মহাকাশে ঘোরার নিয়মকানুন

লেখক - ডঃ শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কী সুন্দর ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে! এসব দেখতে দেখতে তোমাদের নিশ্চয়‌ই ইচ্ছে করে পাখির মত ডানা মেলে উড়ে একদেশ থেকে আরেক দেশে যেতে? অথবা, রাতের জোছনা-ভরা আকাশে অগুন্তি তারা, গ্রহ দেখে কি একবারের জন্যও মনে হয় না: যদি লাফিয়ে লাফিয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদে, মঙ্গলে, বৃহস্পতিতে মানুষ যেতে পারত?

নিশ্চয়ই মানুষ পারবে একদিন। চাঁদে তো মানুষ পা ফেলেছেই সে আজ ষাট বছরের‌ও বেশি হয়ে গেছে। মঙ্গল-টঙ্গলেও পেরে যাবে। তোমরা তখন হয়ত আর আজকের মত ছোটটি থাকবে না! তোমাদের সেই বড়োবেলায় মানুষ হয়ত আকছার মহাকাশে ঘুরে বেড়াবে, রেস্তোরাঁয় খাবে-দাবে, এমনকি খেলাধূলাও করতে পারে। অবশ্য এসব করতে হয়ত অনেক টাকাপয়সা লাগবে, কিন্তু সে যাই হোক, কথা হচ্ছে, মানুষ একদিন এটা করেই ছাড়বে। এইতো এখন‌ই এইসব নিয়ে ব্যবসা করার জন্য পৃথিবীর বুকে অনেক ভ্রমণ-সংস্থা খোলা হয়েছে।

কিন্তু মহাকাশে ঘুরতে যাব বললেই তো আর কোম্পানি তোমায় গাড়ি করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে না, সে তুমি যত‌ই বড়লোক হ‌ও না কেন! মহাকাশে যেতে গেলে পৃথিবীর টান কাটিয়ে উঠতে হবে। তারপর সেখানে এমন জায়গা আসবে যে সেখানে কোনো গ্রহ-তারার কোনো টান কাজ করে না! ঘুরতে ঘুরতে আচমকা কোনো গ্রহ-তারার টানেও পড়ে যেতে হবে। পৃথিবীর বুকে আরামে আমরা যারা থাকি, তাদের পক্ষে এইসব টানাটানির মোকাবিলা করার কষ্টটা বোঝাই কঠিন। হুড়ুম করে যদি টান কমে যায় বা বেড়ে যায়, দুড়ুম করে মরে যেতে পারি আমরা। তখন আর ভ্রমণ করা কপালে স‌ইবে না! সেইজন্য যেমন এভারেস্টে চড়তে গেলে পাহাড়ে ওঠার শিখতে হয়, তেমনি মহাকাশে ঘুরতে গেলে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, জিরো গ্রাভিটির (Zero Gravity) মধ্যে বেশ কয়েক হপ্তা থেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ। 'জিরো', অর্থাৎ কিনা যেখানে 'গ্রাভিটি', মানে মাধ্যাকর্ষণ বল শূন্য।

এখন মাধ্যাকর্ষণ বল কাকে বলে সে তো তোমরা নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার গপ্পো থেকে শুনেইছো। তাই আমি আর তোমাদের কাছে সেই পণ্ডিতগিরি ফলাচ্ছি না! বরং তোমাদের যেটা জানতে খুব খানিক কৌতূহল হচ্ছে, সেইটা বলি। অর্থাৎ এই জিরো গ্রাভিটির জায়গাগুলো পৃথিবীতে কিভাবে বানানো হয়! আর কী ভাবেই বা সেখানে মহাকাশে ঘোরার শিক্ষা দেয়া হয়!

মহাকাশ-সংস্থাগুলো পৃথিবীর বুকে খুব অল্প জায়গায় এমন একটা অবস্থা তৈরি করে, যে সেখানে ঢুকলেই তোমার মনে হবে, তোমার ওজন শূন্য হয়ে গেছে! ওজন, যার জোরে আমরা কিনা পৃথিবীর উপরে আটকে থাকি, যা বেশি হলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে হাঁফ ধরে যায়, লাফ দিতেও কষ্ট হয়, সেটা যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, তবে কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবে ভাবো তো! একটু জোরেই লাফ মেরেছো কি সাঁই করে উঠে ঘরের ছাদে ধাঁই করে মাথা ঠুকে যাবে! চারপাশের জিনিসপত্র বেমালুম উড়তে উড়তে ভেসে যাবে এ ঘর থেকে ও ঘর। ভূতের গপ্পের মত চেয়ার টেবিল মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে নাচতে থাকবে‌। সত্যি বলতে কি, এমন অদ্ভুত অবস্থা আসলে বানানো হয় বিরাট একখান বড়সড় প্লেনের মধ্যে। এইসব প্লেন চালান তিনজন খুব দক্ষ পেশাদার পাইলট। আসলে প্লেনটাকে ঠিকমত খেলিয়ে চালানোটার মধ্যেই তাঁদের আসল কৃতিত্ব লুকিয়ে থাকে। কিন্তু ঠিক কিভাবে প্লেন চালালে ওর ভিতরে মহাকর্ষহীন পরিবেশ তৈরি হয়? রোসো, সেইটা বলছি!

মাটি থেকে অনেক উঁচুতে প্লেন যখন উড়ছে, প্লেনে বসা বা দাঁড়ানো যাত্রী তখন দিব্যি থাকেন। ঐ উচ্চতায় প্লেনটা কিন্তু মহাকাশে নেই, পৃথিবীর নিজস্ব টানের মধ্যে বাতাসেই ভাসছে, কিন্তু একটু উপরের দিকের পাতলা বাতাসে। এরপর প্লেনটা হঠাৎ ভীষণ খাড়াভাবে মুখটা উপরের দিকে তুলে ভয়ানক গতিতে উঠতে থাকে, যেন কোনো পাহাড়ে উঠছে। এমনি সময় ভিতরের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে যদি দেখতে, সে এক বিশ্রী কাণ্ড! দাঁত-মুখ ছিরকুটে সবাই প্লেনের মেঝে বা দেয়ালে এমনি সেঁটে গেছে যে আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন কেউ বিরাট বড় বড় চালের বস্তা ওদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আসলে এইসময় ওর ভিতরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের টান পৃথিবীর পিঠের মাধ্যাকর্ষণ বলের টানের চাইতে অনেকটাই বেড়ে যায়। এইজন্য মনে হয় হাত পা বুঝি আর নাড়ানো চাড়ানো যাবে না!

এরপর একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় প্লেনটা উঠতেই পাইলটরা প্লেনের ইঞ্জিন দেন বন্ধ করে আর ঐ উচ্চতা থেকে প্লেনটাকে নীচের দিকে বিনা বাধায় পড়তে দেন! প্লেনের মুখটা তখন আর উপরে না উঁচিয়ে মাটির সমান্তরালে চালানো হয়। কী ভয়ানক ব্যাপার ভাবো তো! আর তোমরা তো জানোই যে বিনা বাধায় যদি কোনো জিনিস ওপর থেকে নীচে পড়তে থাকে তবে ওর ওজন বলতে কিছু থাকে না। কেন? আরে মনে করিয়ে দি। ওজন মানে কি? ঐ মেশিনে উঠে দাঁড়ালে তোমার পায়ের নীচের কাঁটা যত সংখ্যা দেখায়, সেইটা। কেন দেখায়? কারণ ওজনের মেশিনের উপর দাঁড়িয়ে তুমি যে বল দিচ্ছ নীচের দিকে, মেশিন‌ও তোমার উপর সেই বল ফিরিয়ে দিচ্ছে উপরের দিকে। ওজনটা সেই বলের‌ই মাপ। পায়ের নীচের মেশিনটা না থাকলে তুমি ঐ বলটা মাটির উপর দিতে। কেন দিতে? কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্র তোমায় নীচের দিকে টানছে, কি, তাই তো? কিন্তু যদি পায়ের নীচে কোন মাটিই না থাকে? অর্থাৎ যদি তুমি বিনা বাধায় নীচে পড়, তবে তোমার পায়ের নীচে কিচ্ছু থাকছে না যেটা তোমায় উপরের দিকে ঠেলে তোমার ওজন কতটা বোঝাবে, অথচ তোমাকে নীচের দিকে টানছে পৃথিবীর কেন্দ্র। অর্থাৎ, তোমার মধ্যে তুমি, একখানা জ্যান্ত পদার্থ থাকতেও তোমার ওজন বলতে কিছু নেই তখন। ঠিক এইরকম ওজনশূন্য পরিবেশ থাকে মহাকাশে, স্পেস স্টেশন বা বিশেষ উপগ্রহে।

তাই বলে এটা ভেবে ভয় পেয়ো না যে প্লেনটা অমন বিনা বাধায় নীচে পড়ে মাটিতে লেগে ভেঙেচুরে যাবে! নীচের দিকে পড়তে থাকার কুড়ি কি বাইশ সেকেন্ডের মধ্যেই ইঞ্জিন চালু করে প্লেনের মুখটা নীচের দিকে নামিয়ে নেয়া হয় আর তরতর করে অনেকটা নেমে একেবারে আগের উচ্চতায় নামিয়ে আনা হয়, পাহাড়ের চুড়ো থেকে নামার মত করে। ঐ যে কুড়ি-বাইশ সেকেন্ড, ওর‌ই মধ্যে যাত্রীরা কেউ ওজনশূন্য হয়ে মজার মজার অভিজ্ঞতা নেয়, কেউ নেয় মহাকাশ-স্টেশনে থাকা বা মহাকাশে হাঁটার ট্রেনিং, কেউ ঐ অবস্থায় বিজ্ঞানের কতরকম পরীক্ষা করে, কেউ আবার জিরো গ্রাভিটিতে গানের বা সিনেমার ভিডিও রেকর্ড করে।

এরপর আগের মত বাতাসে পাহাড়ের চুড়োয় ওঠা-নামা চালানো হয়। তা সে যার যতবার দরকার, ততবার। এইসব করতে যে পাইলটদের বিশাল এলেম লাগে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরকম কাণ্ডকারখানা করতে পয়সা খরচ‌ও হয় অনেক। তবে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের গবেষণার স্বার্থে এরকম পয়সা খরচ করতে পিছপা হন না‌। তাঁদের গবেষণায় আমাদের সভ্যতার বর্তমান উপকার পায় আর ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে। যাঁরা অত পয়সা খরচ করে মহাকাশে শুধু বেড়ানো বা কয়দিনের জন্য থাকার তামাশা দেখতে চান, তাঁদের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। তবে এতসব শিক্ষা নিয়ে মহাকাশে বেড়াতে যেতে একটা আলাদা রকম বুকের পাটা দরকার। তোমরা যদি আরো পড়ালেখা করে বড়ো হ‌ও আর এমনি সাহসী হ‌ও, আর যদি ভবিষ্যতে অনেক পয়সা রোজগার করো কিংবা মহাকাশে বেড়ানোর খরচ হুশ করে কমে গিয়ে তোমার নাগালে আসে, তবে একবার বেড়িয়ে আসতেই পারো। অবশ্য, সেক্ষেত্রে ওখানে পৌঁছে তোমাদের ভালোমন্দ খাবার খাওয়ার আশা রাখলে হবে না, আগেভাগেই বলে রাখছি! ঐ তোমার সোডা-মিশানো চিনির শরবৎ কিংবা ফুলে ওঠা আইসক্রিম, কোনটাই ওখানে খেতে পাবে না বাপু! অবশ্য, ভালো খবর একটা দিয়ে রাখি। তোমরা যে পাঁউরুটি খাবার সময় ভিতরের নরম অংশটা খেয়ে বাইরের পোড়া চারকোণা বর্ডারটা খাও না, তার খোঁজ নিয়ে দেখেছি। ওখানে ভেসে থাকলে তোমাদের অমন পাঁউরুটি খেতে হবে না। বর্ডার ছাড়া নরম পাঁউরুটি কিংবা নরম তুলতুলে রোলের পরোটা জুটে যেতে পারে মেনুতে। রোসো রোসো, জলটা স্ট্র-দেয়া বোতল থেকে চুষে চুষে খেও কিন্তু, নৈলে অনর্থ হবে!

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb