ক্যালকুলাসের জনক লাইবনিজ

লেখক - বিকাশ মণ্ডল

                                  

নিউটন না লাইবনিজ --- ক্যালকুলাসের জনক কে? এটাই ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো বিতর্কিত প্রশ্ন। ব্রিটিশরা দাবি করতো নিউটন , জার্মানরা দাবি করতো লাইবনিজ। শেষে এই বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়াল। একই ধারণাকে পৃথক পৃথক প্রতীকের মাধ্যমে পৃথক পৃথক সময়ে প্রকাশ করেছিলেন পৃথক পৃথক দেশের দুই প্রথিতযশা গণিতজ্ঞ। লাইবনিজের পূর্বে নিউটনের হাত ধরে ক্যালকুলাসের সৃষ্টি হয়েছিল 1664-66 সময়সীমার মধ্যে। কিন্তু নিউটন তা প্রকাশ করেছিলেন লাইবনিজের পরে, 1693 সালে । অন্যদিকে নিউটনের পরে লাইবনিজের হাত ধরে ক্যালকুলাসের জন্ম 1672-76 সালের মধ্যে কিন্তু তিনি প্রকাশ করেছিলেন নিউটনের পূর্বে, 1684 সালে। কাজেই বিতর্কের কারণ ছিল স্পষ্ট এবং এই বিতর্ক শেষমেশ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। উভয়পক্ষের দাবি মেনে সবদিক বিবেচনা করে মহামান্য  আদালত নিউটন ও লাইবনিজ  উভয়কেই  ক্যালকুলাসের জনক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই থেকে বিশ্ববাসী উভয়কেই  ক্যালকুলাসের জনক হিসাবে মেনে নিয়েছে।   

একটিমাত্র প্রবন্ধে দুই দিগগজ গণিতজ্ঞের জীবনের কথা বলা কার্যত অসম্ভব। তাই আমি বেছে নিয়েছি নিউটনের থেকে চার বছরের ছোটো  লাইবনিজকে। 1646 সালের 1 লা জুলাই জার্মানির লিপজিগ শহরে এক শিক্ষিত ও প্রভাবশালী পরিবারে লাইবনিজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পুরো নাম গটফ্রিড উইলহেম লাইবনিজ(Gottfried Wilhelm Leibniz)। পিতা ফ্রেডরিক  লাইবনিজ(Friedrich Leibniz) ছিলেন লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক। মাতা ক্যাথেরিনা স্মাক(Catherina Schmuck) ছিলেন এক আইনের  অধ্যাপকের মেয়ে। 1652 সালে , লাইবনিজের বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর পিতা ফ্রেডরিক পরলোক গমন করেন। পিতার মৃত্যুর পর সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটি লাইবনিজ  উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তা হল তাঁর পিতার পার্সোনাল লাইব্রেরী । দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের ওপর বিভিন্ন  প্রকার বইয়ের দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল এই লাইব্রেরী। যেহেতু  লাইব্রেরীর বেশিরভাগ বই ল্যাটিন ভাষায় লেখা ছিল, তাই সেইসব বই পড়তে পড়তে খুব অল্প বয়সে লাইবনিজের ল্যাটিন ভাষার ওপর দখল জন্মায়। 7 বছর বয়সে লাইবনিজকে নিকটবর্তী নিকোলাই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। লাইবনিজ ছিলেন ব্যতিক্রমী প্রতিভাধর ছাত্র। মাত্র 12 বছর বয়সে তিনি ল্যাটিন ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও পদ্য রচনা করতে পারতেন।15 বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতার একসময়ের কর্মক্ষেত্র লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই  1662 সালে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতক এবং 1664 সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরের দুবছর আইন পড়া সম্পূর্ণ করে 1666 সালে 20  বছর বয়সে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করার আবেদন পত্র জমা দেন। কিন্তু অল্প বয়সের কারণে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রী দিতে অস্বীকার করলে তিনি লিপজিগ ত্যাগ করে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরের অ্যালডর্ফ বিশ্ববিদ্যালয়  (University of Altdorf) -এর কাছে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য আবেদন করেন। তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ “De Casibus Perplexis” এর জন্য অ্যালডর্ফ বিশ্ববিদ্যালয়  তৎক্ষণাৎ তাঁকে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। শুধু তাই নয় তাঁকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধও করা হয়। কিন্তু লাইবনিজ তা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবর্তে তিনি নুরেমবার্গ অ্যালকেমিস্ট সোসাইটির সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন। লাইবনিজের  কর্মজীবন ছিল বড়ো বিচিত্র। তিনি রাজনৈতিক আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টের কাউন্সিলর, লাইব্রেরিয়ান , ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদের অধিকারী ছিলেন।  গণিতবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, দর্শনবিদ্যা, ইতিহাস, অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন “Master of all trades’ এবং  যথার্থ অর্থেই  “Last Universal genious.”   

শুধুমাত্র গণিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। তিনি যে গণকযন্ত্রটি(Leibniz Wheel or stepped drum) আবিষ্কার করেছিলেন তা পাস্কালের তৈরি ‘পাস্কালাইন’ অপেক্ষা উন্নত।

পাস্কালের তৈরি গণকযন্ত্রে কেবলমাত্র  যোগ এবং বিয়োগ করা যায় কিন্তু লাইবনিজের গণকযন্ত্রে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ অর্থাৎ পাটীগণিতের চারটি মৌলিক প্রক্রিয়া করা সম্ভব। এমনকি তাঁর তৈরি গণকযন্ত্রে কোন সংখ্যার মূল নির্ণয় করা সম্ভব ছিল।

 a.b দ্বারা a ও  b এর গুণফল বোঝায়। এইভাবে দুটি রাশির মাঝে একটি ডট(Dot) দিয়ে গুণফল প্রকাশের কীর্তি তাঁরই।

আধুনিক দ্বিপদ সংখ্যা পদ্ধতির(Binary Number System) স্রষ্টা হলেন লাইবনিজ। তিনি তাঁর “Explanation of the Binary arithmetic” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কিভাবে 0 ও 1 -এর দ্বারা যেকোনো সংখ্যাকে প্রকাশ করা যায়।

তিনি দেখিয়েছেন যে      । তাঁর নামানুসারে বর্তমানে এটি ‘লাইবনিজের শ্রেণি’ নামে পরিচিত। 

তবে গণিতে তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হল ক্যালকুলাসের আবিষ্কার। 1684 সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “Ecta Eruditorum”  গ্রন্থে গণিতের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে।  অবকলন বিদ্যায় ব্যবহৃত  , dx, dy, চিহ্নগুলি এবং  সমাকলন বিদ্যায় ব্যবহৃত  চিহ্ন তাঁরই দেওয়া। দুটি অপেক্ষকের গুণফলের উচ্চতর ঘাতের অবকল সহগ নির্ণয়ের সূত্র তাঁর নামানুসারে “লাইবনিজের গুণফল সূত্র’ নামে পরিচিত।

সত্তর বছর বয়সে, 1716 সালের 14 ই নভেম্বর জার্মানির হ্যানোভার শহরে এই মহান গণিতজ্ঞের  জীবনাবসান হয়।

                                   

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb