স্মৃতির দরজা ঠেলে

লেখক - সাগ্নিক সিনহা

 

                                                             

                                                                        চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল

মফস্বলের ভিজে বিকেল, রাস্তায় জল জমেছে বর্ষায়। জানলার ওপাশে বেশ গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। দুটো বনকলমী, কয়েকটা পাতাবাহার আর এক খানা পুরনো জবাগাছকে ঘিরে থাকে অনেকগুলো জংলি লতাপাতা। তার গা দিয়েই দাঁত বের করে থাকে ইঁটের এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, ওই রাস্তা সোজা চলে গেছে পাড়ার পিছন দিকে, বারোয়ারী পুকুরের ধার ঘেঁষে, সেই যে দূরে দেখা যায় প্রাইমারি ইস্কুলের হলদে বাড়িটা.. ওইদিকে। ইস্কুলের মাঠ এই বিকেলের দিকে ফাঁকা হয়ে যায়। তাই বলে রোজ না। আজকে জানলার ধারে এসে বসলেই শোনা যাচ্ছে হই-হল্লার শব্দ। মনটা খারাপ লাগছে হয়তো একটু একটু। কেন? ওই যে, দুপুরেই ফতোয়া জারি করেছে মা, চোখ পাকিয়ে বলেছে, " একদম পা বাড়াবি না ওদিকে, সামনে হাফ ইয়ারলি সে খেয়াল আছে? চার ছক্কা মেরে কি ইস্কুল টপকাবে?"....আজ তাহলে যাওয়া হবে না!

ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ে সামনের দিকে, ওই যে ইঁটের উপর টিপে টিপে পা ফেলে, কাদা ছিটকানি এড়িয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে সে। হাত নেড়ে ডাকছে, " আরে, আয় আয়, পরে কাকিমাকে কিছু একটা বলে দিবি। আজকে ম্যাচের দিন থাকবি না মানে, বললেই হল?"...

মন বলছে, যাব যাব। যেতেই হবে। ওই তো সামনেই সদর দরজা। মা সব কাজকর্ম করে শুতে গেছে, অনেক দেরি হয়েছে সন্ধ্যার আগে ঘুম ভাঙ্গেনা মায়ের। যাই না, কি আর হবে। দরজাটা খুলে গেল। স্মৃতির দরজা…বেরিয়ে আসে গল্পগুলো। তবু কোন ফাঁক গলে হারিয়ে গেল টুকরো টুকরো কিছু জোনাকির আলো। কি যেন নাম ছিল ছেলেটার? ঝাঁকড়া চুল, কথায় কথায় দিব্বি দিত, মগডাল থেকে আম পেড়ে আনত একলা দুপুরগুলোয়…ওই যে সেদিন খেলার জন্য ডাকতে এসেছিল যে, সেই। কি যেন নাম তার? মনে পড়ে না। মনে পড়ে না, সেই মেয়েটার কথা।

ইলেভেনে প্রথম কো-এড স্কুলে ভর্তি। বসার নিয়মে ভারী কড়াকড়ি, ছেলেরা একদিকে মেয়েরা একদিকে। এই ধারের পাশাপাশি বেঞ্চে বসত মেয়েটা…কি সব হাবিজাবি বকবক করত আর নিজেই হেসে ফেলত। ওর সাথে গল্প করার দোষে কতবার বাইরে বের করে দিয়েছেন রাগী ক্লাস টিচার, গোনা হয়নি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগত তার দিকে, মনে পড়ে না ..কে সে! স্মৃতির দেওয়াল লিখনে পুরনো প্লাস্টারের মতই ঝরে পড়ে গেছে কয়েকটা চাঙড়, খুব দরকারী প্রিয় কয়েকটা টুকরো।

কালি, কলম, মনলেখে তিনজন

মন এবং মস্তিষ্ক। এই নিয়ে আমাদের দুনিয়াদারি। মানবমনের কোনো কম্পিউটার সিমুলেশন আজ পর্যন্ত তৈরি করা যায়নি, এবং অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোনো দুরাশা নেই। আর এই মনের আরো অন্যান্য হাজারখানা জটিল কাজের মধ্যেই সবচেয়ে দুর্বোধ্য হল এই স্মৃতি।

মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের স্মৃতির মেকানিজম বেশ সোজাসাপ্টা এবং অনেকটাই যান্ত্রিক গোত্রের, বেশ সীমিত। যেমন, কুকুর, বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা তাদের চেনা মানুষকে মনে রাখে বিশেষ গন্ধ দিয়ে, নিজেদের চেনার জন্য ব্যবহার করে ফেরোমন। মাছেরা আবার বড়োসড়ো ঘটনা মনে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, তাদের ডিএনএ সজ্জায় বিশেষ এক প্যাটার্নে মিথাইল (-CH³) মূলক জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে। শীত পড়লে সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী পাখিরা তাদের হাজার হাজার কিলোমিটারের মহাদেশজোড়া চলনপথ মনে রাখে উঁচু পাহাড়চূড়া, ঘন জঙ্গল, নদীর গতিপথ এবং আরো এরকম কিছু ভৌগোলিক marker দিয়ে। আকাশের অনেক উপর থেকে এই জিনিসগুলো চেনার জন্য পাখিরা লক্ষ্য করে তাদের চারপাশের ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের (earth's magnetic field) বিন্যাসের দিকে, বিভিন্ন জায়গায় যেটা পাল্টে যায় নানা কারণে।

মানুষের ক্ষেত্রে আমরা যেটুকু বুঝেছি সেটা একেবারেই সীমিত। আমরা এতদিন ধরে জানি, মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সের হিপোক্যাম্পাস নামের ছোট্ট টুকরোটাই ধরে রাখে যাবতীয় সুখ দুঃখের স্মৃতি। কিন্তু এখন জানা গেছে শুধু সে ব্যাটাই না, এই মনে রাখার ক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নেয় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স নামের অংশটা। যার কাজ active memory নিয়ে, অর্থাৎ কোনো একটা মুহূর্তে একজন মানুষের যা যা তথ্য দরকার পড়ছে সেগুলোকে যোগান দেয়া, আর জমিয়ে রাখা স্মৃতিকে দরকারে মনে করা। তারপর স্মৃতির আছে অনেক রকমফের।

কেউ বলেন স্মৃতি মানে দু রকম - ক্ষণস্থায়ী (short term) আর দীর্ঘ মেয়াদি (long term)। আবার অন্যরা বলেন, এর চেয়ে ভালো হচ্ছে স্মৃতিকে, episodic (অর্থাৎ স্থান, কাল, পাত্র জাতীয় তথ্য) আর semantic ( বা যুক্তিযুক্ত ভাবে শেখা তথ্য, এটা পড়াশোনাও হতে পারে)। এর বাইরেও স্মৃতি হতে পারে তথ্যমূলক ( declarative) কিংবা কারিগরী দক্ষতা মূলক ( অর্থাৎ non declarative বা যেসব কাজ করতে আমরা আলাদা করে শিখি, যেমন সাইকেল চালানো, দাবা খেলা, গীটার বাজানো… সেই skill গুলো)।

স্মৃতি বলতে গেলে জটিল একটা সার্কিটের মত যার এলোমেলো সুতোগুলো ছড়িয়ে আছে মাথার আনাচে কানাচে, তাই শুধু ওই উপরের ওই দুটো অংশই না, এছাড়াও টেম্পোরাল লোব, প্যারাইটাল এবং অক্সিপিটাল লোব, সেরিবেলাম ( এর কাজ মূলত প্রটিবর্ত ক্রিয়ার স্মৃতি ধরে রাখা) মিলিয়ে গোটা ব্রেইনটাই তার সৈন্য সামন্ত অর্থাৎ কয়েক লাখ কোটি নিউরোন নিয়ে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যায় দিনরাত।

মরীচিকা, মিথ্যে শহর, ঘরবাড়ি

" কী যে ভাল মিথ্যে তুমি, অপচয়হীনা

আমিও সমস্ত ভাবি। নিজেকে ভাবি না…"

(মিথ্যে, শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায় )

ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে ভয় লাগে, কারণ এই বিষয়টা একটা সরু দড়ির ব্রিজ। পা ফস্কাবে যখন তখন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে, এই বছর দশেক আগে হলিউডের "মী টু" মুভমেন্টের কথা মনে আছে? যেখানে একের পর চিত্র তারকা থেকে শুরু করে সাপোর্ট স্টাফ, ফ্লোর স্টাফ, স্টুডিও ক্রু হিসেবে কাজ করা মহিলারাও শয়ে শয়ে অভিযোগ করেছিলেন যৌন নিগ্রহের। আঙুল সবক্ষেত্রেই কোনো না কোনো বিতর্কিত পুরুষ পরিচালক বা প্রযোজকের দিকে। ব্যাপারটা শুনে gimmick মনে হতেই পারে, কিন্তু অভিযোগগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি বলে প্রমাণ হয়। অনেকেই এই অভিযোগের ভিত্তিতে কাজ হারান, বরাবরের মতো ব্ল্যাক লিস্টেড হন ইন্ডাস্ট্রিতে।

 আপাত সম্পর্ক বিহীন একাধিক মহিলার এভাবে রুখে দাঁড়ানো বা নিজের জন্য গলা উঁচানো ইতিহাসে বিরল। জিনিসটা নারী শক্তির পরিচায়ক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মানুষের মন সিঁদুরে মেঘ দেখতে অভ্যস্ত। তাই প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হল না, তাদের ব্যাপারটা কি স্রেফ প্রমাণের অভাব? এমনও তো হতে পারে এটা সেই witch hunt এর মতই শ্রেণীবিদ্বেষ? আর যাদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যিই প্রমাণ পাওয়া গেছিল, এমনটা না যে যতজন অভিযোগ করেছিলেন তাঁদের সবাইকেই খুঁজে পাওয়া গেছিল অভিযুক্তের সাথে জড়িয়ে পড়তে, এমনটা কিন্তু না।

বড় জোর এক বা দুইজনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই বিচার হয়েছে, নির্দিষ্ট নিয়মেই, কারণ খুন একটা হলেও খুন, দশটা হলেও খুন। তাহলে বাকি যাদের অভিযোগ প্রমাণ হল না তাদের ব্যাপারটাই বা কি? যার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলা হল, সে যে আসলেই অমানুষ…সেটা কিন্তু প্রশ্নের অতীত। তাহলে যে অভিযোগগুলোর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেল না, সেগুলোও নিশ্চয়ই সত্যিই আসলে ঘটেছিল!

যাকগে, বাদ দিন। আচ্ছা ভেবে বলুন তো। ধরা যাক আপনি বাড়ির বাইরে বেরোলেন, বেশ কিছুটা হেঁটেই খেয়াল করলেন রোদ্দুর টা বেশ চড়চড় করছে আজকে, ছাতা খোলা দরকার। ব্যাগে হাতড়ালেন, কিন্তু ছাতার হদিশ নেই। আরে, সকালেই তো ব্যাগে ঢুকিয়েছেন ছাতাখানা, পরিষ্কার মনে আছে। ফিরে এলেন বাড়িতে, দেখলেন দিব্যি টেবিলের উপরেই রেখে চলে গেছেন। অথচ, তখনও আপনার মন আপনাকে বলছে, " বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু ঢুকিয়েছিলাম ব্যাগেই…”

হয় নি কখনও আপনার সাথে, ঠিক এইরকম? যে স্মৃতি টাটকা আপনার মনে, পরে সেটাই স্রেফ কল্পনা বলে প্রমাণ হয়নি কি কখনও? হয়েছে তো। মানুষের মনের একটা সহজাত প্রবৃত্তি এটা।

এইবার ফিরে আসা যাক হলিউডি গল্পের সেকেন্ড পার্টে। ইতিহাস ঘাঁটলে মী টু আন্দোলনের কাছাকাছি যে ঘটনার কথা উঠে আসে, সেটা বহুকাল আগের। সত্তর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়টাতে আমেরিকায় শিশুদের যৌন নিগ্রহের ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছিল, এই কয়েক বছরের মধ্যেই যত অভিযোগ জমা পড়ে, তার আগের কয়েকটা দশক মিলিয়েও এত রিপোর্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। 1984 সালে ম্যানহাটনের ম্যাকমার্টিন প্রি স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন এক অভিভাবক। দাবি জানান, তাঁর ছেলেকে ধর্ষণ করা হয়েছে স্কুল চত্বরে, ছুটির পর। ঘটনা চাউর হয়ে যায় ক্লাসে। আর তারপরই আশ্চর্য ভাবে, আরো বিশ পঁচিশ জন অভিভাবক এগিয়ে আসেন, তাঁরাও জানান তাদের বাচ্চার সাথেও ঘটেছে একই নারকীয় ঘটনা, স্রেফ লোকলজ্জার ভয়ে এতদিন বাবা মাকে জানাতে পারেনি সে।

প্রায় আগুন জ্বলে যাওয়ার মত অবস্থা, কারণ এসব যে সময়ের কথা, তখনও sexual offense এমন রোজকার খবর হয়ে ওঠেনি। স্বততই এমন গুরুতর পৈশাচিক ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ, সংবাদপত্রে হেডলাইন জুড়ে থাকে ইস্কুলের নাম। পরবর্তী ছয় বছর ধরে তদন্ত চলে, শুরু হয় ফৌজদারি মামলা। শেষমেষ 1990 সালে খারিজ হয়ে যায় কেস, বিচারক বলেন, প্রায় 90% অভিযোগই আসলে ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিক। উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যে না। বরং অসহায় মনের মরিয়া ছলনায় পা দেওয়া।

একটু খেয়াল করলে জানা যাবে, এই সময় নাগাদ ওই দেশে হিপনোথেরাপি, সাইকোথেরাপির মত নতুন জিনিসগুলো সামাজিক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেরাপিস্টরা রুগীদের নির্দেশ দিতেন তারা যেন বহুকালের চেপে রাখা যাবতীয় গভীর ক্ষতকে আবার মনে করার চেষ্টা করে, প্রকাশ করে (repressed trauma), তবেই মানসিক শান্তি মিলবে। ফলাফল? আশ্চর্যভাবে মিথ্যে হেনস্থার স্মৃতি রোমন্থন করতে শুরু করেন বেশিরভাগ মানুষ, যেটা তাঁদের সাথে হয়নি…হয়তো কখনও গল্প শুনেছিলেন, সেটাকেই নিজের জীবনের গল্প হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন অজস্র মানুষ। False memory নিয়ে গবেষণামূলক কাজের উদাহরণ বলতে গেলে এটাই প্রথম। দেশ বিদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন মিথ্যে অভিযোগের সংখ্যা তো অনেক বটেই, আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এমন কাল্পনিক "অপরাধের" দোষে অভিযুক্ত মানুষদের একটা বিরাট অংশ প্রায় বিনা দোষে শাস্তিভোগ করতেও বাধ্য হন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। যেমন জোসেফ পেসলি। ভদ্রলোক এক সকালে উঠে বাড়ির দরজায় পুলিশকে ধাক্কা দিতে যত না অবাক হয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি চমকে যান থানায় যাওয়ার পর। জেরার টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা এক মহিলা সঙ্গে সঙ্গেই শনাক্ত করেন তাঁকে। অভিযোগ ? জোসেফ না কি আগেরদিন রাত্রে ওই মহিলার বাড়িতে জানলা ভেঙে ঢুকে ( যাকে ওদেশে ডাকা হয় break in and entering) ঘুমের মধ্যেই তাঁকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেন। নেহাত সেসময় আরো একই ধরণের কিছু ঘটনার জেরে এই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন মনোবিদ এলিজাবেথ লফটাস। আদালতে তিনি প্রমাণ করে দেন, প্রচণ্ড স্ট্রেসের মধ্যে কিভাবে জট পাকিয়ে যায় স্মৃতির প্রবাহে, তখন উটকো লোককে দেখেও টম ক্রুজ ভাবা একেবারেই অসম্ভব না। তার উপর এখানে ভাবতে হবে, racial stereotype এবং generalisation এর কথা। ঠিক যেমন 9/11 এরপর মুসলিম মাত্রেই তালিবানি সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ভিসা বাতিল করে দেওয়া হচ্ছিল বারোয়ারী হারে, এক্ষেত্রেও অভিযোগকারী মেক্সিকান ভদ্রমহিলার কাছে অপরাধীর সম্মন্ধে মূল স্মৃতি বলতে শুধু "সাদা চামড়ার এক আমেরিকান মাঝবয়সী লোক"। সেই ছকে নিশ্চিন্তে ফেলে দেওয়া যায় পাশের ব্লকেই বাড়ি, বড়সড় চেহারার জোসেফকে, যাকে ওই ভদ্রমহিলা থানায় সেদিন মুখোমুখি হওয়ার আগেই হয়তো কখনও রাস্তাঘাটে দেখেছিলেন। সেই স্মৃতিই তালগোল পাকিয়ে যায় আগের রাতের অমন ঘটনার উস্কানিতে। অপরিচিত এক ভদ্রলোক টাইপকাস্ট হয়ে মানসপটে ধরা পড়েন হানাদার হয়ে। ভাবা যায়?!

এই নিয়ে একখানা বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টের গল্প শুনবেন? 1995 সালে লফটাস 24 জন কলেজ পড়ুয়াকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করেন। এই 24 জনের সব্বাইকে একগোছা কাগজ দেওয়া হয়, তাতে তাদের ছোটবেলার চারটে করে বড়োসড়ো ঘটনার কথা লেখা আছে। সেই ঘটনা কারোর ক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনা, অন্য কেউ হয়তো কোনো প্রিয় জিনিস হারিয়েছিল, কিংবা কোনো প্রিয় বন্ধু বা প্রেয়সীর সাথে বিচ্ছেদ…যেকোনো কিছু। এখন মজার কথা হচ্ছে, গোপনে আগে থেকেই যোগাযোগ করা হয়েছিল পরীক্ষাধীন এই 24 জন সাবজেক্টের বাবা মায়ের সাথে। তাঁদের থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল মোট তিনটি করে ঘটনা, যা তাঁদের বাচ্চাকে বেশ ভালোমত নাড়া দিয়েছিল ছোটো বয়সেই। যার যেমন তার তেমন সেই তিনটি করে ঘটনা ছাপা হয়েছিল ওই কাগজে, আর এর সাথে সবার কাগজেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল একটা চতুর্থ কাল্পনিক গল্প যেখানে ভিড়ে ভর্তি শপিং মলে মায়ের হাত ছাড়িয়ে হারিয়ে গেছে তারা, তারপর কেউ এসে হয়তো উদ্ধার করেছে তাদের।

 প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে যখন 24 জনকে জিজ্ঞেস করা হয়, " তাহলে বলুন তো, চারটে ঘটনা কি কি ঘটেছিল আপনাদের জীবনে?", দেখা যায় তিনটি সত্যি ঘটনা যত বিশদে মনে রেখেছে তারা ওই চতুর্থ গাঁজাখুরি গল্পটাও একইরকম seriousness নিয়ে একেবারে নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করছে তারা এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সত্যিই এমনটা ঘটেছিল। এটা suggestion এর মাধ্যমে বিশাল জনগণের perception এবং memory যে ইচ্ছেমত manipulate করা যায়, তার একটা বাস্তব উদাহরণ। ভেবে দেখলে স্পষ্ট বলা যায়, রাজনীতিবিদ এবং ধর্মগুরুরা নিজেদের স্বার্থে বিভেদের রাজনীতি তৈরি করেন ঠিক এইভাবেই। সুদূর অতীতের কোনো সামান্য ঘটনাকে রঙ চড়িয়ে বা আদপেই চূড়ান্ত কাল্পনিক কোনো গল্পকে ইতিহাস বলে পেশ করে এক শ্রেণীর মানুষকে অন্য শ্রেণীর মানুষের থেকে আলাদা করার যে নোংরা খেলা চলে আসছে সভ্যতার শুরু থেকে, তার মুলে তো এইটেই।

কিন্তু কেন ঘটে এমনটা? আসলে স্মৃতি বড়ো ঠুনকো, ভীষণ নমনীয়। শর্ট টার্ম থেকে লং টার্ম হয়ে পাকাপাকিভাবে মাথায় গেঁথে বসার মাঝে যে ফাঁকটুকু থাকে, সেই সময়েই হয়ে যায় কিছু অদল বদল। সেটার কারণ নানাবিধ। বাস্তবে যেটা হয়েছিল সেই ঘটনা ঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণেও পরে মানব মন নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারে ওই অভিজ্ঞতা। শিশুদের ক্ষেত্রে ছোটবেলায় বাস্তব দুনিয়াকে তারা যেভাবে বোঝে বা perceive করে, তার ভিত্তিতেই remodelling হতে থাকে অনেক অভিজ্ঞতার। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে হয়তো সত্যি কিন্তু তার interpretation এ রয়েছে গন্ডগোল। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিসটা হচ্ছে আবেগ, যার বশে আমরা আরো অনেক কাজের সাথে সাথে মনগড়া ইতিহাসে বিশ্বাস করতেও শুরু করি। আবার সামাজিক চাপে পড়ে সবার সাথে তাল মেলাতে গিয়েও বহু মানুষ একরকম জোর করেই সত্যিটা ভুলে অন্য রকম ভাবে ভাবতে convince করেন নিজেকে।

এরপর আরো অন্যান্য কারণ যেমন বয়সের ভারে, মানসিক অসুখ (OCD, সাইকোসিস, সিজোফ্রেনিয়া এইসব আর কি, যাতে রুগীর এমনিই কল্পনাপ্রবণ হয়), এমনকি নিজের সাথে হওয়া কোনো ট্রমার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও ( mental blocking, বা সোজা ভাষায় বললে survival instinct হিসেবে মন ভুলে যেতে চায় খারাপ অভিজ্ঞতা…আসল ঘটনাকে নিজের মতো নিরামিষ করে সাজিয়ে মাথায় save করে রাখে) false memory syndrome হতে পারে। মনোবিদরা বলেন, আমাদের মোট স্মৃতির, বিশেষ করে ছেলেবেলার যেটুকু মনে পড়ে তার অন্তত 30%ই আসলে ভুয়ো। মিথ্যে স্মৃতির অসুখ…যে স্মৃতি সুখের তাকে মিথ্যে বলে জানার যে নির্মম বাস্তব, তার চেয়ে কোনো অংশে কম বিপজ্জনক না।

শেষ করার আগে এই একই বিষয়ে বলতে ইচ্ছে করে ম্যান্ডেলা এফেক্টের কথা। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজেতা, মানবাধিকার যোদ্ধা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা কিভাবে জড়িয়ে পড়লেন বিভ্রান্তকর এই মিথ্যে স্মৃতির জালে?

 2009 সালে ফিওনা ব্রুন নামের এক ভদ্রমহিলা ইন্টারনেটে রীতিমত সাড়া ফেলে দেন। এক কনফারেন্সে তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেন, 1980 সালে কেপটাউনের জেলে নেলসন ম্যান্ডেলার অকালমৃত্যুতে গোটা পৃথিবী কিভাবে শোক প্রকাশ করেছিল। এদিকে তিনি জানতেন না যে, ম্যান্ডেলা তখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে ( এরও চার বছর পর, 2013 সালে তাঁর সত্যি সত্যি মৃত্যু হয়)। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সভায় উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু এমন আজগুবি দাবি শুনে কোনো প্রতিবাদ করেননি, নিদেন পক্ষে হেসেও ওঠেননি। ফিওনা সবটা জেনে খুব অবাক হয়ে নিজের ব্লগে লেখেন এই ঘটনার কথা।

ভাইরাল হয়ে যাওয়া সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে এসে আরো হাজার হাজার মানুষ দাবি করেন, তাঁরাও ওই লেখা পড়ার আগে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ম্যান্ডেলা মারা গেছেন। এবং এটা যে স্রেফ হুজুগেপনা নয়, সেটা প্রমাণ করার জন্য তাঁদের বেশিরভাগই বিশদে লিখে যান কি কি মনে রেখেছেন তাঁরা….সেই তালিকায় ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের শোকবার্তার বিবরণ থেকে শুরু করে মৃত্যু পরবর্তী তদন্ত, ম্যান্ডেলার শেষযাত্রার তারিখ, সময়, অন্ত্যেষ্টক্রিয়ায় তাঁর পোশাকের এবং কফিনের রংয়ের মত টুকরো টুকরো ডিটেইলও উল্লেখ হতে থাকে ক্রমাগত।

এই কয়েক হাজার মানুষ তো কেউ কাউকে চেনেন না! এমনকি তাঁরা থাকেন আলাদা আলাদা দেশে, একেকজন পৃথিবীর একেক প্রান্তে। তাহলে কিভাবে একদল সম্পূর্ন সম্পর্ক বিহীন মানুষ স্রেফ বানিয়ে বানিয়ে হুবহু একই গল্প বলতে পারে, সেটাও কি না এতটা খুঁটিয়ে?

এর পিছনে সমান্তরাল মহাবিশ্বে জাতীয় ভয়ানক সব থিয়োরি আছে অনেক, তবে সেসব নিয়ে না ভেবে দেখা যাক স্নায়ু বিজ্ঞানীরা কি বলেছেন।

মানুষের মস্তিষ্কের নিজের উপর বেজায় ভরসা। নিজেকে নিখুঁত ভাবাই তার প্রবৃত্তি। তাই মন স্মৃতির এলোমেলো ভাব বা তথ্যের ফাঁক ফোকর ঘেন্না করে, ঠিক আমার আপনার মতই। ঘটনাচক্রে কোথাও যদি ঘাটতি থাকে স্মৃতিতে , মন তাকে জোড়াতালি লাগিয়ে নেয় ওই ঘটনার আশেপাশে ঘটা অন্যান্য জিনিসের স্মৃতি থেকে ধার করে। অনেকটা mix and match game গুলোর মত ভাবতে পারেন, তাই না? এখন কথা হচ্ছে, ম্যান্ডেলার মত এমন বিশ্ববিখ্যাত মানুষের মৃত্যু জাতীয় গুরুগম্ভীর একটা বিষয় যখন একেবারে সাবলীল ভাবে কেউ জানাল, উল্টোদিকের মানুষের মন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিল এটা সত্যি হওয়াই দস্তুর, কারণ এমন জিনিস নিয়ে এভাবে কি কেউ ইয়ার্কি মারে?

মন তখন বোঝাল, " গলদ তো তোমার, তুমিই মনে রাখতে পারনা কিছু। শোনো বাপু, ঘটনাটা হয়েছে তো অবশ্যই…কই চেষ্টা করে বল দেখি বাকিটা তোমার মনে পড়ে কি না?" তখনই আমরা অবচেতন মনেই হাতড়াতে শুরু করি স্মৃতির সন্ধানে, আশেপাশে যেটুকু যা জানি সেই ভাঁড়ার থেকেই তুলে আনতে চাই মালমশলা, এই ক্ষেত্রে ওই ব্লগ পোস্ট পড়ার পর আশেপাশের সময়ে ঘটা অন্য কোনো ব্যক্তিত্বের মৃত্যু পরবর্তী ঘটনার থেকে তথ্য নিয়ে ম্যান্ডেলার ঘাড়ে জুড়ে দেয় নাছোড়বান্দা মন।

আর ঠিক এই কারণেই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানও আজকাল যথেষ্ট বিশ্লেষন না করে একেবারে চূড়ান্ত বেদবাক্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয় না। কারণ, আমরা চোখে দেখি ঠিকই, কিন্তু যা কিছু দেখি তার উপর নিজের মন মর্জি মানসিকতা অনুযায়ী একটা আলগা ফিল্টার লাগিয়ে তবেই স্মৃতির ফোল্ডারে জমা করি। এর সাথে উপরি হিসাবে যোগ হয়, ঘটনার পর অন্যান্যদের মুখ থেকে ওই ঘটনারই বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিবরণ শোনা, ঘটনার কার্য্য কারণ সম্মন্ধে বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান তথ্য জানা এই সবকিছুই। ফলে, আদালতে ঘটনাটা যে আঙ্গিকে পেশ করছে প্রত্যক্ষদর্শী, আদপে হয়তো জিনিসটার পরিপ্রেক্ষি ছিল অন্য কিছু। কিন্তু বয়ানে চোখে দেখা ঘটনার নিরপেক্ষ বাস্তবতার উপরে যোগ হতে থাকে নিজের এবং অন্যদের নানান মতামত, ব্যাখ্যা, আবেগ…পাল্টে যেতে থাকে পরিবেশনা, নিজের ধারণা অনুযায়ী বাদ পড়ে যায় অপছন্দের অংশ, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অস্বাভাবিক অবাস্তব ভাবে প্রকাশ পায় চাঞ্চল্যকর দৃশ্যটুকু। অবাক হওয়ার কিছুই নেই, এমন করে একটি গল্পকে বিভিন্ন চরিত্রের চোখ দিয়ে দেখার চল তো সাহিত্যে আমরা বরাবরই দেখেছি, তাই না?

স্মৃতি মানুষের একমাত্র অতিমানবিক ক্ষমতা, স্মৃতি দিয়েই আমরা বাঁচতে পারি কয়েক দশক জুড়ে, একইসাথে। আর এই স্মৃতিই মানুষের সবচেয়ে বড়, লজ্জাজনক দুর্বলতা। স্মৃতির দরজা ঠেলে যে বিশাল হলঘরে ঢুকতে পারি আমরা প্রত্যেকে, সেই ঘরের সজ্জা হয়তো মিলবে না মানুষটার বাইরের সাজপোশাক, রুচি অরুচি, সযত্ন যাপনের সাথে।

স্মৃতি এক রহস্য, যার ব্যাপ্তি সাহিত্য, শিল্প এবং মিথ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানেও। কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুব শিগগিরই হয়ে উঠতে চলেছে এই শতাব্দীর চালিকা শক্তি, স্মৃতির রহস্যের ঘূর্ণাবর্তে হেঁটে মরা বিজ্ঞানীরা সেদিকেও হাত বাড়াতে শুরু করেছেন বৈকি। 

মানুষের মস্তিষ্কের আশ্চর্য কর্মক্ষমতা আমরা জানি, কিন্তু তার কার্য কারণ আর ভিতরের মালমশলা বোঝার দিকে আমরা এখনও বলতে গেলে পঞ্চদশ শতকের স্প্যানিশ কনকুইস্টাডরদের মত, গহীন জঙ্গলে ঘুরপাক খাচ্ছি এল ডোরাডোর সন্ধানে। সেই মানচিত্রে রোজই যুক্ত হচ্ছে নতুন পথ নির্দেশ, যারা বলছে আর দেরি নেই, আমরা এসে পড়েছি গন্তব্যের ভীষণ কাছাকাছি। কিন্তু তবু, চূড়ান্ত রহস্যভেদ এখনও অনেক সূর্যাস্ত দূরে।

" শুধু এলোমেলো কীসব যেন লিখি /

আর ভান করি ভুলে গেছি, সেই তোমায়.."

(অক্ষম, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী )

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb