কল্পবিজ্ঞানের নির্মাণকথা

লেখক - মানস প্রতিম দাস

‘হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)

হয়ে গেল "হাঁসজারু" কেমনে তা জানি না।’

বড় মাপের মানুষরা মাঝে-মাঝে প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে যান, নিজের মত করে কিছু তৈরি করেন। স্কুলে বাংলার শিক্ষক বলে দিয়েছিলেন যে একে বলে ‘আর্ষ প্রয়োগ’। তা বেশ, সব ঘটনারই একটা নাম থাকা ভালো। কিন্তু ‘কেমনে তা জানি না’ বললে যে অন্ধকার পরিবেশ বোঝানো হয় তার সঙ্গে বড় মানুষদের আচরণ তো মেলানো যায় না। তাঁরা জানতে চাইবেন, অনুসন্ধান করবেন, অন্ধকার সরিয়ে আলো আনবেন - এটাই প্রত্যাশিত। অতএব হাঁস আর সজারুর মিলনে হাইব্রিড ‘হাঁসজারু’ আদৌ হতে পারে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হয়েই তাঁরা লিখবেন, এমনটাই ভাবা অভ্যাস আমাদের। আলোচনার ঠিক এই জায়গাটায় অবধারিতভাবে একজন এসে হাজির হয়ে বলবেন – কল্পনার আবার ঠিক-বেঠিক কী? কল্পনা পাখা মেলবে আর তারপর উড়ে যাবে যেমন খুশি, যেদিকে খুশি। তা বটে! নিখাদ কল্পকথা বা ফ্যান্টাসির এই হল ধারা। বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ থাকার দায় নেই।

‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড’ নামে কাহিনীর কথাই ধরা যাক। সেটা লেখা হয়েছিল ১৮৬৫ সালে। আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটে যায় সেই কাহিনীতে, যেন ম্যাজিক অথবা ভোজবাজি! একটা বোতল থেকে তরল পান করে বাচ্চা মেয়ে অ্যলিস উচ্চতায় হয়ে যায় মাত্র দশ ইঞ্চির। কিছুক্ষণ পরে কেকের একটা ছোট টুকরো খেয়ে নিয়ে সে খুব লম্বা হয়ে যায়, এবার তার উচ্চতা ন’ ফিট! কীভাবে হল ব্যাপারগুলো? কাহিনীতে তো ব্যাখ্যা করা নেই। বড়জোর সুকুমার রায়ের সুরে সুর মিলিয়ে বলা যায় ‘কেমনে তা জানি না’। বিজ্ঞানে এমনতর নানা কাণ্ড হয় বলে জানি সবাই কিন্তু এমন আচমকা, অদ্ভূতভাবে ঘটে না। অতএব এটাকে সায়েন্স ফ্যান্টাসি বললেও বলতে পারি আমরা। লেখক যিনি, লুই ক্যারল যাঁর ছদ্মনাম, বাস্তবে যিনি চার্লস লুডউইগ ডজসন, তিনি ছিলেন একজন গণিতবিদ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াতেন। লজিক নিয়ে ভাবতে, লজিকের বিন্যাস পাল্টে দিতে ভালোবাসতেন তিনি। উদ্ভাবন করেছিলেন বেশ কিছু খেলা ও ধাঁধার যা মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা-স্নায়ুকে চঞ্চল করে তোলে। তাঁর হাতে সায়েন্স ফ্যান্টাসির রচনা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১৮৭১ সালে বের হল এর সিক্যুয়েল, ‘থ্রু দ্য লুকিং-গ্লাস অ্যাণ্ড হোয়াট অ্যালিস ফাউণ্ড দেয়ার’। এখানেও সেই ম্যাজিকের মত ব্যাপারস্যাপার কিন্তু কয়েকজন বিশ্লেষক আমাদের নজর ঘুরিয়েছেন এই লেখারই কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে যা আমরা খেয়াল করি না। যেমন অ্যালিস পরিচিত হতে এসেছে রেড কিংয়ের সঙ্গে কিন্তু তিনি তখন ঘুমোচ্ছেন। পার্ষদ বললেন যে রাজা স্বপ্ন দেখছেন, তাঁর ঘুম না ভাঙানোই ভালো কারণ তাতে অ্যালিসের ক্ষতি। কেমন ক্ষতি, জানতে চাইল অ্যালিস। পার্ষদ বললেন, অ্যালিসের অস্তিত্ব রাজার স্বপ্নের মধ্যে। স্বপ্ন ভাঙলে অ্যালিসও ভ্যানিশ হয়ে যাবে। মানতে নারাজ অ্যালিস, প্রশ্ন করল পার্ষদকে যে তুমি তাহলে কী? কোথায় তোমার অবস্থান? অবাক কাণ্ড, পার্ষদের মানতে বাধা নেই যে তাঁর অস্তিত্বও রয়েছে রাজার স্বপ্নের মধ্যে। এখন এই যে বাক্যালাপ তা সাধারণ একজন পাঠকের কাছে নিছক ননসেন্স বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে লুই ক্যারল এর মাধ্যমে বাস্তবতার ধারণা নিয়ে ঐতিহাসিক লড়াইকে ধরেছেন। বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছিলেন যে এমন গভীর একটা বিষয়কে এত মজা করে পরিবেশন না করলে পড়তে ভারি কষ্ট হত!

পৃথিবীর প্রথম কল্পবিজ্ঞান

‘প্রথম’ ব্যাপারটা নিয়ে একটা আহ্লাদ আছে আমাদের। পরীক্ষায় প্রথম, লটারিতে প্রথম, দৌড়নোতে প্রথম ইত্যাদি সব ব্যাপারেই বেশ আগ্রহী আমরা। বিজ্ঞানের কল্পকথার ব্যাপারেই বা সেটা খাটবে না কেন? এখানে অবশ্য বেশি চেনা শব্দ ‘কল্পবিজ্ঞান’ ব্যবহার করেছি আমরা। ফ্যান্টাসির উল্লেখ করি নি একেবারেই। তার কারণ সায়েন্স ফ্যান্টাসি প্রথম কবে রচিত হয়েছিল তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চারকে কেউ যদি সেই মর্যাদা দিতে চান তবে দিন, অসুবিধে নেই। শুধু সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু কল্পবিজ্ঞান শব্দটাকে বগলদাবা করে যে সন্ধানে নেমেছি তাতেও সমস্যা বিস্তর। আগে কাজটাকে চিহ্নিত করা যাক।

সালটা ১৮১৫। এপ্রিল মাসের গোড়ার দিক। গুড়গুড় করে শব্দ শুরু হল তাম্বোরা পাহাড়ে, শব্দের জোর বাড়তে লাগল ভীষণভাবে। মাসের দশ তারিখে পাহাড়ের খোলামুখ দিয়ে বেরিয়ে এল তিনটে লেলিহান শিখা, সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া আর গ্যাসের উদ্গীরণ। এই সব কিছু আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে পঁচিশ মাইলেরও বেশি উচ্চতায় পৌঁছে গেল নিমেষের মধ্যে। গরম বাতাস উপড়ে ফেলল চারপাশের অজস্র গাছপালা। উত্তপ্ত লাভা পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘন্টায় একশো কিলোমিটারেরও বেশি বেগে। চলার পথে যাবতীয় জৈব-অজৈব জিনিস নিশ্চিহ্ন করে গিয়ে পড়ল প্রায় পঁচিশ মাইল দূরের সমুদ্রে। ইন্দোনেশিয়ার এই অগ্নুৎপাতে শুধু যে স্থানীয় অঞ্চলের ক্ষতি হয়েছিল তা একেবারেই নয়। আমাদের জানা ইতিহাসে এই অগ্নুৎপাত সবথেকে মারাত্মক। উদ্গীরণের হার কমতে-কমতে লেগে গিয়েছিল জুলাই মাসের মাঝামাঝি। সালফারযুক্ত গ্যাস মিশেছিল বাতাসের জলীয় বাষ্পের সঙ্গে আর অনেক উপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বায়ুপ্রবাহ সেই মিশ্রণ বয়ে নিয়ে গিয়েছিল দূরদূরান্তে। গ্রেট ব্রিটেন সহ গোটা ইউরোপে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি বৃষ্টি হল ১৮১৬ সালের গ্রীষ্মে, সে বছরের নামই হয়ে গেল ‘ইয়ার উইদাউট আ সামার’।

১৮১৬ সালের মে মাসে নানাবিধ কেলেঙ্কারিতে জড়িত লর্ড বায়রন ইংল্যাণ্ড ছেড়ে গেলেন জেনেভায়। সঙ্গে গেলেন তাঁর চিকিৎসক জন পলিদোরি। যে হোটেলে তাঁরা উঠেছিলেন সেখানেই ছিলেন পার্সি বিস শেলী ও মেরি ওলস্টোনক্রাফট গডউইন। চেনা-পরিচিতরা ঘটনাক্রমে জড়ো হলেন একই জায়গায়। শেলী আর বায়রনের দেখা হওয়ার পরে তাঁরা নিজেদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে লেক জেনেভার তীরে দুটো ভিলায় উঠে গেলেন। সেখানে বসে পাহাড় পেরিয়ে এগিয়ে আসা ঝড়-বজ্রপাত-বৃষ্টি দেখতেন সবাই, একটানা বর্ষায় বাইরে বেরনোর উপায় ছিল না কারও। এমন অবস্থায় একদিন বায়রন লিখতে শুরু করলেন ভ্যাম্পায়ার নিয়ে। কিন্তু আট পাতা লেখার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন তিনি। বায়রনের ফেলে যাওয়া সূত্র তুলে নিলেন পলিদোরি, লিখলেন ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার’। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কল্পকাহিনী বোনার ঐতিহাসিক সূত্রপাত হল এভাবে। আবার এখানেই মৃত শরীরে প্রাণ ফেরানো নিয়ে গল্প করতে-করতে মেরি সিদ্ধান্ত নিলেন যে একটা গল্প লিখবেন তিনি। পরের দিনই তিনি শুরু করলেন লেখা আর ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হল ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেলেন লেখিকা, পরে সেটাকে প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর মর্যাদা দেওয়া হল।

যে সমস্যার ইঙ্গিত দিয়েছি কিছু আগে সেটা এই ‘কল্পবিজ্ঞানের’ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে। এই প্রবন্ধের পরিসরে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন তোলাই যায় যে এই কাহিনীতে মৃত মানুষের শরীরে প্রাণ সঞ্চারের ব্যাপারে যেমন বর্ণনা হয়েছে তেমন কোনও অগ্রগতি সেই সময়ের বিজ্ঞানীরা করতে পেরেছিলেন কিনা। ২০১৮ সালে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশের দু’শ বছর উদযাপিত হয়। তার দু’ এক বছর আগে থেকেই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক দিক নিয়ে আলোচনা বেরোতে থাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ২০১৬ সালে বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচার তার অনলাইন সংস্করণে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করে। ব্যাঙ-নাচানো বিজ্ঞানী লুইগি গ্যালভানির কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। ১৭৮০ সালে তিনি দেখান যে মৃত ব্যাঙের পা নড়ে ওঠে বিদ্যুতের সংযোগে। তাঁর ভাইপো, ইতালীয় বিজ্ঞানী গিওভানি অ্যালদিনি এই কাজে আরও অনেকটা অগ্রসর হন। ওদিকে জার্মানির শারীরতত্ত্ববিদ যোহান ফ্রিডরিশ ব্লুমেনবাখ নতুন কিছু তত্ত্ব উপস্থিত করেছিলেন। এই সব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল পার্সি শেলী, মেরি শেলী, বায়রন প্রমুখের মধ্যে। শুনছিলেন পলিদোরি, তিনিই পরে জানান এই তথ্য। ওদিকে ইংল্যাণ্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনে সেই সময়ে বিতর্ক চলছিল মানুষের চেতনা (consciousness) নিয়ে। একইসঙ্গে জীবন-প্রক্রিয়ার মূলে তড়িতের উপস্থিতি নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছিলেন সেখানকার চিকিৎসকরা। কোনো ভাবনার সপক্ষেই সন্দেহাতীত প্রমাণ ছিল না আর সেই অনিশ্চয়তাই বোধহয় গল্প লেখার জন্য সবথেকে ভালো রসদ। মেরি শেলী কাজে লাগিয়েছিলেন এইসব উপাদান, গড়েছিলেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে।১০

এখানে মেরির পারিবারিক পরিবেশটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক। লেখালেখি ছিল মেরির রক্তে। তাঁর মা মেরি ওলস্টোনক্রাফট খ্যাতি পেয়েছিলেন লেখিকা হিসাবে। এক কথায় তাঁর বিষয় ছিল ফেমিনিজ্‌ম। এদিকে তাঁর বাবা, দর্শনের জগতে বিশিষ্ট এক নাম, উইলিয়াম গডউইন ছিলেন অ্যানার্কিজ্‌মের প্রবক্তা। অর্থাৎ চালু রীতিনীতিকে অনুসরণ না করে বরং সেগুলোকে ভাঙ্গায় আস্থা ছিল তাঁর। গডউইনের বন্ধুবর্গের মধ্যে ছিলেন দিকপাল সব মানুষ – তড়িতের গবেষক হামফ্রে ডেভি এবং উইলিয়াম নিকলসন, আফিমে আচ্ছন্ন অসামান্য কবি কোলরিজ প্রমুখ। তবে মাটি বা পরিবেশ থাকলেই যেমন তা থেকে যে কেউ মূর্তি নির্মাণ করতে পারেন না, ঠিক তেমনি উপাদান থাকলেই কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখা সম্ভব হয় না সবার পক্ষে। টিনএজার মেরি, প্রেমিক শেলীর উৎসাহে লিখে ফেলতে পেরেছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অদ্ভূত জীবনকথা। বলা হয়ত বাহুল্য যে মেরী ব্যতিক্রমী, তাঁর মত সবাই পারেন নি এমন কাহিনী রচনা করতে।১১

রসামের রোবট

মেরি শেলীর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশিত হওয়ার প্রায় এক শতক পরে, ১৯২০ সালে, প্রকাশিত হয় চেক নাট্যকার কারেল শাপেক রচিত রসাম্‌স ইউনিভার্সাল রোবট। এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদক পল সেলভার ও নাইজেল প্লেফেয়ার অনুবাদের শুরুতেই ছোট করে লিখে দিয়েছেন কাহিনীটা। সেখানে এক দ্বীপে রোবট তৈরির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। লক্ষ-লক্ষ রোবট তৈরি হয়েছে সেখান থেকে, সেগুলো শুধুমাত্র নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে পারে। সেটাই তারা করে অবিরাম, সংসারের আর কোনও কাজে সেগুলোর কোনও উপযোগিতা নেই। হিউম্যানিটারিয়ান লীগের প্রেসিডেন্ট হেলেনা গ্লোরি চাইলেন দ্বীপে পৌঁছে রোবটদের অবস্থার ‘উন্নতি’ করতে। সেখানে পৌঁছে ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। এদিকে হেলেনার কথায় কিছু কাজ হল। শারীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর গল অল্প কিছু রোবটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন মানবিক গুণ। এতে অবশ্য ফল হল মারাত্মক। শুরু হল ভয়ঙ্কর একটা আন্দোলন, মানবিক গুণসম্পন্ন রোবটদের নির্দেশে গোটা মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলল রোবটরা। তারা বাঁচিয়ে রাখল কেবল অ্যালকুইস্ট-কে যিনি তৈরি করেছিলেন কোম্পানিটাকে। রোবটদের মতই অ্যালকুইস্ট নিজে কাজ করেন বলে তাঁকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া হল। মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তখন অ্যালকুইস্ট খুঁজে চলেছেন প্রজননের সুযোগ, বংশবিস্তারের সম্ভাবনা। অবশেষে খুঁজে পেলেন এমন দুটো রোবটকে যেগুলোর মধ্যে আদম আর ঈভের বৈশিষ্ট্য পেলেন তিনি। অর্থাৎ সব আশা হারিয়ে যায় নি!১২

পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। শাপেকের নাটক কতটা বিজ্ঞানভিত্তিক? সমসময়ের বৈজ্ঞানিক চর্চার সঙ্গে কতটা যোগ রয়েছে সেটার? এখানে কোনও বিতার্কিক ঢুকে পড়ে যদি বলেন যে তৎকালীন বিজ্ঞানের ভিত্তির উপরেই দাঁড়াতে হবে কেন কল্পবিজ্ঞানকে? সেটা কি সুদূর ভবিষ্যতের কথা বলতে পারে না? উড়িয়ে দেওয়ার মত নয় প্রশ্নটা। শাপেক হয়ত তাই ভেবেছিলেন এবং নাটকের মাধ্যমে বলেছিলেন। তবে তাঁর যে সব বিবৃতি নথিবদ্ধ আছে তাতে তিনি সমসাময়িক পরিস্থিতিকে টেনে এনেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারণাস্ত্রের নৃশংস প্রয়োগ দেখে আরও অনেকের মতই ব্যথিত হয়েছিলেন শাপেক। বিজ্ঞান যে সব স্বপ্ন (utopian notions) দেখাচ্ছিল সেই সময়ে তা নিয়েও ঘোরতর সন্দিহান ছিলেন তিনি। লণ্ডন স্যাটারডে রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মানুষের মস্তিকের সৃষ্টিগুলো বেরিয়ে গিয়েছে মানুষের হাত থেকে।’ তাঁর বক্তব্যের আরও একটু বিস্তারিত বয়ান পাওয়া যায় যেখানে তিনি বৈজ্ঞানিক পিতা-পুত্র রসামের আচরণ বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, প্রবীণ বৈজ্ঞানিক, পিতা রসাম উনবিংশ শতকে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের টিপিক্যাল প্রতিনিধি। কৃত্রিম মানুষ তৈরি করে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অপ্রমাণ করতে চান। রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের রসদ কাজে লাগিয়ে এই নির্মাণের প্রচেষ্টাকে শাপেকের মনে হয়েছে একগুঁয়ে এবং বোকা-বোকা! অন্যদিকে তরুণ বৈজ্ঞানিক পুত্র রসাম কোনও আদর্শ বা আবেগের (metaphysical ideas) ধার ধারেন না। তিনি কোনও কিছু প্রমাণ করতে আসেন নি। তাঁর কাছে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাফল্য মানে শিল্প উৎপাদনে তুমুল বৃদ্ধি। চেক শব্দ রোবোটা-র অর্থ হল জোর করে শ্রম দেওয়ানো (forced labor) যেমনটা মালিকরা আশা করেন ক্রীতদাসদের থেকে। শাপেকের এই বয়ান থেকে বোঝা যায় যে আবিশ্ব যান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। তবে শাপেকের প্লট অতীত আর ভবিষ্যতের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে বলে মনে করেন অনেক আলোচক। রোবট তৈরি হচ্ছে, অবিশ্রান্তভাবে কাজ করছে কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ জমা থাকছে। রোবট নির্মাণের সূত্র বা ফর্মূলার এদিক-ওদিক হলেই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হলেই ধ্বংস নামিয়ে আনছে তারা। এমনটা ছিল মেরি শেলীর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনে, ভিন্নভাবে। এমনটা রয়েছে বিংশ শতকের ব্লেড রানার, টার্মিনেটর প্রভৃতি গল্পে। এখানেই সমসময়কে ছাপিয়ে শাপেকের কাজ কালজয়ী!১৩

ভারতে কল্পবিজ্ঞানের পাঠ

বিজ্ঞানী ও লেখক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকর কল্পবিজ্ঞানকে সমাজ গঠনের এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে গণ্য করেন। তাঁর বক্তব্য, যেভাবে পশ্চিম থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের আচমকা আগমন ঘটেছে এ দেশে তাতে জনমানসে বিজ্ঞানের সঠিক পরিচয়টা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। বিজ্ঞানকে কখনও অদ্ভূত, কখনও ম্যাজিক, আবার কখনও ভয়ঙ্কর দুর্বোধ্য এক উৎপাতের মত মনে হয় নাগরিকদের। বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগে সায় দিতেও বাধে না অনেকের। তাই কল্পবিজ্ঞান সঠিকভাবে পরিবেশিত হলে তা সমাজের সদস্যদের সঠিক দিকনির্দেশ দিতে পারবে বলে তাঁর মনে হয়। প্রমাণিত বিজ্ঞানের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানকে জুড়ে রাখার ব্যাপারে একান্তভাবে আগ্রহী নারলিকর। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কহীন কল্পনার বেলাগাম উড়ানকে তিনি অপছন্দ করেন, তাতে ভিত্তিহীন ভাবনার প্রসার ঘটা বেশি সম্ভব। এটা অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত কিন্তু সমালোচনা করেই সরে যান নি তিনি, নিজের লেখা গল্পে ব্যক্তিগত ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৭০এর দশকের মাঝামাঝি লেখা গল্পে তিনি একজন বিজ্ঞানীকে উপস্থিত করেন যিনি মাতৃজঠরে থাকা ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় করতে নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে পুরুষ সন্তানের কামনায় ডুবে থাকা ভারতীয় সমাজে লিঙ্গ অনুপাতে বড়সড় বৈষম্য দেখা দেবে। গল্পের শেষে দেখা গেল যে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্র নষ্ট করে ফেলছেন। এই গল্প খুব জনপ্রিয় হয় এবং বম্বে দূরদর্শনে অভিনীত নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে আমাদের দেশ এই লিঙ্গ নির্ধারণের বিপজ্জনক আবর্তে নিমজ্জিত হয়, নারলিকরের কল্পবিজ্ঞান বাস্তবে রূপ পেতে সময় লাগে নি।১৪

আগের কয়েকটা অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে একটা সত্য বেরিয়ে আসছে। সেটা হল, বিজ্ঞানের সূত্রগুলো বিশ্বজনীন হলেও সামগ্রিক অর্থে কল্পবিজ্ঞান স্থান ও কাল নিরপেক্ষ নয়। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রবণতা এবং ঐতিহাসিক ক্ষণের প্রভাব কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী এবং পরিবেশনের নকশা ঠিক করে দেয়। বুদ্ধিজীবী হিসাবে লেখকের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা এগুলো থেকে বিযুক্ত নয়। তবে নিজের দেশে কল্পবিজ্ঞানের চল না থাকলে কোনও লেখক বিদেশের স্টাইলে মজে থাকতে পারেন, এটাও সত্যি। কল্পবিজ্ঞানে ভারতীয়ত্ব বলতে কী বোঝাতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নারলিকর আরও উদাহরণ দিয়েছেন, এনেছেন নিজের ‘ধূমকেতু’ গল্পের কথা। লেখা হয়েছিল মারাঠি ভাষায় এবং উপজীব্য ছিল মহাকাশের গভীরতা থেকে আসা ধূমকেতু। আসলে ১৯৯২ সালে যখন ধূমকেতু সুইফ্‌ট টাট্‌ল নিয়ে আলোচনা শুরু হল বিজ্ঞানীদের মধ্যে তখন এই ধূমকেতুর পরবর্তী আগমন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিল। গণনা করে বলা হল যে সুইফ্‌ট টাট্‌ল আবার ফিরবে ২১২৬ সালে এবং তখন সূর্যের আরও কাছাকাছি কক্ষপথে পাক খাবে সেটা। বেসামাল হওয়া এই ধূমকেতু পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে ওই বছরের অগাস্ট মাসের চোদ্দ তারিখে। এই সম্ভাব্য আঘাত এড়ানো যায় কীভাবে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হল। নিউক্লীয় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূমকেতুর পথ পরিবর্তন নিয়ে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়েও ভাবা হল। নারলিকরের গল্পে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নাম দত্ত এবং তিনিই আবিষ্কার করেছেন ধূমকেতুটাকে। তাঁরই নামে নামকরণ হয়েছে সেটার। বিজ্ঞানীদের বহুজাতিক এক জোট বিপদ এড়াতে নিউক্লীয় বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করছেন এবং দত্ত সেই উদ্যোগের সমর্থক। এদিকে ভারতে সাধারণভাবে পুরো ব্যাপারটাকে দেখা হচ্ছে এক অদ্ভূত দৃষ্টিতে, গোটা দেশ জুড়ে যজ্ঞ করা হচ্ছে বিপদ এড়ানোর জন্য। এগুলোকে প্রকাশ্যে তাচ্ছিল্য করেন দত্ত। বহুজাতিক উদ্যোগ একদিন সফল হল এবং গর্বিত হলেন বিজ্ঞানী দত্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তাঁর স্ত্রী ঘোষণা করলেন যে তাঁদের নাতির করা যজ্ঞের কারণেই ধূমকেতুর বিপদ এড়ানো গিয়েছে। দত্ত তখন উপলব্ধি করেন যে এদেশে বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব কী চরম!১৫

কল্পবিজ্ঞানের রচনা এবং তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এমন নানা দিক রয়েছে যা আলোচনার দাবি রাখে। কল্পবিজ্ঞানকে কেউ হয়ত অবান্তর ভাবেন, কেউ সেটাকে শিহরিত বা আমোদিত হওয়ার একটা উৎস বলে মনে করেন। সম্ভবতঃ কল্পবিজ্ঞানের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে অক্ষম এঁরা। কল্পবিজ্ঞানকে ব্যবহার করে সামাজিক ইস্যুকে আরও প্রকট করে তোলার সুযোগও সম্ভবতঃ স্বেচ্ছায় বা অজ্ঞানতার কারণে হারিয়েছেন মূল ধারার সাহিত্যিকরা। তাই এই বিষয়ে যত বেশি আলোচনা হয় ততই সমাজের পক্ষে মঙ্গল।

তথ্যসূত্রঃ

১। খিচুড়ি, সুকুমার রায় শিশু সাহিত্য সমগ্র,   http://sukumarray.freehostia.com/view.php?cat_id=1&article_id=2, ডাউনলোড করা ১২ নভেম্বর ২০২২

২। The Works of Charles Dodgson: Short List, The Lewis Carroll Society (registered charity no. 266239 ~ founded 1969), ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ১২ নভেম্বর ২০২২

৩। The Project Gutenberg eBook of Alice’s Adventures in Wonderland, by Lewis Carroll, www.gutenberg.org, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ১২ নভেম্বর ২০২২

৪। The Life of Charles Dodgson, উপরে উল্লিখিত (২)

৫। উপরে উল্লিখিত (২)

৬। Eric Walker, Science Fiction and Fantasy Books by Lewis Carroll, www.alice-in-wonderland.net/resources, ডাউনলোড করা ১২ নভেম্বর ২০২২

৭। Robert Evans, The eruption of Mount Tambora killed thousands, plunged much of the world into a frightful chill and offers lessons for today, Smithsonian Magazine, July 2002, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ২৫ অগাস্ট ২০২১

৮। Richard Holmes, Science fiction: The science that fed Frankenstein, Nature,  535, pages 490–491 (2016), https://doi.org/10.1038/535490a

৯। E. T. Whittaker, A History of the Theories of Aether and Electricity. Vol 1, Nelson, London, 1951

১০। আগে উল্লিখিত (৮)

১১। ঐ

১২। Karel Capek, Rossum's Universal Robots, Project Gutenberg's R.U.R., Release Date: March 22, 2019 [EBook #59112], ডাউনলোড করা হয়েছে ১৯ নভেম্বর ২০২২

১৩। John M. Jordan, The Czech Play That Gave Us the Word ‘Robot’, The MIT Press Reader, https://thereader.mitpress.mit.edu/origin-word-robot-rur/, ডাউনলোড করা হয়েছে ১৯ নভেম্বর ২০২২

১৪। Jayant V. Narlikar, The Scientific Edge, Penguin Books India, 2003, পৃষ্ঠা ১৮১-১৮৫, ডাউনলোড করা হয়েছে ১৯ নভেম্বর ২০২২

১৫। ঐ

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb