সূচিতে ফিরুন

জল হল যৌগ ও এক লাজুক বিজ্ঞানীর কথা

লেখক - ইন্দ্রনীল মজুমদার
img

একটা সময়ে বলা যায় প্রায় আড়াইশো বছর আগে ইউরোপীয় বিজ্ঞানে 'ফ্লোজিষ্টন তত্ত্ব' বেশ চালু ছিল। তা, সেই তত্ত্ব কি বলে? ফ্লোজিষ্টন তত্ত্বের মতে, সকল দাহ্য বস্তুর মধ্যেই 'ফ্লোজিষ্টন' নামে একটি দাহ্য পদার্থ থাকে। যতক্ষণ ফ্লোজিষ্টন থাকে ততক্ষণ বস্তুটির দহন হয় এবং তা নিঃশেষ হয়ে গেলে বস্তুর দহনও বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো আরও কিছু বছর ধরে মানুষ এই তত্ত্বে বিশ্বাস করত যদি না একজন এর রহস্য উদঘাটন না করতেন। প্রায় সবাই যখন উক্ত তত্ত্বে বিশ্বাস রাখত তখন এক ইংরেজ যুবক এগিয়ে এলেন এই ফ্লোজিষ্টনকে আলাদা করার এবং তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করার কাজে।

সেই ফ্লোজিষ্টনের রহস্য উদঘাটন করার জন্য তিনি শুরু করলেন নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষার সময় টিন, দস্তা এবং লোহা ইত্যাদি ধাতুর ওপর লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড ঢেলে একটি বর্ণহীন গ্যাস উৎপন্ন হয়। সেই যুবক বিজ্ঞানী এটাও দেখেন যে, গ্যাসটি বায়ুর চেয়ে হালকা এবং বায়ুতে দহন করলে সেটি এক নীলাভ শিখায় জ্বলে। বিজ্ঞানী ভাবলেন যে, এই বুঝি সেই কাঙ্খিত 'ফ্লোজিষ্টন গ্যাস'। যেই ভাবা ওমনি কাজ! ১৭৬৬ সালে তিনি তাঁর এই গবেষণার ফল জানান ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটিকে। কিন্তু, যে গ্যাসটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পরে তা জানা গেল সেটি 'ফ্লোজিষ্টন' নয়, তার নাম 'হাইড্রোজেন'। প্রকৃতিতে থাকা আবিষ্কৃত এই নতুন গ্যাসটির নানান আশ্চর্য ও মজাদার কিছু ধর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। আর সেইসব ধর্মের কথা জানতে পেরে এই গ্যাস নিয়ে অনেক জাদুকর নানান জাদু প্রদর্শনী করতে লাগলেন। কখনো কাগজের ব্যাগে এই গ্যাসটি পুরে ছেড়ে দিয়ে তারা দেখালেন যে ব্যাগটি আকাশে উঠে যাচ্ছে। আবার কখনো বায়ুর উপস্থিতিতে এই গ্যাসটি আগুনের শিখার সংস্পর্শে নিয়ে গিয়ে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁরা দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিলেন। এভাবেই, তাঁরা এই হাইড্রোজেন গ্যাসটিকে নিয়ে জাদু দেখিয়ে কিছু পয়সা রোজগার করতে লেগেছিলেন।

এদিকে গ্যাসের আবিষ্কারক বিজ্ঞানীবাবু বেশ অবাক হলেন তাঁর আবিষ্কৃত গ্যাসের এইসব মজাদার ধর্ম লক্ষ্য করে। তিনি আরও অবাক হলেন যখন দেখলেন যে, হাইড্রোজেন গ্যাসকে দহন করলে একটি স্বচ্ছ তরল পদার্থ উৎপন্ন‌ হয়। কি সেই স্বচ্ছ তরল পদার্থটি? তা জানার জন্য তিনি উক্ত গ্যাসটির সাথে মেশালেন অক্সিজেন গ্যাসকে। আর এই মিশ্রণটিকে একটি কাচের গোলকে পুরে বিদ্যুৎ-স্ফলিঙ্গের সাহায্যছ বিস্ফোরণ ঘটালেন। এরপর ঘটল এক অবাক কাণ্ড। ঐ কাচ-গোলকের ভেতরের গায়ে দেখা দিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বচ্ছ তরল কণা! সেই বিজ্ঞানী মহাশয় আউন্স খানেক সেই তরল পদার্থ উৎপন্ন‌ করে সংগ্রহ করলেন। এরপর চলল সেই স্বচ্ছ তরল পদার্থ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি ঐ তরলের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারলেন যে, ঐ তরল শুধু স্বচ্ছই নয় তা বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীনও বটে। সেই তরলকে বাষ্পীভূত করলে সেটি পুরোটাই বাষ্পীভূত হয়ে যায় কোনও তলানি আর পড়ে থাকে না। আরেকটা মজার বিষয় হলো, নির্দিষ্ট আয়তনের জল আর সেই তরলের ওজন মাপলে দেখা যাবে যে দুটো একই। তাহলে, সেই তরল কি জল? অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানী মহাশয় এই সিদ্ধান্ত পৌঁছলেন যে, ঐ স্বচ্ছ তরল পদার্থ হল জল। আর এরফলে, তিনি কুঠারাঘাত করলেন রসায়ন তথা বিজ্ঞান জগতের এক প্রথাগত ধারণাকে। তখনকার দিনে মনে করা হত যে, জল (Water) একটি মৌল বা মৌলিক পদার্থ (element অর্থাৎ যে পদার্থ একই রকম পরমাণু দ্বারা গঠিত)। কিন্তু, তিনি প্রথম প্রমাণ করলেন যে জল একটি যৌগ বা যৌগিক পদার্থ (compound অর্থাৎ যে পদার্থ দুইরকম বা তার বেশি পরমাণু দ্বারা গঠিত) যা হাইড্রোজেন ( Hydrogen) ও অক্সিজেন (Oxygen) নিয়ে তৈরি। তিনি এও জানালেন যে, দুই আয়তন হাইড্রোজেন ও এক আয়তন অক্সিজেনকে নিয়ে তা মিশিয়ে তাতে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটালে জল উৎপাদিত হয়। হাইড্রোজেন গ্যাস আবিষ্কারের পরে জল যে যৌগিক পদার্থ তা আবিষ্কার করা তাঁর এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। তিনি নাইট্রিক অ্যাসিড ও আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। তবে, তিনি কে? আসলে, আমরা যাঁকে নিয়ে আলোচনা করছি সেই যুবক বিজ্ঞানী মহাশয় হলেন হেনরী ক্যাভেণ্ডিশ।

এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল ১৭৩১ সালের ইংল্যান্ডের এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁর যখন মাত্র দুই বছর বয়স তখন তাঁর মা মারা যান। ছোটবেলায় হেনরী ভর্তি হন একটি বোর্ডিং স্কুলে। সেখান থেকে লেখাপড়া সেরে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যান কেম্ব্রিজে। লেখাপড়ায় তিনি অত্যন্ত ভালো ছিলেন। বিজ্ঞানে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ ও ভালোবাসা। তাঁর এই বিজ্ঞানের আগ্রহ বাড়াতে তাঁর বাবা লর্ড চার্লস ক্যাভেণ্ডিশ তাঁকে প্রায়ই নিয়ে যেতেন লন্ডনের প্রসিদ্ধ রয়্যাল সোসাইটিতে। সেখানে নানান মজাদার বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা দেখার ফলে তাঁর মনে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলো এক গভীর দাগ কাটত ও তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আরও উৎসাহবোধ করতেন। বিজ্ঞানের প্রতি হেনরীর কিশোর হেনরীর প্রবল উৎসাহ ও ভালোলাগা দেখে তাঁর বাবা বাড়িতেই এক ছোটখাটো পরীক্ষগার বা ল্যাবরেটরি তৈরি করে দিয়েছিলেন যেখানে আপন মনে বালক হেনরী চালাতেন বিজ্ঞানের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তা, কেম্ব্রিজ ছেড়ে প্যারিসে যান লেখাপড়খর জন্য। প্যারিস থেকে অবশেষে তিনি ফিরে আসেন তাঁর দেশ ইংল্যান্ডে।

তবে, তাঁর এক মানসিক অক্ষমতা ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির— কারুর সাথে তেমন মিশতে পারতেন না। তিনি কিরকম লাজুক প্রকৃতির ছিলেন তার কিছু নিদর্শন দেওয়া যাক।

বাড়ির রাঁধুনি-চাকরের সম্মুখীন হতেও সঙ্কোচ বোধ করতেন তিনি। রোজ সকালে সেদিন কি কি খেতে চান তা একটি কাগজে লিখে রাখতেন। তারপর সেই লেখা কাগজটি তিনি সবার অলক্ষ্যে রাঁধুনি-চাকরদের ঘরে ফেলে দিয়ে আসতেন। তারা তা দেখে সময়মতো খাবার রেখে দিয়ে আসত খাবার টেবিলে। তিনি ধনী ছিলেন বলে তাঁর বাড়ি ছিল হাল ফ্যাশানের। তা সেই বাড়ির সামনের সদর দরজা বা সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত নয় বরং তার পেছন দিকে থাকা একটি সিঁড়ি বেয়েই লাজুক প্রকৃতির বিজ্ঞানী হেনরী ওঠানামা করতেন৷

একটি ঘটনা হল। তখন লন্ডন শহরে সবে সন্ধ্যা নেমেছে। বাড়ির পেছনের দরজা হঠাৎ খুলে দেখা গেল দরজায় একটি ছায়ার মতো মূর্তি দাঁড়িয়ে। তিনি পড়ে আছেন সেকেলে পোশাক। ইনি বিজ্ঞানী হেনরী ক্যাভেণ্ডিশ। তা তিনি রাস্তার এদিক-ওদিক বেশ ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে নিলেন কাছেপিঠে কেউ কোথাও আছে কি না। যখন দেখলেন যে, কেউ কোথাও নেই তখনি তিনি বেড়িয়ে পড়লেন। তাঁর বেড়নোর উদ্দেশ্য ছিল সারাদিন কাজকর্মের পর নিরিবিলি স্থানে একটু সান্ধ্য-ভ্রমণ করা। একটু এগোতেই রাস্তার বাঁকের কাছে চলে এলো একটি গাড়ি। সেই গাড়ির মধ্যে ছিলেন দুইজন ভদ্রমহিলা। রাস্তার ধারে গ্যাসের আবছা আলোয় তাঁরা চিনতে পারলেন বিজ্ঞানী ক্যাভেণ্ডিশকে। তাঁরা তাঁকে সম্বোধনও করলেন।

হেনরী ক্যাভেণ্ডিশ তো ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত রসায়নবিদ। তিনি তো কোনও অপরাধী বা গুপ্তচর ছিলেন না। তাহলে, সন্ধ্যায় ঐভাবে চুপিচুপি বেরোতেন কেন তিনি? ধনী বা পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অহঙ্কারের জন্যে নয়। আসলে, এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের আর তাই মানুষের সাথে মিশতে পারতেন না। এই একটি ছিল তাঁর দোষ বা বলা ভালো তাঁর মানসিক অক্ষমতা। মানুষের সাথে মেলামেশা করতে তাঁর সঙ্কোচ বোধ হতো। মহিলাদের তো বটেই এমনকি লোকজনের সান্নিধ্যে তিনি তেমন আসতে চাইতেন না।

এই মানী ও ধনী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ১৮১০ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ নিয়ে তাঁর নামেই গড়ে ওঠে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের এমনকি বিশ্বের বিখ্যাত 'ক্যাভেণ্ডিশ ল্যাবরেটরি'। যেখানে সারা বিশ্ব থেকে কৃতী বিজ্ঞানীরা গিয়ে অজানাকে জানার কাজটি অর্থাৎ বিজ্ঞানের অন্বেষণ করে চলেছেন।

(এই নিবন্ধের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)