গল্প নয়

লেখক - ড. জয়শ্রী পট্টনায়ক

                                                

শেষপর্যন্ত পরিমলবাবুকে আসতে হল মুম্বাই র টাটা মেমোরিয়াল হাঁসপাতালে। নিজের শরীরকে আমল দেওয়ার বিশেষ সুযোগ পান নি এতদিন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। অসময়ে বাবাকে হারিয়ে পড়াশুনো সংক্ষেপে সারতে হয়েছে। অভাবের জ্বালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দেখতে না পেলেও ব্যাংকের ছোটখাটো চাকরিটা পেয়ে গেছিলেন অল্পবয়সে। সেই থেকে মায়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অফিসে ধাপে পদোন্নতির সাথে ছোট দুই ভাই বোন কে দাঁড় করাতে কখন যে যৌবন পার হয়ে গেল বুঝতেই পারেন নি। এখন এই মধ্য বয়সে পুরনো রোগটা যেন একটু বেশি জ্বালাচ্ছে। সেই কোন কিশোর বয়সের রোগ। মাঝে মাঝে পস্রাবের রঙ গাঢ় বাদামী হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা তলপেটে।

বয়ঃসন্ধিকালে পরিমলবাবুর অনিয়মিত পস্রাবের সমস্যা হত। তার জন্য অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। তাদের পরামর্শে এক ছোট্ট অস্ত্রোপচার করানো হয় এবং এর কিছুদিন পর শুরু হয় নতুন সমস্যা। মাঝে মাঝে মূত্রের রঙ হালকা বাদামী হয়ে যেত, সঙ্গে মৃদু ব্যথা তলপেটে। দু তিন দিন পর আবার সব ঠিকঠাক। উদ্বিগ্ন মা বাবা ছেলেকে নিয়ে ছোটেন ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসক তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেন -----          

  • খোকা বেশি করে জল খাও। ডিহাইড্রেশান এর জন্য এমনটা হচ্ছে।      

এরপর মা তাকে ঠেসে জল খাওয়াতে শুরু করেন। এভাবেই চলছিলো এতদিন। মাঝে মাঝে যখন পস্রাবের রঙ বদলে যেত তখন প্রচুর জল খেতেন।  দু তিন দিন পর আর কোন সমস্যা থাকতো না।  কিন্তু গত একবছর এই সমস্যা বেড়েছে। পস্রাবের রঙ গাঢ় বাদামি হয়ে যাচ্ছে এবং প্রচুর জল খেয়েও তা স্বাভাবিক হচ্ছে না। ডাক্তারি পরীক্ষার পর দেখা গেল পস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হচ্ছে অনিয়মিত ভাবে। প্রথমে তো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) ভেবে প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক ডোজ নিতে হল। তাতেও কিছু না হওয়াতে কিডনি ও লিভারের অসুখ ভেবে চলল নানান ওষুধ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু কিছুই হল না। শেষে পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ ঘোষাল বললেন------------     

- পরিমলবাবু, একবার মুম্বাই র টাটা মেমোরিয়াল হাঁসপাতালে চলে যান তো!  

অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠলেও পরিমলবাবু সাহস করে বললেন

-কেন? ভয়ের কিছু দেখছেন নাকি?

- আরে মশায়, একবার পরীক্ষা করে নিতে দোষ কি? ঠিকঠাক রোগ নির্ধারণ হলে, সঠিক ওষুধ পেটে পড়বে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই ভাল হয়ে যাবেন।  

অগত্যা ছুটি নিয়ে মুম্বাই এর ট্রেনে চড়ে বসলেন। বার বারণ করা সত্ত্বেও ছোট ভাই কিছুতেই দাদাকে একা ছাড়ল না, সঙ্গে এল।   

মুম্বাই র হাঁসপাতালে শুরু হল নানান পরীক্ষা । প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের চক্ষু চড়কগাছ। ঠিক দেখছেন তো!  ধন্দ কাটানোর জন্য জোর দিলেন নানান ধরনের ক্রোমোজোম সংক্রান্ত পরীক্ষার। এবার উপসর্গ ধরা পড়ল। পরিমল বাবু এক বিরল সমস্যায় আক্রান্ত। তার শরীরে পুরুষ যৌনাঙ্গ ছাড়া স্ত্রী – শরীরের ডিম্বাশয় ও জরায়ু র দুইই আছে। যাবতীয় পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারলেন যে পরিমলবাবু জন্ম থেকেই উভলিঙ্গ (intersex) । বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মাঝে মাঝে তাঁর মূত্রের রঙ পরিবর্তন-এর কারণ হল অনিয়মিত ঋতুস্রাব ।  

পরিমল বাবুর সাথে ডাক্তারের কথোপকথন সহজ ছিল না। যতটা সম্ভব বিশদ করে বিশেষজ্ঞরা বললেন যে ----------          

  • চিকিৎসা শাস্ত্রে আপনার সমস্যাটাকে এক বিরল জিনগত ত্রুটি বলে মনে করা হয়। এই ত্রুটি মানব শরীরের লিঙ্গজনিত বৈশিষ্টগুলো ওলটপালট করে দেয়। ইংরাজিতে একে ‘rare genetic disorder of   sexual development’ বলা হয় । এটা পুরুষদের এক বিরলতম সমস্যা, এবং এতে আক্রান্ত মানব শরীরে জন্ম থেকেই নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রজনন অঙ্গ থাকে। এদের উভলিঙ্গ বলা হয়। আপনার শরীরের নানান পরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত যে আপনি জন্ম থেকেই উভলিঙ্গ………। 

এতটা শুনেই পরিমলবাবু মাথাটা ভোঁভোঁ করে উঠলো। চারিদিকটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। কোন কথা কানে যাচ্ছে না শুধু ডাক্তারের ঠোঁট নাড়া দেখছেন। কতক্ষণ এভাবে কাটল খেয়াল নেই। ধীরেধীরে ডাক্তারের কথা কানে ঢুকতে শুরু করলো ----  

  • ………এখন পর্যন্ত ডাক্তারি রিপোর্টে ৩০০-৪০০ জন উভলিঙ্গ মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে এই পৃথিবীতে। আপনার বিরলতম শারীরিক গঠন অনুযায়ী পস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত অর্থাৎ ঋতুস্রাব এক স্বাভাবিক ঘটনা। এটা কোন রোগ নয়। বয়সের বাড়ার সাথে কয়েক বছরের মধ্যে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ হয়ে যাবে রক্তপাত।

এতক্ষণে ভাষা ফুটল পরিমলবাবুর মুখে। কাতর ভাবে বললেন----- 

  • অর্থাৎ আমাকে উভলিঙ্গ পরিচয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে? 
  • দেখুন যদি আপনি এটা মেনে নিতে না পারেন তবে অস্ত্রোপচার করে শরীরের মহিলা প্রজনন অঙ্গ বাদ দিয়ে আপনার বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তবে আপনার ডাক্তারি রিপোর্টে বলছে যে শীঘ্রই স্বাভাবিক ভাবে এই সমস্যার সমাপ্তি ঘটবে ।  

বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। সবাই জানতে পারলো যে ভয়ের কিছু নেই। শুধু ডাঃ ঘোষাল সত্যি টা জানলেন। দৈনন্দিন জীবন আগের মত চলতে থাকলেও মনের মধ্যে ঝড় চলছে পরিমল বাবুর। ৪০ বছর ধরে পুরুষ পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার পর এখন তাঁকে উভলিঙ্গ পরিচয়ে বাঁচতে হবে? নেট এ খুঁজতে লাগলেন এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত অনান্যদের চিকিৎসার খুঁটিনাটি। সময় পেলে চলে যেতেন ডাঃ ঘোষাল এর চেম্বারে -----আলোচনা করতে।

  • ডাক্তারবাবু, এখন পর্যন্ত ডাক্তারি পরীক্ষায় মাত্র ৩০০-৪০০ জন উভলিঙ্গ মানুষ পাওয়া গেছে এই পৃথিবীতে! তথ্যটা সত্যি?   
  • হুম, সংখ্যাটা বেশী ও হতে পারে। অনেকের ব্যক্তিগত আপত্তিতে ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়। আবার স্বাস্থের বড় কোন সমস্যা না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে লোকজন ডাক্তারের কাছে যায় না।     
  • এর কি কোন সঠিক চিকিৎসা নেই?    
  • দেখুন, সব উভলিঙ্গ পুরুষের শরীরে স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ একই ভাবে বিকশিত হয় না।  তাই শারীরিক গঠন অনুসারে বিভিন্ন উভলিঙ্গ ব্যাক্তির বিভিন্ন উপসর্গ থাকে। সুতরাং উপসর্গ অনুসারে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে যায়। বিশেষ শারীরিক সমস্যা না থাকলে অনেকে অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেন আবার অনেকে অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নেন।
  • ভারতবর্ষে কি এই ধরনের অস্ত্রোপচার সফল হয়?  
  • কেন হবেনা?  এই তো, কয়েক বছর আগে, সালটা যতদূর মনে হয় ২০১৭, রাজস্থানের উদয়পুরে ২০-২২ বছরের এক ছেলের এই ধরণের অস্ত্রোপচার হয়। তার সমস্যাটা একটু জটিল। তাই অস্ত্রোপচার করে তার শরীরের মহিলা প্রজনন অঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া আবশ্যক ছিল। এখন সে এক স্বাভাবিক পুরুষের মত বিয়ে করার কথা ভাবছে।  

অস্ত্রোপচার এর জন্য মানসিক ভাবে তৈরি হতে গড়িয়ে গেল দিন মাস বছর। ইতিমধ্যে পরিমলবাবুর ঋতুস্রাব নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে, যেমনটি মুম্বাই এর চিকিৎসকরা বলেছিলেন। অর্থাৎ কালের নিয়মে স্বাভাবিক ভাবে পরিমল বাবুর সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এখন তিনি আর পস্রাবের সমস্যায় ভোগেন না। অন্য পাঁচজন মধ্যবয়সী পুরুষের মত স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন।  

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb