মানবতার মূর্ত প্রতীক লুই পাস্তুর

লেখক - পঞ্চানন মণ্ডল

                                             

১৮৮১ সালের আগস্ট মাস।লন্ডনে চিকিৎসাবিদ্যার আন্তর্জাতিক অধিবেশন(International Congress of Medicine) শুরু হবে।ফ্রান্স থেকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হলো এক বিখ্যাত  বিজ্ঞানীকে। তিনি অধিবেশনে গিয়ে  দেখলেন সে এক বিশাল জনসমূদ্র। বিজ্ঞানী ভাবছিলেন এই অধিবেশন উদ্বোধন করার জন্য নিশ্চয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো  রাজা আসছেন। তাই হয়তো তাকে একবার চাক্ষুস দেখবার জন্য এতো লোক ভিড় করেছে। এতো উল্লাস করছে।

বিজ্ঞানী একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলেন ,  "নিশ্চয় রাজা আসছেন তাই সবাই এতো জয়ধ্বনি করছে।"

কর্মকর্তা  হেসে বললেন-" না, তিনি এখন আসছেন না। "

-"তাহলে ওরা এতো জয়ধ্বনি করছে কেন? "

- "ওরা আপনাকেই অভিনন্দন জানাচ্ছে। এরা সবাই আপনার গুনমুগ্ধ। ওরা আপনাকে এক নজর দেখবার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এখানে ছুটে এসেছে । আপনি এ অধিবেশনে আসছেন, এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেইজন্যই ওরা এসেছে। "

আর আসবেইনা বা কেন? পৃথিবীতে সর্বকালের সর্বযুগে সে মানুষটি মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণসাধন করে গেছেন তাকে দেখে সম্মান জানানোর জন্যই তারা আজ সমবেত হয়েছেন। এই মহান বিজ্ঞানী হলেন লুই পাস্তুর।এক অসাধারণ জনপ্রিয় এক বিজ্ঞানী।

 ফ্রান্সের লিল্লেতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যার গবেষণায় ব্যস্ত লুই পাস্তুর।এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল একটি আখক্ষেতের মাঝখানে। কাছেপিঠে কয়েকটি মদের কারখানা ছিল। সেখানে বিটচিনি থেকে মদ প্রস্তুত করা হতো। একদিন একদল মদ্য প্রস্তুত কারক এসে পাস্তুরের সঙ্গে দেখা করল। তারা পাস্তুরকে জানালো , তাদের প্রস্তুত করা মদ প্রায়ই টকে গিয়ে নষ্ট হয়। তার ফলে তারা বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই তরুণ অধ্যাপককে মদ টকে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তারা অনুরোধ জানালা । পাস্তুর তাদের অনুরোধ মতো গবেষণা শুরু করলেন । অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে ঐ মদ পরীক্ষা করে পাস্তুর ওতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেলেন। তাঁর ধারণা হলো যে, ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলোই মদকে খারাপ করে দেয়। গবেষণা করে তিনি ঐ ব্যাকটেরিয়াদের বিনাশের ব্যবস্থা করলেন। মদ প্রস্তুতকারকদের বললেন, তোমরা মদকে ১২০° ফারেনহাইট উষ্ণতায় উত্তপ্ত করো। তাতে ব্যাকটেরিয়াগুলো মরে যাবে, তাতে মদের স্বাদ ও ধর্মের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। মদ প্রস্তুতকারকেরা তাঁর নির্দেশে কাজ করল।  ধ্বংসের হাত থেকে ফরাসি দেশের মদ্যশিল্প বাঁচল।

পাস্তুর পরে দুধকে জীবাণুমুক্ত করার জন্যও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে সুফল পেলেন। তাঁর নামানুসারে ঐ পদ্ধতির নাম দেওয়া হলো - পাস্তুরীকরণ ( Pasteurization )

ঐ সময় ফ্রান্স রেশম শিল্পে বেশ উন্নত ছিল। রেশম শিল্পের জন্য ওদেশে রেশম মথের গুটিপোকার চাষ করা হতো। কিন্তু ১৮৬৫ সালে ফরাসি দেশে গুটিপোকার মড়ক লাগে। রেশম শিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। তখন আবার ডাক পড়ে পাস্তুরের। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অক্লান্ত গবেষণা করে পাস্তুর গুটিপোকার মড়কের কারণ খুঁজে পেলেন এবং প্রতিবিধানের ব্যবস্থাও করলেন। ফ্রান্সের রেশম শিল্প বাঁচল।

তখন ফ্রান্সে  ‘চিকেন কলেরা’ নামে এক মারাত্মক রোগে লক্ষ লক্ষ বাচ্চা মুরগি মরে যাচ্ছিল।পোল্ট্রি চাষীরাও পাস্তুরের সাহায্য প্রার্থনা করল। পাস্তুর এগিয়ে এলেন তাদের সাহায্য করতে। তিনি সুস্থ বাচ্চাগুলোকে টিকা দিলেন, দেখা গেল বাচ্চাগুলোর কলেরা রোগ হলো না। চিকেন কলেরা রোগের কবল থেকে বাঁচল ফ্রান্সের কোটি কোটি মুরগির বাচ্চা।

গরু-মোষ ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশুর এই সময় ‘অ্যানথ্রাক্স’ রোগ হতো। এই রোগে বহু গৃহপালিত পশু মারা যেতো। তিনি টিকাদানের মাধ্যমে ঐ রোগের মারাত্মক আক্রমণ থেকে রক্ষা করলেন। রোগ প্রতিরোধের জন্য এই গৃহপালিত পশুদের  টিকা দিয়ে অসামান্য সাফল্য লাভ করায় পাস্তুর খুব আনন্দিত হন।  টিকার মাধ্যমে মানুষের রোগ প্রতিরোধ করা যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা  করতে থাকেন।শুরু হলো এক নতুন যাত্রা। 

সে সময়ে হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক ছিলো এক ভয়াবহ ব্যাধি। জলাতঙ্কে রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়তো। প্রচুর পিপাসা পেলেও জল পান করতে পারতো না। এমনকি অনেক রোগী জল দেখলে বা জলের  শব্দ শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। একটা সময় রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। এই রোগের ছিলো না কোনো চিকিৎসা। পাস্তুরের মন চঞ্চল  হয়ে উঠল রোগীদের করুণ মৃত্যু দেখে। কিছু একটা করতে চাইলেন তিনি।

শুরু করলেন গবেষণা। নিজেই এলাকার পাগলা কুকুর ধরে এনে পুষতে শুরু করলেন। একদিন এক বিশাল বুলডগ উন্মাদ হয়ে চিৎকার করছিলো। বুলডগটির মুখ দিয়ে অবিরত ঝরছিলো লালা। বহু কষ্টে সেই বুলডগকে ধরা হলো। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই কুকুরের মুখের সামনে পাত্র ধরে সংগ্রহ করলেন লালা। এই লালা গবেষণার কাজে লাগবে! গবেষণার মাধ্যমে এই বিষাক্ত লালা থেকে প্রস্তুত করলেন জলাতঙ্কের সিরাম।

এবার পরীক্ষা করে দেখার পালা। আসলে কাজ কতটুকু হবে তার জন্য সেই সিরাম প্রয়োগ করতে শুরু করলেন বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহে মানে জীবজন্তুর উপর ট্রায়াল । প্রথম পরীক্ষাটি চালালেন খরগোশের উপর। ফলও পেলেন আশানুরূপ। কিন্তু মানুষের দেহে কীভাবে এই সিরাম প্রয়োগ করবেন তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। ঠিক কোন মাপে কতখানি সিরাম প্রয়োগে রোগী সুস্থ হবে, তা তো জানা নেই। একটুখানি ভুলের জন্য ঘটতে পারে মারাত্মক কোনো বিপদ।কিন্তু এই কঠিন সমস্যার সমাধান কীভাবে করবেন সেটা বুঝতে পারছিলেন না পাস্তুর।

এমন সময় ১৮৮৫ সালে একদিন ‘যোশেফ মাইস্টার’ নামে নয় বছরের একটি ছেলেকে পাগলা কুকুরে কামড়ায়। কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত ছেলেটিকে নিয়ে তার মা উদ্বিগ্নচিত্তে লুই পাস্তুরের গবেষণাগারে এসে উপস্থিত হন। পাস্তুর ছেলেটিকে পরীক্ষা করলেন। ভাবলেন- তার আবিষ্কৃত টিকা দেবেন কি দেবেন না। না দিলে ছেলেটি মারা যাবে। তবুও দেখা যাক একবার শেষ চেষ্টা করে। এই ভেবে ছেলেটির মায়ের অনুমতি নিয়ে পাস্তুর যোসেফ মাইস্টারের চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। ওষুধে কাজ হলো। ছেলেটির আর জলাতঙ্ক রোগ হলো না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এই যে, সেদিন প্রথম প্রমাণিত হলো যে, টিকা দিয়ে মানুষকেও জলাতঙ্ক রোগের কবল থেকে বাঁচানো যায়।

এরপর পাস্তুর তার নিজের গবেষণাগার খুলতে চাইলেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো সবাই। মিলানের খবরের কাগজই তুললো ৪০০ পাউন্ড। রাশিয়ার জার পাঠালেন হাজার পাউন্ড, এছাড়া সাহায্য করলেন ব্রাজিলের ও তুরস্কের সম্রাট। সবশেষে ১৮৮৮ সালে প্যারিসে পাস্তুর ইন্সটিটিউটের উদ্ভধন করলেন প্রেসিডেন্ট নিজেই।

পাস্তুর ছিলেন না কোন ডাক্তার। কিন্তু তিনি রসায়নে যা করে দেখিয়েছেন তা হয়তো অনেকেই  আর পারেন নি। তার সহকর্মীরা এরপর প্লেগ, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, পোলিও সহ নানা রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন। তিনি তার দেশকে এনে দিয়েছেন অসামান্য সম্মান। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বিজ্ঞানের কাছে, মানুষের কাছে।

একের পর এক বড় বড় আবিষ্কারের ফলে পাস্তুরের যশ খ্যাতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সে  যত রকমের পুরস্কার ও সম্মান ছিল- সবই প্রায় পাস্তুর পেলেন। কিন্তু সে সবে তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন।

নেপোলিয়ন তাকে বলেছিলেন তিনি এতো কম অর্থে কেন কাজ করেন। পাস্তুর বলেছেন বিজ্ঞান কখনো স্বার্থের জন্য কাজ করে না। বিজ্ঞান কোন দেশের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। তার প্রত্যেকটি বিষয়ে রয়েছে পুরো মানবজাতির অধিকার।

১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের  ‘ডোল’ শহরে লুই পাস্তুরের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন সৈনিক। সৈনিকের ছেলে কিন্তু বড় হয়ে সৈনিক হন নি, হয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত এক চিকিৎসক বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এইসব অসামান্য আবিষ্কার স্বর্ণাক্ষরে  লেখা থাকবে।

লুই পাস্তুরের মৃত্যু হয় ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে। ফ্রান্সে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত একটি গবেষণা কেন্দ্রের চত্বরেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে তাঁকে প্রতিবছর  শ্রদ্ধা জানায় । যোসেফ মাইস্টার বড় হয়ে পাস্তুরের গবেষণার দ্বাররক্ষী ছিলেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর হাতে ফরাসি বাহিনী এগারো দিনের মাথায় পরাজয় বরণ করলে জার্মান সৈনিকেরা পাস্তুরের গবেষণাগারে প্রবেশ করতে চাইলে মাইস্টার সাহসিকতার সাথে বাধা দেন ।কিন্তু শেষে জার্মান সৈনিকের গুলির আঘাতে প্রাণ হারান। তিনি সারা জীবন পাস্তুরের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।

পাস্তুর বলেছেন -

“ আমি সমস্ত জীবন ধরে এটাই জেনেছি একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞানতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। ... বিশ্বাস রাখুন এক দিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি সহযোগিতার পক্ষে আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।”

মানবতার প্রতীক বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরকে সায়েন্টিফিলিয়ার পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রনাম জানাই

                                                  

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb