সূক্ষ্ম যন্ত্র গলগি

লেখক - ড সৌমিত্র চৌধুরী

                                          

ছোট্ট যন্ত্র কিন্তু কাজ করে অনেক। কাজের রকম অনেকটা পোষ্ট অফিসের মত। জিনিষ গুলো পেয়ে বাছাই করে, তারপর প্যাকেজিং। এরপর সাপ্লাই। চাহিদা অনুযায়ী ঠিকানায় পৌঁছে দেয় বস্তু সম্ভার।

কী গ্রহণ করে, কোথা থেকে, কাকেই বা সরবরাহ করে? উত্তর দেবার আগে যন্ত্রটার পরিচয় পর্ব। 

যন্ত্রটার নাম গলগি। গলগি অ্যাপারেটাস কিংবা গলগি কমপ্লেক্স। যে নামেই চিহ্নিত হোক, আদতে এটি অতি সুক্ষ এক যন্ত্র অর্থাৎ অ্যাপারেটাস। নামটি উদ্ভট! কেমন এই যন্ত্র, কী কাজ করে, কোথায় থাকে? 

থাকে কোষের মধ্যে। কোষ বা সেল (Cell) জীবিত বস্তুর সংক্ষিপ্ততম রূপ। ল্যাটিন ভাষার সেলুলার (ছোট ঘর) থেকে সেল (কোষ) শব্দের উৎপত্তি। খুবই ক্ষুদ্র আর সুক্ষ গঠন কোষের। বাইরে মেমব্রেন বা পর্দা আর ভিতরে সাইটোপ্লাজম। অনেক যন্ত্রপাতি, প্রোটিন, লিপিড, নিউক্লিক অ্যাসিডের অবস্থান পর্দার ভিতর, সাইটোপ্লাজমে।

কোষের পরিচয় সহজে জানা সম্ভব হয়নি। তিনশ বছরের নিরলস গবেষণা ধীরে ধীরে উদ্ঘাটন করেছিল বহু রকম তথ্য। ‘কোষ’ বিষয়টির সম্পূর্ণ তথ্য উদ্ধার হয়েছে, এখনও বলা যাবে না। 

খালি চোখে দেখা যায় না। বেশীরভাগ উদ্ভিদকোষ বা প্রাণীকোষ (1-100 nm) নজরে আসে অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা লাইট মাইক্রোস্কোপের (Light microscope) সাহায্যে নিয়ে। লাইট মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রে আলোক রশ্মি (visible light) ব্যবহার করা হয়। আলোকরশ্মি ব্যবহার হয় না, এমন মাইক্রোস্কোপও আছে। যেমন, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। আলোকরশ্মির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রন রশ্মি বা ইলেকট্রন বিম।

সুক্ষ বস্তুকে জানতে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের খুবই বড় ভূমিকা। কোষের গঠন সম্পর্কে বহু তথ্য জানান দিয়েছে। কোষের ভিতর ক্রিয়াশীল যন্ত্রপাতির খবরও জানিয়েছে। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রমাণ করছে কোষের মধ্যে আছে বহু রকম অতি সুক্ষ যন্ত্র, ইংরাজিতে অরগানিল (Orgqnelle)। যেমন, নিউক্লিউয়াস, মাইটোকন্ড্রিয়া, লাইসোসোম, এন্ডোপ্লাসমিক রেটিকুলাম।  তেমনই একটি যন্ত্রের নাম, গল্‌গি অ্যাপারেটাস।

কী কাজ এর? দরকারি লিপিড এবং প্রোটিনকে কোষের উপযোগী করে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় গলগি কমপ্লেক্স। কে পাঠায় দরকারি এই সব উপাদান? পাঠায় আরেকটি সুক্ষ যন্ত্র, এন্ডোপ্লাসমিক রেটিকুলাম। গল্‌গি গ্রহণ করে প্রক্রিয়াকরণ করে প্রোটিন লিপিড ইত্যাদি অণু গুলোর। তারপর পরিমাণ মত, প্রয়োজন মত পৌঁছে দেয় অন্য বহু যন্ত্রের কাছে। যদি না পারে?  তখন বড় বিপদ। কোষের কাজে বিঘ্ন ঘটবে। ডেকে নিয়ে আসবে শরীরে অনেক অসুখ। অ্যালজাইমারস, পারকিনসন্‌স অনেক কিছুই ঘটতে পারে।

গলগির অস্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড সহজে জানা যায়নি। ক্যামিলো গলগি (Camillo Golgi, 1843-1926) (চিত্র ১) নামে ইতালির এক বিজ্ঞানী নার্ভ কোষ সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন। তিনি লক্ষ করলেন কোষের ভিতর সুক্ষ পর্দা দিয়ে ঘেরা রয়েছে অতি ক্ষুদ্র এক যন্ত্র। যন্ত্রের নাম দিলেন ইন্টারন্যাল রেটিকুলার অ্যাপারেটাস (1898)।

এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ সঠিক ভাবে ইন্টারন্যাল রেটিকুলার অ্যাপারেটাস-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিল। কালক্রমে বিজ্ঞান পরিভাষায় গল্‌গি কমপ্লেক্স (চিত্র ২, ৩) হিসাবে স্থান লাভ করল (1956) এই সুক্ষ যন্ত্র। আবিষ্কারকের নামেই যন্ত্রের নাম।

ব্যক্তির নামেই নামকরণ। আসলে অ্যাপোনিম (Aponym)। যেমন ভিক্টোরিয়া পার্ক, রানী ভিক্টোরিয়ার নামে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় বহু অ্যাপোনিম স্থান পেয়েছে। ভোল্ট, গ্যালভানাইজ, নিকোটিন, ডেসিবেল, অ্যালগরিদম। এ ছাড়াও কত রকম সূত্র চিহ্নিত হয়েছে বিজ্ঞানীর নামে। তেমনি অ্যাপোনিম, ‘গলগি’ শব্দটি।

ক্যামিলো গলগি। জন্মেছিলেন ১৭৯ বছর আগে, ইতালিতে। ৭ই জুলাই তাঁর জন্মদিন। প্যাথলজি এবং নার্ভ সংক্রান্ত অসুখে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

                                                     

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb