আমিই ফেলুদা

লেখক - প্রতাপ বোস

‘মালতী! অ্যায় মালতী!’

হেমন্তের সকালের একটা আলাদা আমেজ আছে। তবু কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা কোন ঋতু আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে তাহলে তাকে আমার মনের কথাই বলতাম। মন বলছে কোনও বিশেষ ঋতুর চেয়েও আমার বেশি ভালো লাগে ঋতু সন্ধিক্ষণ- এক ঋতু যখন হাতছানি দিয়ে আর এক ঋতুকে ডাকে, বা এক ঋতুর আঙুল ধরে আর এক ঋতুর অবাক বিস্ময়ে হাঁটি হাঁটি পা পা। এই যেমন গ্রীষ্মের শেষ লগ্নে তৃষ্ণাদগ্ধ বুকে বৃষ্টির প্রথম চুম্বন কেমন যেন জীবনের প্রথম চুম্বনের মুগ্ধতা আনে। আবার শীতের বিবর্ণ বুড়ীমা শেষে আর না পেরে কেমন আদর করে ফাগুনকে ডেকে বলে আগুনটা জ্বালাত দিদুন। আর এখন। নভেম্বর মাসের একেবারে শেষের দিক। এইসময়ই অঘ্রাণের গলা জড়িয়ে ধরে শীতের আদুরে আহ্লাদ ওই ভোরবেলার দিকে বেশ বোঝা যায়। সকালের নরম সবুজ ঘাসের মতো রোদ্দুর ভোরের হাওয়ায় অঘ্রাণের গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বলে–‘আমি তোমার অমলকান্তি হতে চাই..’।

কেন এইসব মনে হচ্ছে বলুন তো! আবার কী! আমাদের প্রজন্মও তো সন্ধিক্ষণে। প্রৌঢ়ত্বের। কিন্তু সন্ধিক্ষণের অনুভব যতই সূক্ষ্ম, ডিমের কুসুমের মতো টলটলে নরম হোক না কেন সেই অনুভব কে কাঁচের গ্লাসের মতো করে ফেলে দেওয়ার জন্য আছে শর্বরী, আমার গিন্নী। 

সকাল থেকেই বাড়িতে শব্দের হটাৎ হটাৎ প্রাবল্য অনুভব করছি। সেটা কখনও দুমদাম পায়ের আওয়াজে, কখনও ঠক করে বাসন রাখার শব্দে বা এই এখন যেমন মালতী মালতী বলে চিৎকারে। তবু সেই শব্দের মধ্যেও, হেমন্তের সকালের আমেজটা জানলার রোদ্দুরের কাছে ঋণ নিয়েছিলাম নতজানু হয়ে, হাতে ধরা পাখির বাসার মতো করে। কিন্তু আর পারা গেলো না সেই অনুভবকে ধারণ করতে যখন শর্বরী হাত থেকে কাঁচের গ্লাস পড়ে যাওয়ার মতো করে বলল,

‘মালতী! অ্যায় মালতী! যা তোর ফেলুদাকে গিয়ে সকালের চা-টা দিয়ে আয়।‘

সকালের চা-টা সবসময় শর্বরী আর আমি একসাথে বসার ঘরের এই জানলাটার পাশে বসে খাই। কুড়ি বছরের দাম্পত্য জীবনের অনেক অভ্যাস সময়ের নিয়ম মেনে উঠেছে পড়েছে, কিন্তু এই অভ্যাসটা কী করে যেন আমাদের জীবনের ব্যালকনি হয়ে গেছে। সেই অভ্যাসের ব্যতিক্রম যখন আমাকে ভিতর থেকে ভাঙছে ঠিক তখন মালতীর সামনে আমাকে ‘ফেলুদা’ বলে সম্বোধন করায় আমার ডান হাত আমাকে বলল, গুলি মারো তোমার অনুভবের, তোমার ডান গালে মশার কামড়টা অসহনীয় হয়ে উঠছে, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

এই নিয়ে ‘ফেলুদা’ বলে আমাকে দ্বিতীয়বার সম্বোধন করল শর্বরী। প্রথমবার বলেছিল গতরাতে, ভীষণ রেগে গিয়ে। জানেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফেল করলেও, সে তো অল্পবিস্তর সবাই করে, স্কুল কলেজের পরীক্ষায় আমি কোনোদিন ফেল করিনি, চিরকালের ফার্স্ট বেঞ্চার, কলেজের পরীক্ষার হলে রীতিমত ইঞ্জিন বলে ডাকা হতো আমাকে। সেই আমি কিনা ফেলুদা! হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে গতরাতে দোষের মধ্যে আমি গিন্নীর অজান্তে ঘরের বিভিন্ন জিনিস যেগুলো আমার মনে হয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত, মানে বিবেকানন্দের কথায় বিষ, সেগুলো ফেলে দিয়েছি। তা বলে আমাকে ফেলুদা বলে ডাকবে!

মাথাটা ভীষণই গরম হয়ে গেলো। এর একটা জুতসই কাউন্টার অ্যাটাক করতেই হবে। না, ব্যালকনির খোলা হাওয়ায় দাঁড়ান যাবে না, দাঁড়ালেই মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, আর মাথা ঠাণ্ডা হলেই ‘ফেলুদা’ বলে ডাকার মতো ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর মোলাকাত করা যাবে না। তাই আরও গরম হতে চললাম রান্নাঘরে, গিন্নীর মুখোমুখি হতে, যাতে সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে এশিয়ান প্লেটের সাথে ইন্ডিয়ান প্লেটের ধাক্কা লেগে যেরকম হিমালয় পর্বত তৈরি হয়েছিল সেরকম মুখোমুখি দৃষ্টি সংঘাতে যদি হিমালয়ের মতো কোনও অকাট্য যুক্তি আমার মাথায় খেলে যায়। কিন্তু সে গুড়ে চোরাবালি। শর্বরী পাত্তায় দিল না, একবার তাকিয়েও দেখল না।

কী যে করি, কী যে বলি, যুতসই কিছুই মাথায় আসছে না। আর অনেক ভেবেচিন্তেও যখন কিছু মাথায় এলো না তখন আমার শেষ ভরসা সেই ঘণ্টাদাকেই ধরতে হবে জানি। তাই প্রাথমিক প্রতীকী প্রতিবাদে চা না খেয়েই চললাম ঘণ্টাদার বাড়ি।

রাস্তায় যেতে যেতে মনে পড়ল, এই প্রথমবার নয়, এর আগেও একবার এমন একটা দাম্পত্য সমস্যা হেলায় সমাধান করে দিয়েছিল ঘণ্টাদা। সেবার শর্বরী আক্কেল দাঁতের ব্যথায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। বললাম, তুলে ফেলায় ভালো, মানল না। দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, উনিও তাই প্রেসক্রাইব করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এক তো আক্কেল দাঁত তুলতে ভীষণ কষ্ট সেই অজুহাতে কিছুতেই তুলতে রাজি নয়, তার উপর এতদিন এই আক্কেল দাঁত নিয়ে আমাকে যখন তখন বিদ্রূপ করেছে এখন তুলে ফেললে সেই সুযোগ নষ্ট হবে, এটাও একটা বড় কারণ।

দোষের মধ্যে অনেক গুনে টুনেও আমার আটাশটা দাঁত আর ওর পুরো বত্রিশ পাটি। সুতরাং কথায় কথায় আমার এখনও আক্কেল হয়নি বলে আক্রমণ শানালেও গৃহশান্তি রক্ষার্থে আমাকে সেটাই মেনে নিতে হতো। কিন্তু সেবার আক্কেল দাঁতের ব্যথাতেও যখন গিন্নি তার অস্ত্র ডাক্তারের হাতে তুলে দিতে রাজি হলো না তখন বাধ্য হয়ে ঘণ্টাদার শরণাপন্ন হতেই হলো।

ঘণ্টাদা সব শুনে টুনে বলল, 'বল দেখি আলিঙ্গন মানে কী?'

আমি ভড়কে গেলাম, এসেছি আক্কেল দাঁতের সমস্যা সমাধান করতে, এর মধ্যে আলিঙ্গন কীভাবে এলো! তবু বললাম, 'পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সম্প্রীতি, ভালোবাসা ইত্যাদি প্রকাশ করা।'

'তাহলে আলিঙ্গন শব্দটার মধ্যে লিঙ্গ শব্দটা কীভাবে এলো?'

'তাইতো!' আমি মাথা চুলকালাম। আ+লিনগ্+অন। আসমুদ্রহিমাচল শব্দটায় 'আ' মানে তো পর্যন্ত। তাহলে আলিঙ্গন মানে কি লিঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত যে বন্ধন? যা মনে হলো তাই বললাম ঘণ্টাদাকে।

ঘণ্টাদা বলল, 'আমিও ঠিক জানিনা, সেরকমই হয়তো হবে। আগেকার দিনের সুঠাম চেহারার মানুষরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলে সেই বন্ধন নিশ্চয়ই হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। কিন্তু লিঙ্গ কেন? আজকের দিনের আলিঙ্গন তো ভুঁড়ির কারণে বক্ষের বেশি বিস্তৃত হতে পারে না। আবার লিঙ্গ দিয়ে যে বন্ধনের নিবিড়তা বোঝান হবে তাও নয় কারণ এটা একটা জনসমক্ষে, লিঙ্গ নির্বিশেষে, প্রকাশ্য সম্প্রীতি প্রকাশ। তাই এই শব্দটা নিয়ে বাংলা আভিধানিকদের আক্কেল নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। যেমন আছে কোলাকুলি শব্দটা নিয়েও। কোলের সাথে এই মিলনের কোনও সম্পর্ক নেই অথচ তার নাম কোলাকুলি। আবার বেআক্কেলে কর্মকাণ্ড।'

'সে তো বুঝলাম, কিন্তু তার সাথে আক্কেল দাঁতের কী সম্পর্ক?'

'আক্কেল দাঁত বা উইসডম টিথ-এর ব্যাপারে বাংলা এবং ইংরেজ আভিধানিকরা সমান বেআক্কেলে।'

'কীরকম?'

'আসলে আক্কেল দাঁত ওঠার বয়স হলো মোটামুটি সতের থেকে পঁচিশ। এর আগে পরেও উঠতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ লোক যাদের আক্কেল দাঁত ওঠে তাদের ওই সময়ই ওঠে। আর ওই বয়সটা হলো বুদ্ধি বিবেচনা পাকাপোক্ত হওয়ার বয়স, মানে আক্কেল হওয়ার বয়স। তাই ওই দাঁতগুলোকে বলে আক্কেল দাঁত বা উইসডম টিথ।'

'তাহলে তো কথাটা ঠিকই আছে ঘণ্টাদা।'

'মোটেও নয়। আক্কেল দাঁত কাদের ছিল?'

'কাদের ছিল মানে! মানুষের।'

'হ্যাঁ, কিন্তু কেমন মানুষ? যে মানুষরা বিবর্তনের সিঁড়িতে নিচের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। আগে মানুষ কাঁচা মাংস, ডালপালা এসব খেতো আর এগুলো খাওয়ার জন্য বেশি দাঁতওয়ালা বড়ো পোক্ত চোয়াল দরকার হতো। তাই বিবর্তনের নিচের দিকের মানুষের আক্কেল দাঁত থাকত। দিনে দিনে এর ব্যবহার কমে যাওয়ায় এগুলো লুপ্ত হতে শুরু করেছে। মানে অনেকটা লেজের মতো। তোর যে আক্কেল দাঁত নেই আর তোর গিন্নির যে আছে এতে বোঝায় তুই আর তোর গিন্নি বিবর্তনের  সিঁড়ির বিস্তর উঁচু নিচু ধাপে আছিস। আভিধানিকরা আগে ব্যাপারটা জানতেন না, উইসডম টিথ নাম দিয়েছিলেন, কিন্তু এখনও কেন সেই শব্দবন্ধ থাকবে?'

উফফ! এমন একটা সলিড লজিক পেয়ে লাফিয়ে উঠেছিলাম। হু হু বাওয়া! আমাকে বেআক্কেলে বলা! আমি যে ওর থেকে বুদ্ধি বিবেচনায় অনেকটাই এগিয়ে সেটা এবার প্রমাণ হয়ে গেল। এবার গিন্নিকে বলে বলে গোল দেব এমন ভেবে বাড়িতে এসে কথাটা পেড়েছি আর কী, চারিদিকটা ভিসুভিয়াস হয়ে গেল। সেই উদগীরণ থামাতে ঘণ্টাদার দেওয়া আর একটা তথ্য দিয়ে তবে ম্যানেজ করতে হয়েছিল ব্যাপারটা। ইদানীং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে যে আক্কেল দাঁত তুলে ফেললে খাওয়ার স্বাদ নাকি বেশ কিছুটা বেড়ে যায়। ব্যাস। খাওয়া, স্বাদ এসব শুনে আমার গিন্নি খুশ। রাজি হলো আক্কেল দাঁত তুলতে এবং আমাকে আর কখনও বেআক্কেলে না বলতে।

কিন্তু এবারে যে কী হবে, খুব চিন্তিত মুখ নিয়ে ঘণ্টাদার বাড়ি ঢুকলাম। হাসতে হাসতে দরজা খুলে দিল ঘণ্টাদা, ‘আয়, আয়। বোস।‘

বসতে বসতেই কফি এসে গেল। কফি হাতে নিয়ে ঘণ্টাদা চুমুক দিল, ‘এরকম ফেল করা ছাত্রদের মতো মুখ নিয়ে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে খুলে বল?’

আবার ফেল! ঘণ্টাদাও আমাকে ফেলুদা বলছে! মরমে মরে গিয়ে পাপোশের উচ্চতা থেকে বললাম, ‘ঘণ্টাদা তুমিও?’

‘কেন আমি আবার কী করলাম?’

‘তুমি আমাকে ফেলু বললে! ওদিকে গিন্নীর ফেলুদা ফেলুদা খোঁটা শুনে কিছু সুরাহার আশায় কিনা তোমার কাছেই এলাম!’

‘আহা! কী হয়েছে সেটা তো খুলে বল।‘

কফি খেতে খেতে সবটাই বললাম ঘণ্টাদাকে, সন্ধিক্ষণের অনুভব থেকে ফেলুদা পর্যন্ত। সব শুনে ঘণ্টাদাও একটু থমকাল। কফি শেষ করে একটা লম্বা সিগারেট ধরাল ঘণ্টাদা। কফিটা রীতিমত কড়া ছিল। তার উপর এখন ঘণ্টাদার ভাবার সময়। রাস্তার সিগন্যাল লাল হওয়ার পর জেব্রা ক্রসিংটা যেমন নিশ্চিন্তে পার হওয়া যায় সেরকমই একটা নিশ্চয়তার বোধ আমাকেও একটা সিগারেট ধরাতে প্ররোচনা দিল।

সিগারেটের ধোঁয়ার গোল গোল রিঙে ভরে যাচ্ছে ঘরটা। সেটা বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হটাৎ দেখি ঘণ্টাদার সিগারেটের ছাইটা ক্রমশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে। এও যেন এক সন্ধিক্ষণ, ছাইটার যে কোনও মুহূর্তের পড়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণ। তবে এই মুহূর্তটা আমি চিনি, ঘণ্টাদা নিশ্চিত করে কোনও একটা সমাধানের রাস্তা খুঁজে পেয়েছে, তাই সিগারেটে এখন আর লম্বা টান দেখা যাচ্ছে না। সিগারেটটা শেষ হতেই আবার কী যেন একটু ভাবল ঘণ্টাদা, তারপর বলল,

‘শোন, এই কেসের সমাধান শুধু ঘরে বসে হবে না। বাইরে বেরতে হবে। চারিদিক দেখতে হবে।‘

‘কীরকম?’

‘বলছি, তার আগে,’ বলতে বলতে আমাকে টেনে নিয়ে গেল বইয়ের আলমারির কাছে, ‘এই আলমারির উপরের সারির একদম বাঁ দিকের বইটা দেখ।‘

‘হ্যাঁ, দেখেছি। নামটা তো দেখছি লেখা ‘সাবট্র্যাক্টঃ দ্য আনট্যাপড সায়েন্স অব লেস'। কিন্তু এটা কার লেখা?’

‘জার্মান গণিতবিদ ডিয়েট্রিখ বেসের নাম শুনেছিস?’

‘না।‘

‘এই সাবজেক্টের উপর কাজকর্মে উনিই হচ্ছেন গুরু। আর ওঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এই বইটা লিখেছেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাইডি ক্লৎজ।‘

‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এর সাথে আমার কেসটার কী সম্পর্ক?’ আমি একটু অধৈর্য হয়ে উঠছি দেখে ঘণ্টাদা আমাকে নিয়ে সোজা রাস্তায় চলে এলো।

নেতাজি সুভাষ রোড ধরে আমরা হাঁটছি। সামনেই এই এলাকার সবচেয়ে নামী ছেলেদের স্কুল। তারপরেই রেলওয়ে ক্রসিং-এর গেট।  গেট ক্রশ করে আরও কিছুটা এগোলেই আবার একটা স্কুল, এই এলাকার সবচেয়ে নামী মেয়েদের স্কুল। এই গেট দিয়েই রেল লাইনের এপার ওপার করে সমস্ত এলাকাবাসী। এখন বেশ বেলা হয়েছে। স্কুলের ছেলেরা ক্রমশ জড়ো হচ্ছে স্কুলের সামনে, মেয়েরা গেট ক্রস করে যাচ্ছে ওপারে, অফিস টাইমের জন্য সমস্ত যানবাহনের স্রোত রেলওয়ে ক্রসিং-এর গেটের দিকে। আর তার ফলে মারাত্মক ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে। ভাবছি কোথায় নিয়ে চলেছে ঘণ্টাদা। মাথার জট ছাড়াতে ফাঁকা জায়গায় না গিয়ে আরও ভিড়ের জায়গায় কেন এলাম আমরা! আমার ভাবনাটা বুঝতে পেরেই মনে হয় মুখ খুলল ঘণ্টাদা,

‘আচ্ছা, বলত সামনের এই ট্রাফিক-সমস্যার সমাধান কী?’

‘সে তো খুবই সোজা। রেললাইনের উপর দিয়ে একটা ফ্লাইওভার বানিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান। এই নিয়ে তো অনেকবার পিটিশন দেওয়া হয়েছে সমস্ত কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু কিছু তো হচ্ছে না দেখছি।‘

‘এখানেই তোর সমস্যার বীজ লুকিয়ে আছে।‘

‘কীরকম?’ বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম ঘণ্টাদাকে।

‘দেখ, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো যেকোনো সমস্যার সমাধানে প্রথমেই যোগের দিকটা এক্সপ্লোর করা আর বিয়োগের দিকটা উপেক্ষা করা। যেমন এখানে ট্রাফিকের ভিড় কমানোর জন্য তুই প্রথমেই একটা শর্টকাট রাস্তা বানানোর প্রস্তাব দিলি, ফ্লাইওভার বানানোর।  দেখা যাবে, ফ্লাইওভার বানালে তখন সবাই সেই শর্টকাট রাস্তা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ফলে, যানজট আরও বেড়ে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল-এ ঠিক এর উল্টোটাই করা হয়েছিল । ২০০৩ সালে সোল-এ একটি বহু ব্যবহৃত ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভিড় কমানোর জন্য।‘

‘সেকি!’ আমি আঁতকে উঠলাম।

‘সোল-এর সবাই ঠিক এরকমই আঁতকে উঠেছিলেন সেদিন। সবাই বলল, ভিড় হয় বলে ভেঙে ফেলা? ভিড় কমাতে নতুন আর একটি ফ্লাইওভার বানানো উচিত নয় কি?’

‘ঠিক প্রশ্নই তো করেছিল তারা!’

‘না, মোটেও ঠিক প্রশ্ন করেননি না তারা। ফ্লাইওভারটা সত্যিই ভেঙে ফেলা হলো। ফ্লাইওভারের নিচের মরে যাওয়া খালটা জিইয়ে তোলা হলো। দুবছর পর...।‘ ঘণ্টাদা কথা থামিয়ে চট করে রাস্তার পাশের একটা সিগারেটের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনল।

‘দুবছর পর...’ আমার কৌতূহলের লেজে আগুন লেগে গেছে তাই আমিই তড়িঘড়ি খেই ধরিয়ে দিলাম ঘণ্টাদাকে।

‘দুবছর পরে’ ঘণ্টাদা আবার শুরু করল, ‘কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল যে শহরের এই দিকে যানজট সত্যিই কমে গিয়েছে এবং শহরের মাঝখান দিয়ে এই জলস্রোত এক অভিনব সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।‘

‘বাঃ। তার মানে তুমি বলতে চাইছ এখানে ফ্লাইওভার বানানোর থেকে স্কুলগুলো রিলোকেট করা অনেক বেশি কার্যকরী?’

‘একদম। আগে প্ল্যান করে স্কুলগুলো লোকেট করা হয়নি বলে আবার নতুন করে করা যাবে না, তা তো নয়। আগের লোকেশনটা ফেলে দিয়ে নতুন লোকেশনে স্কুলগুলো নিয়ে গেলেই পঞ্চাশ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।‘

যুক্তিটা বেশ পছন্দ হলো বলে সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না তাতে আমার সমস্যার কী সমাধান হলো! ভাবতে ভাবতে কখন পার্কের সামনে এসে গেছি খেয়াল করিনি। এদিকটা ফাঁকা, ফাঁকা। চারিদিকে সবুজে সবুজ, বেশ মনোরম পরিবেশ। বাচ্চারা খেলাধুলো করছে, অনেক বয়স্ক মানুষ সকালের হাঁটা এখন হেঁটে নিচ্ছেন। ঘণ্টাদা এদিকে আমাকে নিয়ে এল কেন? প্রশ্নটা উদয় হওয়ার মুহূর্তেই একটা সহজ প্রশ্ন উড়ে এল আমার কাছে,

‘সাইকেল চালাতে তো পারিস?’

‘তা পারি। সেই ছোটবেলাতেই শিখেছি।‘

‘তা হলে বল তোর সময়ের সাইকেল চালানো শেখা আর এখনকার সাইকেল চালানোর মধ্যে পার্থক্য কী?’

এটা আবার কী প্রশ্ন হলো? মাথা চুলকাতে চুলকাতে নীরবে ঘণ্টাদার দিকে তাকালাম।

‘ওদিকে তাকা, পার্কের দিকে। দেখ ছোট ছোট ছেলেরা সাইকেল চালানো শিখছে।‘

‘সে তো দেখতেই পারছি। কিন্তু পার্থক্যটা তো চোখে পড়ছে না। একইরকমই তো! আমরা যেভাবে শিখতাম সেরকমই।’

‘ভালো করে দেখ। বাচ্চাদের সাইকেল চালানো শেখানোর জন্য পিছনে দুদিকে দুটো ছোট ছোট চাকা লাগানো থাকে। কিন্তু এটা অনেকেরই অভিজ্ঞতা যে এতে বিশেষ লাভ হয় না। কয়েক বছর আগে একটা নতুন ডিজাইন বেরিয়েছে, যেখানে ওই দুটো অতিরিক্ত ছোট চাকা দুটো তো ছেড়েই দে প্যাডল দুটোও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বাচ্চারা সেই প্যাডল ছাড়া সাইকেল পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে দিব্যি ব্যালেন্স করতে শিখে যাচ্ছে। দেখ একদম বাঁদিকের কোনার ছেলেটাই ওইরকম সাইকেল চালাচ্ছে। এই যে প্যাডল বিয়োগ করে দেওয়া হলো এটাই আসল কেরামতি।  অথচ, এটা সরিয়ে দেওয়ার কথা এত বছর কারও মাথায় আসেনি।‘

হটাৎ মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি লাগল, সেই এশিয়ান প্লেটের সাথে ইন্ডিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের মতো। তাইতো! বিয়োগে লাভ হচ্ছে। মানে...আমার মনের ভাবনা বুঝতে পেরে ঘণ্টাদা আবার বলল,

‘এবার আয় বাড়ির সাজ সজ্জায়। যখন সেই সজ্জা আমাদের চোখে কেমন কেমন ঠেকে তখন প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে দোকানে গিয়ে নতুন আসবাবপত্র, পর্দা, বিভিন্ন কভার, ইত্যাদি কিনে আনার কথা। অথচ হয়তো একটু ভাবলে দেখা যেত যে, কোন কিছু ফেলে দিলেই বাড়ির চেহারা ভালো হয়ে যেত। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই রোগের শিকার হন যাঁদের অবস্থা সচ্ছল নয়, তাঁদেরই মনে হয় ধারকর্জ করে বেশি কেনাকাটির কথা।‘

আরে, এ তো আমাদের কথা। আসলে কী জানেন শর্বরী কিনতে ভালোবাসে ভয়ংকর, শুধু নতুন নতুনভাবে ঘর সাজাতে, কিন্তু ফেলতে চায় না এক টুকরোও। আর আমি একটুও অতিরিক্ত পছন্দ করি না, কোনও কিছু অতিরিক্ত, বহু দিন অব্যবহৃত দেখলেই ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সংসারে গিন্নীর সাথে কে আর কবে পেরে উঠেছে, ফলে বাড়ি ঘরের অবস্থা তথৈবচ। তবু মাঝে মাঝেই সাহসী মন দুম দাম অনেক কিছুই বাতিল বক্সে ফেলে দিয়ে আসে। তাতে অনেক সময় কাজের জিনিসও আমার কল্যাণে উধাও হয়ে যায়। এই ফেলা স্বভাবটা দিন দিন বাড়তে থাকায় শর্বরী রেগে গিয়ে আজকাল আমাকে ফেলুবাবু বলে ডাকে। বারবার এই ডাকটা শুনেই মাথাটা বেশ গরম হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন রাগটা কেমন আমার মন থেকে বিয়োগ হয়ে গেল।

আসলে ঘণ্টাদার বিয়োগের তত্ত্ব শোনার পর থেকেই মনে হলো আচ্ছা সত্যজিৎ রায় কেন ফেলুদার নাম ফেলুদা রেখেছিলেন। এরকম নামকরণের কারণ সত্যজিৎ কোথাও লিখেছেন বলে আমার মনে পড়ল না। তাহলে সত্যজিতের ফেলুদা নামের রহস্য কী? ভাবছি, ভাবছি। ফেলুদার তো কোনও ফেল করার রেকর্ড নেই। তাহলে? মনের কথা বুঝতে পেরে ঘণ্টাদাই বলল,

‘ইটস এলেমেন্টারি মাই ডিয়ার ওয়াটসন....অ্যাপ্লাই মেথড অব এলিমিনেশন।‘

আর বেশি বলার সুযোগ দিলাম না ঘণ্টাদাকে। পার্কেই ঘণ্টাদাকে পার্ক করে চললাম বাড়ি। এলিমিনেশন মানে ফেলতে থাকো, ফেলতে থাকো। যেমন আমি ফেলতে থাকি আমার চারপাশ জুড়ে আর শর্বরী চেঁচিয়ে আমাকে ডাকে ফেলুদা! সত্যজিতের ফেলুদাকেও তো সব অপ্রয়োজনীয় কারণগুলোকে ফেলতে ফেলতে আসল সত্যে উপনীত হতে হয়। তাই নাম ‘ফেলুদা’।

ইয়েস!

উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি শর্বরী শুনছ? আর কয়েক মিনিট ব্যাস! দশ বারো বার রং অ্যানসার পেরিয়ে উত্তর পেয়েছি, দেবো না কিছুতেই আমাকে হারাতে আর! তারপরেই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াব আমি, তুমি দেখবে শর্বরী।

হ্যাঁ, আমিই ফেলুদা। আমি গর্বিত যে আমি ফেলুদা।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb