
একটা শব্দ।
একটা বাঁধভাঙ্গা কোলাহল।
সে এসেছে।
নিজের গবেষণাগারে বসে কাজ করছিলেন ডাঃ রোহিত মুখার্জী। সৃষ্টি, স্থিতি আর লয় এই তিন নিয়েই যেন তাঁর গবেষণাগার। তাঁর আবিষ্কৃত বেশ কিছু ওষুধ অনেক মারণব্যাধি রোধ করেছে। অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছে। স্থিতি পালিত হয়েছে।
তাঁর অনেক ওষুধ পৃথিবী থেকে অনেক কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়া আর চিকিৎসকদের ঘাম ঝরিয়ে দেওয়া রোগকে আপাতত ইতিহাসের জমিতে পুঁতে দিয়েছে।
স্থিতি আর লয় কার্য তিনি আন্তরিক ভাবে পালন করেছেন বিষ্ণু আর মহেশ্বরের মত।
কিন্তু সৃষ্টি?
একটা শব্দ। ডাঃ মুখার্জীর অতিপরিচিত সেই শব্দটা।
সে কি তবে এসেছে?
শব্দের চেহারা এখন পাল্টেছে। শব্দটা হতাশাগ্রস্ততার বহুবচন। শোকের বহুবচনও বলতে গেলে। একসঙ্গে বহু লোকের বিলাপ। বহু অত্যাচারের স্পষ্ট প্রমাণ রেখে সে চলে গেছে।
সে এসেছিল। প্রমাণগুলো তারই।
শহরের এখানে সেখানে এখন তখন ঘটছে হামেশাই ঘটছে এমন ঘটনা। এক বুভুক্ষু দানবের কেড়ে খাওয়ায় ঘটনা। রেস্টুরেন্ট, খাওয়ার দোকান, মিষ্টির দোকান মানে সব প্রস্তুত খাদ্যের ভান্ডার।
সে আসছে নাকি একটা ঝড় আসছে বোঝা যাচ্ছে না। তার আকার তেমন কারোর বর্ণনায় তেমন স্পষ্ট নয়। কেউ বলেছে অন্তত কুড়ি ফুট তো হবেই লম্বায়। কিন্তু লম্বা দিয়ে এর বিচার হবে না। কারণ এই জন্তুটার লম্বার থেকে আকারের বীভৎসতাই অনেক বেশি। গায়ের কী রঙ তা বোঝা যায় কারণ সারা গা কালো বড় বড় লোমে ঢাকা। মাথায় চুল কিংবা বড় লোম তা গভীর বিশ্লেষণ ছাড়া বলা মুশকিল। বিরাট দেহের ওপরে দুটো ছোট ছোট কুতকুতে চোখে শুধু যেন একটা জিঘাংসা ফুটে উঠছে। সব লুঠপাঠ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রাণীটা।
কিন্তু সব খাবার মানে প্রস্তুত করা খাবার। কোনও কাঁচা আনাজ বা মাছ মাংস নয়। তবে ফলের গাড়িগুলো রক্ষা পাচ্ছে না। ফল বা মিষ্টি। খাবার নিতে বাধা পেলেই সে আক্রমণ করে। দিয়ে দিলে আর সে ফিরেও তাকায় না তার দিকে। আর অকারণে কাউকে আক্রমণ করেছে বলেও শোনে নি কেউ। তবে ভয়ে কি আর ত্রিসীমানায় থাকে কেউ?
কোন দিন কোথায় তার হামলা হবে বলা বেশ মুশকিল। আগে থেকে আঁচ পাওয়া খুব মুশকিল। সে আসে অতি দ্রুত ঝড়ের বেগে।
সে একটা দানব। এ ছাড়া তার বর্ণনার সঙ্গে অন্য কিছুর মিল পাওয়া ভার।
কোথায় তার বাস? মোতিঝিলের আশেপাশেই। ধরতে গেলে মোতিঝিল এলাকা এই দানব অধ্যুষিত বললে বলায় তেমন ভুল থাকে না কিছু।
হাসপাতালের ট্রমা বিভাগে যেন জায়গার আকাল পড়েছে হঠাৎ। কারোর হাত ভেঙ্গেছে কারোর পা। কারোর চোয়াল ভেঙ্গে গিয়ে একটা বড় ‘চ’ এর আকার ধারণ করেছে। কারোর মাথাটা হয়েছে ‘ম’-এর মত। সে এক বীভৎস কান্ড। অন্তত জনা কুড়ি থেকে পঁচিশ নানা বয়েস আর লিঙ্গের মানুষ শরীরে অস্বাভাবিক বিকৃতি নিয়ে এসেছে। এই বিকৃতি আঘাতের। মারাত্মক আঘাতের।
কিন্তু শহরতলীর কোনও হাসপাতালের তো এত বেড থাকতে পারে না যে তাদের বেড দেওয়া যায়। আবার এই মানুষগুলোকে সিটি হাসপাতালে পাঠানো জরুরি হলেও সময় আপাতত অনুমতি দিচ্ছে না। চিকিৎসা এই মুহূর্তে শুরু না করে দিলে এরা ভবলীলা সাঙ্গ করবে। তাই এরা মেঝেতেই পড়ে আছে যত্রতত্র। চেষ্টা হচ্ছে কিছুটা অন্তত সারিয়ে যাতে বড় হাসপাতালে পাঠানো যায়।
ডাঃ চিন্তাহরণ সেন আর দুঃখহরণ দাস খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন এদের। একটা চিন্তা দুজনের কপালেই সমান গভীরতার ভাঁজ ফেলেছিল। আর তা হল এক একজন সে মার খেয়েছে তা এক কথায় অমানুষিক। কোনও রূপক নয় আক্ষরিক অর্থেই।
-এ তো কোনও মানুষের মার হতেই পারে না ডাঃ সেন।
-আমিও তাই ভাবছি ডাঃ দাস। জায়গায় জায়গায় আঁচড়ের যে চিহ্ন পাচ্ছি তাতে কোনও বুনো জন্তুর নখকে ইঙ্গিত করছে অবশ্যই। এদের শরীরে প্রচুর লোমের অস্তিত্ব বলে দিচ্ছে আক্রমণকারী কোনও মানুষ নয়। মানুষের এত বড় লোম হতেই পারে না।
-হ্যাঁ ডাঃ সেন। ক্ষতগুলির গভীরতা এটাই বলছে প্রচন্ড বলশালী এই জন্তু। নখ বিরাট লম্বা, শক্ত আর ধারাল। প্রায় বাঘের মত বললে দোষের কিছু নেই।
যে অসুস্থ মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে চিকিৎসক যুগল এই মন্তব্য করছিলেন তারা জ্ঞানে ছিল না। থাকলে শোনামাত্র আবার অজ্ঞান হয়ে যেত চিকিৎসকদের বর্ণনায়।
আঘাত সম্পর্কে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হল চিকিৎসা যথাসম্ভব দ্রুত শুরু করা হল। এখন বাঁচা মরা নিয়তির হাতে। নিয়তিকে দেব-দৈবের আখ্যা দিতে আপত্তি থাকে তারাও বলতে পারে এটা আপাতত প্রকৃতির জিম্মায়।
দুই থেকে তিনজন স্কেচ আর্টিষ্ট ডাকা হয়েছে। ডাক্তারদের বক্তব্য অর্থাৎ আঘাতের ধরণ ধারণ আর আহতের দৈহিক মানসিক অবস্থা বিচার করে তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা চিত্র এঁকেছে আগন্তুক আঘাতকারীর। সাধারণত এই কাজটা পুলিশের স্কেচ আর্টিস্ট করে প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনে। সম্ভাব্য আততায়ীর দেহের একটা ছাপ পাওয়া যায়।
এখন সেটা শুরু হয়েছে ট্রমা বিভাগেও। আঘাতের ধরণ দেখে আঘাতকারীর চেহারা আঁকার কাজ। একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কাজ। আর শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয় শুরু হয়েছে যে কোনও বস্তুর ওপর আঘাতের ক্ষেত্রেও। একটা বাস আর একটা মোটরকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। অন্ধকারে কেউ দেখতে পেল না সেটা কী। কিন্তু আঘাতের বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য চিত্র আঁকা হল আঘাতকারী বাসটির। মোটর গাড়ির ওপরে পড়ে থাকা বা লেগে থাকা গুঁড়ো গুঁড়ো পদার্থের ফোরেন্সিক পরীক্ষা করে বাসটার মোটামুটি রঙ আঁকাও সম্ভব হল। সঠিক হয়ত একশ ভাগ হল না। কিন্তু এই যে নব্বই ভাগ সাফল্য সেটাই বা কম কী? সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই ছবিটাই।
স্কেচ আঁকা সম্পূর্ণ। তিনজন তিনটে আলাদা স্কেচ দিয়েছে বটে কিন্তু তাতে মৌলিক পার্থক্য খুব একটা তেমন নেই। ট্রমা বিভাগের বেডে পড়ে থাকা এই প্রায় কুড়ি পঁচিশটি মানুষ কার আঘাতে আহত হয়েছে জানা গেছে।
সবাই বিস্মিত, বিভ্রান্ত আর বাক্যহারা। এটাই তবে আততায়ী? কিন্তু এটা তো-
গুঞ্জন আর গুঞ্জন রইল না। খবরের কাগজের পাতায় জায়গা নিয়ে নিল।
সে এসেছিল। সে আসে মাঝে মাঝেই। ঘোরাঘুরি করে এই মোতিঝিলের আশেপাশেই। অন্ধকারে মিশিয়ে সে হাঁটে। খোঁজে গাছের পাতার আড়াল আবডাল। কেউ দেখেছে কি তাকে এ পর্যন্ত? হ্যাঁ দেখেছে। কিন্তু সেই চকিত দেখার যে অবস্থা তাদের হয়েছিল সেটা তারা মনে রাখতে পারে না বা চায় না। কিন্তু মোতিঝিলে এই দানব এল কী করে?
এই মোতিঝিল অবশ্য সিরাজের বেগমের মোতিঝিল নয়। এটা অন্য এক জেলার এক মস্ত ঝিল। মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল পুরো অশ্বখুরাকৃতি। কিন্তু এটা লম্বায় সামান্য একটু বাঁকা। ঝিলের চারপাশে প্রচুর গাছপালা। বড় এবং ছোট। ধরতে গেলে জঙ্গল বলা যেতে পারে।
বহু বছর আগের কথা। অধ্যাপনা ছেড়ে গবেষণায় মন দিয়েছেন ডাঃ রোহিত মুখার্জী। বিষয় ছিল এন্ডোক্রিন। হর্মোন থেরাপির সাহায্যে কিছু জটিল রোগের মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কোলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন এই নির্জন জায়গায়। মোতিঝিলের পাশে একটা পুরোন বাড়ি পেয়েও গিয়েছিলেন।
স্ত্রী পিয়ালিকেও আসতে হয়েছিল। প্রথমে সে আসতে চায় নি। বরানগরে বাপের বাড়ির কাছেই ছিল তারা। সেখানে কত হৈ হট্টগোল। আর এখানে জনহীন জঙ্গলের পাশে ভূতের বাড়ির মত একটা বাড়ি।
স্বামী সারাদিন প্রায় নিজের গবেষণায় ডুবে থাকে। নিত্য সকালে অবশ্য কিছু লোকের দেখা হয়। এরা রোহিতের রোগী। ধরতে গেলে এরা তার গবেষণার গিনিপিগ। কিন্তু এই সকাল ছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময় একা পিয়ালি। একেবারেই একা।
হয়ত একটু ভুল হল। নিঃসঙ্গতা আর চিন্তা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকে। ছেলে হল। কিন্তু-
বাবা আর মা দুজনের কপালে দুরকমের ভাঁজ ফেলল। এই জঙ্গলের মধ্যে শিশু পালনের উপযুক্ত পরিবেশ কোথায়? শিশুর নিরাপত্তার চিন্তায় চিন্তিত হল মা।
বাবা মানে ডাঃ রোহিতের চিন্তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা গোত্রের।
মোতিঝিলের ঠিক পাশ দিয়ে একটা রাস্তা গেছে। এই রাস্তা অবশ্য একেবারে ঝিলের পাশে এটা বলা ভুল। ঝিল আর রাস্তা এই দুইয়ের মাঝে ব্যবধান আছে একটা ছোট মানে অল্প পরিসরের ষাট সত্তর ফুটের একটা জঙ্গল। জঙ্গলের বেধ কম হলেও তার ঘনত্ব অনেক অধিক হওয়ায় ঝিলকে দেখাই যায় না রাস্তা থেকে। কিন্তু এই রাস্তাটা শহর থেকে ঢুকে ঝিলের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে আর একটা শহরের দিকে। এই দুই শহরের যোগসূত্র এই রাস্তা বেশ নির্জন তা বলা যায়। যদিও রাস্তার একপাশে রয়েছে ঝিল কিন্তু তার অন্যপাশে নেই ঘরবাড়ি বা চাষের জমি। কিলোমিটারের পরে কিলোমিটার জুড়ে পড়ে আছে শুধুই পরিত্যক্ত আর অব্যবহৃত শূন্যস্থান।
তাই সারাদিনে তো বটেই বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায় এই রাস্তা অতিক্রম করতে গা একেবারে ছম ছম করে। যারা ভূতে বিশ্বাস করে তারা ভূতের ভয় পায় বটে, তবে এই ভূতের আড়ালে থাকা ‘অন্য কিছু’র ভয় পায় যারা দামি কিছু বহন করে।
নন্দপুর আর শিমূলপুর এই দুই শহরকে যুক্ত করেছে এই রাস্তাটা। আর একটা মস্ত কথা হল এই রাস্তা আবার আজ যুক্ত করতে যাচ্ছে এই দুই শহরের দুই পরিবারকে। নন্দপুরের বোস পরিবার আর শিমূলপুরের ঘোষ পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সুতো বাঁধতে চলেছে আগামী পরশু। নন্দপুরের বোসপরিবার হল মেয়ের বাড়ি তাই তার প্রস্তুতি স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি। কারণ বিয়ের কাজটা সেখানেই হবে। তুলনায় শিমূলপুরের ঘোষ পুরের শুধু পাত্রীপক্ষ আর তাদের সহযাত্রীদের সাদরে গ্রহণ অর্থাৎ রিসেপশন।
বোস পরিবারের যা নামডাক তাতে তার বিয়ের প্রস্তুতিও বিরাট হওয়াই স্বাভাবিক। তাই তিন চারটে ভারবাহী গাড়িতে করে যাচ্ছে আনাজ পাতি। মশলা, তেল, মিষ্টি সব কিছু। নামে শহর হলেও নন্দপুরের বাজারের তেমন আভিজাত্য আর বাহুল্য নেই। তাই এত বিশাল পরিমাণ জিনিস যোগানোর সাধ্যও তার নেই। এখন শিমূলপুরের বাজারই ভরসা। সেখান থেকেই আপাতত চলেছে এই বিপুল যোগান।
একেবারে সামনের গাড়ির ড্রাইভারের মনে হল পাশে ঝোপের মধ্যে কী যেন নড়ল। এখন তো হাওয়ার কোনও কারবার নেই। সবাই বলছে পরিবেশ দূষণের জন্যে নাকি দিনে দিনে গরম বাড়ছে। আগে সারা দুপুর ঘাম ঝরালেও সন্ধেবেলা একটু গাছের পাতা নড়িয়ে হাওয়া করে মানুষকে স্বস্তি দিত। সন্ধ্যেবেলার সেই ফুরফুরে হাওয়া ভুলিয়ে দিত ঘাম ঝরান দুপুরের কথা। কিন্তু এখন তাও নেই। দুপুর আর সন্ধ্যের মধ্যে পার্থক্য শুধু রোদের উপস্থিতিটাই।
হাওয়া নেই তবু ঝোপ নড়ছে। সতর্ক হল ড্রাইভার। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড় আর কতটা সামাল দিতে পারে একটা ছোট নৌকো। ড্রাইভার শুধু দেখল সেই জঙ্গলের টুকরোটা ঝড় ছাড়াই এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।
রাস্তায় আলো বিশেষ নেই। এখানে বাড়ি ঘরদোর নেই। তাই কার জন্যে আর আলো জ্বালা হবে?
কিন্তু সেই অন্ধকারেই দেখা যাচ্ছে জঙ্গলে থেকে আর একটা জঙ্গল আলাদা হল তারপর সেটা গুটি গুটি কিন্তু বড় বড় পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল।
ড্রাইভার গাড়ির গতিবেগ শুধু বাড়িয়েই দিল তা নয় পেছনের গাড়ির ড্রাইভারদের মোবাইলে সতর্ক করে দিল। কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে। যেন তাকে সবাই ঠিকঠাক ভাবে অনুসরণ করে। এই বিপদে বিচ্ছিন্ন হলে বিপদ বাড়বে।
কিন্তু বিপদ বাড়লই। কারণ সে এল। গাড়িগুলো এক এক করে মাথার ওপর দোলাতে দোলাতে আছাড় মারতে লাগল। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল শুধু গাড়ির ছিন্ন ভিন্ন অংশ আর আনাজপাতি আর মিষ্টির পাহাড়। কেউ কেউ অবশ্য তৈরি খাবার বা আনাজ পাতি কিছুই দেখতে পায় নি।
-কিন্তু জন্ম থেকে এত কম বাড়বৃদ্ধি কেন ছেলেটার?
পিয়ালির প্রশ্নটা ঘুরিয়ে নিজেই নিজেকে করেছিল রোহিত।
ক্রেটিনিজম? না না ফিজিক্যাল সিম্পটম ছাড়াও থাইরয়েড গ্ল্যান্ড পরীক্ষা করেছে ডাঃ রোহিত। কিছু তেমন নেই। বিকৃতিও নেই তেমন।
পিয়ালি অধীর হয়ে বলল, কী বিড় বিড় করছ? একটা কিছু তো বল? একটা ধেড়ে বেড়াল পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি লম্বা হয় যে।
তবে কি হাইপো পিটুইটারিজম? নিজের মনে নিজেকেই এই উত্তর দিল রোহিত। তবে সেই স্বরে কিছুটা জোর থাকায় সেটা কানে গেল পিয়ালির।
-দেখ তোমার ওই মেডিক্যাল টার্ম আমি কিছু বুঝি না তা তুমি ভাল করেই জান।
-আরে না না তেমন কিছু নয়। আমি ছাড়াও অন্য ডাক্তার তো দেখছে নাকি?
এটেন্ডিং ডাক্তার বলেছে, না না ডাঃ মুখার্জী। চিন্তা করবেন না। হয়ত কিছু সময়ের জন্যে গ্রোথ স্টান্টেড হয়েছে।
রোহিতকে আবার দুশ্চিন্তায় ফেলে গ্রোথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় ছেলেটার। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের গঠন আর প্রকৃতিও। হর্মোন ছাড়াও আরও কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে। রোহিতের ওষুধ নাকি মন্ত্রের মত কাজ করে। তার গুণমুগ্ধ রোগীরা বলে। তাদের সেই বিবৃতি দিনে দিনে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে ডাঃ রোহিত মুখার্জীর।
আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বটে কিন্তু সমাধান সামনে দিকে হাঁটে নি এক পা-ও। কুন্তলের চেহারার এতটুকু বাড়বৃদ্ধি ঘটে নি।
আজ একটা নতুন হর্মোনের উপস্থিতির সন্ধান পেয়েছে রোহিত তার ছেলের দেহে। তার স্থির বিশ্বাস এই নতুন হর্মোনের উপস্থিতিই তার ছেলের বৃদ্ধির সূচনা করবে আর শরীরের সেই উদ্ভট যান্ত্রিক ত্রুটিটা দূর করবে।
আজ কাঁপতে কাঁপতে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে রোহিত। কাঁপতে কাঁপতে এই কারণেই যে তার নতুন ওষুধেও তেমন কাজ হয় নি কিছু। সে বিগত এক সপ্তাহ ধরে যেমন নতুন ওষুধটার ফলাফল লক্ষ করেছে ঠিক তেমনি আবার আরও একটা নতুন ওষুধ প্রস্তুতির দিকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গেছে।
নতুন এই ফর্মুলায় রয়েছে গ্রোথ হর্মোনের কড়া ডোজ। তবে এই হর্মোন আবার প্রচলিত মানুষের দেহে থাকা হর্মোন নয়। এটাও ডাঃ রোহিতের নবতম আবিষ্কার। এর গিনিপিগ আপাতত তার নিজের ছেলেই। তাই হাত তো যথেষ্ঠ কাঁপবেই।
মানুষের ছেলে হোক মানুষের ছেলের মতই। বৃদ্ধি তো কোনও কিছুতেই নেই। না শরীরে না মগজে। জ্ঞান-বুদ্ধি তো কিছুই হল না। একটা অক্ষর পর্যন্ত চেনানো গেল না। পড়াশোনা তো দূরের কথা।
পিয়ালি চলে গেছে ছেলেকে ছেড়ে। এমন ছেলেকে নিয়ে সে আর চলতে পারছে না। নাকি ওর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল কে জানে। ভয়ে চিন্তা করাই ছেড়ে দিয়েছে রোহিত।
বছরের পরে বছর কাটছে। একটা প্রায় জড়ভরত ছেলে নিয়ে কাটছে রোহিতের দিন।
কাঁপা হাতে সে ইঞ্জেকশনটা মানুষের বাড়বৃদ্ধির তার সর্বশেষ আবিষ্কৃত ওষুধ। এটা এখনও পরীক্ষা করা হয় নি। গিনিপিগ আপাতত তার বাড়িতেই হাজির। আকারে প্রকারে তাকে আক্ষরিক ভাবেই গিনিপিগ বলা যায়।
একটা কেমন ভুল হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে রোহিতের। হঠাৎ কেন বার্থ ডেটের কথা খেয়াল হল তার? আরে তার ছেলে তো পিউবার্টি পেরিয়ে গেছে অনেকদিন আগে। মানে বয়ঃসন্ধির পালা শেষ। এখন এই ইঞ্জেকশন যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
করবে কেন করেছে। ইতিমধ্যেই করেছে।
ডাঃ সেনশর্মা এলেন। ভয়ে আর আশংকায় প্রায় চীৎকার করে উঠে বললেন, উৎসাহের আতিশয্যে এ কী করলেন ডাঃ মুখার্জী। বয়েসটা খেয়াল করেন নি। আপনার এই ওষুধের ইমপ্যাক্ট হিসেব করেছেন? নর্মাল ডোজের থেকে এর ডোজ কত বিশাল মাত্রায় বেশি জানেন? আপনার এই ওষুধ প্রথমে ইঁদুর জাতীয় কিছুর ওপর প্রয়োগ করা উচিত ছিল।
পাথরের মত মুখ নিচু করে বসেছিল রোহিত। একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, জানি। লং বোনের আর গ্রোথ হবে না। কিন্তু সেটা পুষিয়ে দিতে যা ফল হবে সেটা কী এখনও কিছু কল্পনা করা যাচ্ছে না।
চুপ করেছিলেন ডাঃ সেনশর্মা। মুখে বাক্য ফুটছে না। রোহিতের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, এক্রোমেগালি। সিভিয়ার।
-এখন পরিণতির জন্যে অপেক্ষা করুন।
সাংঘাতিক কঠোর স্বর ডাঃ সেনশর্মার। কঠোর একটা ভবিষ্যৎ বাণী করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। মানুষের সন্তান নিয়ে এমন ছেলেখেলা যেন মাথা তাঁরই নিচু হয়েছিল।
সেদিন ভোরে উঠে হাতুড়ি চালিয়ে ঘরটার ঝিলের দিকের পাঁচিল নিজেই ভেঙ্গে দিয়েছিল রোহিত। কোনও লোক ডাকতে ভরসা হয় নি জানাজানির ভয়ে। জানলা দিয়ে উঁকি পেড়ে দেখেছিল ভীষণ জড় সড় হয়ে মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে বসেছিল। অপরিচিত আচ্ছাদনে মুখটা ঢাকা থাকলেও মুখের কষ্টটাকে ঢাকা দিতে পারে নি।
দড়াম করে ঘরের দেওয়ালটা বাইরে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। আর কেউ একজন মুক্তির আনন্দ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। মোতিঝিলের দিকেই।
সিটি হসপিটালের ট্রমা সেন্টার এবারেও আহতদের ক্ষত পরীক্ষা করে আর ফরেন্সিক পরীক্ষার বিশ্লেষণ নিয়ে স্কেচ আর্টিস্টদের ডেকে স্কেচ করাল। তারা অবাক হয়ে দেখল আগের স্কেচের সঙ্গে এই স্কেচের পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই। তার মানে আগের সেই আক্রমণকারীই এই আক্রমণ করেছে। তার মানে এমন একটা ভয়ানক জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরই আশেপাশে? অনেকেই বলেছে এই বিকট জন্তুটাকে দেখা গেছে মোতিঝিলের কাছাকাছিই।
ডাঃ দাস আর ডাঃ সেন দুজনেই বললেন, আমরা তো মানুষের ডাক্তার। আমাদের পক্ষে তো জন্তুদের স্বভাব সব ভাল করে বলা যাবে না।
অতএব বিরাট পশুবিদদের নিয়ে বোর্ড বসল। পশুবিদ ডাঃ শংখ মাহাত বললেন, যতদূর মনে হচ্ছে জন্তুটা একটা গরিলা। গরিলা স্পিশিসের তো বটেই।
ডাঃ সেনশর্মাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিড়বিড় করলেন, কিংবা গরিলাইজম।
কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কেউ শুনতে পেল না তার বিড়বিড়ানি। এমন কী ডাঃ মাহাতও নয়।
গরিলা? গরিলা স্পিশিস? এই জঙ্গলে গরিলা আসবে কোথা থেকে? বাঘ, ভাল্লুক, গন্ডার, হাতি আসতে পারে। কিন্তু গরিলা? সে তো আর এদেশের জন্তু নয়।
সমস্যাটা ঘাড়ের কাছে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেললেও সমাধানের দরজার আগল খুলল না।
তবে খুলল না যে তাও নয়। পাহাড়ের যেমন চুড়োয় উঠেই আবার নিচে নামতে হয় তেমনি যে কোনও সংকট যখনই তার চরম আকার ধারণ করে তখন তার আশেপাশেই কোথাও সমাধানের চাবিকাঠি তৈরি হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। কারণ সমস্যা আর সমাধান সর্বদা পাশাপাশি থাকে। সমস্যার বাড়বাড়ন্ত কমলেই সমাধানের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়।
সেও এক সন্ধ্যা। কিন্তু সন্ধাটা ছিল দিনের থেকেও ঊজ্জ্বল। কারণ আলোর কোনও অভাব রাখা হয় নি সেখানে। মোতিঝিলের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রাণীটাকে। যত বড় আর শক্তিশালী প্রাণীই হোক একসঙ্গে পঞ্চাশ ষাটটা মানুষের বল অনেক।
ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছে প্রাণীটাকে। বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে লক্ষ করা হচ্ছিল সে কখন কোথায় আসে, কোথা থেকে আসে এইসব। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তো বটেই আবার পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও। সিসিটিভি স্পাই ক্যামেরা আর মাইক্রো চিপসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রাণীটার গতিবিধির পুঙ্খানুপুংখ বিশ্লেষণ করে তবে আজ তাকে ধরা হয়েছে।
গরিলার মতই দেখতে বটে তবে গরিলা যে নয় তা প্রাণীবিদ ডাঃ শংখ মাহাতর কথাতেই স্পষ্ট।
-গরিলা তো নয়ই এমন কী গরিলা স্পিশিস পর্যন্ত নয়।
তার মন্তব্যে চমকে উঠল সবাই। গরিলা নয় অথচ গরিলার মত দেখতে? এ আবার কী বিদকুটে প্রাণী রে বাবা। কিন্তু গায়ের জোর তো সবাই দেখেছে। ডাঃ সেন ডাঃ দাসের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে এ তো আমাদের সেই স্কেচ আর্টিষ্টদের আঁকা প্রাণীর মত প্রাণী দেখছি।
পুলিশের রেকর্ড থেকে বেরোল স্কেচগুলো। হ্যাঁ একেবারে হুবহু এক।
ডাঃ মাহাত বললেন, তবে ফোরেন্সিক পরীক্ষা চাই। চাই ডি-এন-এ পরীক্ষাও। কার সঙ্গে মেলে সেটা তো দেখতে হবে। তার ওপর নির্ভর করছে এর ভবিষ্যৎ।
কিন্তু এতকাল পরে হাতের কাছে যখন পাওয়াই গেছে এই প্রাণীগুলো তখন তার গুষ্টির তুষ্টি তো করতেই হবে। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঁধা সেই জন্তুটার ওপর। সকলের রাগ মেটাতে এবার সকলেই যে যার খুশি মত প্রতিশোধ নেবে।
আবার ওদিকে যেন একটা ঝড় উঠল। এলোমেলো পোশাকে উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে হাজির ডাঃ রোহিত মুখার্জী।
-এই যে ডাঃ মুখার্জী। এতদিন তো আপনি খুব ভয়ে ভয়েই ছিলেন। আপনার বাড়ির কাছাকাছিই ঝিলের চারপাশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছিল এটা। ভয়ের বিষয় তো বটেই।
ডাঃ মাহাত বললেন, একটা গরিলা ধরা পড়েছে জানেন তো ডাঃ মুখার্জী। তবে গরিলা নয় গরিলার মত। এখনও ডি-এন-এ এনালিসিস হয় নি।
-গরিলা নয় গরিলা নয়। ও একটা-
হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল রোহিত।
-হ্যাঁ গরিলা নয় সেটা আমরা আন্দাজ করেছি। শুধু পরীক্ষা করা দরকার।
একটা বড় লোহার খাঁচা জোগাড় করা হচ্ছিল। অনেক করে প্রাণীটার কাছে যাবার চেষ্টা করল রোহিত মুখার্জী। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হল।। একটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এমন ক্ষতি করে দিক প্রাণীটা তা আর কে চাইবে?
জোর করে ধরে বেঁধে তাকে খাঁচায় পোরা হল। জুল জুল করে সে দেখতে লাগল ডাঃ রোহিতকে। ডাঃ রোহিত কাছে এলেন। পুলিশ তাকে সরিয়ে দিল।
-প্লিজ সবাই সরে যান। এবার ওকে নিয়ে যাওয়া হবে। গরিলা কি কী জন্তু সেটা আগে দেখতে হবে।
-ও গরিলা নয়। ও-
সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে ডাঃ রোহিতের দিকে। ডাঃ রোহিত কী বলতে চান?
-ডাঃ রোহিত আপনি কি বলতে পারবেন আসলে প্রাণীটা কী?
--ও যে- ও যে আমার ছেলে। আমার ছেলে। আমাএকটা শব্দ।
একটা বাঁধভাঙ্গা কোলাহল।
সে এসেছে।
নিজের গবেষণাগারে বসে কাজ করছিলেন ডাঃ রোহিত মুখার্জী। সৃষ্টি, স্থিতি আর লয় এই তিন নিয়েই যেন তাঁর গবেষণাগার। তাঁর আবিষ্কৃত বেশ কিছু ওষুধ অনেক মারণব্যাধি রোধ করেছে। অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছে। স্থিতি পালিত হয়েছে।
তাঁর অনেক ওষুধ পৃথিবী থেকে অনেক কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়া আর চিকিৎসকদের ঘাম ঝরিয়ে দেওয়া রোগকে আপাতত ইতিহাসের জমিতে পুঁতে দিয়েছে।
স্থিতি আর লয় কার্য তিনি আন্তরিক ভাবে পালন করেছেন বিষ্ণু আর মহেশ্বরের মত।
কিন্তু সৃষ্টি?
একটা শব্দ। ডাঃ মুখার্জীর অতিপরিচিত সেই শব্দটা।
সে কি তবে এসেছে?
শব্দের চেহারা এখন পাল্টেছে। শব্দটা হতাশাগ্রস্ততার বহুবচন। শোকের বহুবচনও বলতে গেলে। একসঙ্গে বহু লোকের বিলাপ। বহু অত্যাচারের স্পষ্ট প্রমাণ রেখে সে চলে গেছে।
সে এসেছিল। প্রমাণগুলো তারই।
শহরের এখানে সেখানে এখন তখন ঘটছে হামেশাই ঘটছে এমন ঘটনা। এক বুভুক্ষু দানবের কেড়ে খাওয়ায় ঘটনা। রেস্টুরেন্ট, খাওয়ার দোকান, মিষ্টির দোকান মানে সব প্রস্তুত খাদ্যের ভান্ডার।
সে আসছে নাকি একটা ঝড় আসছে বোঝা যাচ্ছে না। তার আকার তেমন কারোর বর্ণনায় তেমন স্পষ্ট নয়। কেউ বলেছে অন্তত কুড়ি ফুট তো হবেই লম্বায়। কিন্তু লম্বা দিয়ে এর বিচার হবে না। কারণ এই জন্তুটার লম্বার থেকে আকারের বীভৎসতাই অনেক বেশি। গায়ের কী রঙ তা বোঝা যায় কারণ সারা গা কালো বড় বড় লোমে ঢাকা। মাথায় চুল কিংবা বড় লোম তা গভীর বিশ্লেষণ ছাড়া বলা মুশকিল। বিরাট দেহের ওপরে দুটো ছোট ছোট কুতকুতে চোখে শুধু যেন একটা জিঘাংসা ফুটে উঠছে। সব লুঠপাঠ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রাণীটা।
কিন্তু সব খাবার মানে প্রস্তুত করা খাবার। কোনও কাঁচা আনাজ বা মাছ মাংস নয়। তবে ফলের গাড়িগুলো রক্ষা পাচ্ছে না। ফল বা মিষ্টি। খাবার নিতে বাধা পেলেই সে আক্রমণ করে। দিয়ে দিলে আর সে ফিরেও তাকায় না তার দিকে। আর অকারণে কাউকে আক্রমণ করেছে বলেও শোনে নি কেউ। তবে ভয়ে কি আর ত্রিসীমানায় থাকে কেউ?
কোন দিন কোথায় তার হামলা হবে বলা বেশ মুশকিল। আগে থেকে আঁচ পাওয়া খুব মুশকিল। সে আসে অতি দ্রুত ঝড়ের বেগে।
সে একটা দানব। এ ছাড়া তার বর্ণনার সঙ্গে অন্য কিছুর মিল পাওয়া ভার।
কোথায় তার বাস? মোতিঝিলের আশেপাশেই। ধরতে গেলে মোতিঝিল এলাকা এই দানব অধ্যুষিত বললে বলায় তেমন ভুল থাকে না কিছু।
হাসপাতালের ট্রমা বিভাগে যেন জায়গার আকাল পড়েছে হঠাৎ। কারোর হাত ভেঙ্গেছে কারোর পা। কারোর চোয়াল ভেঙ্গে গিয়ে একটা বড় ‘চ’ এর আকার ধারণ করেছে। কারোর মাথাটা হয়েছে ‘ম’-এর মত। সে এক বীভৎস কান্ড। অন্তত জনা কুড়ি থেকে পঁচিশ নানা বয়েস আর লিঙ্গের মানুষ শরীরে অস্বাভাবিক বিকৃতি নিয়ে এসেছে। এই বিকৃতি আঘাতের। মারাত্মক আঘাতের।
কিন্তু শহরতলীর কোনও হাসপাতালের তো এত বেড থাকতে পারে না যে তাদের বেড দেওয়া যায়। আবার এই মানুষগুলোকে সিটি হাসপাতালে পাঠানো জরুরি হলেও সময় আপাতত অনুমতি দিচ্ছে না। চিকিৎসা এই মুহূর্তে শুরু না করে দিলে এরা ভবলীলা সাঙ্গ করবে। তাই এরা মেঝেতেই পড়ে আছে যত্রতত্র। চেষ্টা হচ্ছে কিছুটা অন্তত সারিয়ে যাতে বড় হাসপাতালে পাঠানো যায়।
ডাঃ চিন্তাহরণ সেন আর দুঃখহরণ দাস খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন এদের। একটা চিন্তা দুজনের কপালেই সমান গভীরতার ভাঁজ ফেলেছিল। আর তা হল এক একজন সে মার খেয়েছে তা এক কথায় অমানুষিক। কোনও রূপক নয় আক্ষরিক অর্থেই।
-এ তো কোনও মানুষের মার হতেই পারে না ডাঃ সেন।
-আমিও তাই ভাবছি ডাঃ দাস। জায়গায় জায়গায় আঁচড়ের যে চিহ্ন পাচ্ছি তাতে কোনও বুনো জন্তুর নখকে ইঙ্গিত করছে অবশ্যই। এদের শরীরে প্রচুর লোমের অস্তিত্ব বলে দিচ্ছে আক্রমণকারী কোনও মানুষ নয়। মানুষের এত বড় লোম হতেই পারে না।
-হ্যাঁ ডাঃ সেন। ক্ষতগুলির গভীরতা এটাই বলছে প্রচন্ড বলশালী এই জন্তু। নখ বিরাট লম্বা, শক্ত আর ধারাল। প্রায় বাঘের মত বললে দোষের কিছু নেই।
যে অসুস্থ মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে চিকিৎসক যুগল এই মন্তব্য করছিলেন তারা জ্ঞানে ছিল না। থাকলে শোনামাত্র আবার অজ্ঞান হয়ে যেত চিকিৎসকদের বর্ণনায়।
আঘাত সম্পর্কে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হল চিকিৎসা যথাসম্ভব দ্রুত শুরু করা হল। এখন বাঁচা মরা নিয়তির হাতে। নিয়তিকে দেব-দৈবের আখ্যা দিতে আপত্তি থাকে তারাও বলতে পারে এটা আপাতত প্রকৃতির জিম্মায়।
দুই থেকে তিনজন স্কেচ আর্টিষ্ট ডাকা হয়েছে। ডাক্তারদের বক্তব্য অর্থাৎ আঘাতের ধরণ ধারণ আর আহতের দৈহিক মানসিক অবস্থা বিচার করে তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা চিত্র এঁকেছে আগন্তুক আঘাতকারীর। সাধারণত এই কাজটা পুলিশের স্কেচ আর্টিস্ট করে প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনে। সম্ভাব্য আততায়ীর দেহের একটা ছাপ পাওয়া যায়।
এখন সেটা শুরু হয়েছে ট্রমা বিভাগেও। আঘাতের ধরণ দেখে আঘাতকারীর চেহারা আঁকার কাজ। একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কাজ। আর শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয় শুরু হয়েছে যে কোনও বস্তুর ওপর আঘাতের ক্ষেত্রেও। একটা বাস আর একটা মোটরকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। অন্ধকারে কেউ দেখতে পেল না সেটা কী। কিন্তু আঘাতের বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য চিত্র আঁকা হল আঘাতকারী বাসটির। মোটর গাড়ির ওপরে পড়ে থাকা বা লেগে থাকা গুঁড়ো গুঁড়ো পদার্থের ফোরেন্সিক পরীক্ষা করে বাসটার মোটামুটি রঙ আঁকাও সম্ভব হল। সঠিক হয়ত একশ ভাগ হল না। কিন্তু এই যে নব্বই ভাগ সাফল্য সেটাই বা কম কী? সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই ছবিটাই।
স্কেচ আঁকা সম্পূর্ণ। তিনজন তিনটে আলাদা স্কেচ দিয়েছে বটে কিন্তু তাতে মৌলিক পার্থক্য খুব একটা তেমন নেই। ট্রমা বিভাগের বেডে পড়ে থাকা এই প্রায় কুড়ি পঁচিশটি মানুষ কার আঘাতে আহত হয়েছে জানা গেছে।
সবাই বিস্মিত, বিভ্রান্ত আর বাক্যহারা। এটাই তবে আততায়ী? কিন্তু এটা তো-
গুঞ্জন আর গুঞ্জন রইল না। খবরের কাগজের পাতায় জায়গা নিয়ে নিল।
সে এসেছিল। সে আসে মাঝে মাঝেই। ঘোরাঘুরি করে এই মোতিঝিলের আশেপাশেই। অন্ধকারে মিশিয়ে সে হাঁটে। খোঁজে গাছের পাতার আড়াল আবডাল। কেউ দেখেছে কি তাকে এ পর্যন্ত? হ্যাঁ দেখেছে। কিন্তু সেই চকিত দেখার যে অবস্থা তাদের হয়েছিল সেটা তারা মনে রাখতে পারে না বা চায় না। কিন্তু মোতিঝিলে এই দানব এল কী করে?
এই মোতিঝিল অবশ্য সিরাজের বেগমের মোতিঝিল নয়। এটা অন্য এক জেলার এক মস্ত ঝিল। মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল পুরো অশ্বখুরাকৃতি। কিন্তু এটা লম্বায় সামান্য একটু বাঁকা। ঝিলের চারপাশে প্রচুর গাছপালা। বড় এবং ছোট। ধরতে গেলে জঙ্গল বলা যেতে পারে।
বহু বছর আগের কথা। অধ্যাপনা ছেড়ে গবেষণায় মন দিয়েছেন ডাঃ রোহিত মুখার্জী। বিষয় ছিল এন্ডোক্রিন। হর্মোন থেরাপির সাহায্যে কিছু জটিল রোগের মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কোলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন এই নির্জন জায়গায়। মোতিঝিলের পাশে একটা পুরোন বাড়ি পেয়েও গিয়েছিলেন।
স্ত্রী পিয়ালিকেও আসতে হয়েছিল। প্রথমে সে আসতে চায় নি। বরানগরে বাপের বাড়ির কাছেই ছিল তারা। সেখানে কত হৈ হট্টগোল। আর এখানে জনহীন জঙ্গলের পাশে ভূতের বাড়ির মত একটা বাড়ি।
স্বামী সারাদিন প্রায় নিজের গবেষণায় ডুবে থাকে। নিত্য সকালে অবশ্য কিছু লোকের দেখা হয়। এরা রোহিতের রোগী। ধরতে গেলে এরা তার গবেষণার গিনিপিগ। কিন্তু এই সকাল ছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময় একা পিয়ালি। একেবারেই একা।
হয়ত একটু ভুল হল। নিঃসঙ্গতা আর চিন্তা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকে। ছেলে হল। কিন্তু-
বাবা আর মা দুজনের কপালে দুরকমের ভাঁজ ফেলল। এই জঙ্গলের মধ্যে শিশু পালনের উপযুক্ত পরিবেশ কোথায়? শিশুর নিরাপত্তার চিন্তায় চিন্তিত হল মা।
বাবা মানে ডাঃ রোহিতের চিন্তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা গোত্রের।
মোতিঝিলের ঠিক পাশ দিয়ে একটা রাস্তা গেছে। এই রাস্তা অবশ্য একেবারে ঝিলের পাশে এটা বলা ভুল। ঝিল আর রাস্তা এই দুইয়ের মাঝে ব্যবধান আছে একটা ছোট মানে অল্প পরিসরের ষাট সত্তর ফুটের একটা জঙ্গল। জঙ্গলের বেধ কম হলেও তার ঘনত্ব অনেক অধিক হওয়ায় ঝিলকে দেখাই যায় না রাস্তা থেকে। কিন্তু এই রাস্তাটা শহর থেকে ঢুকে ঝিলের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে আর একটা শহরের দিকে। এই দুই শহরের যোগসূত্র এই রাস্তা বেশ নির্জন তা বলা যায়। যদিও রাস্তার একপাশে রয়েছে ঝিল কিন্তু তার অন্যপাশে নেই ঘরবাড়ি বা চাষের জমি। কিলোমিটারের পরে কিলোমিটার জুড়ে পড়ে আছে শুধুই পরিত্যক্ত আর অব্যবহৃত শূন্যস্থান।
তাই সারাদিনে তো বটেই বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায় এই রাস্তা অতিক্রম করতে গা একেবারে ছম ছম করে। যারা ভূতে বিশ্বাস করে তারা ভূতের ভয় পায় বটে, তবে এই ভূতের আড়ালে থাকা ‘অন্য কিছু’র ভয় পায় যারা দামি কিছু বহন করে।
নন্দপুর আর শিমূলপুর এই দুই শহরকে যুক্ত করেছে এই রাস্তাটা। আর একটা মস্ত কথা হল এই রাস্তা আবার আজ যুক্ত করতে যাচ্ছে এই দুই শহরের দুই পরিবারকে। নন্দপুরের বোস পরিবার আর শিমূলপুরের ঘোষ পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সুতো বাঁধতে চলেছে আগামী পরশু। নন্দপুরের বোসপরিবার হল মেয়ের বাড়ি তাই তার প্রস্তুতি স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি। কারণ বিয়ের কাজটা সেখানেই হবে। তুলনায় শিমূলপুরের ঘোষ পুরের শুধু পাত্রীপক্ষ আর তাদের সহযাত্রীদের সাদরে গ্রহণ অর্থাৎ রিসেপশন।
বোস পরিবারের যা নামডাক তাতে তার বিয়ের প্রস্তুতিও বিরাট হওয়াই স্বাভাবিক। তাই তিন চারটে ভারবাহী গাড়িতে করে যাচ্ছে আনাজ পাতি। মশলা, তেল, মিষ্টি সব কিছু। নামে শহর হলেও নন্দপুরের বাজারের তেমন আভিজাত্য আর বাহুল্য নেই। তাই এত বিশাল পরিমাণ জিনিস যোগানোর সাধ্যও তার নেই। এখন শিমূলপুরের বাজারই ভরসা। সেখান থেকেই আপাতত চলেছে এই বিপুল যোগান।
একেবারে সামনের গাড়ির ড্রাইভারের মনে হল পাশে ঝোপের মধ্যে কী যেন নড়ল। এখন তো হাওয়ার কোনও কারবার নেই। সবাই বলছে পরিবেশ দূষণের জন্যে নাকি দিনে দিনে গরম বাড়ছে। আগে সারা দুপুর ঘাম ঝরালেও সন্ধেবেলা একটু গাছের পাতা নড়িয়ে হাওয়া করে মানুষকে স্বস্তি দিত। সন্ধ্যেবেলার সেই ফুরফুরে হাওয়া ভুলিয়ে দিত ঘাম ঝরান দুপুরের কথা। কিন্তু এখন তাও নেই। দুপুর আর সন্ধ্যের মধ্যে পার্থক্য শুধু রোদের উপস্থিতিটাই।
হাওয়া নেই তবু ঝোপ নড়ছে। সতর্ক হল ড্রাইভার। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড় আর কতটা সামাল দিতে পারে একটা ছোট নৌকো। ড্রাইভার শুধু দেখল সেই জঙ্গলের টুকরোটা ঝড় ছাড়াই এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।
রাস্তায় আলো বিশেষ নেই। এখানে বাড়ি ঘরদোর নেই। তাই কার জন্যে আর আলো জ্বালা হবে?
কিন্তু সেই অন্ধকারেই দেখা যাচ্ছে জঙ্গলে থেকে আর একটা জঙ্গল আলাদা হল তারপর সেটা গুটি গুটি কিন্তু বড় বড় পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল।
ড্রাইভার গাড়ির গতিবেগ শুধু বাড়িয়েই দিল তা নয় পেছনের গাড়ির ড্রাইভারদের মোবাইলে সতর্ক করে দিল। কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে। যেন তাকে সবাই ঠিকঠাক ভাবে অনুসরণ করে। এই বিপদে বিচ্ছিন্ন হলে বিপদ বাড়বে।
কিন্তু বিপদ বাড়লই। কারণ সে এল। গাড়িগুলো এক এক করে মাথার ওপর দোলাতে দোলাতে আছাড় মারতে লাগল। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল শুধু গাড়ির ছিন্ন ভিন্ন অংশ আর আনাজপাতি আর মিষ্টির পাহাড়। কেউ কেউ অবশ্য তৈরি খাবার বা আনাজ পাতি কিছুই দেখতে পায় নি।
-কিন্তু জন্ম থেকে এত কম বাড়বৃদ্ধি কেন ছেলেটার?
পিয়ালির প্রশ্নটা ঘুরিয়ে নিজেই নিজেকে করেছিল রোহিত।
ক্রেটিনিজম? না না ফিজিক্যাল সিম্পটম ছাড়াও থাইরয়েড গ্ল্যান্ড পরীক্ষা করেছে ডাঃ রোহিত। কিছু তেমন নেই। বিকৃতিও নেই তেমন।
পিয়ালি অধীর হয়ে বলল, কী বিড় বিড় করছ? একটা কিছু তো বল? একটা ধেড়ে বেড়াল পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি লম্বা হয় যে।
তবে কি হাইপো পিটুইটারিজম? নিজের মনে নিজেকেই এই উত্তর দিল রোহিত। তবে সেই স্বরে কিছুটা জোর থাকায় সেটা কানে গেল পিয়ালির।
-দেখ তোমার ওই মেডিক্যাল টার্ম আমি কিছু বুঝি না তা তুমি ভাল করেই জান।
-আরে না না তেমন কিছু নয়। আমি ছাড়াও অন্য ডাক্তার তো দেখছে নাকি?
এটেন্ডিং ডাক্তার বলেছে, না না ডাঃ মুখার্জী। চিন্তা করবেন না। হয়ত কিছু সময়ের জন্যে গ্রোথ স্টান্টেড হয়েছে।
রোহিতকে আবার দুশ্চিন্তায় ফেলে গ্রোথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় ছেলেটার। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের গঠন আর প্রকৃতিও। হর্মোন ছাড়াও আরও কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে। রোহিতের ওষুধ নাকি মন্ত্রের মত কাজ করে। তার গুণমুগ্ধ রোগীরা বলে। তাদের সেই বিবৃতি দিনে দিনে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে ডাঃ রোহিত মুখার্জীর।
আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বটে কিন্তু সমাধান সামনে দিকে হাঁটে নি এক পা-ও। কুন্তলের চেহারার এতটুকু বাড়বৃদ্ধি ঘটে নি।
আজ একটা নতুন হর্মোনের উপস্থিতির সন্ধান পেয়েছে রোহিত তার ছেলের দেহে। তার স্থির বিশ্বাস এই নতুন হর্মোনের উপস্থিতিই তার ছেলের বৃদ্ধির সূচনা করবে আর শরীরের সেই উদ্ভট যান্ত্রিক ত্রুটিটা দূর করবে।
আজ কাঁপতে কাঁপতে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে রোহিত। কাঁপতে কাঁপতে এই কারণেই যে তার নতুন ওষুধেও তেমন কাজ হয় নি কিছু। সে বিগত এক সপ্তাহ ধরে যেমন নতুন ওষুধটার ফলাফল লক্ষ করেছে ঠিক তেমনি আবার আরও একটা নতুন ওষুধ প্রস্তুতির দিকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গেছে।
নতুন এই ফর্মুলায় রয়েছে গ্রোথ হর্মোনের কড়া ডোজ। তবে এই হর্মোন আবার প্রচলিত মানুষের দেহে থাকা হর্মোন নয়। এটাও ডাঃ রোহিতের নবতম আবিষ্কার। এর গিনিপিগ আপাতত তার নিজের ছেলেই। তাই হাত তো যথেষ্ঠ কাঁপবেই।
মানুষের ছেলে হোক মানুষের ছেলের মতই। বৃদ্ধি তো কোনও কিছুতেই নেই। না শরীরে না মগজে। জ্ঞান-বুদ্ধি তো কিছুই হল না। একটা অক্ষর পর্যন্ত চেনানো গেল না। পড়াশোনা তো দূরের কথা।
পিয়ালি চলে গেছে ছেলেকে ছেড়ে। এমন ছেলেকে নিয়ে সে আর চলতে পারছে না। নাকি ওর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল কে জানে। ভয়ে চিন্তা করাই ছেড়ে দিয়েছে রোহিত।
বছরের পরে বছর কাটছে। একটা প্রায় জড়ভরত ছেলে নিয়ে কাটছে রোহিতের দিন।
কাঁপা হাতে সে ইঞ্জেকশনটা মানুষের বাড়বৃদ্ধির তার সর্বশেষ আবিষ্কৃত ওষুধ। এটা এখনও পরীক্ষা করা হয় নি। গিনিপিগ আপাতত তার বাড়িতেই হাজির। আকারে প্রকারে তাকে আক্ষরিক ভাবেই গিনিপিগ বলা যায়।
একটা কেমন ভুল হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে রোহিতের। হঠাৎ কেন বার্থ ডেটের কথা খেয়াল হল তার? আরে তার ছেলে তো পিউবার্টি পেরিয়ে গেছে অনেকদিন আগে। মানে বয়ঃসন্ধির পালা শেষ। এখন এই ইঞ্জেকশন যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
করবে কেন করেছে। ইতিমধ্যেই করেছে।
ডাঃ সেনশর্মা এলেন। ভয়ে আর আশংকায় প্রায় চীৎকার করে উঠে বললেন, উৎসাহের আতিশয্যে এ কী করলেন ডাঃ মুখার্জী। বয়েসটা খেয়াল করেন নি। আপনার এই ওষুধের ইমপ্যাক্ট হিসেব করেছেন? নর্মাল ডোজের থেকে এর ডোজ কত বিশাল মাত্রায় বেশি জানেন? আপনার এই ওষুধ প্রথমে ইঁদুর জাতীয় কিছুর ওপর প্রয়োগ করা উচিত ছিল।
পাথরের মত মুখ নিচু করে বসেছিল রোহিত। একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, জানি। লং বোনের আর গ্রোথ হবে না। কিন্তু সেটা পুষিয়ে দিতে যা ফল হবে সেটা কী এখনও কিছু কল্পনা করা যাচ্ছে না।
চুপ করেছিলেন ডাঃ সেনশর্মা। মুখে বাক্য ফুটছে না। রোহিতের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, এক্রোমেগালি। সিভিয়ার।
-এখন পরিণতির জন্যে অপেক্ষা করুন।
সাংঘাতিক কঠোর স্বর ডাঃ সেনশর্মার। কঠোর একটা ভবিষ্যৎ বাণী করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। মানুষের সন্তান নিয়ে এমন ছেলেখেলা যেন মাথা তাঁরই নিচু হয়েছিল।
সেদিন ভোরে উঠে হাতুড়ি চালিয়ে ঘরটার ঝিলের দিকের পাঁচিল নিজেই ভেঙ্গে দিয়েছিল রোহিত। কোনও লোক ডাকতে ভরসা হয় নি জানাজানির ভয়ে। জানলা দিয়ে উঁকি পেড়ে দেখেছিল ভীষণ জড় সড় হয়ে মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে বসেছিল। অপরিচিত আচ্ছাদনে মুখটা ঢাকা থাকলেও মুখের কষ্টটাকে ঢাকা দিতে পারে নি।
দড়াম করে ঘরের দেওয়ালটা বাইরে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। আর কেউ একজন মুক্তির আনন্দ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। মোতিঝিলের দিকেই।
সিটি হসপিটালের ট্রমা সেন্টার এবারেও আহতদের ক্ষত পরীক্ষা করে আর ফরেন্সিক পরীক্ষার বিশ্লেষণ নিয়ে স্কেচ আর্টিস্টদের ডেকে স্কেচ করাল। তারা অবাক হয়ে দেখল আগের স্কেচের সঙ্গে এই স্কেচের পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই। তার মানে আগের সেই আক্রমণকারীই এই আক্রমণ করেছে। তার মানে এমন একটা ভয়ানক জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরই আশেপাশে? অনেকেই বলেছে এই বিকট জন্তুটাকে দেখা গেছে মোতিঝিলের কাছাকাছিই।
ডাঃ দাস আর ডাঃ সেন দুজনেই বললেন, আমরা তো মানুষের ডাক্তার। আমাদের পক্ষে তো জন্তুদের স্বভাব সব ভাল করে বলা যাবে না।
অতএব বিরাট পশুবিদদের নিয়ে বোর্ড বসল। পশুবিদ ডাঃ শংখ মাহাত বললেন, যতদূর মনে হচ্ছে জন্তুটা একটা গরিলা। গরিলা স্পিশিসের তো বটেই।
ডাঃ সেনশর্মাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিড়বিড় করলেন, কিংবা গরিলাইজম।
কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কেউ শুনতে পেল না তার বিড়বিড়ানি। এমন কী ডাঃ মাহাতও নয়।
গরিলা? গরিলা স্পিশিস? এই জঙ্গলে গরিলা আসবে কোথা থেকে? বাঘ, ভাল্লুক, গন্ডার, হাতি আসতে পারে। কিন্তু গরিলা? সে তো আর এদেশের জন্তু নয়।
সমস্যাটা ঘাড়ের কাছে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেললেও সমাধানের দরজার আগল খুলল না।
তবে খুলল না যে তাও নয়। পাহাড়ের যেমন চুড়োয় উঠেই আবার নিচে নামতে হয় তেমনি যে কোনও সংকট যখনই তার চরম আকার ধারণ করে তখন তার আশেপাশেই কোথাও সমাধানের চাবিকাঠি তৈরি হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। কারণ সমস্যা আর সমাধান সর্বদা পাশাপাশি থাকে। সমস্যার বাড়বাড়ন্ত কমলেই সমাধানের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়।
সেও এক সন্ধ্যা। কিন্তু সন্ধাটা ছিল দিনের থেকেও ঊজ্জ্বল। কারণ আলোর কোনও অভাব রাখা হয় নি সেখানে। মোতিঝিলের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রাণীটাকে। যত বড় আর শক্তিশালী প্রাণীই হোক একসঙ্গে পঞ্চাশ ষাটটা মানুষের বল অনেক।
ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছে প্রাণীটাকে। বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে লক্ষ করা হচ্ছিল সে কখন কোথায় আসে, কোথা থেকে আসে এইসব। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তো বটেই আবার পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও। সিসিটিভি স্পাই ক্যামেরা আর মাইক্রো চিপসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রাণীটার গতিবিধির পুঙ্খানুপুংখ বিশ্লেষণ করে তবে আজ তাকে ধরা হয়েছে।
গরিলার মতই দেখতে বটে তবে গরিলা যে নয় তা প্রাণীবিদ ডাঃ শংখ মাহাতর কথাতেই স্পষ্ট।
-গরিলা তো নয়ই এমন কী গরিলা স্পিশিস পর্যন্ত নয়।
তার মন্তব্যে চমকে উঠল সবাই। গরিলা নয় অথচ গরিলার মত দেখতে? এ আবার কী বিদকুটে প্রাণী রে বাবা। কিন্তু গায়ের জোর তো সবাই দেখেছে। ডাঃ সেন ডাঃ দাসের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে এ তো আমাদের সেই স্কেচ আর্টিষ্টদের আঁকা প্রাণীর মত প্রাণী দেখছি।
পুলিশের রেকর্ড থেকে বেরোল স্কেচগুলো। হ্যাঁ একেবারে হুবহু এক।
ডাঃ মাহাত বললেন, তবে ফোরেন্সিক পরীক্ষা চাই। চাই ডি-এন-এ পরীক্ষাও। কার সঙ্গে মেলে সেটা তো দেখতে হবে। তার ওপর নির্ভর করছে এর ভবিষ্যৎ।
কিন্তু এতকাল পরে হাতের কাছে যখন পাওয়াই গেছে এই প্রাণীগুলো তখন তার গুষ্টির তুষ্টি তো করতেই হবে। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঁধা সেই জন্তুটার ওপর। সকলের রাগ মেটাতে এবার সকলেই যে যার খুশি মত প্রতিশোধ নেবে।
আবার ওদিকে যেন একটা ঝড় উঠল। এলোমেলো পোশাকে উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে হাজির ডাঃ রোহিত মুখার্জী।
-এই যে ডাঃ মুখার্জী। এতদিন তো আপনি খুব ভয়ে ভয়েই ছিলেন। আপনার বাড়ির কাছাকাছিই ঝিলের চারপাশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছিল এটা। ভয়ের বিষয় তো বটেই।
ডাঃ মাহাত বললেন, একটা গরিলা ধরা পড়েছে জানেন তো ডাঃ মুখার্জী। তবে গরিলা নয় গরিলার মত। এখনও ডি-এন-এ এনালিসিস হয় নি।
-গরিলা নয় গরিলা নয়। ও একটা-
হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল রোহিত।
-হ্যাঁ গরিলা নয় সেটা আমরা আন্দাজ করেছি। শুধু পরীক্ষা করা দরকার।
একটা বড় লোহার খাঁচা জোগাড় করা হচ্ছিল। অনেক করে প্রাণীটার কাছে যাবার চেষ্টা করল রোহিত মুখার্জী। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হল।। একটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এমন ক্ষতি করে দিক প্রাণীটা তা আর কে চাইবে?
জোর করে ধরে বেঁধে তাকে খাঁচায় পোরা হল। জুল জুল করে সে দেখতে লাগল ডাঃ রোহিতকে। ডাঃ রোহিত কাছে এলেন। পুলিশ তাকে সরিয়ে দিল।
-প্লিজ সবাই সরে যান। এবার ওকে নিয়ে যাওয়া হবে। গরিলা কি কী জন্তু সেটা আগে দেখতে হবে।
-ও গরিলা নয়। ও-
সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে ডাঃ রোহিতের দিকে। ডাঃ রোহিত কী বলতে চান?
-ডাঃ রোহিত আপনি কি বলতে পারবের সন্তান। আমার একমাত্র সন্তান।
খাঁচাটা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে উঠেছে। সেই প্রবল চীৎকারে ঢাকা পড়ে গেছে ডাঃ রোহিতের স্বর।

|