বসে আছি পথ চেয়ে

লেখক - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

                                                 

কালো রাতের পর্দা চিরে মানবসভ্যতার লেশহীন গ্রহটির আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল আগুনে আলো। কৃত্রিম আলোয় সেজে ওঠা মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে নেমে আসছে পাথুরে মাটির বুকে। এই গ্রহ যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল দীর্ঘকাল। বড় দীর্ঘ সেই প্রতীক্ষা। অবশেষে তার অবসান হল আজ। ওরা কি ফিরে এসেছে তবে? সেই যারা চলে গেছিল একদিন? ওরা কি সেই দুপেয়ে মানুষেরই উত্তরসূরি? রকেটের ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে। জ্বালানি নির্গমন থেমে যাচ্ছে এবার। ভারী ধাতব বস্তুটা মাটির সংস্পর্শে এসে মৃদু কেঁপে উঠে স্থির হল।

‘ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী, আমরা এত গ্রহে অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু সত্যি বলছি, এখানকার মত এত বিচিত্র জীবজগৎ আর এত বন্য প্রাণপ্রাচুর্য আর কোথাও দেখেছি বলে তো মনে করতে পারছি না! আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়েও বেশি, তাই কৌতূহল হচ্ছে এ বিষয়ে আপনার অভিমতটা জানতে।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ ইশান, এ ব্যাপারে আমিও একমত। তবে আমি তো মূলত পদার্থবিজ্ঞানী, আর তুমি একজন জীববিদ্যা বিশারদ। তুমি আরও ভাল বলতে পারবে এই গ্রহের বাসিন্দাদের বিষয়ে।’

একটু থেমে আবার বললেন, ‘ভাবতেও অবাক লাগে, তাই না? এই পৃথিবী ছিল আমাদেরই পূর্বপুরুষদের একমাত্র আবাসস্থল। প্রায় দু’লক্ষ বছর আগে যখন তাঁদেরই কৃতকর্মের দায়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গোটা জীবজগৎটাই মৃত্যুর সম্মুখীন হল, তখন তাঁদের মধ্যে যাঁরা সমাজের একটু উঁচু সারিতে ছিলেন, তাঁরা পাড়ি দিলেন অন্যত্র, গ্রহান্তরে। উপনিবেশ বানালেন সৌরজগৎ ছাড়িয়ে একাধিক উপযোগী পরিবেশে, তাঁদেরই একদলের উত্তরসূরি এই আমরা।’

‘হ্যাঁ, ততদিনে এখানে শুরু হয়ে গেছে পরিব্যাপ্তির ভয়ঙ্কর খেলা। টিকে থাকার লড়াইয়ে মিউটেশনের ফলে জন্ম নিচ্ছে একের পর এক অদ্ভুত জীব। তাদের কেউ ভয়ানক অণুজীব, কেউ আবার হিংস্র দানবসম। মানবসভ্যতা পুরোপুরি লোপ পাওয়ার পর প্রকৃতি বোধহয় আরও হাত  খুলে খেলেছিল। তারই ফলাফল আজ আমাদের চোখের সামনে!’

‘ঠিক। এখন আমাদের দ্রুত দেখে নিতে হবে, স্বাভাবিক বিবর্তনের প্রক্রিয়া এত বছরে এখানে ঠিক কতদূর অগ্রসর হয়েছে। মানুষের সমতুল্য না হোক, কোনও উন্নত প্রাণির দেখা এখানে মেলে কিনা লক্ষ্যণীয়। তবে চারপাশে যা সব নমুনা দেখছি, তাতে সে আশা খুবই ক্ষীণ মনে হচ্ছে। সেইসঙ্গে এতদিন পর এই গ্রহ আবার মানব উপনিবেশ স্থাপনের পক্ষে উপযুক্ত হয়েছে কিনা সেটাও দেখা জরুরি।’

‘প্রথম প্রশ্নটা নিয়ে আমিও আপনার মতই সন্দিহান ক্যাপ্টেন। তবে দ্বিতীয়টার ব্যাপারে আমার মন বলছে, একটু গড়েপিটে নিলে এ জায়গা আমাদের উত্তরসূরিদের সেরা ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে আবার।’

                ‘সেটা হলেই ভাল, ইশান। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে, প্রাকৃতিক আর খনিজ সম্পদের জোগান দেওয়ার জন্য আমাদের আরও উপনিবেশ শিগগির দরকার।’

ইশান, ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী সহ বাকি বিজ্ঞানী এবং সহকারীরা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন জৈব নমুনা সংগ্রহ, ছবি তোলা এবং অন্যান্য নানা পরিমাপে। রাতে নিজেদের যানে ফিরেই তাঁরা বিশ্রাম নেন। তিন দিনে তেমন বুদ্ধিমান কোনও প্রাণির দেখা অবশ্য তাঁরা পেলেন না। বা তেমন কেউ থাকলে তার কার্যকলাপের কোনও চিহ্নও তাঁদের নজরে এল না।   

তবে তাঁদের নভোযানটি যেখানে নেমেছিল তার খুব কাছেই এমন একজন ছিল, যে তাঁদের খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল রোজ। সে এই গ্রহের প্রাচীন একজন বাসিন্দা । সবকিছুই দেখেছে, জেনেছে, বুঝেছে। ধরে নিই তার নাম ‘সাক্ষী’। বিবর্তনের পথ ধরে এক চমকপ্রদ ক্ষমতা অর্জন করেছে সাক্ষী। সেটা কী, এই পৃথিবীর মানুষেরা তা জানে না।

‘আপাতভাবে মনে হচ্ছিল এই গ্রহ এখনও তৃণভোজীদেরই চারণভূমি। কিন্তু এখানে মাংসাশী প্রাণিও আছে মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন। দেখুন ওইদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে গাছগুলোর নিচে কত হাড়গোড়ের স্তূপ!’

‘তাই দেখছি। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। তবে আমাদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আমাদের আশেপাশে তেমন কোনও সন্দেহজনক প্রাণির নড়াচড়া হলেই তা ধরা পড়বে।’

সাক্ষী এ কথা শুনে মনে মনে হাসল।

‘ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী, আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? এদিকের জঙ্গলের গাছগুলো কেমন অদ্ভুত রঙের। উজ্জ্বল সবুজ রঙ অমিল। ফুল ফলও তেমন দেখছি না। কোনও বিকিরণ-টিকিরণ কিছু…?’

‘না ইশান, জিম এম কাউন্টার বা অন্যান্য কোনও যন্ত্রেই তেমন কিছু বিকিরণের প্রভাব দেখতে পাইনি এখনও। ফল-ফুল কেন দেখতে পাচ্ছি না, সেটা একটু আশ্চর্যের তো বটেই!’

একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ‘যাই বলো, এই কদিনে এখানকার জল-হাওয়া-মাটি আর প্রধান উদ্ভিদ আর প্রাণিদের সম্বন্ধে যেটুকু যা তথ্য জোগাড় করা গেছে, তাতে অচিরেই এখানে আমাদের মানুষদের ঘরবাড়ি গড়ে তুলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

ইশান সে বিষয়ে একমত হল। তারপর কয়েকদিন কাটল চূড়ান্ত ব্যস্ততায়। ছোটখাটো কিছু মাংসাশী প্রাণির সন্ধানও পাওয়া গেল-- জলে, ডাঙ্গায়, আকাশে। লেজারগান সহ নানা আধুনিক অস্ত্রে তাদের সহজেই খতম করা গেল যথাসম্ভব। তা ছাড়া রুটিনমাফিক সব পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ করা হল। এবার সবকিছু গুটিয়ে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়। আর সেটাও আবার নতুন ভাবে ফিরে আসার তাগিদেই। সাক্ষী সবকিছু দেখছিল মন দিয়ে। এবার সে নিজের কাজ শুরু করল।

ইশান আর ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী মহাকাশযানের সামনে একটা উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে সহকারীদের সব কাজ তদারক করছিলেন, চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলেন। ইশান হঠাৎ বলে উঠল, ‘ক্যাপ্টেন, কেন জানি না মনে হচ্ছে আমরা কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি। সব কাজই আপাত মসৃণভাবে চলছে, কিন্তু কী একটা অস্বস্তি হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। যেন এই গ্রহটা এখনও কিছু বলতে চায় আমাদের, এমন কিছু যা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

‘কী বলছ ইশান! বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমারও প্রায় একই কথা মনে হচ্ছিল আজ। তাহলে মনে হয় আমাদের অন্যভাবে একবার ভেবে দেখা উচিৎ।’

‘ক্যাপ্টেন, ভাবছিলাম আজ রাতটা যদি আমরা আমাদের যানের বাইরে এখানে এই খোলা জায়গায়, এই অরণ্যের কোলে তাঁবু খাটিয়ে কাটাই কেমন হয়? রাতে তো আমরা এই গ্রহকে কাছ থেকে দেখিনি খুব একটা। সেই অভিজ্ঞতাটা আমাদের নতুন কিছুর সন্ধান দিতেও পারে!’

‘গুড আইডিয়া ইশান! লেটস ডু ইট! আমি টিমের বাকিদের জানিয়ে সব বন্দোবস্ত করে ফেলছি।’

যা কথা সেই কাজ। সহকারীদের তৎপরতায় দরকারি সব যন্ত্রপাতি ও আত্মরক্ষার অস্ত্রশস্ত্র সমেত তাঁরা দুজন এবং আরও দুজন দুটি তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। মহাকাশযানে রয়ে গেলেন আরও দুজন।

রাত বাড়ল। তাঁবুর অধিবাসীরা সবাই অদ্ভুতভাবে প্রায় একইসঙ্গে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। চারদিকে অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। না! পুরোপুরি নিস্তব্ধ নয়। একটা অচেনা খসখস শব্দ ক্রমেই এগিয়ে আসছে তাঁবু দুটো লক্ষ করে। কীসের শব্দ ও?

এ হল সেই সাক্ষী, আর কেউ নয়, সে এক বিরাট গাছ। মানুষের চেনা পরিচিত গাছের চেয়ে একেবারেই আলাদা সে। বিবর্ণ চেহারায় সবুজের আভা বলে বিশেষ কিছু নেই, তার ধূসর কাণ্ডের উপর থেকে সন্তর্পণে নেমে আসছে সর্পিল শাখাপ্রশাখা। অক্টোপাসের মত শুঁড় যেন তাদের মাথায়। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে একে একে ভিতরে প্রবেশ করল তারা। তারপর নির্বিঘ্নে অচেতন দেহগুলোকে পেঁচিয়ে পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরল অমোঘ আলিঙ্গনে। ধীরে ধীরে চারটে মানব শরীর তাদের কব্জায় এসে গেল সম্পূর্ণরূপে। তারপর সেই দেহগুলোকে ধরে শুঁড়গুলো অথবা গাছের ডালগুলো আবার উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। বহুদিন পর এমন খাবারের স্বাদ পাবে সাক্ষী। আজকের পর আর হয়ত এই সুযোগ আসত না। তাই এই মানুষদের মনকে বশ করতে হয়েছিল তাকে বেশ কায়দা করে। তার তীক্ষ্ণ মগজ অন্য প্রাণির মস্তিষ্ককে দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মিউটেশনের ফলে এই অপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করেছে সে। এই ক্ষমতার বলেই বহু হতভাগ্য প্রাণি তার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে, যাদের হাড়গোড়ের স্তূপ দেখেও ইশান বা ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী কিছু বুঝতে পারেননি।

 যাই হোক, তার কাজ প্রায় হয়েই এসেছিল, এমন সময় মহাকাশযানে অপেক্ষারত দুজন বিজ্ঞানীর একজন কী কারণে যেন সেখান থেকে তাঁর রাতে দেখার জন্য ইনফ্রারেড চশমাটি পরে তাঁবুর দিকে চোখ রেখেছিলেন । যা দেখলেন প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। ঠাহর করা মাত্রই চিৎকার করে উঠলেন – ‘হেল্প! হেল্প! কী সাংঘাতিক। গাছটা জীবন্ত! গাছটা শিকারি! হায় কপাল। এক্ষুনি ওঁদের উদ্ধার করতে হবে!’

অন্যজনও ততক্ষণে ছুটে এসেছেন সেখানে। কালবিলম্ব না করে ওখান থেকেই লেজারের অত্যাধুনিক অস্ত্র তাক করলেন তাঁরা ওই গাছের মারণ শুঁড়গুলো লক্ষ করে। তীব্র আলোর ঝলকানিতে আর অস্ত্রের অভিঘাতে কেঁপে উঠল চারপাশ। শুঁড়গুলো এই অতর্কিত আঘাতে শিথিল হতেই চারজনের দেহ ধুপ ধুপ করে উপর থেকে মাটিতে পড়ল। এবং তাঁদের জ্ঞানও ফিরে এল তখনই।

ইশান, ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী সহ বাকিদের তখন চেঁচিয়ে ডাকছেন মহাকাশযানের দুজন বিজ্ঞানী। তাঁরা তখনও আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ নিশ্চিত শিকার হাতছাড়া হওয়ার আক্রোশে ফুঁসে ওঠা সেই গাছ, সাক্ষী তখন ফের ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে তার সচল ডালপালা মেলে দিচ্ছে যতটা পারে। কিন্তু মুক্তি পেয়ে ওই চারজন মানুষ তখন প্রাণপণে ছুটছেন নিজেদের যানের দিকে।

ছুটতে ছুটতেই ইশান বলল, ‘ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী, ইনিই তাহলে এই গ্রহের বুদ্ধিমান জীব!’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘বুদ্ধিমান! এই ফাঁদ পেতে শিকার ধরা খুনে গাছকে তুমি বুদ্ধিমান বলছ?’

‘শিকার ধরার জন্য ফাঁদ পাততেও কি বুদ্ধি লাগে না ক্যাপ্টেন? ভেবে দেখুন তো! তা ছাড়া আপনি এবং আমি দুজনেই যে আজ একই রকম ভাবনার বশবর্তী হয়ে বাইরে রাত কাটানোর পরিকল্পনা করলাম এটা কি নেহাত কাকতালীয়?’

‘মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘আর কিছুই না। আসলে ওই গাছটাই মনে হয় আমাদের মনকে নিজের বশে এনে ফেলেছিল, ওর ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা চালিত হয়েছি ওর ফাঁদের দিকে। এমন ‘বুদ্ধি’ বা ক্ষমতা যাই বলুন না কেন, মানুষের কিন্তু এখনও নেই ক্যাপ্টেন!’

রাত কেটে ভোর হয়ে আসছিল। অভিযাত্রীরা বিনা বাক্যব্যয়ে পৃথিবী ছেড়ে রওনা হয়ে গেলেন নিজেদের বর্তমান গ্রহের দিকে। এখানে উপনিবেশ স্থাপনের কথা এক্ষুনি আর ভাবছেন না তাঁরা কেউই।

                যান চলছিল আপন গতিতে। পৃথিবী ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল আকাশে। সেদিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা ইশান, গাছটা যদি এতই বুদ্ধিমান হবে, তাহলে আমাদের সঙ্গে ও কথা বলার বা কিছু জানানোর চেষ্টা করল না কেন প্রথমে? কেন আমাদের মেরে ফেলার জন্যই উঠেপড়ে লাগল?’

ইশান জবাব দিল, ‘আমার মনে হয় চেষ্টা করেছিল ক্যাপ্টেন। ও করুক, বা অন্য কেউ। অন্য কোনও গাছও সেই প্রয়াস করে থাকতেই পারে। আমরাই হয়ত সে ভাষা বোঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিমান নই। তাই সে সঙ্কেত আমরা ধরতে পারিনি।’

                                              

                

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb