আমি আর আমরা

লেখক - ডঃ শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

-তারা আসে। প্রতিদিন‌ই আসে। প্রতিক্ষণেই তারা আসে। মাঝেমাঝে মনে হয়, তারা আশেপাশেই ঘাপটি মেরে থাকে। আবার কখনো নিজেকে ওদের সাথে গুলিয়ে ফেলি। আমি যে আমি, আমার অন্য কোনো রূপ নয়, তা পরীক্ষা করে দেখতে বারবার নিজেকে চিমটি কাটতে হয়। ভুল বললাম। আগে ওতে কাজ হত।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে একটু থামলাম। ডাক্তার বললেন, 'আগে কাজ হত? এখন হয় না? এখন কিসে কাজ হয়?

-এখন একটা ব্যাজ ব্যবহার করি। এই যে…

হাত বাড়িয়ে ডাক্তারকে দেখাই ব্যাজটা। ডাক্তার দেখেন। বিভিন্ন বীজগাণিতিক আর ত্রিকোণমিতির চিহ্ন দিয়ে ওতে একটা সমীকরণ লেখা আছে।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, 'মানে কি এর?'

-আমার বানানো একটা প্রোটিন অণুর ফোল্ডিং কাইনেটিক্স মাপার সমীকরণ। এই সমীকরণে পৌঁছনোর পরেরদিন থেকেই ওরা আসে। কাজেই আমার ধারণা হয়েছে, সমীকরণটা কিভাবে তৈরি হয়েছে সেটা ওরা জানে না। প্রতিবার নিজেকে পরীক্ষা করার সময় তাই এই ব্যাজটা বুকের ভিতরের পকেট থেকে বার করি, আর মনে করার চেষ্টা করি সমীকরণ তৈরির কোনো একটা আদিম ধাপকে। যদি মনে পড়ে যায়, তাহলে তো আমি আমিই।

ডাক্তার হাসলেন। প্রশ্ন করলেন, 'আর যদি না মনে পড়ে…?'

-এরকম এখন‌ও পর্যন্ত হয়নি। তবে হবে, খুব তাড়াতাড়ি হবে, মনে হচ্ছে।

'আপনি আগে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?'

-দেখিয়েছি। সবার এক‌ই বক্তব্য, আমি জেনোফোবিয়ার শিকার। জেনোফোবিয়ার ওষুধ এই তিনহাজার কুড়ি সালেও আবিষ্কার হয়নি।

'জেনোফোবিয়া। হ্যাঁ, হতে পারে। জেনোফোবিয়ার অর্থ জানেন তো? ভিন্ন জাতের মানুষ দেখে, এমনকি ভিনগ্রহের প্রাণীদের অস্তিত্ব অনুভব করেও অহেতুক ভয় পাওয়া। জেনোফোবিক হতে হতে একসময় জেনোসাইডের দিকে মোড় নেয় ঐ ভয়টা। যার ফল…'

-যার ফল আমরা বিগত সত্তর বছর ধরে ভুগছি। তাইতো? জানি ডাক্তারবাবু। কিন্তু জানা সত্ত্বেও আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা কি আটকাতে পেরেছিলেন সেই জেনোসাইড? সেই ধর্মে ধর্মে লাঠালাঠি, সেই দাঙ্গা, এর থেকে আমরা বাঁচিনি। সারা দেশ বাঁচে নি। গোটা পৃথিবী বাঁচে নি। সেই জেনোফোবিয়া অমূলক ছিল। আমার ফোবিয়া কিন্তু অমূলক নয়, ডাক্তারবাবু।‌ বিশ্বাস করুন। আমি বড় বিপদে, আমায় বাঁচান। আমি জানি না যে এই মুহূর্তে আমি বাদে আর কে এই বিপদের মধ্যে আছে! তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা একা আমার মধ্যে নেই‌। পরবর্তী শিকার যে আপনি হবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই ডাক্তারবাবু।

'আচ্ছা, বুঝেছি! আপনার বক্তব্য, আপনার মত দেখতে, হুবহু এক‌ই ব্যক্তি, আপনার ঘুম থেকে ওঠার আগে ও পরে বারবার আপনার কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করছে। আপনার ধারণা, অ্যাজ পার ইয়োর কেস হিস্ট্রি অ্যাজ আই লুক ইনটু, ওটা আপনিই। আপনি এক‌ই সাথে দুটো জায়গায় কিভাবে থাকতে পারেন? মানে, আপনি একজন সাধারণ মানুষ। এ দেশের সংবিধান একজন সাধারণ নাগরিকের বাল্ক এনট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানোর অনুমতি দেয় না। আর ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী আপনি বেআইনি কাজ কিছু করেন‌ও নি।'

-ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছেন ডাক্তারবাবু। ওগুলো আমিই। আমার এনট্যাঙ্গলড্ রূপ নয়। আদি ও অকৃত্রিম আমি। বিভিন্ন সময়ের আমি।

'ও, সমান্তরাল মহাবিশ্ব-গোছের কিছু একটা? প্যারালাল ইউনিভার্স? সে তো আমরা প্রতিদিন‌ই প্রতিক্ষণে যাতায়াত করছি।'

-একটু ভুল বললেন। যাতায়াত করছি না। পার করছি। স্টেশনের মত। সামনে অপছন্দের স্টেশন এলে পিছনে ফিরে কম অপছন্দের স্টেশনটা বেছে ঢুকে যেতে পারি না। সবকিছু আগের মত হয় না। কারো ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক হয়ে যায়। কারো একচুল এদিক-ওদিক। কিন্তু পার্থক্যটা তৈরি হয়। ছোট ফাটলের মত। তারপর গোটা কাচটা একদিন ঝরঝর করে ভেঙে যায়।

'শুধু ভেঙেই যায় কেন? জুড়েও তো যেতে পারে!'

-না ডাক্তারবাবু। ভেঙে যাওয়ার জন্য‌ই আমাদের জোড়া দেয়া হয়। এনট্রপি চায় যাতে আমরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মহাবিশ্বের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ি‌।

'আপনি তো জীবন নিয়ে সেই প্রোটিনের উক্তিটা মনে পড়িয়ে দিলেন।'

-কোন্ উক্তিটা ডাক্তারবাবু? সেই যে প্রোটিন গড়া আর প্রোটিন ভাঙার মাঝের ঘটনার নাম?

'হ্যাঁ। ওটাই জীবন। যিনি বলেছিলেন, মানুষ আজ তাঁর নাম মনে রাখেনি। কিন্তু এটাই আমাদের বর্তমান সভ্যতার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

-হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। ঠিক বলেছেন। যতদূর স্মৃতিতে আছে, বছর পাঁচেক আগে কোনো এক রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনী প্রচারে এই উক্তিটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে বিরোধী দলের মানুষ মারতে নৈতিক কুন্ঠাবোধ আমাদের না থাকে। তবে আমি আজকাল খবর খুব কম দেখি। মনে ভয় ছাড়া আর কিছু থাকে না। সেই নেতার নাম মনে নেই‌। একশো বছরের‌ও বেশি আগে যে বিজ্ঞানী ঐ উক্তি করেছিলেন, তাঁর নামও মনে নেই। আমার মনজুড়ে এখন শুধু ভয়, শুধুই ভয়।

'দেখুন, আমাদের জীবন একটা ঘটনা। বা বলা ভালো, একটা রাস্তা। সোজা নয়, আঁকাবাঁকা। সুতরাং রাস্তায় অনেক মোড় আছে। তেমাথা বা পাঁচমাথার থেকেও বহু, সংখ্যায় অসীম সেইসব মোড়ের মাথাগুলো। আপনি যেদিন পড়াশোনার বিষয় হিসেবে কাব্য ছেড়ে বায়োএঞ্জিনিয়ারিং বাছলেন, সেদিনই আপনি জীবনের রাস্তায় বেশ কয়েকটা মাথাওয়ালা মোড় তৈরি করলেন। এই প্রতিটা মোড়ে একেকটা আলাদা মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্স তৈরি হয়েছে। যে বিশ্বে আপনি কবি হতে পারতেন, আপনার অজান্তেই আপনি সেই বিশ্ব ছেড়ে এমন একটা বিশ্বে পদার্পণ করেন, যাতে আপনি একজন বায়োএঞ্জিনিয়ার। যে বিশ্বে আপনি অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে পারতেন, সে বিশ্ব ছেড়ে আপনি এমন আরেকটা বিশ্বে এসেছেন, যেখানে আপনি সুধাদেবীকে বিয়ে করেছেন। যে বিশ্বটা ছেড়ে এসেছেন, আপনি ভালো করেই জানেন সেটায় ফিরে আপনি যেতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে, আপনার মতে, সবকিছু আগের মত একরকম থাকবে না। তাহলে আপনিই বলুন, আপনার অন্য বিশ্বে থাকা রূপগুলো প্রতিক্ষণে কী করে আপনার সামনে প্রকট হতে পারে? এটা কিন্তু সাংঘাতিকভাবে অসম্ভব একটা ব্যাপার হবে!'

-অসম্ভব এখন আপনি ভাবছেন। আর একশো বছর পরে হয়ত এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হবে। আমার ধারণা, না, ধারণা বলব না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি এইরকম পরীক্ষার একটা সাবজেক্ট।

ডাক্তার হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন কিছুক্ষণ ধরে। এই দৃষ্টিটা আমার খুব চেনা ঠেকলো। কোথায় যেন দেখেছি এই ডাক্তারবাবুকে...এই দুটো চোখ আমার খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছিলো।

ডাক্তার খুব মোলায়েম গলায় আমায় আবার বোঝাতে শুরু করেন। আমার কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে, ঠিক যেন চেম্বারের ভিতর চারপাশের দেয়ালটা একটু একটু করে আমাদের টেবিল ঘিরে এগিয়ে আসছে। শুনতে পেলাম ডাক্তারবাবু বলছেন, 'সমান্তরাল বিশ্বের ব্যাপারটা আরেকটু বুঝুন। খামোখা উতলা হচ্ছেন আপনি। ধরুন, 'ক' সমান্তরাল বিশ্বের আপনি আর 'খ' সমান্তরাল বিশ্বের আপনি, এরা দুজনেই এক‌ই সময়ে এক‌ই জায়গায় থাকলেও একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। একেবারে শূন্য বললেও কোনো ক্ষতি নেই। কেন নেই? কারণ, 'ক' বিশ্বের আপনি, অর্থাৎ আপনার দেহের প্রতিটা অণু-পরমাণু ঐ বিশ্বের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে বাঁধা। 'খ' বিশ্বের বেলাতেও সেই এক‌ই কথা, কিন্তু সেই কম্পাঙ্কটা আলাদা। এখন যদি কোনোভাবে দুটো এরকম বিশ্বের মধ্যে তাদের কম্পাঙ্কদুটো এক করে মিলিয়ে দেয়া যায়, ঠিক বেতার-তরঙ্গ টিউনিং করার মত, একমাত্র তবেই 'ক' বিশ্বের আপনি, 'খ' বিশ্বের আপনার কাছে এসে আপনাকে জ্বালাতে পারে! পঞ্চাশ বছর আগেই এই থিওরি প্রমাণ করে দিয়েছে আমাদের কৃত্রিম কোয়ান্টাম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু ঐ মিলিয়ে দেয়ার ব্যাপারটাই এখনো প্র্যাকটিক্যালি আমাদের আয়ত্তে আসেনি।'

-আর ঠিক এইখানেই আপনি ভুল ভাবছেন, ডাক্তারবাবু।‌ ওটা আয়ত্তে এসে গেছে। তবে তাতে হাত পাকিয়েছে এখনকার কেউ নয়, ভবিষ্যতের কেউ। এবং তার ফলে বিভিন্ন সম্ভাব্য বিশ্বের আমি-রা, যারা জীবনকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে নিজেদের ব্যর্থ বলে মনে করে, সেই তারা শেষমেশ এই আমির উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। ওদের বক্তব্য, কেন আমি এই বিশ্বটা বানিয়েছি। এ বিশ্বে আমার সাফল্য ওরা সহ্য করতে পারে না, ডাক্তারবাবু। তাই ওরা আমায় মেরে ফেলতে চাইছে। আমি চাই, আপনি আমায় তার আগেই মেরে ফেলুন। ওই, ওই ব্যাটারাও তাহলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ওরা আমাকে ধরার আগেই আমি মিশে যেতে চাই এই বিশ্বে। যাব না, আমি যাব না ওদের বিশ্বে, হ্যাঁ, আমায় বাঁচান, মেরে বাঁচান, ডাক্তারবাবু।

ডাক্তার অদ্ভুত একটা শব্দ করে হাসলেন। এইবার সেই শব্দ শুনে আমার কেমন মনে পড়ে গেল, ওরকম হাসি আগে আমি হাসতাম। সুধা মারা যাবার পরে আর আমি হাসি নি। কোনোদিন‌ও না। সুধা বলত, এইরকম সুন্দরভাবে পৃথিবীর আর কেউ হাসতে পারে না! আমি সেটা শুনে শুনে এতটা বিশ্বাস করতে নিয়েছিলাম যে সেই বোধটা আমার চেতনায় গেঁথে গিয়েছিল। এই ডাক্তার কিকরে ঐ হাসিটা নকল করল!

আমি খুব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার ঐভাবেই হাসতে হাসতে ধীরে ধীরে মুখের মাস্কটা খুললেন। তাঁকে দেখেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠাণ্ডা জলের স্রোত বয়ে গেল! কে এটা? তিনি, মানে, আমি, হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরতে এগিয়ে আসছেন, নাকি, আমিই আসছি? চেম্বারের চারদিকের দেয়াল ছোট হয়ে আমায় বুজিয়ে ফেলতে চাইছে। অর্থাৎ ওরা আমায় ধরে ফেলেছে! নিজের অস্তিত্ব একেবারে মুছে যাবার আগে আমি চোখদুটো বুঁজে ফেললাম।

স্থান: সাল ৫৬০৫৪, কাল: গ্র্যান্ড ওয়ান মহাবিশ্ব, স্যাগিটেরিয়াস এ স্টার ব্ল্যাকহোল।

রিপোর্ট অনুযায়ী এই স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে, সেপিয়েন্সদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম, সমান্তরাল মহাবিশ্বে অনায়াস যাতায়াত সম্ভব হয়েছে, বাহ্যিক শক্তির ব্যবহার ছাড়াই। পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে স্থান ৩০২০-এর কাছাকাছি, একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপরে, যে নিজেকে সারাজীবন একজন সেপিয়েন্স হিসেবেই ভেবে এসেছে। এর গঠনগত উপাদান ছিল সম্পূর্ণ মানবদেহ। সুতরাং প্রমাণিত হয়েছে, মানবদেহের পক্ষে সমান্তরাল বিশ্বে যাত্রা এবং প্রত্যাবর্তন সম্ভব। তবে এর ফলে মানুষটার জীবনে এবং জীবন সম্পর্কে তার বোধে বেশ ভালোমত প্রভাব পড়ে। সে প্রভাব মানুষের পক্ষে ভালো না মন্দ, সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য আরো সাবজেক্ট চাই এবং সেগুলো আরো পিছনের স্থান থেকে সংগ্রহ করলে ভালো হয়, কারণ মোটামুটি স্থান ২০০০ পর্যন্ত সেপিয়েন্সদের ইতিহাস সংরক্ষণ করা গেছে।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb