মহর্ষি সুশ্রুত ও প্রাচীন ভারতের প্লাস্টিক সার্জারির ইতিহাস

লেখক - শুভঙ্কর মজুমদার

১৮১৬ সালে ডাক্তার জোসেফ কনস্ট্যান্টাইন কার্পু প্রকাশ করেন একটি বই যার নাম ছিল ‘An account of two successful operations for restoring a lost nose from the integuments of the forehead’। সেই বইতে তিনি প্লাস্টিক সার্জারির উপর বেশকিছু গবেষণা প্রকাশ করেন। প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়টি তখন ইউরোপে ছিল একেবারেই নতুন বিষয়। কার্যত ডাক্তার জোসেফ কনস্ট্যান্টাইন কার্পু-ই প্রথম ইউরোপীয় যিনি প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে কোন বাক্তির কাটা নাক জোড়া লাগিয়ে দেন। সারা বিশ্ব এই বিষয়ে হতবাক হয়ে যায়। এই ঘটনা ইউরোপের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে। তবে জোসেফ কনস্ট্যান্টাইন কার্পু বলেন এই পদ্ধতি আসলে তার আবিষ্কার নয়, এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন ভারতের কিছু অজ্ঞাত মানুষ। কিন্তু ভারত তখন পরাধীন দেশ, তারা অসভ্য ও অশিক্ষিত জাতি, কালো চামড়ার নিগার, ওরা কি করে এই সব আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার করবে? বিজ্ঞান বিশেষ করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কেবল ইউরোপীয় জাতীর মতো শিক্ষিত জাতীর আবিষ্কার। জোসেফ কনস্ট্যান্টাইন কার্পু বললেন এই বিষয়টি তিনি নিজে জেনেছেন ১৭৯৪ সালের জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিনে ছাপা একটি রিপোর্ট থেকে।

এই বিষয়ে তারপর শুরু হয় অনুসন্ধান। ইংল্যান্ড থেকে বেশ কিছু বিজ্ঞানী ও ডাক্তারের দলকে পাঠানো হয় ভারতে। তাদের উদ্দেশ ছিল ভারতের এই প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টিকে ভুল প্রমাণ করা, কারন যাদের কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাদের পক্ষে এতো বড় চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। ১৭৯৪ সালের জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিনে ডাক্তার ক্রসো এবং ফিনল লিখেছিলেন "পুনের ‘কুমার’ সম্প্রদায়ের ভেতর এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিখুঁতভাবে কাটা নাক সারিয়ে দিতে পারে। তবে তাদের এই অস্ত্রোপচার পদ্ধতি তাদের নিজেদের আবিষ্কার নয়, বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় তারা এই জ্ঞান অর্জন করেছে। তবে কবে কে উদ্ভাবন করেছিলো এই পদ্ধতি, তা তারা নিজেরাও জানে না!" বিজ্ঞানী ও ডাক্তারদের সেই দল গেলেন সেই গ্রামে, আর সেখানে গিয়ে তারা অবাক! কি আশ্চর্য বিষয়, সত্যি এই অঞ্চলের মানুষরা শল্যচিকিৎসাতে বিশেষ পারদর্শী, অথচ এদের কোন ডাক্তারি ডিগ্রি নেই, নেই কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। তাহলে কি করে তারা পেলেন এই জ্ঞান? এই নিয়ে শুরু হল গবেষণা।

বিভিন্ন পুথি, নথি, বই ও লোককথার উপর ভিত্তি করে তারা আবিষ্কার করলেন তৎকালীন সময় থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির, যা আজকের সময় থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগের। হ্যাঁ, শুনতে অলৌকিক, কল্পবিজ্ঞান বা ম্যাজিক মনে হলেও আজ থেকে ২৮০০ বছর আগেই ভারতীয়রা প্লাস্টিক সার্জারির মতো জটিল বিষয় রপ্ত করে ফেলেছিল। এই আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিলেন ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসক মহর্ষি সুশ্রুত। তবে মহর্ষি সুশ্রুতের জন্মকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের ভেতরে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। হরিদ্বারের ‘পতঞ্জলি যোগপীঠ’ এ মহর্ষি সুশ্রুতের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে জীবিত ছিলেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তার জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছিলো খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালের ভেতরে কোনো এক সময়ে। টাকলামাকান মরুভূমির প্রাচীন এক বৌদ্ধবিহার থেকে পাওয়া গুপ্ত যুগের বাওয়ার লিপিতে উল্লেখ পাওয়া যায় মহর্ষি সুশ্রুতের। অর্থাৎ খুব কম করে ধরলেও খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সাল নাগাত তিনি প্লাস্টিক সার্জারির মতো জটিল বিষয় রপ্ত করে ফেলেছিল যা শিখতে ইউরোপিয়ানদের আরও ২৬০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়।

এক সময় বেনারস নগরী ছিল আয়ুর্বেদের পীঠস্থান। এই প্রাচীন বেনারস শহরে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালের ভেতরে কোনো এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহর্ষি সুশ্রুত। সেখানেই তিনি আয়ুর্বেদ ও অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি শেখেন। সেখান থেকেই তিনি শারীরের বিভিন্নও অংশের মধ্যে কি করে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণা ও চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি সেখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন চিকিৎসক হওয়ার। তার অনুসারীদের বলা হতো সৌশ্রুত। সমস্ত সৌশ্রুতকে ৬ বছর ধরে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। যার সিলেবাস ছিল অনেকটা এরকম, প্রথম ১ বছর শিক্ষার্থীদের শুধু পুথিপত্র পড়তে হত, পরবর্তী ২ বছর তারা তাদের শিক্ষক চিকিৎসকের সাথে বিভিন্নও চিকিৎসা পদ্ধতি দেখত, পরবর্তী ২ বছর তারা তাদের শিক্ষক চিকিৎসকের সহায়াক রূপে কাজ করতো ও রোগীদের চিকিৎসা করতো, শেষ ১ বছর তারা তাদের শিক্ষক চিকিৎসকের অধীনে অস্ত্রোপচার ও শল্যচিকিৎসা করতো, এবং শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পরে তাদের একটি শপথ নিতে হতো। পদ্ধতি গুলি ছিল ঠিক আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিদ্যার মতো।

শিক্ষার্থীদের বোঝার সুবিধার জন্য তিনি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করেন। এগুলো হচ্ছে,

১) ছেদন (excision)- কেটে বাদ দেওয়া। যেমন মারাত্মক ক্ষত হয়ে যাওয়া আঙুল বা নিরাময়ের অযোগ্য পা।

২) লেখন (sacrification)- কোনো একটি অংশকে দাগ কেটে আলতোভাবে চিরে ফেলা কিংবা কোনো ক্ষতের বাড়তি মাংস বা ময়লা ছেঁচে তুলে ফেলা।

৩) ভেদন (puncturing)- কোনো অঙ্গে বিশেষ যন্ত্র দিয়ে ছিদ্র করে পেটের গহ্বরে বা অণ্ডকোষে কিংবা মাংসপেশির মাঝে জমা হওয়া অস্বাভাবিক তরল ফেলে দেওয়া।

৪) এষণা (exploration)- আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না, এমন সব জায়গা যেমন দেহ গহ্বর কিংবা অসুখের ফলে সৃষ্ট সাইনাস সমূহ উন্মুক্ত করে পর্যবেক্ষণ করা।

৫) আর্য্যন (extraction)- উৎপাটন বা শরীরে ঢুকে যাওয়া কিছু (যেমন তীরের অগ্রভাগ) টেনে বের করা।

৬) সিবন(suturing)- অস্ত্রোপচারের পর উন্মুক্ত স্থান সেলাই করে দেওয়া। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় ঠিক এই কাজগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করা হয়।

মহর্ষি সুশ্রুত তার সকল গবেষণা লব্ধ জ্ঞান ও চিকিৎসা পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে যান তার বই সুশ্রুত সংহিতায়। বইটিতে মোট ১৮৬টি অধ্যায় রয়েছে, যার মধ্যে প্রথম পাঁচটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘পূর্বতন্ত্র’ এবং পরের অংশ গুলি নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘উত্তরতন্ত্র’। এতে প্রায় ১,১২০টি অসুস্থতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক আঘাতের ফলে সৃষ্ট বৈকল্য, বয়স বাড়ার ফলে সৃষ্ট অসুস্থতা, প্রসূতিদের সাথে সম্পর্কিত নানাবিধ রোগ, এমনকি মানসিক রোগের বিভিন্ন দিক এবং তার প্রতিকার সাথে চোখের ছানির অপারেশনের মতো সুক্ষ অস্ত্রোপচারের পদ্ধতির উল্লেখ আছে। পাশাপাশি রয়েছে ৭০০টি ওষধি গাছের বর্ণনা এবং তাদের ব্যবহার সাথে ৬৪টি খনিজ পদার্থজাত এবং ৫৭টি প্রাণীজ উৎসজাত ওষধি দ্রব্যের বর্ণনা এবং তাদের ব্যবহার। এই বইয়ের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির বিভিন্ন পদ্ধতি ও তাতে ব্যবহার করা যন্ত্রগুলোর বিবরন। এমনকি কীভাবে এই যন্ত্রগুলো তৈরি করা যাবে, তারও পদ্ধতি তিনি লিখে যান। তার শল্যচিকিৎসায় ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্রের নাম মণ্ডলাগ্র সূচিকা, কুশপত্র, উৎপল পত্র, শবরিমুখ কাঁচি, অন্তর্মুখ কাঁচি প্রভৃতি। সুশ্রুত সংহিতা এতটাই বিখ্যাত ছিলো যে এটি বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়। অষ্টম শতকে ‘কিতাব-ই-সুশ্রুত’ নামে আরবিতে অনুবাদ হয় এই বইটি। আরবি অনুবাদের এই বইটি মধ্যযুগের শেষে ইউরোপে পৌছায়। সেখানে নানা দেশ তাদের নিজস্ব ভাষায় এই বইটির অনুবাদ করে। সব শেষে কবিরাজ কুঞ্জলাল ভিষকরত্ন ১৯১৬ সালে সুশ্রুত সংহিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন ও আনুষ্ঠানিক ভাবে তা প্রকাশ করেন। হয়ত আমরা কখনোই আমাদের অতীতের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে জানতে পারতাম না, যদি না মহর্ষি সুশ্রুত আমাদের জন্য এই বইটি রেখে যেতেন। হয়তো প্রাচীন ভারতে আরও এমন অনেক আবিষ্কার হয়ে ছিল যা কালের গভীরে হারিয়ে গেছে। হয়তো তার আর কোন উল্লেখ ইতিহাসে নেই। প্রাচীন ভারতের এই সব ইতিহাস সত্যি এক একটা রত্ন ভাণ্ডার, যাকে রক্ষা করা সকল ভারতীয়র কর্তব। এই সব তথ্যই প্রমাণ করে যে ভারতীয়রা একটা সময় সারা বিশ্বের থেকে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে ছিল। তবে বর্তমানে সারা বিশ্ব মহর্ষি সুশ্রুতকে সান্মান জানিয়েছেন এবং তাকে অস্ত্রোপচারের জনক" বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় হিসেবে এটা সত্যি আমাদের কাছে একটা গর্বের বিষয়।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb