বেণীমাধবের কল্পবিজ্ঞান

লেখক - ডঃ শংকর ঘটক

 

                                                

                                                                   চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল

বেণীমাধব কল্প বিজ্ঞানের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। দেশবিদেশের অগুনতি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, উপন্যাস বা কবিতা ওনার নখদর্পণে। বাংলায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের কোন রচনাই তার অপঠিত নেই। কম বেতনের সরকারি চাকরি ছাড়া, যেটি উনি খুব যত্ন নিয়েই করেন, তা হল কল্পবিজ্ঞান। একমাত্র নেশা। অত্যন্ত সাদাসিধা, সরল, নিরীহ, স্পষ্টভাষী, ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ বেণীমাধব হঠাৎ কোন এক অজ্ঞাত কারণে ক্ষেপে উঠেছেন। কল্পবিজ্ঞানের যাবতীয় সংগ্রহ, যা উনি গতকালও মনে করতেন একটি মূল্যবান সংগ্রহ হিসাবে, আজ চলে গেছে বহু পুরনো একটা রঙচটা লোহার তোরঙ্গে। মস্ত বড় একটা তালা ঝুলিয়ে বাক্সটাকে চৌকির তলায় চালান করে নিজেই বসে গেছেন গল্প লিখতে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প। মহাশ্চর্যের ব্যাপারটি হল বেণীমাধবের ভাষা। একবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার একটি আধাবস্তির অন্ধকার হাওয়া বর্জিত স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে উনি গল্প শুরু করলেন শুদ্ধ ভাষায়।

      “বঙ্কিম যদি বাঁচিয়া থাকিতেন, উনিও কি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখিতেন? হয়ত লিখিতেন, হয়ত বা লিখিতেন না। কিন্তু যদি লিখিতেন তাহা হইলে কি লিখিতেন। লিখিতে লিখিতে কি তাহার গাত্র চর্ম শিহরিত হইত? কমলাকান্তকে তিনি কি তাহার গল্পের নায়ক নির্বাচিত করিতেন? এই প্রশ্নের কোন উত্তর মিলিবেক না। কিন্তু বঙ্কিম একখানি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখিতেছেন ইহা কল্পনা করিতে বাধা কোথায়?

এই পর্যন্ত লিখে বেণীমাধব যেন বিশেষভাবে চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়লেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল।

পরপর চারটে ব্ল্যাকক্যাট বিড়ি শেষ করলেন। ব্ল্যাকক্যাট বিড়ির রঙ অসাধারণ। কমলাকান্তের আফিং-এর থেকেও চমকপ্রদ এর মস্তিষ্ক উত্তেজক ক্ষমতা।

স্বল্প পরিসর ঘরে এদিক থেকে ওদিক- একটু হাঁটহাটি করলেন বেণীমাধব। গল্পটাতে শুরুতেই একটা ক্লাইম্যাক্স থাকলে জমবে ভালো। ক্লাইম্যাক্স থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাবে শাখাপ্রশাখা নিয়ে। বঙ্কিম না করলেও বেণীমাধবের কমলাকান্তকে নায়ক বানাতে কোন অসুবিধা নেই। কমলাকান্তর মত এমন একজন স্থিতধী, প্রাজ্ঞ এবং অবশ্যই অসীম জ্ঞানভাণ্ডারে সংপৃক্ত, ব্যাপক জনপ্রিয় এবং জনমানষে বিপুল প্রভাব সঞ্চারকারী ব্যক্তিত্বের নায়ক হতে কোন বাধা থাকার কথা নয়। এরকম একটা চিন্তা মাথায় আসতেই বেণীমাধবের সম্বিত ফেরে।

দুচোখ রগড়ে সামনে তাকাতেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান বেণীমাধব। সামনে দাঁড়িয়ে এযে চিরকালের সাহিত্য সম্রাট। অতিশয় গম্ভীর মুখ, রাশভারী চেহারা।

“এ তোর কি ধরনের সাহিত্য হচ্ছে রে বেণীমাধব? এ কি ভাষা? তোদের এখানকার সাহিত্যের ভাষা ত এ নয়? এসব লোকে পড়বে বলে তোর ধারণা? অপদার্থ!” সাহিত্য সম্রাটের এরকম মন্তব্যে ঘাবড়ে গেল বেমীমাধব। সাহিত্য সম্রাটের কথ্য ভাষায় বিচরণটাও বেণীমাধবকে শঙ্কিত করে।

“এ কীরূপ ভাষা প্রয়োগ করিতেছেন সম্রাট! আমি তো এরূপ ভাষা আপনার নিকট হইতে শিখি নাই?” কাতর কণ্ঠে বেণীমাধবের আকুতি।

“ন্যাকামো ছাড়। ব্যাটা বাংলা ভাষাটাই শিখিস নি, করতে বসেছিস সাহিত্য চর্চা। তোদের সঙ্গ ছেড়েছি তা হল প্রায় একশ বছরের ওপর। এই এতগুলো বছরে তোদের ভাষাটা অনেক পাল্টেছে। রবি তো একাই ক্যানটার করে ছেড়েছে” ।

আঁতকে ওঠে বেণীমাধব। “সম্রাট, এ কি শব্দের প্রয়োগ করছেন আপনি। ক্যানটার শব্দটা কি বাংলা”?

“অবশ্যই। বাঙালীরা আজকাল এ জাতীয় শব্দের এন্তার প্রয়োগ করছে। এটা কি নির্দিষ্ট অর্থ-দ্যোতক নয়? রবি একেকটা বাংলা শব্দের চার-পাঁচ রকম বানান লিখে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সবিশেষ সুবিধা করার চেষ্টা করেছিল। বেচারা সফল হয়নি। সফল হয়নি তোদের মত গুটিকয়েকের জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় একবিংশ শতকের বাংলা লিখিস না। ও কেউ পড়বে না”।

বেণীমাধব লিখলেন, “সাহিত্য সম্রাটের সহিত এইরূপ কথোপকথন চলিতে ছিল। সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সর্বশেষে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানে সম্রাটের জ্ঞান আমাকে প্লাবিত করিল। সম্রাটের সন্দর্পনে আরও তিনটি ব্ল্যাকক্যাট। বিড়ি গ্রহণ করিয়া যখন আমি যথেষ্ট পরিমাণে উদ্দীপ্ত হইয়াছি, তখনই ছন্দপতন। আবির্ভূত হইলেন মোটা পৈতা পরিহিত, তৈলবিহীন কেশমণ্ডিত, সর্বগাত্রে ব্রাহ্মণচিহ্ন শোভিত এক বৃদ্ধ। একখণ্ড বস্ত্র বৃদ্ধের ঊর্ধ্বাংশ সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত করিতে পারে নাই। বৃদ্ধের চক্ষু দুটি উদাস নেশাগ্রস্থের মত। বৃদ্ধের আবির্ভাবে সাহিত্য সম্রাট আন্দোলিত হইলেন। চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হইল। তর্জনী তুলিয়া হুঙ্কার ছাড়িলেন -

...কমলাকান্ত, না?”

“আজ্ঞে, মহাশয় সঠিক অনুমান করিয়াছেন” ।

“এতদিন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে হে?”

“এত তর্জন গর্জন কিসের জন্য? তোমাকে হাতেনাতে ধরবার জন্যই তো আমার আগমন। যতদূর অনুমান তুমিই ভীষ্মদেব খোশ্‌নবীস। আমার পাণ্ডুলিপির দপ্তরটি তুমি চুরি করে বেশ দু’পয়সা কামিয়েছ। অথচ সামান্য একটু আফিঙের জন্য আমার সে কি দুরবস্থা।

সাহিত্য সম্রাট জোর গলায় প্রতিবাদ করেন — “মোটেই আমি চুরি করিনি। তুমি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে। নিজের চেষ্টায় কমলাকান্তর দপ্তর বঙ্গ দর্শনে ছাপিয়ে আমি তোমাকে জগদ্বিখ্যাত করেছি। কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবে, কৃতার্থ থাকবে, তা না চোটপাট!

বেণীমাধব লিখলেন — “এইরূপ বাদানুবাদ চলিতেছিল, আমি ঐ সকল কথোপকথনের বিন্দুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেছিলাম না। আমার অসহায় অবস্থা দর্শনক্রমে দয়াপরবশ হইয়া কমলাকান্ত মহাশয় একখণ্ড কাগজ আমার দিকে বাড়াইয়া দিলেন”।

“নাও হে, পড়ে দেখ। এখনকার শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতকার —- এদের নামে চুরির বদনাম। এরা নাকি চুরি বিদ্যাটাকেই এক মহান শিল্পে পরিণত করেছেন। পড়ে দেখ তোমাদের সম্রাটদের কাজ।

বেণীমাধব ফের লিখলেন — “আমি কাগজখানি বারংবার পাঠ করিয়া নিতান্তই বিঘ্নবোধ করিলাম। মনে হইতেছে কমলাকান্ত মহাশয়ের বক্তব্যই সঠিক। পাঠকের সুবিধার্থে চিঠিখানি নিচে উদ্ধৃত করিলাম।

পূজ্যপাদ

শ্রীযুক্ত বঙ্গদর্শন সম্পাদক মহাশয়

শ্রীচরণকমলেষু,

আমার নাম শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী, সাবেক নিবাস শ্ৰীশ্ৰী নসিধাম, আপনাকে আমি প্রণাম করি। আপনার নিকট আমার সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পরিচয় নাই, কিন্তু আপনি নিজগুণে আমার বিশেষ পরিচয় লইয়াছেন, দেখিতেছি। ভীষ্মদেব খোশনবীস, জুয়াচোর লোক আমি বুঝিয়াছিলাম — আমি দপ্তরটি তাহার নিকট গচ্ছিত রাখিয়া তীর্থদর্শনে যাত্রা করিয়াছিলাম; তিনি সেই অবসর পাইয়া সেইটি আপনাকে বিক্রয় করিয়াছেন। বিক্রয় কথাটি আপনি স্বীকার করেন নাই, কিন্তু আমি জানি, ভীষ্মদেব ঠাকুর বিনামূল্যে শালগ্রামকে তুলসী দেন না, বিনামূল্যে যে আপনাকে শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী প্রণীত দপ্তর দিবেন, এমত সম্ভাবনা অতি বিরল। এই জুয়াচুরির কথা আমি এত দিন জানিতাম না। দৈবাধীন একজোড়া জুতা কিনিয়া এই সন্ধান পাইলাম। একখানি ছাপার কাগজে জুতা জোড়াটি বান্ধা ছিল, দেখিয়া ভাবিতেছিলাম যে, কাহার এমন সৌভাগ্যের উদয় হইল যে, তাহার রচনা শ্রীমৎ কমলাকান্ত শৰ্ম্মার চরণযুগলের ব্যবহার্য পাদুকাদ্বয় মণ্ডন করিতেছে! মনে করিলাম, সার্থক তাহার লেখনী ধারণ! সার্থক তাহার নিশীথ তৈলদাহ! মুখের দ্বারা তাহার রচনা পঠিত না হইয়া সাধুজনের চরণের সঙ্গে যে কোন প্রকার সম্বন্ধযুক্ত হইয়াছে, ইহা বঙ্গীয় লেখকের সৌভাগ্য। এই ভাবিয়া কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া পড়িয়া দেখিলাম যে, কাগজখানি কি। পড়িলাম, উপরে লেখা আছে, “বঙ্গদর্শন। ভিতরে লেখা আছে, “কমলাকান্তের দপ্তর”। তখন বুঝিলাম যে, আমারই এ পূৰ্ব্বজন্মার্জিত সুকৃতির ফল।

কমলাকান্তর এরূপ অভিযোগে সাহিত্য সম্রাট যৎপরোনাস্তি উত্তেজিত হইলেন। কম্পিত হস্তের তর্জনই আন্দোলিত করিয়া পাল্টা অভিযোগ আনিলেন কমলাকান্তর বিরুদ্ধে।

“তুই ব্যাটা বড় ওস্তাদ। বেচারই প্রসন্নকে টুপি পড়িয়ে বিনি পয়সায় দুধ, সর, মাখন, ছানা খেলি। তারপর আবার গরু নিয়ে মামলায় প্রসন্নকেই বিপাকে ফেললি। চোরেরই এমন বড় গলা। মানায় বটে!

এইরূপ উত্তেজনার মধ্যে সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করিয়া এক কৃষ্ণবর্ণা মহিলার আবির্ভাব হইল এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল”।

      বেণীমাধবের এবার ঘোরতর সন্দেহ হল যে এই আবির্ভূত মহিলা প্রসন্ন না হয়ে যায় না। অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন মহিলাটি সরাসরি কমলাকান্তকে আক্রমণ করলেন।

      ‘আমার মঙ্গলা দুধে গত্তি লাগিয়ে, এই নচ্ছার ব্যাটা, আমাকেই লেঙ্গি মেরেছে। তোর আফিং-এর নেশা এবার আমি ছুটিয়ে দেব”। হঠাৎ-ই নজর গেল বেণীমাধবের দিকে — “এ ছোঁড়াটা আবার কোত্থেকে এলো? একে তো দেখিনি কোনদিন। তুই কে রে?”

      আজ্ঞে, আমি বেণীমাধব। অতি সাধারণ মানুষ। ছিলাম সুখেই। হঠাৎ খেয়াল গেল বিজ্ঞানের গল্প লিখব। আর তাতেই এত বিপত্তি। তোমরা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলে বলতে পারো?”

      “এ মোলো যা। এযে আবার উল্টে আমাকেই শুধোয় দেখি? এতো সহজ লোক নয়! তোদের নষ্ট কাজের জন্যই ত আমাদের আসতে হল গো। এই যে এতবড় লোকটাকে তোরা মোটা মলাট দিয়ে বাঁধিয়ে তাকে তুলে পুজো করছিস - মলাট খুলে দেখেছিস ভেতরে কি আছে? বিজ্ঞানের গল্প’ত সে কবেই নিকেছে। ওরে ওই কমলা – না কমলা বললে মেয়ে মেয়ে শোনায়, তা ভাল ঐ কান্ত। ওহে কান্ত তোর দপ্তরের সেই নেকাটা দেকানা। আমার কেচ্চা করতে যেটা নিকেছিলি”।

      কমলাকান্ত ঘাবড়ে গিয়ে চট করে একটা লেখা মেলে ধরল বেণীমাধবের সামনে। লেখাটা পড়ে বেণীমাধব হতভম্ব।

      ‘আমি ব্রাহ্মণদিগকে নমস্কার করিয়া পাশের দোকানে গেলাম।

      দেখিলাম, ইহাদিগের সম্মুখেই এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের দোকান। কতকগুলি সাহেব দোকানদার, ঝুনা নারিকেল, বাদাম, পেস্তা, সুপারি প্রভৃতি ফল বিক্রয় করিতেছেন। ঘরের উপরে বড় বড় পিতলের অক্ষরে লেখা আছে।

Messrs Brown Jones And

Robinson

Nut Suppliers

Established 1757

On The Field of Plassey.

Messrs Brown Jones And Robinson,

Offer To The Indian Public

A Large Assortment of Nuts,

Physical, And Metaphysical, Logical, Illogocal

And

Dislocate The Teeth of All Indian Youths

Who Stand in Need Of Having Their

Dental Superfluities Curtailed.

 দোকানদার ডাকিতেছেন — “আয় কাল বালক, Experimental Science খাবি আয়। দেখ, ১ নম্বর এক্সপেরিমেন্ট – ঘুসি; ইহাতে দাঁত উপড়ে, মাথা ফাটে এবং হাড় ভাঙ্গে। আমরা এ সকল এক্সপেরিমেন্ট বিনামূল্যে দেখাইয়া থাকি। পরের মাথা বা নরম হাড় পাইলেই হইল। আমরা স্থূল পদার্থের সংযোগ বিয়োগ। সাধনে পটু — রাসায়নিক বলে বা বৈদ্যুতীয় বলে বা চৌম্বক বলে, জড়পদার্থের বিশ্লেষণেই সুদক্ষ – কিন্তু সর্বাপেক্ষা মুষ্ট্যাঘাতের বলে মস্তকাদির বিশ্লেষণেই আমরা অকৃতকাৰ্য। মাধ্যাকর্ষণ, যৌগিকাকর্ষণ, চৌম্বকাকর্ষণ প্রভৃতি নানাবিধ আকর্ষণের কথা আমরা অবগত আছি, কিন্তু সর্বাপেক্ষা কেশাকর্ষণেই আমরা কৃতবিদ্য। এই সংসারে জড়পদার্থের নানাবিধ যোগ দেখা যায়; যথা বায়ুতে অম্লজান ও যবক্ষারজানের সামান্য যোগ, জলে জলযান ও অম্লজানের রাসায়নিক যোগ, আর তোমাদিগের পৃষ্ঠে, আমাদের হস্তে, মুষ্টিযোগ। অতএব এই সকল আশ্চর্য ব্যাপার দেখিবে যদি, মাথা বাড়াইয়া দাও; এক্সপেরিমেন্ট করিব। দেখিবে, গ্রাবিটেশ্যনের বলে এই সকল নারিকেলাদি তোমাদের মস্তকে পড়িবে; পৰ্কশন্ নামক অদ্ভুত শাব্দিক রহস্যেরও পরিচয় পাবে, এবং দেখিবে, তোমার মস্তিষ্কস্থিত স্নায়ব পদার্থের গুণে তুমি বেদনা অনুভূত করিবে।

অগ্রিম মূল্য দিও; তাহা হইলে চ্যারিটিতে এক্সপেরিমেন্ট খাইতে পারিবে”।

আমি এই সকল দেখিতে শুনিতেছিলাম, এমন সময়ে সহসা দেখিলাম যে, ইংরেজ দোকানদারেরা লাঠি হাতে দ্রুতবেগে ব্রাহ্মণদিগের ঝুনা নারিকেলের গাদার উপর গিয়া পড়িলেন, দেখিয়া ব্রাহ্মণেরা নারিকেল ছাড়িয়া দিয়া, নামাবলি ফেলিয়া, মুক্তকচ্ছ হইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিলেন। তখন সাহেবেরা সেই সকল পরিত্যক্ত নারিকেল দোকান হইতে উঠাইয়া লইয়া আসিয়া, বিলাতী অস্ত্রে ছেদন করিয়া, সুখে আহার করিতে লাগিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “এ কি হইল?” সাহেবেরা বলিলেন, “ইহাকে বলে, Asiatic Researches.” আমি তখন ভীত হইয়া, আত্মশরীরে কোন প্রকার Anatomical Researches আশঙ্কা করিয়া, সেখান হইতে পলায়ন করিলাম”।

“লিখতে পারবি না এমন গল্প। সাত, জন্ম তপস্যা করেও পারবি না। তার চেয়ে বরং বঙ্কিম বুড়োকেই ধর। নিকতে ত একন পারে না মুখে বলে যাবে তুই লিকে নিবি”।

বেণীমাধব মুষড়ে পড়ে। সে চেয়েছিল লেখক হতে, অনুলেখক নয়। আরও সমস্যা আছে। কোন প্রকাশক, কিংবা সম্পাদক, বিশ্বাস করবে না যে মৃত্যুর পরে ফের ফিরে এসে বঙ্কিমচন্দ্র আবার লিখছেন।

সমস্যা হলেই বেণীমাধবের হাতটা অজান্তেই চলে যায় পকেটে। একটা ব্ল্যাকক্যাট বার করে একটান দিতেই চোখে পড়ল কমলাকান্তর মুখ।

“ধোঁয়াটায় ত বেশ সুন্দর গন্ধ রে! কি টানছিস?”

“আজ্ঞে ব্ল্যাকক্যাট বিড়ি”

“বেশ! চমৎকার! এত দেখেছি আফিঙ-এর থেকেও এক কাঠি সরেস। আফিঙ ত আজকাল খেতে পারিনা। প্যাশিভ খেয়েই থাকি। ধোঁয়াটা আমার দিকে ছাড় দেখি!”

“আফিঙ-এ কি দোষ — মহাশয়। খাইতে আপত্তি। কেন?”

“গাধা। একটা আস্ত গাধা। আরে দেহটাই ত নেই – আফিঙ খাব কি করে?

“দেহবিহীন আপনি বর্তমান কি উপায়ে?

“তুই তো বিজ্ঞান লেখক হবার সাধনায় নেমেছিস। তুই-ই ভেবে বল কি উপায়ে? আমার প্রসন্নকে শুধো — ওই বলে দেবে।

ফ্যাঁচ্ করে ওঠে প্রসন্ন— “আমার নাম নিবি না কান্ত। মেলা বিরক্ত করেছিস আগে। ব্যাটা আফিঙ গিলত আর আমায় স্বপ্নে দেখত। স্বপ্ন দেখার সাধ ছিল বে করার ক্ষমতা ছিল না। তকন সে বামুন ঠাকুর আর আমি হলেম গোয়ালিনী। ফের যদি পেছন পেছন ঘুরেছিস বঁকাকে দিয়ে গল্প বানাবো তোর নামে।

বেনীমাধব লিখলেন — “এহেন গালিগালাজ এবং কুইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা চলিতে লাগিল। বুঝিলাম কমলাকান্তর সহিত প্রসন্নর সম্পর্ক আদৌ ভাল নহে। কিন্তু যে প্রশ্ন আমাকে বিশেষভাবে ভাবিত করিল তাহার উত্তর মিলিবে না বলিয়াই মনে হয়। প্রশ্নটি হইল — উভয়ের মধ্যে সদ্ভাবের যদি এতই অভাব থাকিবে তাহা হইলে প্রসন্ন কেন বিনি পয়সায় কমলাকান্তকে দুগ্ধ, মিষ্টান্ন, ঘৃত ইত্যাদি সহযোগে সেবা করাইবে! কিন্তু এইরূপ অবান্তর তর্কবিতর্ক অধিককাল চলিতে দেওয়া যায় না। ইতিমধ্যেই আমার কল্পবিজ্ঞানের গল্প রচনার সাধ তিরোহিত হইতে বসিয়াছে। কল্প বিজ্ঞানের গল্প লিখিতে গিয়া এইরূপ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়িতে হইবে পূর্বে অনুমান করি নাই। আমি এক্ষণে স্থির করিয়াছি — এ জীবনে আর গল্প লিখিব না। অনেক হইয়াছে, আর নহে”।

এই পর্যন্ত লিখে, আরেকটা ব্ল্যাকক্যাট ধরিয়ে, বেণীমাধব, নিমীলিত চক্ষে হয়ত একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সম্বিত ফিরল পিঠে কারো সস্নেহ হাতের ছোঁয়ায়! পিছনে চেয়ে দেখেন — অবিকল সেই জোব্বা পড়া, পাগড়ী মাথায়, চির পরিচিত সাহিত্য সম্রাট। সস্নেহে হাত বোলাচ্ছেন বেণীমাধবের পিঠে। কাছে পিঠে আর কেউ নেই, না কমলাকান্ত, না প্রসন্ন।

চট করে একটা আইডিয়া খেলে গেল বেণীমাধবের মাথায়। প্রসন্নর নির্দেশ মেনে সম্রাটকে বলেই ফেললেন কথাটা।

“সম্রাট— আপনি যদি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখিতেন, তাহা কোন বিষয়ের উপর, কোন প্লটে হইত? নায়ক-নায়িকা বা অন্যান্য চরিত্ররাই বা কেমন হইত? একটু শুনিতে ইচ্ছা হয়!”

সম্রাট কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। সম্রাটের মুখটা উত্তরোত্তর কঠিন। হতে থাকল। বেণীমাধবের পিঠে হাতটা রাখাই আছে কিন্তু নিশ্চল। অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে সম্রাট বললেন—

বেণীমাধব লিখলেন — “আমি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখতাম না। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিজ্ঞান আজ নিজেকে এইরূপ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। আজকের বাস্তব বিজ্ঞান কল্পবিজ্ঞানের অপেক্ষা অনেক চমকপ্রদ”।

“সম্রাট আপনি কি কল্পবিজ্ঞান লেখার বিরোধী?”

“তোদের জেনারেশনের এই একটা রোগ। সমর্থক-বিরোধী, পক্ষে-বিপক্ষে; একটা কিছু কি হতেই হবে! তা যাই হোক, পক্ষে বিপক্ষের ব্যাপার নয় এটা। আমার কথা হল — আসল বিজ্ঞান যখন কল্পবিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়েও আরও অনেক দূরে চলে গেছে তখন তা নিয়ে অহেতুক গল্প লেখার কি প্রয়োজন?

“কল্পনার সীমা ছাড়াইয়াছে বলিতে, সম্রাট, আপনি কোন অর্থ বুঝাইতেছেন?”

“অর্বাচীন, দেখতে পাচ্ছিস না, মানুষ আজ গ্রহান্তরে পাড়ি জমাচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে অন্তর্বিশ্ব মানুষের নখদর্পণে। রোগভোগের বিরুদ্ধে বিশাল অভিযান। বিশ্বের বিশাল খাদ্যভাণ্ডার। কি নেই! মানুষ এখন পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ এখন পরীক্ষাগারে মানুষ তৈরি করতে সক্ষম। এর পরে আর কল্পনা করা যায়?”

“তাহা হইলে কি বর্তমান কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের আর কিছুই করিবার নাই? আপনি যদি কোন ডাকসাইটে সম্পাদক কিংবা প্রকাশকের অনতিক্রমণীয় চাপে কল্প বিজ্ঞানের গল্প রচনা করিতে বসেন, তাহা হইলে কি বিষয়ে লিখিবেন?”

সাহিত্য সম্রাটকে বিশেষ চিন্তামগ্ন মনে হল। বেণীমাধব লিখলেন—“সাহিত্য সম্রাট দীর্ঘক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করিলেন। তাহার চিন্তার কালটি ধরিয়া আমার এই ‌ক্ষুদ্রক‌ক্ষে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়া চলিল। কখনো কক্ষটি অপূর্ব জ্যোৎস্নালোকের আলোর ধারায় প্লাবিত হইল, কখন তীব্র আলোকচ্ছটায় দুই চক্ষুতে অন্ধকার নামিয়া আসিল। কক্ষের ভিতর এক সময় বিলাস প্রাচুর্যের জীবনযাত্রার চিত্র অঙ্কিত হইল, পরমুহূর্তেই সেইগুলি মিলাইয়া গেল এবং তাহার স্থান দখল করিল সারি সারি অন্নহীন, বস্ত্রহীন, চর্মসার মলিন মানব দেহের সমাহার। প্রচণ্ড গর্জনে হঠাৎ যেন মানব কোলাহল অস্তমিত হইল। তীব্র আলোকচ্ছটায় মানব সভ্যতার অন্ত্যোষ্টি সংঘটিত হইল। বুঝিলাম পারমাণবিক বোমার উপর্যুপরি বিস্ফোরণে মানবসভ্যতা শেষ হইল। একদিকে মানব প্রগতির বিশাল ভাণ্ডার—খাদ্য, পানীয়, ঔষধি, অন্যদিকে রোগগ্রস্থ মানব-মানবী-শিশুর করুণ বিলাপ। একদিকে অন্ধকার—ঘোর অমানিশা; অপরদিকে প্রচুর্যের ‍‌উদ্ভাস। এইরূপ দৃশ্যাবলী পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সময় হইতে অদ্যাবধি যাহা যাহা ঘটিতেছে তাহা দেখাইতে লাগিল। আমি সম্মোহিত হইয়া গভীর নিদ্রামগ্ন হইলাম।

পরদিন প্রত্যুষে আমার নিদ্রাভগ্ন হইল। প্রভাতের প্রথম সূর্যের আলো ক‌ক্ষে প্রবেশ করিয়াছে। দেখিলাম আমার কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখিবার খাতায় একটি সুন্দর হস্তাক্ষরের রচনা। রচনাটি পাঠ করিয়া আমি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখিবার প্রচেষ্টা বাতিল করিলাম। প্রাপ্ত রচনাটির অন্তিম পংক্তিটি,যাহা আমাকে উদ্দেশ করিয়া রচিত বলিয়া আমার ধারনা, আমি সুধী পাঠকদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিলাম

“ বিধাতা তোমায় তেজ দেন নাই, এজন্য তুমি শান্ত, বেগ দেন নাই, এজন্য তুমি সুধীর, বুদ্ধি দেন নাই, এজন্য তুমি বিদ্বান; এবং মোট না বহিলে খাইতে পাও না, এজন্য তুমি পরোপকারী! আমি তোমার যশোগান করিতেছি; ঘাস খাইয়া সুখী কর”।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তর দপ্তর অনুসরনে রচিত

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb