অভয়বাবুর স্মার্টফোন

লেখক - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



“উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত। লক্ষ্যবস্তু তৃতীয় গ্রহ। দুই একক সময়ের মধ্যে নিকটতম বিন্দুতে পৌঁছোব আমরা। সতের নং কক্ষের বাহকরা তৈরি হোন।”

চুরুট আকৃতির পৌনে এক মাইল লম্বা উপনিবেশ যানটা একটা গ্রহাণু খুদে তৈরি। নক্ষত্রমণ্ডলে অজস্র গ্রহ। তাদের মধ্যে সামান্য কিছু জায়গাতেই প্রাণের স্পর্শ লেগেছে। বুদ্ধিমান প্রাণের বাসস্থান আরো কম। তাদের একেকটির সন্ধান পাবার জন্য অনেক সময় ধরে লম্বা পথ চলতে হয় তাকে। তারপর, সন্ধান মিললে, চলতে চলতেই সেখানে বীজগুলি বুনে দিয়ে তার যাত্রা চলে ফের।

পাথুরে যানের একটা গুহায় ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠেছে। সেখানে অপেক্ষায় থাকা এক হাজার শরীর কিলবিলে শুঁড় দিয়ে খুলির গায়ে বসিয়ে নিচ্ছে সদ্য তৈরি হয়ে আসা প্রতিস্থাপক যন্ত্রগুলোকে।

যন্ত্রগুলোর চেহারা ভারী অদ্ভুত। লম্বাটে ও চ্যাপ্টা। একপাশে কাচের পর্দা। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, এ-গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ ও জ্ঞান আদানপ্রদাণের যন্ত্রকে ঐরকমই দেখতে।

প্রতি গ্রহের ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতিটা নেয়া হয়। জনপ্রিয় যোগাযোগের যন্ত্রের চেহারা নিয়ে বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছোতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যায় অনেক। ওরা সন্দেহ করে না।

একটা ক্ষীণ শিসের শব্দ উঠল হঠাৎ যানের সতের নম্বর গুহায়। উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে জেগে উঠেছে প্রতিস্থাপক যন্ত্রদের প্রসেসর। মস্তিষ্কগুলো থেকে ঝড়ের বেগে শুষে নিচ্ছে স্মৃতি আর ব্যাক্তিত্বের বৈদ্যুতিক নকশাগুলোকে।

তীব্র যন্ত্রণায় আছাড়িপিছাড়ি করতে থাকা শরীরগুলো একসময় স্থির হয়ে এল। নিভে এসেছে প্রতিস্থাপক যন্ত্রদের আলোও। একে একে স্বচ্ছ খুলিগুলো ছেড়ে তারা ভেসে উঠছিল গুহার মাথায় বসানো একটা উৎক্ষেপক নলের খোলামুখের দিকে। ওদিকে, গুহার মেঝের ওপর খুলে যাওয়া গোল জানালা দিয়ে তখন মহাকাশে ছিটকে যাচ্ছে প্রাণহীন শরীরগুলো। এই চেতনাবাহক জৈব যন্ত্রদের কাজ এবারে ফুরিয়েছে।

সময় পার হয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। গ্রহমণ্ডলের কেন্দ্রের হলুদ তারাটাকে পেছনে ফেলে, মহাকাশ সাঁতরে ধীরে ধীরে নীলাভ গ্রহটার কাছাকাছি এগিয়ে আসছিল পাথুরে জাহাজ। একসময় লক্ষ্যবস্তু থেকে প্রায় দেড় কোটি মাইল দূরে পৌঁছে একমুহূর্তের জন্য স্থির হল সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, তার পাথুরে শরীর থেকে  গ্রহটাকে লক্ষ করে তিরবেগে ভেসে গেল  ছোটো ছোট একঝাঁক চৌকো, চ্যাপ্টা যন্ত্র।

প্রাণহীন মহাকাশের বুকে সামান্যতম নড়াচড়া না জাগিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছিল গ্রহটার  উদ্দেশ্যে। অতিকায় যান তখন ফের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে যাত্রা করেছে তার পরের লক্ষ্যের সন্ধানে। কেউ দেখল না। শুধু এর কিছুক্ষণ বাদে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরন্ত এক দুরবিনের কমপিউটার তার পার্থিব প্রভুদের কাছে একটা খবর পাঠিয়েছিল, “গ্রহাণু ওউমুয়ামুয়া পৃথিবীর নিকটতম বিন্দু ছেড়ে মঙ্গলের দিকে সরে যাচ্ছে।” 

_______________________________________________________________

সকাল সকাল মেজাজটা খিঁচড়েই থাকে রোজ অভয়বাবুর। আজও তার অন্যথা হয়নি। দুটো টাকা দিলে সুযশ বাড়ি বয়ে একগাদা করে ফুল দিয়ে যায়। কিন্তু তাতে গিন্নির মন উঠবে না। রোজ ভোরে কাঁচা ঘুম থেকে ঠেলে তুলে সাজি ধরিয়ে...

কেন হে!  তাজা ফুল চাই তো বাড়িতে দুম্বো একটা ছেলে বসে আছে, তাকে সক্কাল সক্কাল ওঠাতে পারো না?

কিন্তু সে-কথা মুখ ফুটে বলবার কি জো আছে এ বাড়িতে? বললেই বলবে, আহা এমএসসি ক্লাশের সায়েন্সের পড়া। কত কঠিন কঠিন অঙ্ক সব! সারারাত জেগে ওই পড়ে, তারপর সকালটা একটু ঘুমোবে তাতেও তোমার চোখ টাটায়?

ধুস্‌! পড়াশোনা না কাঁচকলা। যখন দেখ ওই এক ফোন নিয়ে খুটখাট করে চলেছে। তাহলে পড়ে আর কখন? কিছু বললেই বলবে, আজকালকার পড়াশোনা নাকি তিনি বুঝবেন না। যত্তসব বাজে কথা। তিরিশ বছর ধরে অরবিন্দ কলেজে লাইব্রেরিয়ানগিরি করলেন, কত জুয়েল ছেলেপিলে হাত দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর তাঁকে পড়াশোনা বোঝাবে নাকি ওই কালকের ছোকরা!    

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে ছেলের জানালার দিকে চোখ যেতে ফের রাগটা তেড়েফুঁড়ে উঠল মাথায়। নবাবপুত্তুর দশটা অব্দি ঘুমোবেন, আর বুড়ো বাপকে...

ঠিক তক্ষুণি জানালার নীচে বেলফুলের ঝাড়টার দিকে চোখ যেতে মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল অভয়বাবুর। এইবার বাগে পাওয়া গেছে একে। কাল রাত্তিরে নিশ্চয় জানালার ধারে মোবাইল ফেলে শুতে চলে গিয়েছিল। কোনোভাবে সেটা বাইরে পড়ে গেছে। এখন নে। যেমন অযত্ন, তেমনি খুঁজে মর কদ্দিন! কদিন না ভুগিয়ে এ ফোন ওকে ফেরৎ দেবেন না অভয়বাবু।

পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে ফোনটা তুলতে গিয়ে হাতটায় যেন একটু ছ্যাঁকা লাগল তাঁর। বেজায় গরম হয়ে আছে যন্ত্রটা। ফেটেটেটে যাবে না তো আবার! কী জানি বাবা! মাঝেমধ্যেই তো কাগজে খবর ওঠে ওই নিয়ে।

ফোনটা পকেটস্থ করতে করতেই খেয়াল হয়েছিল যেখানটায় সেটা পড়ে ছিল তার এদিক ওদিক শুকনো ঘাসে আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে খানিক খানিক পোড়া দাগ। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না অভয়বাবু। কেউ বিড়ি সিগারেট খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে হয়ত। নইলে ফোনের গরমে তো আর ঘাস পুড়বে না!

টিফিনবেলায় লাইব্রেরিতে বসে হঠাৎ ফোনটার কথা মনে পড়ল অভয়বাবুর। ঝোলায় ভরে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন কলেজে আসবার সময়। রাজপুত্র তখনো ঘুমোচ্ছেন। কথা বলবার সুযোগ হয়নি।

একহাতে টিফিনকৌটো থেকে রুটির টুকরো মুখে পুরতে পুরতেই ঝোলা থেকে ফোনটাকে বের করে আনলেন অভয়বাবু। বস্তুটা একটা স্মার্টফোন। আজকাল তো সবার হাতেই একটা করে থাকে। তবে অভয়বাবু এসব যন্ত্রের ধারেকাছে নেই। গিন্নির একটা বোতাম টেপা ছোটো ফোন আছে, দরকারে সেই থেকেই কাজ চালিয়ে নেন। তবে সেটা এক দুই লেখা বোতাম দেয়া ফোন। টিপেটুপে কাজ হয়। কিন্তু এ-যন্ত্রের গায়ে তেমন কোনো বোতামও তো নেই! সামনে শুধু একটা কালো কাচ। পেছনটা সাদা প্লাস্টিকে মোড়া।

জিনিসটা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছেন তখন হঠাৎ ক্যান্টিনের গণশা চা নিয়ে এল। ফোনটা দেখে বলে, “নতুন কিনলেন নাকি অভয়বাবু? কোন কোম্পানির?”

ফোন কেমন করে পেলেন তার গুহ্যতত্ত্ব নিয়ে এর সঙ্গে আলোচনা করবার কোনো কারণ ছিল না। অভয়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এইটেকে চালু করে কী করে বল তো?”

গণশা ফিক করে হাসল। তারপর কাপটা নামিয়ে রেখে চলে যেতে যেতে বলে, “ধারে একটা বোতাম থাকবে দেখুন। সেইটে ধরে টিপে থাকলেই খানিক বাদে চলতে শুরু করবে।”

অভয়বাবুর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। টিফিনকৌটো বন্ধ করে চায়ের কাপটায় লম্বা একটা চুমুক দিয়ে ফোনটার ধারের দিকটায় আঙুল চালালেন তিনি। হ্যাঁ, বোতামমত কিছু একটা আছে বটে ওখানে।

তাতে চাপ দিতে গিয়েও কী ভেবে আঙুলটা একবার সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ছেলের ফোন। তিনি খুলেছেন টের পেলে শেষে কুরুক্ষেত্র বাধায় যদি! কিন্তু খানিক বাদে কৌতুহলেরই জয় হল। কী এমন বস্তু যে দুনিয়াশুদ্ধু লোক ওই নিয়ে সারাদিন নাচছে। একবার দেখাই যাক। অতএব, দোনোমনা ছেড়ে বোতামটায় চাপ দিলেন অভয়বাবু।

একটা হালকা শব্দ করে হঠাৎ পর্দাটা জেগে উঠল তাঁর চোখের সামনে। সেখানে অচেনা অক্ষরে দুটো শব্দ ভেসে উঠছে। বোধায় হিব্রুটিব্রু কিছু হবে। অক্ষরদুটোর তলায় একটা সবুজ বোতামের ছবি। অভয়বাবু একটু অবাক হলেন। ফোনে তো ইংরিজিতেই সব লেখে। এ আবার কোন জিনিস তবে?

কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল অক্ষরগুলো। তারপর হঠাৎ সেগুলো মিলিয়ে গিয়ে ফের নতুন কয়েকটা অক্ষর জেগে উঠল সেখানে। অনেকটা চিনে বা জাপানি অক্ষরের মত। কী করা উচিৎ তাই ভাবছেন, এমন সময় সেগুলো উবে গিয়ে ইতিহাস বইতে পড়া হিয়েরোগ্লিফিকের ক’টা ছবি সেখানে ভেসে উঠতে অভয়বাবু খানিক ঘাবড়ালেন। ব্যাপার সুবিধের নয়।

ভয়ে ভয়ে ফোনটা বন্ধ করতে গিয়েও একেবারে শেষমুহূর্তে থমকে যেতে হল অভয়বাবুকে। পর্দায় এবারে পরিষ্কার বাংলায় শব্দ দুটো ভেসে উঠছে, “ভাষা- বাংলা।”

এইবার বোঝা গেল ব্যাপারটা। ফোন তাঁর ভাষা জানতে চাইছে। আজকালকার যন্ত্রে যে কত কায়দাই হয়েছে! অভয়বাবু তাড়াতাড়ি সবুজ বোতামটার গায়ে হাত ছোঁয়ালেন। তাইতে লেখাগুলো মিলিয়ে গিয়ে একটা বুড়ো আঙুলের ছবি ফুটল সেখানে। তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, “পরিচয়।”

ছেলে মধ্যে মধ্যে পাসওয়ার্ড না কীসব বলে সেই হবে বোধায়। অভয়বাবু নিজের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা ঠেসে ধরলেন ছবিটার ওপরে। 

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গোটা ঘরটা যেন দুলে উঠল তাঁর চোখের সামনে। আঙুলটাকে যেন কেউ বেজায় জোরে ঠেসে ধরে রেখেছে পর্দার গায়ে। তবে সেদিকে তখন আর তাঁর কোনো খেয়াল ছিল না। তাঁর চোখের সামনে তখন সিনেমার উলটো রিলের মত ছবির পরে ছবি ভেসে উঠছে। আজ সকালে ফোনটা কুড়িয়ে পাওয়া, গতকাল বাজারের মোতির সঙ্গে ঝগড়া, পরশু, তার আগের দিন, গত বছর, তারও আগে...

ওই তো টোপর মাথায় বিয়ে করতে চলেছেন তিনি ছাব্বিশ বছর আগে! তারও আগে কলেজের কনভোকেশান, প্রথম ক্লাশ পালিয়ে সিনেমা, ঐ তো নাগরদোলায় উঠবে বলে চিলচিৎকার জুড়েছে খুদে অভয়...

তারপর আরো আরো পুরোনো স্মৃতির বন্যা এল। দূর অতীতের সেইসব দৃশ্য থেকে আস্তে আস্তে তাদের অর্থ মিলিয়ে যাচ্ছিল। শুধু শিশুর চোখে ধরা পড়া অর্থহীন ছবির মিছিল। তারপর বুকে একটা তীব্র যন্ত্রণার স্মৃতি, প্রথম হাওয়া টেনে ফুলে ওঠা ফুসফুসের টান...তারপর শুধু অন্ধকার।

“আরে অভয়বাবু যে! স্মার্টফোন তাহলে কিনলেন শেষতক! কত নিলো? দেখি দেখি?”

কানের কাছে ক্যাশিয়ার সুরেন মিত্তিরের গলা পেয়ে হঠাৎ সচেতন হলেন অভয়বাবু। কোথায় কী? ফোনের পর্দা ফের বেবাক কালো মেরে গেছে।

ফোনটা হাতে নিয়ে খানিক নেড়েচেড়ে দেখল মিত্তির। তারপর বলে, “ছাপছোপ তো কিছু নেই গায়ে। সস্তার চিনে বস্তু বোধায়। তা এতে ফোনটোন করা যায়তো, নাকি...দেখি একবার মেয়েকে ধরে!”

বলতে বলতেই ফোনটা হাতে নিয়ে টকটক করে কীসব টিপেটুপে দেখল সে। তারপর মুখটা ভেঙচে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “দূর মশাই। এ দেখি না রাম না গঙ্গা কিছুই বলে না! শিওর ভাঙা জিনিস গছিয়েছে। দেখেশুনে কেনেন না কেন, অ্যাঁ?”

বাড়ি ফিরে প্রথমেই দেখা গেল সন্তু বসে বসে তার বিখ্যাত মোবাইলে খুটখাট করছে। হঠাৎ একটু নিশ্চিন্দি বোধ করলেন অভয়বাবু। ফোনটা তাহলে ওর নয়। কেমন যেন একটা টান পড়ে গেছে তাঁর ফোনটার ওপর। হাত থেকে ছাড়তেই মন চাইছে না সেই দুপুরবেলা থেকেই।

তবে গিন্নির চোখকে ফাঁকি দেয়া দুষ্কর। রাতে শুতে যেতে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করে এনে বলেন, “ফোন কিনেছ দেখছি! চালাতে পারো?” অভয়বাবু মুচকি হেসে বললেন, “তোমার থেকে শিখে নেব’খন।”

সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ বালিশের নীচ থেকে হালকা একটা কাঁপুনিতে অভয়বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। গিন্নি ঘুমিয়ে কাদা। বাইরে শাঁ শাঁ করছে রাত।

আস্তে আস্তে মাথা তুলে ফোনটা বের করে আনলেন অভয়বাবু। তার পর্দাটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে হঠাৎ। তার ঠিক মাঝখানে একটা ঘন অন্ধকার ফুটকি। ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিল ফুটকিটা। ফোনটার পর্দা ছাড়িয়ে একটা ঢেউয়ের মত তাকে ঘিরে ধরে...

না! কালো ফুটকি নয়! একটা ঘড়ি। তাঁরই হাতঘড়িটার মতন দেখতে তো! কাঁটাগুলো স্থির হয়ে আছে তার বুকে...

হঠাৎ তাঁর মাথার মধ্যে গুণগুণ করে উঠল একটা গলা...উঁহু গলা নয়...একটা অনুভূতি...

“সময়ের স্রোতকে অনুভব কর। তাকে বেয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখবে না?” 

একটা অজানা প্রেরণায় হঠাৎ প্রাণপণে কাঁটাদুটোর দিকে মনটাকে ঘুরিয়ে ধরলেন অভয়বাবু। একটু ঝাঁকুনি খেল যেন কাঁটাদুটো। তারপর আস্তে আস্তে, বড়ো অনিচ্ছায় এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

তীব্র একটা যন্ত্রণার অনুভূতি উঠে আসছিল অভয়বাবুর খুলির ভেতর থেকে। সবকিছু ভেঙেচুরে যাচ্ছে যেন সেখানে... কাঁটাদুটো বনবন করে ঘুরছে এখন। ঘন্টাগুলো এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে...

হঠাৎ উজ্জ্বল আলোর একটা ঝলক চোখদুটোকে ধাঁধিয়ে দিয়ে গেল অভয়বাবুর। কোথায় কী? বেলা সাতটা বাজে ঘড়িতে। রান্নাঘরে গিন্নির প্রেশার কুকারে সিটি দিচ্ছে। ফুলের সাজিটা নামিয়ে রেখে সেদিকে এগিয়ে গেলেন অভয়বাবু। আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই একটা বিশ্রী শব্দ। ফেটে যাওয়া কুকারটা ছিটকে এসেছে গিন্নির মাথার দিকে...অভয়বাবু চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

“আরে এই দ্যাখ। ভোররাত্তিরে অমন ওঁ ওঁ করে শব্দ করছ কেন?”

গিন্নির ধাক্কায় তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফেললেন অভয়বাবু। বাইরে আলো ফুটেছে। কাক ডাকছিল।

*****

সময়কে ছুঁতে পারলে, তার উজান-ভাটিতে হেঁটে যাওয়া, পথেঘাটে চলবার মতই সাধারণ কাজ। মহাযুদ্ধে ধ্বংস হওয়া গ্যালাক্সির যে অঞ্চল থেকে জৈবযন্ত্রের মাথায় ভরা উদ্বাস্তু চেতনাদের বয়ে নিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছিল ওই পাথুরে যান, সেখানে সেইটেই প্রাণের স্বাভাবিক ধর্ম।

তবে এ-গ্রহের এই তিনমাত্রার জীবদের মস্তিষ্ক, সময়ের পথে হেঁটে যাওয়া সেইসব চেতনাকে বইবার ক্ষমতা রাখে না। চেতনা প্রতিস্থাপনের আগে তাকে তাই গড়েপিটে নিতে হয়। প্রতিস্থাপক যন্ত্রের স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা চারমাত্রার জীবচেতনার প্রথম পরীক্ষা এইবার সফল হয়েছে। জীবটার জেগে উঠতে থাকা মস্তিষ্ক তাকে এই প্রথমবার সময়ের স্রোত ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখতে শিখিয়েছে। তবে এখনও সেখানে বাসা বাঁধার সময় আসেনি তাঁর। আরো পথ যেতে হবে একে।

*****

সকালে যখন ফুল তুলতে গেলেন অভয়বাবু, তখন একটা বাজারের ব্যাগে গিন্নির প্রেশার কুকারটা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। দুঃস্বপ্নটা মাথা থেকে যাচ্ছে না কিছুতেই। ফিরে আসবার পথে পালবাজারে একবার থামলেন তিনি। নিতাইয়ের রিপেয়ারিং শপ-এ কুকারটা দিয়ে বললেন, “একটু দেখে দে দিকি! সব ঠিক আছে তো!”

কুকারটা দেখেশুনে নিতাই মুখ মটকাল। বলে, “এইভাবে জিনিসপত্তর কেউ ব্যাভার করে কাকা? সিটির ফুটোটার মুখে একগাদা ময়লা জমে টাইট হয়ে আছে। যেকোনদিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারত। দাঁড়ান সাফ করে দি। চল্লিশটা টাকা দেবেন।”

গিন্নি অবশ্য মুখ মটকালেন বাড়ি ফিরতে। বলেন, “জীবনে তো কুটোটি নাড়লে না। তা আজ হঠাৎ কুকার নিয়ে পড়লে যে! নিতাইটা যা জোচ্চোর! দিব্যি ঘসামাজা জিনিসকে খুঁতো বলে খানিক পয়সা খসিয়ে নিল!”

নিতাইবাবু কোনো জবাব দিলেন না। শুধু বুকপকেটে রাখা ফোনটায় হাত দিয়ে দেখলেন একবার।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ গড়িয়ে গেল তারপর। স্মার্টফোনটার সঙ্গে ক্রমশ আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ছিলেন অভয়বাবু। ফোনটা এখন তাঁর সঙ্গে কথা বলে। না, কথা ঠিক নয়, তাঁর অনুভূতিতে সরাসরি যোগাযোগ করে এসে। কোন বিচিত্র পথে সে তাঁর চেতনায় গেঁথে দেয় সময়কে অনুভব করবার, তার গতিপথ ধরে সামনে পেছনে বিচরণ করবার অসীম শক্তিকে।

আস্তে আস্তে দেখবার চোখটাই বদলে যাচ্ছে অভয়বাবুর। কোনকিছুর ওপর চোখ পড়লে একইসঙ্গে তার অতীত আর ভবিষ্যতের বেশ অনেকটা নজরে এসে মাথা গুলিয়ে যায়। একদিন রাত্রে হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, “ভরদুপুরে ক্যান্টিনের কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিস যে বড়ো? খুব লায়েক হয়েছ না?” সন্তু তাতে বেজায় অবাক হয়ে তাঁর দিকে গোলগোল করে তাকিয়ে বলে, “তুমি কী করে...”

ভুলটা বুঝতে পেরে অভয়বাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন, “আন্দাজ! বুঝলি, আন্দাজ!”

*****

প্রতিস্থাপক যন্ত্রের গভীরে তার মেমোরি চিপ আশ্রয় করে থাকা ভিন দুনিয়ার উদ্বাস্তু চেতনা বুঝতে পারছিল, সময় এগিয়ে আসছে। সময় নামের চতুর্থ মাত্রাকে ছুঁতে ক্রমশ আরো অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এই প্রাণীটা। শিখেছে তাকে বেয়ে সামনে-পেছনে এগিয়ে উঁকি মারবার কৌশল। তবে এখনো খানিক পথ বাকি। এখনো নিজের শরীরকে সেই পথে চালিয়ে নেবার কৌশল অর্জন করেনি এর মস্তিষ্ক। সে-কৌশল না জানলে এর চেতনায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করে লাভ হবে না কোনো। এই জীবদের মতই সময়ের স্রোতে একমুখি ভেসে যাওয়া, চলৎশক্তিহীন পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে।

তবে সে-সময়ের দেরি ছিল না আর। এ-গ্রহে আসা তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জেনেছেন, এ-সময়টা সাধারণত একটা তীব্র আবেগের ধাক্কা এদের শেষ ধাপটা পার করে দেয়। নিকট ভবিষ্যতের দিকে চোখ ফেলে তিনি জেনেছেন সেই ধাক্কা খাবার সময়টা এগিয়ে আসছে এর।

                লাইব্রেরির বই বাছবার জন্য কলকাতা বইমেলায় আসতে হয়েছিল অভয়বাবুকে। সন্ধে আটটা নাগাদ ভিড়ে, ধুলোয় গলদঘর্ম হয়ে, একগাদা বইয়ের ভারী ঝোলাটা কাঁধে মেলা থেকে বেরিয়ে সাবওয়েতে ঢুকতেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল তাঁর। অজস্র রঙিন পোশাকের ফুর্তিবাজ মানুষের ভিড়ের ফাঁকে তাঁর চোখটা আটকে গেছে দেয়ালের গা ঘেঁষে রাখা একটা ওয়েস্টবিনের দিকে। আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তাঁর চোখের সামনে একটা সিনেমার মত একটা ছবি ভেসে গেল... ঠিক দু’মিনিট পরের ছবি...অতিকায় একটা আগুনের গোলা উঠে আসছে বিনটা থেকে... ভয়ঙ্কর শব্দ একটা... তাঁকে ঘিরে ছিটকে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড শরীর...রক্ত...খানিক আগের হাসিখুশি মানুষেরর স্রোতটা...উঃ!

সময় নেই একটুও। মাত্র দু’মিনিটের ভেতর...কিছু একটা করতে হবে তাঁকে! এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না!

হঠাৎ বিনটার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন অভয়বাবু। এক...দুই...তিন...সেকেন্ডগুলো বয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে। চোখদুটো বুঁজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার অতীতের দিকে নজর চালিয়ে দিলেন তিনি।

...বিকেল চারটে দশ। বিরাট চেহারার মানুষটা পিঠে একটা ছোটো থলে নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে সাবওয়ের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। ভিড়ের মধ্যেই ওয়েস্ট বিনটার দিকে এগিয়ে এল সে। তারপর এদিকওদিক তাকিয়ে থলের ভেতর থেকে একটা পুঁটুলি বের করে...

“এই, থাম...”

হঠাৎ গলা থেকে একটা চিৎকার বের হয়ে এল অভয়বাবুর। তাঁর মাথার মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠা কিছু নতুন সাইন্যাপ্টিক পাথওয়ের তীব্র ঝলক শরীরটাকে অবশ করে দিচ্ছে যেন। তাঁকে ঘিরে বয়ে চলা সময়ের প্রবাহ যেন একটা মৃদু আলো ছড়ানো টানেলের মত বয়ে চলেছে অতীত থেকে বর্তমানকে ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে! তার গায়ে জেগে থাকা সময়ের বিন্দুগুলোকে এইবার ছুঁতে পারছিলেন অভয়বাবু।

আর দেরি নয়। টানেলটা ধরে অতীতের দিকে এগিয়ে গি্য়ে হঠাৎ অদৃশ্য হলেন তিনি ঘটমান বর্তমান থেকে বিকেল চারটে দশ মিনিটের অতীতমুহূর্তে।

বিনের ভেতর পুঁটুলিটা ফেলবার মুহূর্তে বাধা পেল লোকটা। কোত্থেকে একটা রোগাভোগা লোক এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে তার পিঠে। একটু থতমত খেয়ে তাকে ঝেরে ফেলল সে।

অভয়বাবু নাছোড়। কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। তাও ফের একবার লাফিয়ে উঠে লোকটার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়েছেন তিনি। আর সেইসঙ্গে চিৎকার, “বোমা মারবি? এতগুলো ভালোমানুষের প্রাণ নিবি? আমি থাকতে তা হতে দেব না শয়তান...”

ততক্ষণে তাঁদের ঘিরে অনেক মানুষের ভিড় জমে গেছে। বাইরে থেকে একটা গম্ভীর গলা বলছিল, “সরে যান, ভিড় করবেন না। পুলিশকে তার কাজ করতে দিন...”

হঠাৎ মানুষটার গলা থেকে আলগা হয়ে এল অভয়বাবুর হাতদুটো। তাঁর নেতিয়ে পড়া শরীরটার বুকপকেটে রাখা ফোনটার থেকে বের হয়ে আসা পজিট্রনের একটা অদৃশ্য স্রোত তখন তাঁর মস্তিষ্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আশ্রয়দাতা মস্তিষ্কের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে। ঘরছাড়া এক উদ্বাস্তু চেতনা অবশেষে খুঁজে পেয়েছে তার আশ্রয়।

এইবারে এই মানুষটা জেগে উঠে ফের জনস্রোতে মিশে যাবেন। নিজের স্মৃতি ও চেতনাকে সঙ্গী করে তিনমাত্রার এই পৃথিবীর বুকে কাটিয়ে চলবেন নিজের স্বাভাবিক জীবন। শুধু সবার নজরের আড়ালে, এই শরীরকে আশ্রয় করে চতুর্মাত্রিক দুনিয়ায় ফের ফিরে আসবেন সে জগতের আরো এক প্রবাসী সদস্য। আরো একটা উপনিবেশ। গ্যালাক্সিতে তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে... 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb