িটা ভারি সুন্দর হয়েছে এটাই ঢের।

মা গরম সিঙ্গাড়া এনেছিল। রান্নাঘরে ঢুকে গেল সেগুলো গোছগাছ করে আনতে। কিন্তু সে আসার  আগেই একটা মেল এসে গেল তার মোবাইলে।

এই জায়গাটা একেবারে নির্জন। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে। লোকালয় এখানে ভয়ানক জঙ্গলের কাছে এসে থমকে পড়েছে। থমকে মাঝে মাঝে পড়ে কিছু মানুষও। তবে সে বড় কম। আলেকালে। হয়ত মাসে দুটো কি একটা। এই জঙ্গলে বেশ বড় একটা জামরুল গাছে চাক হয়। সে চাকের খবর পেয়ে হৈ হল্লা করে ভাঙ্গতে আসে কিছু লোক।

তাদের কিছু লোক দেখেছে নৌকোয় বসে থাকা এই লোকটাকে। পরণে জেলেদের মত লুঙ্গি গুটিয়ে পরা। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। কবে কেচেছিল কে জানে। গায়ের রঙ সত্যিকারের ময়লা নাকি চড়া রোদের তাপে তামাটে হয়ে গেছে সেটা তর্কের বিষয়।

দৃষ্টিতে একটা সদা-কৌতূহলী ভাব। কী যেন ভাবছে আর মনে মনে অঙ্ক করছে। কেউ কেউ তাকে নাকি আবার খুব যত্ন করতে দেখেছে পানাগুলোকে। লোকে তো আগাছা উপড়ে ফেলে দেয়। এ লোকটা আবার আগাছা পালন করে মনে হয়। কী দরদ! চাষি নাকি? এ কেমন চাষি যে শাক-সজি ভেষজ উদ্ভিদ না পুঁতে পুঁতছে কিনা কচুরি পানা, কুঁচো পানা আর আগাছা। হাতে জাল বা ছিপ কেউ কখনও দেখে নি।

তার মানে লোকটা মাঝি নয়, জেলেও নয়। তবে যেটা বাকি থাকে সেটা--

প্রচন্ড গরম। গায়ে জামা রাখা যায় না। সেজন্যে স্যান্ডো গেঞ্জিতেই একটা পকেট রাখতে হয়েছে মানুষটাকে। আর পকেটে রাখতে হয়েছে মোবাইল। আর মোবাইল তো দরকারের জন্যেই। সেই দরকারেই বার করতে হল সেটা।

কল রিসিভ করেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল পাগলটা, যাক ইমেলটা পেয়েছিস তবে। আমি ভাবলাম নেট যেমন স্লো হয়ত পৌঁছতে অনেক দেরি হবে।

ওদিক থেকে কী একটা বলল। পাগলটা চুপ করে শুনে গেল। তারপর বলল, হ্যাঁ অনেকটা এগিয়ে গেছি। তুই এসে দেখে যেতে পারিস।

আবার কথা শুনতে লাগল লোকটা। তারপর ফোন গুটিয়ে রেখে দিল গেঞ্জির পকেটে। গোটানো মনটা আবার মেলে দিল নিজের কাজে।

আজকাল মিডিয়া অন্য সব খবরে এমন ঝাঁপিয়ে পড়েছে যে কিছু কিছু খবর তাদের প্রচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ একদিকে তেমন শাপে বরই বলা যায়। অতিরিক্ত প্রচারের আলোয় এলে অনেক কাজ পণ্ড হবার পথে চলে যায়।

কিন্তু তবু খবরটা বেরোল। একটা ছাপা খবরের কাগজে। সেই পাগলটার একটা ছবিও ছাপা হল। সে নাকি প্রথমে ছবি দিতে বেজায় আপত্তি করে। বলে, দয়া করে আমার কাজে বিঘ্ন ঘটাবেন না। রিপোর্টার একটু রসিকতা করে বলেছে, ভাববেন না। আপনার এই আগাছা পোষার কাজ আমরাই প্রচার করে দেব।

তা সে খবরে কেউ পাত্ত দিল না দেখে রিপোর্টার আর এদিক মাড়ায় নি। কিন্তু এক টিভি চ্যানেল যে সর্বদা ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো এইসব ঘেঁটে ঘেঁটে বেড়ায় তারা এসে তো খুঁজেই পেল না মানুষটাকে। কিন্তু বুম হাতে তারা তল্লাসি বজায় রাখল। আর না পেয়ে শেষে বলল, আমরা যে ভূতটার সন্ধানে এসেছিলুম সে এখন বেপাত্তা। আসলে কি জানেন ভূতেরা প্রচার একেবারে চায় না।

এরপর তারা সেই ডোবাটার চারিদিকে বড় বড় ঘাস আর আগাছা্র মধ্যে দিয়ে বিস্তর হাঁটাহাঁটি করে বুম উঁচিয়ে বলল, চ্যানেলের প্রিয় দর্শকগন, দেখতেই পাচ্ছেন সেই আগাছা ঘাঁটা পাগল ভূত আমাদের দেখে পিঠটান দিয়েছে। কিন্তু আমরা তো এত সহজে ছাড়াবার পাত্র নই তা আপনারা জানেন। সত্যিটাকে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে আপনাদের পাতে পরিবেশন করাই আমাদের মহান কর্তব্য। অতএব আমরা চললুম জঙ্গলে। আপনারা সঙ্গে থাকুন।

চিনু পাকড়াশি এই অঞ্চলের বিখ্যাত চোর আর পাচারকারী। ছোটখাট জিনিস পাচারের পরে তার স্বপ্ন একজন সফল হীরে পাচারকারী হবার। খবরের সন্ধানে যেমন তাকে অনেক কাগজ পড়তে হয় তেমনি দেখতেও হয় অনেক খবরের চ্যানেল। যে কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল সেটা তেমন একটা বড় কাগজ নয়। তবে মাঝে মাঝে তক্কে তক্কে থাকে এইসব অফবিট কিছু ছেপে সার্কুলেশন বা প্রচার বাড়াতে। কিন্তু প্রচার বাড়ে নি এই কাগজের। মধু মাইতি একটা মুদি দোকানের মালিক এই কাগজ রাখে। কেউ পড়ে না তবু সে রাখে। কারণ মশলা পাতি দেবার জন্যে তাকে তো কাগজ কিনতেই হবে। যদি সেটা সস্তা হয় তো মন্দ কী?

চিনু এই দোকানে রোজ আসে। এই কাগজটা পড়ে। অনেক উদ্ভট খবর থাকে এই কাগজে। আর তার ব্যবসাও তো উদ্ভট কিছু নিয়ে।

ভাল করে খবরটা পড়ল সে। তার মনে হল লোকটা মোটেই পাগল নয়। তার এই পাগলামির আড়ালে অন্য কিছু আছে। সম্ভবত এই সুযোগে দামি কোনও জিনিস পাচার করছে। সোনা, সোনার বাট বা টাকা অথবা হীরে কিংবা কোনও হেরিটেজ জিনিস। কোনও দুস্প্রাপ্য জিনিস যেমন কোনও বিখ্যাত মানুষের ব্যবহৃত জিনিস বা কোনও মূর্তি এইসব।

নিউজ চ্যানেল পাগলটার ছবি তোলার অনেক চেষ্টা করেও পারে নি। কিন্তু খবরের কাগজে ওরা ছাপিয়েছে। সম্ভবত তারা না জানিয়ে ছদ্মবেশে গিয়ে থাকবে আচমকা। যদিও কাগজে ছাপানো জিনিস বোঝা খুব দুস্কর তবু তার চেষ্টা চিনু করবেই। জায়গাটা সে বেশ ভাল করে বুঝে নিয়েছে। এবার কোপ নিয়ে ঝোপে হানা দেওয়াটা বাকি।

একটা মাঝি সেজে খালি গায়ে লুঙ্গি হাফ করে পরে আর একটা গামছা মাথায় ফেট্টি করে বেঁধে সে চিনু চলল এক মাঝির সহকারি সেজে। আবার তাকে কেউ জেলের সহকারীও ভাবতে পারে এমনই তার ড্রেস। আর পাগলরা তো সকলকেই সহকারী ভাবে।  

তার ভাগ্য ভাল দেখা মিলেছে পাগলটার। আজ একটা এস্পার কী ওস্পার করে ছাড়বে চিনু। লোকটার পেট থেকে কথা আদায় করা চাই। পাগলটা তখন নৌকোর মাঝে বসে আছে। নৌকোটা তো পুকুরের মাঝে। লোকটার হাতে আবার কিসের যন্ত্র। আরিব্বাস ভারি ধান্দাবাজ তো। কিন্তু এই আদাড়ে পাঁদাড়ে কি কখনও দামি জিনিসের পাচার হয়? লোকে তো দেখে ফেলবে।

আবার ভাবল মনে হয় এ লোকটা অন্য ধান্দায় মেতে আছে। এই পুকুরের নিচে কি আছে? পাঁকাল মাছ নাকি কোনও রহস্য। নৌকো এখন মাঝখানে। নিশ্চয় যন্ত্র দিয়ে গভীরতা পরীক্ষা করছে। ভেতরে একটা কিছু আছে তো বটেই।

-কত্তা বড় মাছ পাইলেন নাকি?

চমকে লোকটা তাকাল পাড়ের দিকে। দাঁত বার করে হা হা করে হেসে বলল, হ হ। তুমার খাওনের লগি। খাইবা?

তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। চিনু খুব খুশি। এবার লোকটাকে কব্জায় এনে তার কাছ থেকে ফন্দিটা আদায় করতে হবে। ঘাড় নাড়ল খুব জোরে। আমার কাছে জাল, ছিপ সব আছে। খুব জবরদস্ত কত্তা।

লোকটা ছিপ নৌকোটাকে দ্রুত পাড়ে নিয়ে আসতে লাগল। এত তাড়াতাড়ি কী করে এই ঘন পানায় ঢাকা পুকুরে আসতে পারে ছিপটা? চিনু তো খুব অবাক। পাড়ে আসতেই উঠে পড়ল। আবার নৌকো চলল মাঝ পুকুরের দিকে। চিনু বলল, পানায় নাও আটকায় না কত্তা?

লোকটা হেসে বলল, কান পাইত্তা শোন।

হ্যাঁ একটা খুব মৃদু শব্দ আসছে কোথা থেকে। খুব সামান্য ঘট ঘট ঘট ঘট--

চিনু অবাক হয়ে বলল, মটরে চলে নাকি কত্তা?

-হ। নইলে এই পানা ঠেইল্যা যাওয়া দুস্কর না?

তা ঠিক। কিন্তু মটর পুড়িয়ে নৌকো আবার মাঝপুকুরে গিয়ে হাতের এক যন্ত্র দিয়ে কী যেন মাপজোক। চিনু কিচ্ছু বুঝতে না পেরে বলল, এই বাদা পুকুরে আর পার হবার লোক কোথায়? যদি বল তো বক্সিগঞ্জের পারঘাটায় তোমাকে মাঝি কইরা দিতে পারি। আমাকে শুধু তুমার এসিস্ট্যান্ট রাখবা বল?  

একটু থেমে বলল, তা এখানে ব্যাপার স্যাপার কি? জালে মাছ নাকি অন্য কিছু?

ততক্ষণে নৌকো আবার চলতে শুরু করেছে। এবার বেশ জোরে শোঁ শোঁ করে পানার ভীড় কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে। তবে সোজা সেই জঙ্গলের দিকে। চিনু তো ভয়ে সারা, কত্তা এ কোথা লিয়ে যাচ্ছ?

ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকাল সেই লোকটা, চুপ! হীরে জহরত দেখবা না?

মহারত্ন তখন বারান্দায়। একটু আগেই মা এসেছে বাজার থেকে সিঙ্গাড়া নিয়ে। এই জিনিসটা খুব ভালবাসে সে। বলে, মায়ের হাতের আনা সিঙ্গাড়া খেলে আমার মাথায় কেমিস্ট্রিটা ভাল জমে।

মা হেসে বলল, তা যা চমৎকার এক গাড়ি আবিষ্কার করেছিস তুই তাতে করে ঘন্টায় ঘন্টায় বাজার যেতেও ভাল লাগে রে। কি সুন্দর গাড়ি। তেল লাগে না, জল লাগে না বিদ্যুৎ লাগে না। কিছুই লাগে না।

-হা হা হা ভুল বললে মা। হাওয়া আর রোদের কথাটা বাদ দিলে হবে? ওগুলো লাগে। হাওয়া লাগে জেট সিস্টেমে আর রোদ লাগে পাম্প চালিয়ে জেটে হাওয়া ভরতে। বাকিটা ঠিক আছে।

মা তো হিউম্যান সাইকোলোজির অধ্যাপিকা। তার কাজ মানুষ নিয়ে। আর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মহারত্নের কাজ রসায়নের যন্ত্র নিয়ে। মা চলে গেল রান্নাঘরে আর ছেলে মন দিল সামনের প্যাডে। সে আপাতত ব্যস্ত হয়ে রইল রাসায়নিক বিক্রিয়া লেখা পাতায়। ফর্মূলা, বিক্রিয়া আর অংকে সে পাতা ভর্তি।

এমন সময় মেলটা এলঃ কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ভাল সহকারী জুটিয়েছি। শুধু শাক সেদ্ধ আর ভাত। জঙ্গলে আর কী পাওয়া যাবে?

একটা অদ্ভুত খোলা গাড়ি আকাশে পাক খাচ্ছে। গাড়িতে সওয়ারি এক। চালক সে নিজেই। পুকুরের কাছাকাছি আসতেই দেখল এক অদ্ভুত জিনিস। অরোরা বোরিওলিস? মেরুজ্যোতি নাকি? পুকুরের ওপরে আন্দাজ প্রায় তিনশ মিটার ওপরে একটা অদ্ভুত মেঘ। হালকা সবুজ রঙের একটা ফিনফিনে পর্দা যেন কেউ টাঙ্গিয়ে দিয়েছে।

নিচে মাঝপুকুরে সেই ছিপ নৌকোর ওপরে বসে সেই পাগলাটা। আরও একজন। একে চেনে মহারত্ন। কিন্তু এ লোকটা এখানে কেন? মহারত্নের মোবাইল একটা গান গেয়ে উঠতেই সেটা সে ধরল।

-তুই এসেছিস?

-হ্যাঁ।

-খুব ভাল হয়েছে। এই ছিপের ওপর তোর স্কাই কার জায়গা পাবে না। আমি ছিপটা পাড়ে নিয়ে যাচ্ছি। তুই ল্যান্ড কর।

মহারত্ন কাছে একটা জায়গায় ল্যান্ড করল। ছিপ দ্রুত এগিয়ে গেল সেই দিকে।

মহারত্নের স্কাই কার যে নীতিতে কাজ করে এই ছিপ নৌকো ঠিক কাজ করে একই নীতিতে। সৌরশক্তি চালিত পাম্প নৌকোর নিচের একটা ট্যাংকে জল জড় করা হয়। তারপর সরু নোজল খুলে সেই জল বার করার চেষ্টা করলেই নৌকো উল্টোদিকে গতি পায়। তবে এখানে অবশ্য জল গরম করে বাষ্প করতে হয়। তাই হিটার লাগে। কারণ আকাশ গাড়ির ক্ষেত্রে ঘর্ষণ বাধা যত তার থেকে অনেক বেশি জলে।

নৌকোয় উঠেই চিনুকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল মহারত্নের। একটু ব্যঙ্গ করে বলল, এই পানা পুকুরে কিছু হেরিটেজ পাওয়া যায় না চিনু যে তাকে পাচার করে পয়সা লুঠবে।

বেশ রেগেছে সে। তার দোষ কী। আসলে চিনুর খ্যাতি এখন বহুদূর পর্যন্ত ছড়ান আছে। সকলের সন্দেহের জালে সে আটকা আর পুলিশ তো বটেই। তার মামা বাড়ি যাওয়ার চান্স এই এবেলা নয় তো ওবেলা গোছের। রাজবংশী বাড়ির একশ বছরের রাধাকৃষ্ণের হার কিংবা শারদা মিউজিয়ামের শা-জাহানের আমলের হীরে সব গেছে এর পেটে বলেই সন্দেহ।

রেগে গিয়ে সবুজ নন্দীর দিকে তাকালো মহারত্ন, হ্যাঁরে এ তোর কিছু হাতায় নি তো?

সবুজ হাসল, পাবে কি যে হাতাবে? তবে-

-তবে?

-হাতাতেই এসেছিল। আমাকে জালে ফেলতে এসে নিজের জালে নিজেই ফেঁসে পড়েছে। আমার সঙ্গে এই পানাপুকুরের পেঁকো মাছ আর কলমি সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেতে হচ্ছে।

মহারত্নের বিশ্বাস হয় না কিছুতেই। বলে, তুই জানিস না পুলিশ ওকে কবে না কবে ফাটকে পুরবে তার ঠিক নেই। রাজবংশীবাড়ির সেই রাধাকৃষ্ণের হার যেখানে বেচেছিল সেখানের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। এবার না তুই-

চিনু হাত জোড় করে বলল, মাইরি বলছি ওসব রটনা।

-ধরা তো সে পড়েছে-

-মানে?

-ধরা পড়েছে সবুজের ফাঁদে। নইলে কি আর ওই সবুজ ঘাসপাতা মুখে রোচে?

চিনু এসে হাত জোড় করে মহারত্নকে বলল, পুলিশ এসে ধরে তো ধরুক। তার আগে একটা ভাল কাজে সঙ্গ তো দিয়ে গেলুম কত্তা।

মহারত্ন হাঁ একেবারে।

সবুজ বলল, এই ছটা মাস কি দুর্ভোগে যে কেটেছে। একা হাতে এই পাঁক আর পানা ঘেঁটে শরীরের বোধহয় আর কিছু থাকবে না এটাই ধরে নিয়েছিলুম। তুমি তো তোমার ফ্যাকটরির চাকরি নিয়েই আছ। অবশ্য ইকুয়েশন লিখে আর অঙ্ক করে দিয়ে আমাকে অনেক সাহায্য করেছ। কিন্তু লোকবল তো চাই।

মহারত্ন বলল, তাই বলে-

-এ শর্মা এল। একে আমি চিনি ভাল করে। এখানে পাচার করার কিছু নেই বটে, তবে আমার এই গবেষণার খবর পাচার হওয়াটাকেও তো আটকানো চাই? নইলে এ বেটা মিডিয়ায় গিয়ে ফাঁস করে দিলে সব গুলিয়ে গু হয়ে যাবে। বললুম এই পুকুরের নিচে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। এক হীরের খনি। আমি জরিপ করার কাজ করছি। যদি বার করতে পারি তো আধা আধি বখরা।

-তারপর?

-তারপর আর কি। তাকে দিয়েই এই সবুজ বহনের সব কাজ করেছি। যে পানা আর আগাছার চাষ হচ্ছে তা হল ক্লোরোফিলের অন্তহীন সম্ভার। এই ক্লোরোফিলের প্রসেসিং হচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে। একটা ফ্যাকটরি বানিয়েছি সেই সবুজের রাজত্বে।

-তারপর তারপর?

-আগের অনেকটা তো তুমি জান। তোমার কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে লাগিয়েছি। ক্লোরোফিল অ্যাটোমাইজ হয়েছে।

-আরে ইয়েস ইয়েস। এবার বুঝেছি, সোৎসাহে বলে উঠল মহারত্ন, তুমি মাথার ওপর খুব হালকা একটা ক্লোরোফিলের মেঘ বা ক্লাউড তৈরি করেছ?

-হ্যাঁ, খুব হালকা। এর মধ্যে দিয়ে সূর্যের র‍্যাডিয়েশন কম হবে। তাপ আর আলো দুই আটকা পড়বে ক্লোরোফিলের এই ফিনফিনে হালকা চাদরে। একটা ছাঁকনি বলতে পার। এখন তো দুপুর সাড়ে বারটা। যত তাপ লাগার কথা তা কি লাগছে তোমার? থার্মোমিটার রিডিং নিয়ে দেখ অন্তত চার সাড়ে চার ডিগ্রী টেম্পারেচার কম।

-হ্যাঁ হ্যাঁ রোদের রঙটাও বেশ একটু মিষ্টি লাগছে।

-ক্লোরোফিলের এই মেঘবলয় যেমন সূর্যের র‍্যাডিয়েশনের তেজ কমাবে তেমনি কার্বন ডাই-অক্সাইডকেও ভেঙ্গে অক্সিজেন করবে। বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বাড়বে আবার অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প খতম করবে। এই দুটো গ্যাস সবচেয়ে বড় গ্রীন হাউস গ্যাস। কথায় বলে না লোহায় লোহা কাটে। আমিও তাই গ্রীন দিয়ে গ্রীন হাউস গ্যাস মেরেছি। দেখ যদি হিউমিডিটি মাপা হয় দেখবে এখানের হিউমিডিটি এই গ্রীন ক্লাউডের রেঞ্জের বাইরের হিউমিডিটির থেকে অনেক কম। তাই গরমে গায়ের ঘাম আর আটকাবে না। যত গায়ের ঘাম বাড়বে তত শরীরের স্বস্তি বাড়বে। বডির টেম্পারেচার রেগুলেটেড হবে।

মহারত্ন যন্ত্র বার করে পটাপট অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর জলীয় বাষ্পের শতাংশ মেপে ফেলল। সবুজের পিঠ চাপড়ে বলল, স্প্লেন্ডিড ভাই! মিরাকুলাস।

-এখন আমাকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। এখন এই ক্লোরোস্ফিয়ার--

চোখ বড় বড় করল মহারত্ন, আয়নোস্ফিয়ার, ওজোনোস্ফিয়ারের মত--

-ইয়েস এটা হবে ক্লোরোস্ফিয়ার। তবে এখনও হয় নি। হবে যখন এই ক্লাউডকে টেনে আমি আরও বেশ কয়েক হাজার কিলোমিটার ওপরে তুলে দিতে পারব। আর-

বন্ধুর সাফল্যের গর্বে হাসিতে মুখ ভরিয়ে মহারত্ন বলল, আর?

-সূর্যের তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্লোরোফিল ক্লাউডের ঘনত্ব আর অন্য কিছু পরিবর্তিত হবে। গরম কালে যেমন বেশি রোদ আটকানো দরকার ঠিক তেমনি কম আটকানো দরকার শীতকালে।

-ব্রেভো ব্রেভো! সত্যি পৃথিবীটা বাঁচল বোধহয়।

চিনু ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, আমি এই সুখবরটা পাচার করতে পারি কি স্যার?

দুজনের মুখেই হাসি। হো হো করে হেসে উঠে সবুজ বলল, আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর বাবা চিনু। আমার গবেষণা পত্রই সেটা ফাঁস করবে। আশা করি আর কয়েকটা সপ্তাহের মধ্যেই গবেষণার কাজ শেষ হবে। ততদিন পর্যন্ত ধৈর্যটা একটু বরং ধরেই রাখ।

এমন সময় আকাশে খুব সামান্য শব্দ। মহারত্নের আকাশ যান বেশি শব্দ করে আকাশে ওড়া পছন্দ করে না। এসেই পারে দাঁড়িয়ে গেল। সবুজ তার ছিপটা দ্রুতগতিতে পাড়ে এল। মহারত্নের মা হেসে বলল, আমি সবুজের মেলটা দেখেছিলুম। মহা যখন ড্রেস পরছিল এখানে আসার জন্যে।  এ কী কাজ করেছিস বাবা সবুজ। তুই তো আমাদের পৃথিবী মাকে মরার হাত থেকে কয়েক ধাপ বাঁচিয়ে দিলি।

সবুজ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, এখন কাজ অনেক বাকি আছে মাসিমা।

-ও সে আমার আশীর্বাদে হয়ে যাবে। কথাটা বলেই স্নেহময়ী সামান্য কুন্ঠার সঙ্গে বলে উঠল, তুই তো আবার বিজ্ঞানী। তা এসব মায়ের আশীর্বাদ টাশির্বাদ বিশ্বাস করিস তো? নাকি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিস?

                               

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb