পর্যায় সারণীর কিছু কথা

লেখক - তপন কুমার বিশ্বাস

পর্যায় সারণীর কিছু কথা

                       

রাসায়নিক মৌলিক পদার্থের পর্যায় সারণী, বিজ্ঞানের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার। কয়েক শতাব্দী জুড়ে প্রথমদিকে রসায়নবিজ্ঞানীদের গবেষণা, ও তারপর রসায়নবিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানী উভয়েরই, নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের ফসল আধুনিক পর্যায় সারণী। এখন মৌলিক পদার্থগুলি সম্পর্কে এক সুস্পষ্ট ধারণা, পর্যায় সারণী থেকেই পাওয়া যায়। যেকোনো মৌল সম্পর্কে তার ও, তাকে নিয়ে যৌগিক পদার্থের ধর্মের এক রূপরেখাও পাওয়া যায়। আধুনিক পর্যায় সারণী থেকে আমরা মৌলটির রাসায়নিক সঙ্কেত(সিম্বল),পারমাণবিক ভর (আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর – রিলেটিভ অ্যাটমিক ম্যাস) ও পারমানবিক সংখ্যা (অ্যাটমিক নাম্বার) ছাড়াও, বহুকিছু জানতে পারা যায় : ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মৌলটি কঠিন নাকি তরল নাকি গ্যাসীয়; তার ঘনত্ব, স্ফুটনাঙ্ক, গলনাঙ্ক, সমস্থানিক (আইসোটোপ), পারমাণবিক ব্যসার্দ্ধ, ইলেকট্রন কনফিগারেশন, ইলেকট্রনের প্রতি আসক্তি, যোজ্যতা(ভ্যালেন্সি), আয়োনাইজেশন এনার্জি, ইলেক্ট্রোনেগেটিভিটি ইত্যাদি।

পারমানবিক সংখ্যা হল, মৌলটির পরমাণুর কেন্দ্রীণে (নিউক্লিয়াস) যতগুলি প্রোটন আছে সেই সংখ্যা। প্রত্যেকটি পারমাণবিক সংখ্যা এক একটি পূর্ণ সংখ্যা; তার আর ভগ্নাংশ হয় না। ইলেকট্রনিক এককে পরমাণুর কেন্দ্রীণে ধণাত্মক আধাণ যত একক, এই পূর্ণসংখ্যা তার সমান। তাই পর্যায় সারণী থেকে পরমাণুর মোট ধনাত্মক আধান তথা প্রোটনের সংখ্যা, ও ঋণাত্মক আধানের পরিমাণ তথা কতগুলি ইলেকট্রন আছে, তাও জানা যায়। হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রীণে আছে একটিমাত্র প্রোটন, তাই হাইড্রোজেনের পারমাণবিক সংখ্যা  ১(এক)। এখনো পর্যন্ত ১১৮টি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার হয়েছে। ১১৮তম মৌল ওগানেসসন (Oganesson), পরমাণুতে আছে ১১৮টি প্রোটন। আধুনিক পর্যায় সারণী ১ থেকে শুরু করে ১১৮ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান  নিরবচ্ছিন্ন সংখ্যা, ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মৌলটি নিয়ে গঠিত। এক(১) থেকে ১১৮ পর্যন্ত পূর্ণসংখ্যার মধ্যে কোনো শূন্যস্থান নেই। এভাবে সাজালে, মৌলগুলির ধর্মের পর্যায়ক্রমে প্রায় পুনরাবৃত্তি হয়। একই স্তম্ভের (গ্রুপ তথা কলাম) মৌলদের রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য থাকে।

আধুনিক পর্যায় সারণীতে ১৮টি উল্লম্ব গ্রুপ ও ৭টি অনুভূমিক পিরিয়ড আছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম পিরিয়ডে যেহেতু অনেক বেশি সংখ্যায় মৌল রয়েছে, তাই এদুটি পিরিয়ড থেকে ১৫টি করে মৌল আলাদা করে নিয়ে, দুটি আলাদা উপ-পিরিয়ড মূল পর্যায়সারণীর সপ্তম পিরিয়ডের নীচে, পর পর দুটি অনুভূমিক সারিতে বসানো হয়েছে : ল্যান্থানাইডস ও অ্যাক্টিনাইডস। ল্যান্থানাম(৫৬) থেকে লুটেটিয়াম(৭১) পর্যন্ত ল্যান্থানাইডস; অ্যাক্টিনিয়াম(৮৯) থেকে লরেন্সিয়াম(১০৩) পর্যন্ত অ্যাক্টিনাইডস।   অনুভূমিক পিরিয়ডের মৌলগুলির মধ্যে ভৌত ধর্মের সাদৃশ্য থাকে।

 

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রসায়নবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের শ্রেণীবিভাগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি রসায়নবিজ্ঞানী আন্তন ল্যাভয়সিঁয়ের, তখনকার দিনে জানা ৩০টি মৌলকে রাসায়নিক ধর্মের ভিত্তিতে  গ্যাস, ধাতু, অধাতু ও মৃত্তিকা এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। (পরবর্তীকালে বোঝা যায় ৩০টির সবগুলি মৌলিক পদার্থ ছিল না।) ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিজ্ঞানী জন ডালটন, হাইড্রোজেনের ওজনকে ১(এক)  ধরে, হাইড্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে যৌগ গঠন করে এমন মৌলদের আপেক্ষিক ওজন নির্ণয় করেছিলেন। পরীক্ষা করে তিনি দেখেছিলেন, এক(১) ভাগ ওজন হাইড্রোজেনের সঙ্গে ৮ ভাগ ওজন অক্সিজেন যুক্ত হয়ে জল উৎপাদন করে। এর থেকে তিনি হাইড্রোজেনের সাপেক্ষে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করেছিলেন ৮। ডালটন বলেছিলেন, সমস্ত পদার্থ অ্যাটম (অণু) দিয়ে তৈরি। অণু অবিনশ্বর, অবিভাজ্য।

পদ্ধতি হিসাবে সুদূরপ্রসারী হলেও,  ডালটন একটা বড়ো ভুল করেছিলেন।  তিনি জানতেন না, অক্সিজেনের অণু দুটি অক্সিজেন পরমাণু নিয়ে ও, হাইড্রোজেন অণু দুটি  হাইড্রোজেন পরমাণু নিয়ে গঠিত। স্বভাবতই, তিনি জলের রাসায়নিক সঙ্কেতকে HO বলে স্থির করেন। (আজকে আমরা জানি জলের রাসায়নিক সংকেত H2O) এর থেকেই তিনি অক্সিজেনের আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজনকে ৮ ধরেছিলেন। তাঁর এই ভুল সেযুগের পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে  ভারতীয় দার্শনিক কণাদ, গ্রীক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস থেকে শুরু করে তাঁর সমকাল পর্যন্ত  মনে করা হত, পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে সর্বশেষ ক্ষুদ্রতম অংশ যা পাওয়া যায় তা হল অণু ; তারপরে আর ভাঙ্গা যায় না। অণু অবিভাজ্য।

বিস্তর পরীক্ষার পর, ১৮০৮ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী গে- লুসাক (জোসেফ লুইস গে-লুসাক) বললেন, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপে দুটি গ্যাসের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যদি  অপর কোনো গ্যাসীয় পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহলে বিক্রিয়ায় অংশ নেওয়া দুটি গ্যাসের এবং উৎপন্ন গ্যাসের আয়তন, সর্বদাই পূর্ণসংখ্যার সরল অনুপাতে থাকবে। দুই আয়তন  গ্যাসীয় হাইড্রোজেন সর্বদাই এক আয়তন গ্যাসীয় অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, দুই আয়তন  জলীয় বাষ্প তৈরি করবে। গে-লুসাকের বক্তব্য অনুযায়ী  আয়তনের অনুপাতে বিক্রিয়া ঘটে,  অপরদিকে ডালটনের মতে আণবিক (অ্যাটমিক) ওজনের অনুপাতে বিক্রিয়া হয়। দুটিই আপাত পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা। পরীক্ষালব্ধ তথ্য হলেও,  গে-লুসাকের ব্যাখ্যা মানলেন না ডালটন । ১৮১১ সালে অ্যাভোগাড্রো (লোরেঞ্জো রোমারিও আমাদিও কার্লো অ্যাভোগাড্রো) প্রস্তাব (হাইপোথিসিস) করলেন, একই তাপমাত্রা ও চাপে সমান আয়তনের সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থের ভিতর সমান সংখ্যক মলিকুল (অণু) উপস্থিত  থাকে এই প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে গে-লুসাকের সূত্রের ব্যাখ্যা পাওয়া গেল : হাইড্রোজেনের দুই আয়তন মলিকুলের (অ্যাটম নয়) সঙ্গে এক আয়তন অক্সিজেন মলিকুলের বিক্রিয়ায় দুই আয়তন জলীয় বাষ্পের মলিকুল উৎপন্ন হয়। এখান থেকে প্রথম পাওয়া গেল অণু ও পরমাণু। দুটি অক্সিজেন পরমাণু নিয়ে একটি অক্সিজেন অণু ও, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে একটি হাইড্রোজেন  অণু গঠিত।  অণু (মলিকুল) অবিভাজ্য রইলো না, এক বা একাধিক পরমাণু (অ্যাটম) নিয়ে অণু গঠিত।  কিন্তু অ্যাভোগ্যাড্রোর এই যুগান্তকারী  সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত রয়ে গেল আরো প্রায় ৫০ বছর। অ্যাভোগ্যাড্রোর মৃত্যুর  চার বছর পর এর নিষ্পত্তি হল। ১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মাণীর কার্লসরুহে, ইউরোপের সমস্ত রসায়নবিজ্ঞানীরা এক সম্মেলনে অণু পরমাণু আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজন নির্ণয়,  ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের মীমাংসা করতে বসলেন। ইতালীয় বিজ্ঞানী স্তানিস্লাও ক্যান্নিজারো, তাঁর নিজের পরীক্ষালব্ধ বহু তথ্য সহযোগে অ্যাভোগাড্রোর প্রস্তাবের সপক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন। বহু মৌলের নির্ভুল পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করেছিলেন ক্যান্নিজ্জারো, সেগুলিও পেশ করলেন। এরপরই বহু রসায়নবিজ্ঞানী পর্যায়সারণী তৈরির কাজে এগিয়ে আসেন।

ইতিমধ্যে ১৮১৭ সালে জার্মাণ বিজ্ঞানী জোহান ডোবেরেইনার (জোহান ভোলফগ্যাং ডোবেরেইনার) দেখান, কিছু মৌল-ত্রয়ী রয়েছে যাদের মাঝেরটির পারমানবিক ওজন, অন্যদুটি মৌলের পারমাণবিক ওজনের মাঝামাঝি ; এদের রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এটি ত্রয়ীর সূত্র (ল অব ট্রায়াড) নামে পরিচিত। যেমন :  স্ট্রনসিয়াম মৌলের পারমাণবিক ওজন ক্যালসিয়াম ও বেরিয়াম মৌলদুটির পারমাণবিক ওজনের মাঝামাঝি। এরকম আরো মৌলত্রয়ী পাওয়া গেল : ক্লোরিণ ব্রোমিন  আয়োডিন ; লিথিয়াম  সোডিয়াম পটাশিয়াম। আবার ফ্লুরিন মৌলটিকে বসাতে হল ক্লোরিনের আগে। পাওয়া গেল অক্সিজেন সালফার সেলেনিয়াম টেলুরিয়াম এরকম মৌল; নাইট্রোজেন ফসফরাস আর্সেনিক অ্যান্টিমনি বিসমাথ এরকম। স্বভাতই মৌলগুলিকে একটি নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলা গেল না।

১৮৬০ সালে কার্লসরুহে সম্মেলনের পর, আপেক্ষিক  পারমাণবিক ওজন নির্ণয় ও পর্যায়সারণী সম্পর্কে গবেষণা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। ১৮৬২ সালে ফরাসী ভূতত্ত্ববিদ দ্য-চ্যানকোর্তয়েস (আলেক্সান্দর-এমিল বোগুয়ের দ্য-চ্যানকোর্তয়েস), তখনো পর্যন্ত জানা মৌলদের সম্পর্কে ক্যানিজ্জারোর নির্ণয় করা আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজনগুলিকে একটি চোঙের (সিলিন্ডার) বাইরের দিকে এমন ভাবে বসালেন যেন,  যেসব মৌলের রাসায়নিক ধর্মের মিল রয়েছে, তারা চোঙের গায়ে লম্বরেখা বরাবর একটির  উপরে  বা নীচে পর পর বসে যায়। তাঁর এই ত্রিমাত্রিক সজ্জা ' টেলুরিক স্ক্রু ' নামে পরিচিত। এভাবে লিথিয়াম বসল সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের সঙ্গে একই রেখা তথা একই স্তম্ভ বরাবর; ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালসিয়াম ; বোরণ ও অ্যালুমিনিয়াম ; কার্বণ ও বিসমাথ; ফ্লুয়োরিন ও ক্লোরিন চোঙের গায়ে একই স্তম্ভের উপর বসল। কিন্তু ব্রোমিনের সঙ্গে ক্লোরিণ ও ফ্লুয়োরিণের ধর্মের সাদৃশ্য থাকলেও ব্রোমিন এদের সঙ্গে একই লম্বরেখা বরাবর না এসে, এল কপার ও ফসফরাস বরাবর। ফ্রান্সের অ্যাকাডেমি দ্য সায়েন্সেস এর বিখ্যাত কম্পটেস রেনডুস জার্ণালে এটি প্রকাশিত হয় (কিছুটা অসম্পূর্ণভাবে)। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত এভাবে সব মৌলদের নিয়ে রাসায়নিক পর্যায় সারণী তৈরির  কাজ, বেশীদূর এগোতে  পারলো না। তাহলেও দ্য-চ্যানকোর্তয়েসের টেলুরিক স্ক্রুকে প্রথম পর্যায় সারণী বলা যেতে পারে। পূর্ণ সংখ্যার সঙ্গে মৌলিক পদার্থের ধর্মের অঙ্গাঙ্গী যোগসূত্র রয়েছে, পূর্ণসংখ্যা দিয়ে এক একটি মৌলিক পদার্থকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দ্য-চ্যানকোর্তয়েসের পর্যায় সারণী থেকে বুঝতে পারা যায়। এক অর্থে তিনি আধুনিক পারমাণবিক সংখ্যার অগ্রদূত।

ব্রিটিশ রসায়নবিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ডস (জন আলেক্সান্দার রেইনা নিউল্যান্ডস) মৌলগুলিকে এক(১) থেকে শুরু করে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ওজন অনুযায়ী সাজাতে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন, দুটি মৌলের মধ্যে যদি পারমাণবিক ওজনের পার্থক্য সাত (৭) হয়, তাহলে তাদের ধর্মের সাদৃশ্য থাকে। সঙ্গীতে মজে থাকা নিউল্যান্ডস তথনকার জানা ৬২টি মৌলকে ৭টি স্তম্ভে ও ৮টি অনুভূমিক সারিতে সাজালেন ও এভাবে সাজানো প্রতিটি মৌলকে একটি পূর্ণসংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করলেন ; প্রথম সারিতে রইল হাইড্রোজেন (১), লিথিয়াম(৩), বেরিলিয়াম(৪), বোরণ(৫), কার্বন(৬), নাইট্রোজেন(৭), অক্সিজেন(৮) [নিউল্যন্ডসের প্রথম সারণী অবশ্য একটু ভিন্নরকম ছিল]। এভাবে ৫৬টি ঘরে পরপর এক একটি মৌল রইলো, কিন্তু পর পর দুটি ঘরের মধ্যে কোনো শূন্যস্থান রইলো না। ৬২টি মৌলকে জায়গা দেবার জন্য ৬টি ঘরে একটির জায়গায় স্থান দিলেন দুটি মৌলকে। নিউল্যান্ডস এর নাম দিলেন, 'ল অব অকটেভস'। ১৮৬৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। ভবিষ্যতে নতুন মৌল আবিষ্কার হলে, তার জন্য কোনো ঘর রইলো না নিউল্যান্ডসের এই পর্যায় সারণীতে।

জার্মান রসায়নবিজ্ঞানী জুলিয়াস লোথার মেয়ার ১৮৬৪ সালে ২৮টি মৌলিক পদার্থকে নিয়ে, তাঁর প্রথম পর্যায় সারণী প্রকাশ করেন। এগুলি তিনি মৌলদের রাসায়নিক যোজ্যতা অনুযায়ী এক একটি উল্লম্ব স্তম্ভে রেখে ৯টি স্তম্ভে সাজিয়েছিলেন। ১৮৬৮ সালে তিনি ৫০টি মৌলকে অন্তর্ভুক্ত করে, অজানা মৌলদের জন্য শূন্যস্থান রেখে  দ্বিতীয় আর একটি সারণী মৌলদের পারমাণবিক ওজন ও যোজ্যতা অনুযায়ী প্রস্তুত করেন। কিন্তু তা ১৮৭০ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি। অনেক বিষয়ে তাঁর সারণীর সঙ্গে সমকালীন মেন্ডেলিয়েভের সারণীর মিল ছিল। তিনি সঠিকভাবে মার্কারিকে ক্যাডমিয়াম টিন ও লেডের সঙ্গে, থ্যালিয়ামকে বোরণের সঙ্গে সারণীতে স্থান দিয়েছিলেন। আয়োডিনের পারমাণবিক ওজন ১২৬.৯, টেলুরিয়ামের ১২৭.৬; রাসায়নিকভাবে আয়োডিনের ধর্ম ক্লোরিন ও ব্রোমিনের কাছাকাছি,  টেলুরিয়ামের ক্ষেত্রে সেলেনিয়াম ও সালফারের সমতুল। পারমাণবিক ওজন অনুযায়ী টেলুরিয়ারের আগে আসার কথা আয়োডিনের। কিন্তু রাসায়নিক ধর্মকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে, তিনি টেলুরিয়ামকে আয়োডিনের আগে স্থান দিয়েছিলেন।

রুশ রসায়নবিজ্ঞানী ডিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিয়েভকে পর্যায়সারণীর জনক বলা হয়ে থাকে। তাঁর পর্যায়সারণীর উপর ভিত্তি করে, পরবর্তীকালের পর্যায়সারণী গড়ে উঠেছে। ১৮৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মৌলগুলিকে রাসায়নিক ও, ভৌত ধর্ম অনুযায়ী  শৃঙ্খলাবদ্ধ করার প্রচেষ্টার ফসল হিসাবে, মেন্ডেলিয়েভ তাঁর প্রথম পর্যায় সারণী প্রকাশ করেন। সমস্ত মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মকে এক একটি  কার্ডে লিখে, বারবার সেগুলিকে সাজাতে সাজাতে, তাঁর চোখে উদ্ভাসিত হয় যে, ক্রমবর্ধমান আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজন অনুযায়ী মৌলগুলিকে সাজালে, সেগুলি শৃঙ্খলাবদ্ধ  একটি সারণী আকারে প্রকাশ করা যায়।  এরপর তথনকার জানা সমস্ত মৌলগুলিকে নিয়,  তিনি ১৮৭১ সালে তাঁর পরিমার্জিত দ্বিতীয় পর্যায় সারণী প্রকাশ করেন। এতে ছিল ১৭ টি গ্রুপ (উল্লম্ব স্তম্ভ)। শুধু তাই নয়, এতে তিনি পারমাণবিক ভর অনুযায়ী সাজানো ১৭টি মৌলকে, পর্যায়সারণীতে  তাদের ঘর থেকে সরিয়ে, রাসায়নিক ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ১৭টিকে নতুন ও সঠিক স্থানে বসান।

মেন্ডেলিয়েভ তাঁর পর্যায়সারণীতে তখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত মৌলদের জন্য, পাঁচটি  ঘর ফাঁকা রেখে দিয়েছিলেন। যেমন, বোরণের আগের মৌলকে “একা-বোরণ” ('একা' সংস্কৃত শব্দ = কোনো এক), অ্যালুমিনিয়ামের আগেরটি “একা-অ্যালুমিনিয়াম“ এবং, সিলিকনের আগেরটি “একা-সিলিকন”। এই তিনটি মৌল আবিষ্কার হওয়ার পর তাদের নাম দেওয়া হয়, যথাক্রমে স্ক্যান্ডিয়াম, গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম।   তখনো আবিষ্কার না হওয়া এই  মৌলদের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্ম সম্পর্কে মেন্ডেলিয়েভ  আগাম জানিয়েছিলেন। প্রত্যেকটিই মিলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আরো দুটি মৌল আবিষ্কার হয়েছে : জার্কোনিয়াম, হাফনিয়াম। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ রসায়নবিজ্ঞানী উইলিয়াম র‍্যামজে,  জন উইলিয়াম স্ট্রাট (স্যার র‍্যালে) ও অন্য বিজ্ঞানীরা যখন এরপর ছয়টি নোবল গ্যাস, হিলিয়াম নিয়ন আরগন ক্রিপটন র‍্যাডন ও জেনন আবিষ্কার করলেন, তখন  মেন্ডেলিয়েভ ও অন্যান্যদের প্রস্তাব অনুসরণ করে, পর্যায়সারণীতে ১৭-তম গ্রুপের ঠিক পরে নতুন আর একটি গ্রুপ শূন্য (জিরো) গ্রুপে, তাদের সবাইকে পর্যায়সারণীর নীতি মেনে জায়গা দেওয়া সম্ভব  হল। (ফলে গ্রুপ সংখ্যা দাঁড়ানো ১৭+১ =১৮) এইসব সাফল্যের ফলে মেন্ডেলিয়েভের পর্যায়সারণী সুপ্রতিষ্ঠিত হল।

কিন্তু তবু রয়ে গেল ধাঁধা। পর্যায়সারণী তৈরি হয়েছিল ক্রমবর্ধমান আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজনকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে। এভাবে খুব সুন্দর ভাবে সাজানো যাচ্ছিল মৌলগুলিকে। কিন্তু গোল বাধল আয়োডিন ও টেলুরিয়াম জুটির মত কয়েকটি ক্ষেত্রে। মেণ্ডেলিয়েভ ও লোথার মেয়ার পর্যায়সারণীতে মৌলদুটির পারস্পরিক  অবস্থান পরিবর্তন করে এর সমাধান করেছিলেন।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সমাধান এলো পর্যন্ত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী হেনরী গোউইন মোসলের কাছ থেকে। ১৯১৩ সালে মোসলে নতুন আবিষ্কার হওয়া এক্স-রশ্মি মৌলগুলির উপর ফেলে, তা থেকে নি:সৃত এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ পরিমাপ করে প্রতিটির তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বার করেন ও, সেগুলি থেকে প্রতিটির কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি)  বার করেন। এগুলি থেকে তিনি দেখান এই কম্পাঙ্কের সঙ্গে মৌলিক পদার্থটির কেন্দ্রীণে কয়টি প্রোটন কণিকা আছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়। প্রতিটি মৌলের ক্ষেত্রেই তা সম্পূর্ণভাবে আলাদা। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে ১ থেকে শুরু করে বাকি সমস্ত মৌলের জন্য ২, ৩, ৪,..  ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া গেল। এগুলিকে বলা হয় পারমাণবিক সংখ্যা। পারমাণবিক ওজনের  পরিবর্তে পারমাণবিক সংখ্যা ধরে পর্যায়সারণী সাজানো হল। আয়োডিন-টেলুরিয়ামের মত মৌলদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হল। পাওয়া গেল আধুনিক পর্যায়সারণী।  এরপরেও পারমাণবিক ওজন সম্পর্কে যে অসামঞ্জস্য ছিল, তা কেটে গেল মৌলদের সমস্থানিক আবিষ্কারের পর। এখন একটি মৌলের পারমাণবিক ওজনকে (বা ভর) তার সবগুলি সমস্থানিকের গড় বলে ধরা হয়।।

References :

  1. Periodic Table

The Royal Society Chemistry.

  •  
  1. Periodic Table of Elements

American Chemical Society

  •  
  1. Britannica

Periodic Table|Definition|Elements|Group|Charges|Trends|Facts

Essay of Linus Pauling

  1. The Royal Society of Chemistry

Development of Thr Periodic Table

  •  
  1. Essay : Assembling The Modern Periodic Table  written by

Juliana Poole-Sawyer in American Chemical Society,In Chemistry, ACS Student Magazine, published on 11January, 2019.

  •  

       চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট  

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb