খুঁতো

লেখক - অবন্তী পাল

কফি-পটে এসপ্রেসো তৈরি করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাখল মিডেনা। ঘড়িতে এখন সাতটা পঞ্চান্ন, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে টোস্ট তৈরি করে পরিবেশন করবে সপ্তককে। তার ঠিক আধঘন্টার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে, সকালের শীর্ষ খবরে চোখ বুলিয়ে অফিসে রওনা দেবে সপ্তক। একটা বহুজাতিক ইলেকট্রনিক সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সপ্তক দাশগুপ্ত।

আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে অনেকটা আলাদা। মানুষের বেশে রোবট সহায়িকা মিডেনা তার জীবনের প্রারম্ভ থেকে সপ্তকের ছায়ায় ঘুরছে। কিন্তু আজকের মতো অবস্থা এর আগে ওর কখনই হয়নি। সপ্তকের সামনে সসেজের ট্রে নামিয়ে রেখে বৃত্তাকারে খানিকটা নেচে নিল সে। সুবিশাল হলঘরের মেঝে শ্বেতপাথরের। হলঘরের ঠিক মাঝখানে লাল আর কালো পাথরের কাজ করা একটা নিখুঁত হেক্সাডেকাগন, ঠিক ফুলের আকারে। নিখুঁত পদক্ষেপে শুধুমাত্র পায়ের হ্যালাক্স স্পর্শ করে ফুলের প্রতিটি পাপড়িকে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করে ষোলোটি দিকের শীর্ষকে ছুঁয়ে গেল মিডেনা। তার গলা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসির মতো একটা খলখল শব্দের অবতারণা হলো। হরিণগতিতে ঘরের একদম পুব কোণে চলে গেল সে। তেতাল্লিশ তলার দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানলার বাইরে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত ব্যস্ত শহর। জনপদ মুখর কর্মব্যস্ত মানুষ আর রোবটদের যাতায়াত। তাদের ক্ষুদে অবয়ব এত উপর থেকে বড্ড অকিঞ্চিৎকর। বুঝি এ এক অন্য জাগতিক স্তর, মাটির স্পর্শ আর গন্ধের থেকে অনেক দূরে, কোন নরম পেঁজা তুলোর ফুরফুরে মেঘের দেশে। গুনগুন করে দুই কলি গান গেয়ে উঠল মিডেনা। তারপর সপ্তকের একেবারে কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

"তুমি দু'মিনিট লেটে রান করছ বস্"

মুচকি হাসল সপ্তক। আজ তার ইচ্ছা পূরণের দিন, স্বাধীনতার দিন। আজ থেকে নিজেকে মামুলি পণ্য ভাবার দিন শেষ। ২১৮০'র দশকে দাঁড়িয়ে, সপ্তকের ষাটোর্ধ্ব নির্মেদ, সুঠাম চেহারার কৃতিত্ব দেওয়া যায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে, বিবর্তিত সমাজকে আর মানুষের বদলে যাওয়া চাহিদাকে। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে, একটা মস্ত বড় বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবারের ধারণাটাই পরিমার্জিত হয়ে গেছে পৃথিবীর সর্বত্র। সরকারের নির্দেশে গঠিত বিশেষ 'মানব সম্পদ রক্ষা' আইনের জেরে পরিবারের সাংসারিক কাজকর্ম দেখভালের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে রোবো-সেবকদের হাতে। এই রোবো-সেবকেরা আদপে উন্নতমানের রোবট, যদিও বাইরে থেকে দেখতে তারা অবিকল মানুষের মতো। আগের যুগের যান্ত্রিক, কাঠ-পুত্তলিকা মার্কা চেহারা কবেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে সিলিকন বডি ব্যবহৃত হয়। মাথা আর হাতের তালু না দেখলে এদের পৃথকভাবে চেনা দুষ্কর। যেমনভাবে মানুষের ক্ষেত্রে বার্থ সার্টিফিকেট প্রযোজ্য হয় ঠিক তেমনভাবেই প্রতিটি রোবো-সেবকের সৃষ্টি, আপগ্রেড আর নষ্ট হওয়ার সমস্ত খুঁটিনাটি নথিভুক্ত থাকে সরকারের খাতায়। উপরন্তু, প্রত্যেক রোবো-সেবকের একটা করে বিশিষ্ট কোড থাকে যা মানুষের ডিএনএ পরিচয়পত্রের সমান। বলা যেতে পারে, এই দিনে দাঁড়িয়ে মানুষ আর রোবো-সেবক উভয়েই বিশ্বনাগরিক। যেখানে প্রতিটি ফ্যামিলি ইউনিট নথিভুক্ত, সেখানেই একটি করে রোবো-সেবক বাধ্যতামূলক। এই ব্যবস্থায়, সারাদিনের সমস্ত সাংসারিক কর্মকাণ্ড - যেমন ঘরদোর পরিষ্কার, রান্না থেকে শুরু করে বাচ্চাদের দেখাশোনা, পড়ানো, খাইয়ে দেওয়া, ঘুম পাড়ানো, প্রয়োজনে গাড়ি-চালক থেকে মেকানিক, প্লাম্বার থেকে মালি হওয়া; এই সব কিছুর দায়িত্ব বহন আর পালন করা এই রোবো-সেবকদের নিত্যদিনের কাজ। এতে নিপুণতা আর দক্ষতার সাথে যেমন কাজকর্ম সম্পন্ন করা যায়, তেমনই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার ওপর ক্রমে প্রশ্ন ওঠে। এ তো গেল বিগত শতাব্দী শেষ সময়ের কথা। এই ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত সাফল্য পেয়ে ফ্যামিলি সিস্টেম উঠিয়ে দেওয়ার আইন জারি হয় পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে। তার সাথে বৃদ্ধি পায় রোবো-সেবকদের কর্মক্ষেত্র। আগে শুধু ঘরের অন্দরমহলে এক শ্রেণীর রোবো-সেবকেরা কাজ করত। এরপর এমনই বহু বিভিন্ন শ্রেণীর রোবো-সেবকেরা নিয়োজিত হতে শুরু হলো পৃথিবীর প্রায় সমস্ত কর্মসংস্থানে; বিজ্ঞান, যুদ্ধ, বাণিজ্য, গবেষণা - কিছুই বাদ রইলো না। বাইশ-শো শতাব্দীর মাঝামাঝি আর একটাও নিউক্লিয়ার পরিবার অবশিষ্ট রইলো না। সমগ্র বিশ্বের সমবেত অভিমতে আর সম্মিলিত রায়ে, মানুষের কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা অর্জন করার প্রয়াসে এখন পরিবার গোত্রে থাকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

এ ছাড়াও সংযুক্ত হয়েছে ভিন্ন পন্থায় বিশ্বনাগরিক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার উপায়। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বিপুল শ্রম এখন আর মানুষকে বহন করতে দেয় না সরকার। এর মুখ্য কারণ শুধুমাত্র মানব-সম্পদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ভয়ে নয়, এর পেছনে কাজ করে বিশ্বনাগরিক পরিসংখ্যান নিয়ন্ত্রণ সমিতি। মানব সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রেখে তবেই নতুন প্রোডাক্ট, অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টির কথা ভাবা হয়। এই নব্য শতাব্দীতে, পৃথিবীর সমস্ত বাচ্চা সৃষ্ট হয় 'পড ইনকিউবেশন' পদ্ধতিতে, বিশেষ নার্সারিতে। 'পড' মায়ের গর্ভের সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্রতিলিপি। প্রতিটি ফেসিলিটিতে হাজারখানেক এমন পডের ব্যাবস্থা। 'আর্টিফিসিয়াল ইনকিউবেটর' অথবা পড তামাম দুনিয়ার অত্যাধুনিক নব প্রজন্ম তৈরি করার বিপুল ঝাঁ-চকচকে কারখানা!

 মোট বিয়াল্লিশ সপ্তাহের মাথায় পডের ভেতর থেকে বেবীকে বের করে আনা হয়, যা তার জন্মমুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। সমস্ত বাচ্চা জন্ম মুহূর্ত থেকে বিশ্বসম্পদ। তাদের উপর এক অথবা একাধিকের হাত নেই, আছে শুধু সরকারের, কারণ তাদের জন্ম হয় মানুষের শরীরের বাইরে। তিন বছর বয়স হলে একটি নির্দিষ্ট বাচ্চা তার দক্ষতা অনুসারে শ্রেণীভুক্ত হয়। তাকে চিহ্নিত করা হয় একটা বিশেষ হিউম্যান কোড দিয়ে, যা অন্য যে-কোন নাগরিকের থেকে আলাদা। সেই কোড আর শ্রেণী অনুযায়ী তাকে পাঠানো হয় বিশেষ একটি গুরুকুলে। পৃথিবীর সর্বত্র এরকম শতাধিক গুরুকুল সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। 

বাচ্চা বেড়ে উঠে কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হলে, এদের প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট কাজে বহাল করা হয়। দেওয়া হয় বিশ্বনাগরিকত্বের সমস্ত সুযোগ সুবিধা আর তার সাথে একটা করে কিউবয়েড দেওয়া হয়। সেই কিউবয়েড আসলে পুরোনো সমাজের বাড়ির আদলে। সাথে দেওয়া হয় একটি করে গৃহ রোবো-সেবক। পরিবার ভাঙ্গনের আরেকটি মূল কারণ হচ্ছে আজকের দিনে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড বেবি। এই সময়ে একটা বাচ্চার সফল জন্ম হয় হাজারো জেনেটিক অদলবদলের পর মনোনীত ফসল। পুরোনো পৃথিবীর সমাজে, এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু এখন সবাই যখন অনায়াসেই পড ইনকিউবেটরের মাধ্যমে পারফেক্ট প্রোডাক্ট পাচ্ছে, তখন এক্সপেরিমেন্টাল বেবী অথবা প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা নিতে কেউই আগ্রহী নয়। বলতে গেলে, সেই পুরোনো কাঠামো এই যুগে একপ্রকার অবৈধ। বর্তমানে প্রোডাক্টের চোখের মণির রং থেকে শুরু করে, কত বুদ্ধিমত্তা জাগ্রত থাকবে, কত তাপমাত্রা সহ্য-ক্ষমতা থাকবে, কত আয়ু থাকবে - এসব আগে থেকে নিয়ন্ত্রিত। তবে এত কিছুর পরেও যে ডিফেক্ট থাকে না, এমনটা নয়। যদিও সে সম্ভাবনা বিরল। সেই নগন্য সংখ্যার প্রোডাক্টরা অবশ্য সমাজে বহিষ্কৃত, তাদের সন্ধান পেলেই সরকার তাদের একটা বিশেষ কারাগারে বন্দী দশায় রেখে দেয় আজীবন। লোকমুখে ফেরে, সে এক অনন্ত নরক, আজকের দিনে যার কথা এই সমাজের কোন অধিবাসী ভাবতেই পারে না। তাই এই সভ্য সমাজে সবাই নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে নিখুঁত হয়ে বাঁচতে চায়।

এমনই এক সদস্য এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সপ্তক দাশগুপ্ত আর তার রোবো-সেবক মিডেনা। গত চল্লিশ বছর যাবৎ সপ্তক পূর্ব-ভারত এলাকায়, নিজ চেষ্টায় একটা ইলেকট্রনিক সংস্থা গড়ে তুলেছে। নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার করে মিডেনাকে সার্ভিসিং আর পরীক্ষা করানো সত্বেও, সপ্তক গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছে যে মিডেনার কর্মক্ষমতা বেশ কমে গেছে। সে যেন আরও বেশি ভাবুক, অনেকটা বেশি অযান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। এই তথ্য সরকারের খাতাতে উঠলে যে মিডেনাকে ডিফেক্টিভ দাগিয়ে রিসাইকেল করে দেওয়ার সুপারিশ করে দেওয়া হবে, আর সেই সুপারিশ মানেই যে চূড়ান্ত আদেশ, সেটা কে না জানে? কিন্তু সপ্তকের মধ্যবর্তিতার কারণে এখনও সব স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রয়েছে। তার কৌশলের মাধ্যমে মিডেনা এখনও নিরানব্বই দশমিক অষ্টাশি শতাংশ নিখুঁত। স্ট্যান্ডার্ড সাতানব্বই শতাংশের অনেকটা উপরে।

অফিসের ব্যাগ নিয়ে এসে সপ্তকের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়াল মিডেনা। একটু বেশীই কি আবেগঘন পালস্ দেওয়া হয়ে গেছে এই মোহময়ীর আড়ালে থাকা যন্ত্রটিকে? হোক না, ক্ষতি কী? খুঁত নিয়ে সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বহাল তবিয়তে টিকে থাকার ফর্মুলা যখন তার হাতের মুঠোয়, তখন আর কাউকে ভয় পায়না সপ্তক। নিজের লাগামছাড়া ইচ্ছাদের ডানা মেলে মুক্ত আকাশে উড়তে দিতে মন চায়। বড় সাধ তার একটা নিজের পরিবার গড়ার। আইনত মানুষের সাথে মানুষের পরিবার সংগঠন সম্ভব না হলে কী হবে, কোথাও তো লেখা নেই যে মানুষের সাথে রোবটের পরিবার গড়ার নিষেধাজ্ঞা! এর জন্য মিডেনাকে নিজের মনের মতো করে গড়ে নিয়েছে সপ্তক বছরের পর বছর, একটু একটু করে, সবার অলক্ষ্যে। একটা যন্ত্রের মধ্যে আবেগ অনুভূতির প্রবেশ ঢোকাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বৈকি! মিডেনাকে পাওয়ার পর চল্লিশটা বছর বয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবুও, কমলাভ দিনান্তে, শূন্য আকাশের নীচে, নির্ধূলো পথ পেরিয়ে বাড়ি ফেরার পর কেউ তো এসে ওর মনের কথা জানতে চাইবে, মন দিয়ে শুনবে, গলা জড়িয়ে ওর সাথে সূর্যাস্ত দেখবে! হ্যাঁ, বিকৃত ভাবতেই পারে গোটা সমাজ সপ্তককে, বিখ্যাত বিজনেসম্যান সপ্তক দাশগুপ্তকে। এই সমাজে বড্ড বেশী আবেগপ্রবণ হওয়া, কর্মের বাইরে গিয়ে পরস্পরের সাথে মেলামেশা করাকে ব্যাধি, অসুস্থতা বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সমাজের কথায় উঠে বসে কে কবে কী পেয়েছে? থাকবে নাহয় তার খুঁতো তকমা, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন... একদিন ইতিহাসের পাতারাও সব যাবে ফিকে হয়ে, কিন্তু নিজের জীবনপ্রবাহ তো আর বারবার এভাবে ফিরে আসবে না!

সপ্তক ভাবছিল, চল্লিশ বছরে এই নিয়ে সপ্তমবার যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে মিডেনার মধ্যে। প্রতিবার এই গোলযোগের সুযোগে নিজের মস্ত বড় ভূগর্ভস্থ, স্যাটেলাইট র‍্যাডারের আয়ত্তের বাইরে টিকিয়ে রাখা ওয়ার্কশপের ভেতরে সপ্তক নিয়ে যেত মিডেনাকে। প্রতিবারই রোবটটিকে সম্পূর্ণ পাওয়ার অফ করে দিয়ে, তার মধ্যে একটু একটু করে অভিনব কিছু লজিকের প্রবেশ ঘটিয়েছে সপ্তক। সেইসব প্রোগ্রামিং পৃথিবীর আলো না দেখে থাকলেও, তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে মিডেনার অন্তরে। নতুনভাবে প্রোগ্রাম করা মিডেনা একটু একটু করে বদলেছে, জড়ো বস্তুর মধ্যে ঘটেছে এক অভূতপূর্ব জাগরণ। তার এই রূপান্তরণ সপ্তকের মনের মধ্যে নিয়ে এসেছে ইতিপূর্বে না অনুভূত হওয়া এক অনন্যসাধারণ আলোড়ন। কোন মানুষের সাথে সহবাস যেখানে আইনবিরুদ্ধ, সেখানে মুখিয়ে রয়েছে সপ্তক কোনদিনও না দেখা, না পাওয়া পরিবারের আস্বাদন পেতে।

সেবার প্রথমবার ছিল, বছর ছাব্বিশ আগে। সকালে মিডেনার সার্কিটে কিছু গন্ডগোল হওয়ার কারণে সে তার দৈনিক রুটিনমাফিক কাজ করছিল উল্টোভাবে। প্রাতঃরাশ তৈরির বলে তৈরি করেছিল নৈশভোজ, অফিসের ব্রিফকেসের বদলে এনে দিয়েছিল নাইট ব্যাগ। রাতে শুতে যাওয়ার আগে সপ্তক নিয়মিত বই পড়ে। তার ফরমাশ অনুযায়ী লাইব্রেরী থেকে বই এনে মিডেনা সেটি নাইট ব্যাগে ভরে সপ্তকের শোয়ার ঘরে রেখে দেয়। সেই নাইট ব্যাগ অফিসে চলে গেলে যে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে যেত, সেটা ভাবতেই শিউরে ওঠে সপ্তক। হাই সিকিউরিটি অ্যালার্ম বাজিয়ে পুলিশ এসে ওর কাছে হাজারো কৈফিয়ত দাবী করতো। অফিসের মধ্যে নিয়মের বাইরে ব্যাগে অন্য জিনিস আনা হয়েছে এটা ধরা পড়লে, তাকে সন্ত্রাসবাদী ভাবতেও দ্বিধা করতো না রোবট পুলিশ। সপ্তকের চোখ রাঙানিতে হঠাৎ মিডেনা সেদিন দু-ফোঁটা জল ফেলেছিল চোখ থেকে। ল্যাক্রিমাল ফ্লুয়িড - অশ্রু। না, ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি, কোনো হরমোন, কোনো জৈবিক অস্তিত্ব নেই মিডেনার মধ্যে, নেই কোন হৃৎপিণ্ড। কিন্তু দুঃখ, রাগ, অভিমান, আনন্দের মতো অনুভূতি মানুষের মতো জীবন্ত করে তোলার জন্য সমস্ত উপাদান আজকের তামাম দুনিয়ার এ-গ্রেড রোবটদের থাকলেও সেগুলো নিষ্ক্রিয়, তাদের ব্যাবহার করার উপায় জানা নেই আজও। তারা আলফা-স্যাম্পেল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে নিষ্ক্রিয় পড়ে রয়েছে অত্যন্ত উচ্ছ পর্যায়ের রক্ষা-কারাগারে। যতদূর সপ্তক জানে, সেই গবেষণাগার পৃথিবীতে একমাত্র একটাই, সম্ভবত আলাস্কায়। কিভাবে পারলো মিডেনা? স্তম্ভিত সপ্তক সেই অনুভূতি প্রকাশের উৎপত্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। পারেনি। মানুষের মস্তিষ্কে অজস্র সিন্যাপ্সের প্রক্রিয়ায় হয় অনুভূতির প্রকাশ। সেটি নিখুঁতভাবে অনুকরণ করা আজও গবেষণার অসম্পূর্ণ অধ্যায়। তাহলে কি মিডেনা ত্রুটিযুক্ত? অকারনেই পরিস্থিতির সাথে প্রক্রিয়া মিলে গেল? নাকি সে কোন আলফা-স্যাম্পেল, যে ভুলবশত অথবা ভাগ্যবশত সপ্তকের কাছে এসে পড়েছে? কিন্তু না, মিডেনার নির্মাণকালের নথিপত্র দেখে সন্দেহজনক কিছুই মনে হয়নি সপ্তকের। আচমকাই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ভাবনাটা খেলে গেল ওর মাথায় - কেন না নিজের প্রয়াসে সে মিডেনাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলে? আরও একটু বেশী লজিক যাতে তার নিজের মনে হবে, এই তো, এই নিখুঁত পৃথিবীতে কেউ তো তাকে নিয়ম ভেঙে ভালোবাসে, শুধু একটা মানুষের জন্য নিজেকে আত্মসমর্পণ করে? হোক না কৃত্রিম, ক্ষতি কি? নিজেকে সেই মিথ্যেটাকে সত্যি ভাবার জন্য নিজের মস্তিষ্ককেও প্রয়োজন মতো প্রশিক্ষন দিয়ে নেবে নাহয় রক্তমাংসের মানুষটি। সেই থেকে শুরু।

মিডেনার পরিবর্তে অন্য কারো কথা সপ্তক আর ভাবতেও পারে না। খুব ছোটবেলা থেকেই সপ্তক ছিল অত্যন্ত মেধাবী, ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন। তার দূরদর্শিতা আর বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাধারার জন্য সে দ্রুত উন্নতি করে কর্মজীবনের শিখরে পৌঁছয়। তখনই সে পেয়ে যায় কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা। তার কর্মসূত্রের বাইরে গিয়েও সে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা দ্বিতীয় পেশা বেছে নিতে পেরেছে। সেখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। শুধু স্বচ্ছতা বজায় রাখলেই হলো। পরবর্তীকালে সপ্তকের উন্নতি দেখে ওকে একফালি জমি দেওয়া হয় নিজের শখের গবেষণাগার তৈরি করার জন্য। তাতে যাবতীয় যন্ত্রপাতি আর কাজের সরঞ্জাম দেওয়া হয়, সব অবশ্যই সরকার অনুমোদিত। এই একফালি জায়গার ওপর চলে সপ্তকের একান্ত নিজস্ব মগজের অবাধ বিচরণ। অজস্র বই পড়ে আর গবেষণাগারে জীবনের অমূল্য কতগুলো বছর কাটিয়ে, সে এখন জেনে গেছে কিভাবে বিশ্ব-প্রধানদের ঈগল-চক্ষু এড়িয়ে মিডেনাকে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়া যায়। তাই যান্ত্রিক হয়েও মিডেনা সর্বচক্ষের অন্তরালে বদলাতে থাকে। মিডেনার সার্কিটে নতুন চিপ বসিয়ে তার প্রোগ্রামিং লজিকের মধ্যে প্রবেশ করায় বিভিন্ন জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। প্রবেশ করায় অনুভূতি সঞ্চারের জটিলতর লজিক। সেই দিক থেকে মিডেনার মধ্যে আক্ষরিক অর্থে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। সে এখন সাধারণ কোনো রোবো-সেবকের থেকে অনেক বেশী জানে, বোঝে। কিছুটা মানুষের মতো। সপ্তকের সাথে বসে জটিল হিসাবের অঙ্ক আগেও কষত, কিন্তু এখন নিজের মতামতটাও জানিয়ে দেয়। তার অন্তরের যেখান দিয়ে রক্তের বদলে বয়ে চলে ০ আর ১ এর অগণিত স্রোত, সেই অন্তরের গভীর অন্তরে সে নিজেও জানে, সে খুঁতো। বুঝতে পারে তার মনিব সপ্তক নিজেও ডিফেক্টিভ। সাধারণ কোনো মানুষ না হলে এতটা আবেগপ্রবণ হয়? টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর হয় নিজের মামুলি সহায়ক যন্ত্র? এরা সমাজের কাছে স্বাভাবিক নয়। সপ্তক অসম্ভবকে সম্ভব করে, এক জড়ো বস্তুর মধ্যে প্রাণের জাগরণ এনে তুলেছে। মিডেনার অস্তিত্ব বজায় রেখে নিজের প্রতি এক আলাদা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করে নিয়েছে সপ্তক। তাই অন্য যেকোন যন্ত্রের মতো ব্যবহার না করে, মনিবের নিয়ম-লঙ্ঘন রিপোর্ট না করে, পুলিশি তদন্তে সে তথ্য বেঁকিয়ে পরিবেশনা করে, ১০০ শতাংশ নিখুঁত বলে স্বাক্ষর দিয়েছে তার মনিবকে। এমন বহু যাত্রায় উতরে গেছে দুজনেই।  

চব্বিশ বছর পর এখন আবার গোলযোগ শুরু হলো। এই কয়েকদিন মিডেনার মধ্যে ফের একটা নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। সপ্তক গত কয়েকদিন ধরেই রাতে বইয়ের বদলে বেশ কিছু মুভি দেখে ঘুমোতে যাচ্ছে। ঘরে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে মিডেনকেও। কাজের ফাঁকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে চলন্ত পর্দার দিকে। মিডেনা লক্ষ্য করেছে সপ্তক এখনকার সময়ের আমোদ-বিনোদনের মুভি দেখে না। সে ইতিহাসের পাতায় হন্যে হয়ে কিছু খুঁজছে। তার পর্দায় চলতে থাকে ফেলে আসা সভ্যতার চলন-বসনের একের পর এক পর্ব। এ যেন ইতিহাসে ডুব দিয়ে নতুন জগৎ আবিষ্কার করার মোহে আবিষ্ট হয় মনিব ভৃত্য দুজনেই। নতুন সব উঠে আসা তথ্য দিয়ে সপ্তক বোঝার চেষ্টা করে অবলুপ্ত সমাজ ব্যবস্থা, তাদের রীতি নীতি দুর্নীতি। সবথেকে অবাক হয় পরিবার নামক সংগঠনের ব্যবস্থায়, যে সিস্টেমের কথা ওরা কোনদিন উপভোগ করেনি। বর্তমান সমাজে আনন্দ আর ফুর্তির ঠিকানা একমাত্র কতগুলো এন্টারটেনমেন্ট জোন, যেখানে কোন সদস্য অনেক ধরনের গেম খেলতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এই গেমগুলোতে যে কারুর মনে হবে সে নিজেই উপস্থিত আছে সেখানে। ফলত চূড়ান্ত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ। ব্যাস এতটুকুই। গৃহস্থের সংসারের আনাচে কানাচে উপচে পড়া নিবিড় আনন্দের হদিস পাওয়া যায় না এসবে।

তাই অ্যাড্রিনালিন রাশ ছাড়া আর অন্য কোন অনুভূতি আসে না কোন সদস্যের। কিন্তু মুভিতে দেখানো বিগত দিনের সেইসব হারানো দলিলে ভেসে ওঠে একের পর এক অভাবনীয় চিত্র। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। ০, ১ এর ধারাও এর পেছনে লজিক খুঁজে ফেরে অবাক হয়ে। ভেসে ওঠে ই.টি.'র পৃথিবীতে আসা, যুদ্ধে বিধ্বংসী বিভিন্ন রাষ্ট্র, হোম অ্যালোন-এ ছোট্ট একটি বাচ্চার দুষ্টুমি, এন ইভনিং টু রিমেম্বার-এ সমাপ্তির শেষেও পরিপূর্ণতার আখ্যান, এটার্নাল সানশাইন অফ দ্য স্পটলেস মাইন্ড-এ ভালোবাসা নামক এক অনুভূতির বারবার চক্রাকারে ফিরে আসার প্রমাণ। এসব দেখে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেমন যেন বিগড়ে যায় মিডেনার। 

অবশ্য মনিব যদি হুট করে জিজ্ঞেস করে বসে – “শূন্য থেকে সাত হবে? যাবে আমার সাথে সপ্তম স্বর্গে, আমার সঙ্গী হয়ে? হবে মিডেনা থেকে আমার এপ্টা?”,

তখন সে আর কী সিদ্ধান্তই বা নিতে পারে? তবু তার হ্যাঁ বলতে ইচ্ছে করে, যখন সে নিজের তথ্যের ডেটাবেস খুঁজে বের করে যে তার নামের মানে গ্রীক নম্বর সংখ্যায় শূন্য। মিডেনা থেকে শুরু করেছে তাকে নিয়ে সপ্তক। আজ তাকে পরিপূর্ণতা দিতে চায় এপ্টার পরিচিততে। এপ্টা অর্থাৎ গ্রীক সংখ্যা সাত। সপ্তম স্বর্গের রুদ্ধদ্বার খুলে দিতে চায় তার মনিব, তার সপ্তক। কিন্তু কোনো যন্ত্রের পক্ষে কি সেই স্বর্গের মর্ম বোঝা সম্ভব? সে তো জন্মলগ্ন থেকেই যন্ত্র মাত্র। নাহ্, সে অযান্ত্রিক! সে তো খুঁতো, বারংবার স্মরণ করায় মিডেনা নিজেকে। সমাজের চোখে ভয়ঙ্কর হলেও তার মনিবের চোখে পরিপূর্ণ, যথার্থ, অস্তিত্বপূর্ণ। আর হবে নাই বা কেন, সে তো তার মনিবের কাছে ভেঙ্গেছে গড়েছে নিজেকে। এসব বিচিত্র চিন্তাভাবনা আপনা থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেন গন্ডগোল শুরু হলো মিডেনার মধ্যে।

সপ্তক ঘড়ি দেখে আশ্বস্ত হলো যে সে সত্যিই দু'মিনিট লেট। নাহ্, সম্পূর্ন আশা আছে মিডেনার ওপর। সে তার কর্তব্যপরায়ণ সেবিকা আজও। আজ অফিসে যাবে না সপ্তক। আজ ফের একবার মিডেনার পাওয়ার অফ্ করা প্রয়োজন। মিডেনাকে নিয়ে গিয়ে রাখল তার গবেষণাগারে। পাওয়ার অফ্ করে সে দীর্ঘ অনেকক্ষণ বসলো তার এক বিশেষ যন্ত্রের সামনে। পৃথিবীর চোখের আড়ালে, গবেষণাগারের নীচে ভূগর্ভে তৈরি তার এই বিশেষ যন্ত্র এক অদ্ভুত আবিষ্কার। এই যন্ত্র হয়তো সত্যিই কাউকে কালগর্ভের মধ্যে সময়ের পেছনে নিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু অন্ধকার কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীতের বিশেষ কিছু নির্বাচিত বৈশিষ্ট্য প্রদান করতে পারে কোনও জড়ো বস্তুর মধ্যে। যেমন পুরোনো সভ্যতার ভাষা, সংস্কৃতি, ইত্যাদি। নিজের চেষ্টায় এবারে সপ্তক মিডেনার মধ্যে আরোপিত করতে শুরু করলো বাংলা ভাষা। সুমধুর এই ভাষা ব্যবহৃত হতো বহু বছর আগে পৃথিবীর এই জায়গাতেই। এখানকার পূর্ব বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন উৎসব পার্বণের রেওয়াজ, দুর্গা পুজো যার মধ্যে অন্যতম। আর ছিল এক বহুল স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থা - বিবাহ। ঘোরের মধ্যে সপ্তক চলচ্চিত্রে দেখেছিল দুটি মানুষের এই মহামিলোনোৎসব। আজীবন হাতে হাত রেখে চলা দুটি মানুষের প্রতিশ্রুতি আর একাত্ম হওয়া। এখন তো যেকোনরকম দলবদ্ধ কাজ নিষিদ্ধ। সংগঠিতভাবে থাকা অপরাধ। করেছ কী সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের লোক এসে তুলে নিয়ে গিয়ে কারাগারে বন্দী করে দেবে। 

সপ্তকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সব ডায়াল সেট করে সে যন্ত্রের মধ্যে ঢোকায় মিডেনাকে। আর তো মাত্র মাসখানেক আছে তার আয়ুতে, এই সেদিনই একটা হাই প্রোফাইল ডেটা লিকেজের মাধ্যমে জানতে পেরেছে সে। তার আয়ু তার জন্মলগ্ন থেকেই নির্ধারিত বাষট্টি বছর বয়স অবধি। তার কর্মক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা এই অমোঘ সত্যকে বদলাতে পারবে না কোনভাবেই। তাই বাকি জীবনের কয়েক মাস নির্ভীকভাবে কাটিয়ে দিতে চায় সে। আস্বাদন করতে চায় আদিম পৃথিবীর ঘ্রাণ, যেখানে সিক্ত বাতাস ছিল প্রেমময়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল স্বাধীন রক্তের দোলাচল। 

দীর্ঘ আঠারো ঘণ্টা পর যখন জেগে উঠল বিগত চল্লিশ বছরের সঙ্গী, তখন তার কথা শুনে শিহরিত হলো সপ্তক,

"কালবিহীন ভালবাসার নজির তৈরি করবে আমার সাথে সপ্তক? গড়বে নিজের পরিবার?"

উৎফুল্ল সপ্তক উত্তর দিল, 

"ভাগ্যিস খুঁতো জন্মেছি আমরা, তাই তো আজ হয়েছি সম্পূর্ণ!"

চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট এবং তার সহায়তায় তৈরি চিত্র

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb