বিকল্প ২০২৪

লেখক - রাজকুমার রায়চৌধুরী

                                           ১

সুরেশ ভাওয়াল আমার প্রতিবেশী ৷ ওনার বয়স যাটের কাছাকাছি ৷ বেশী ও হতে পারে ৷ মাথায় বিশাল টাক এবং অল্প পাকা গোঁফ সত্বেও খুব বয়স্ক লাগে না ৷ হাইট মনে হয় পাঁচ ফুট ন ইঞ্চি। সুগঠিত চেহারা ৷

কয়েক বছর হল আমাদের পাড়ায় একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে এসে থাকছেন ৷ ফ্ল্যাট টা অবশ্য আগেই কিনে রেখেছিলেন ৷ এখানে  সম্পত্তির দাম গত দশ বছরে তিনগুণ  বেড়েছে ৷ সুরেশ বাবু একটি বড় প্রাইভেট হাসপাতালে ম্যানেজার জাতীয় পদে ছিলেন ৷ ডাক্তার হবার শখ ছিল কিন্তু সুযোগ হয়নি ৷ রিটায়ার করার পর এখানে এসে থাকতে শুরু করেছেন ৷ এখন একটি স্থানীয় হাসপাতালে পার্ট টাইম চাকরী করেন ৷ কেমিস্ট্রিতে এম এস সি করেছিলেন ৷

বাড়ীতে ছাত্র পড়ান ৷ ভালই পড়ান ৷ ছাত্রের অভাব হয়না ৷ বিপত্লীক মানুষ ৷ সংসার চলে যায়।  এক মাত্র সন্তান ও কন্যা অর্চনা মুম্বাই থাকে ৷ একটি বড় ব্যাঙ্কে কাজ করে ৷সুরেশ বাবু নানা রকমের বই পড়েন ৷ হলিউডের সিনেমাও দেখেন ৷ ভগবানে বিশ্বাস করলেও কোন কুসংস্কার নেই।

আমার সঙ্গে যাকে বলে গাঢ় বন্ধুত্ব নেই কিন্তু মাঝে মাঝে সকালে আমার বাড়িতে আসেন বই ধার নিতে ৷ তখন চা পানের সঙ্গে নানান বিষয়ে আলোচনা হয় ৷ আজ কে আমার বাড়িতে যখন এলেন তখন খুব উত্তেজিত ৷ সোফায় বসার আগেই বললেন " আজ মোকামিকে দেখলাম"

 " আপনি কার কথা বলছেন"

আমার প্রশ্ন শুনে উনি বললেন " আপনি হয়ত আমাকে  বোকা ভাবছেন ৷ কিন্তু আমি সচক্ষে সৌমেন মোকামিকে দেখলাম রুবির ওখানে একটা বাসে উঠছে"।  " কি বলছেন আপনি,মোকামী তো পনেরো দিন আগে মারা গেছেন "সৌমেন মোকামি আমাদের পাড়ায় থাকতেন ৷ নিজের শাড়ীর দোকান ছিল বড়বাজারে। সৌমেন বিবাহিত ছিল ৷ স্ত্রী ও দুই মেয়ে  নিয়ে একটা ছোট একতলা বাড়িতে থাকতো ৷

পঞ্চান্ন বছর বয়সে হঠাৎ হার্ট ফেল করে মারা যান ৷ অথচ যতদূর জানতাম ওর হার্টের কোন অসুখ ছিল না ৷ কিন্তু  এরকম আচমকা মৃত্যু তো আকছারই হচ্ছে ৷

 " আরে আপনি আর আমি দুজনেই তো ওনার শ্রাদ্ধে গিয়েছিলাম ৷ আপনি নিশ্চয় ভুল দেখেছেন৷ চোখটা একবার দেখিয়ে নিন ৷ বলেন তো এক ভালো ডাক্তারের নাম বলছি ৷ আমাকে খুব খাতির করেন ৷ ওনার নিজের আই হসপিটাল আছে ৷ চার্জ ও খুব কম"

" না প্রণব বাবু আমি রিটায়ার করার পরই চোখ দেখিয়েছি ৷ প্লাস পাওয়ারটা একটু বেশী ছিল। কিন্তু এখনো ছানি পড়েনি ৷"

সুরেশ বাবু প্রায় রাগত স্বরেই কথা গুলি বললেন ৷ " হয়ত আপনার মনের ভুল ৷ হয়ত সৌমেন মোকামীর মত হুবহু দেখতে এরকম আর একজন কে দেখেছেন ৷ মোকামী এমনই সাধারণ দেখতে যে কোলকাতার মত শহরে ওর অনেক ডুপ্লিকেট রয়েছে"।  

" হতে পারে " বলে ভাওয়াল আর তর্ক করলেন না ৷ তবে খুব যে convinced হলেন তা মনে হল না ৷

                                              ২

এর পরের রবিবার সুরেশ বাবু আমার বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে এলেন ৷

বাড়িতে ঢুকেই সোফায় বসে খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ৷ আমি কিছু বলবার আগেই বললেন   " আজ যা দেখলাম শুনলে নিশ্চয়ই বলবেননা আমার চোখে ছানি পড়েছে বা ডুপ্লিকেট দেখেছি।  পিশাচে আমিও বিশ্বাস করিনা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এলিয়েন। " আমি ভাবলাম কিছু দিন আগে আমার দুটো বই ধার নিয়েছেন ৷ দানিকেনের একটা বই আর  আসিমভের একটা গল্প সংকলন ৷ হয়ত ওগুলো পড়ে এই সব চিন্তা মাথায় এসেছে ৷ তা ছাড়া ভাওয়াল মেন ইন ব্ল্যাক সিরিজের খুব ভক্ত ৷ আমার এগুলো আদৌও সায়েন্স ফিকশন  মনে হয়না ৷ এলিয়েন মানেই তাদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে ৷ কারুর ঘাড়ে দুটো মুন্ডু আবার কেউ বা আসলে জায়ান্ট আরসোলা মানুষের বেশে ঘুরছে । কেউ বা সুন্দরী মেয়ের ভূমিকায় ছদ্মবেশে আছে  কিন্তু দরকার  হলে  তিরিশ ফুট জিভ বার করছে। দেখতে তো মজা লাগে কিন্তু এগুলিকে বড় জোর সায়েন্স  কমেডি বলা যায় ৷ এর থেকে স্টার ট্রেক অনেক ভাল ৷ " " ঠিক কি হয়েছে একটু খুলে বলুন তো"

" আপনি ডাঃ ভবতোষ দেবরায়কে চিনতেন? " আমি বললাম, " ডাঃ দেবরায় কে ভালভাবেই চিনতাম ৷”

“উনি তো স্নেহ নার্সিং হোমের নিউরোলজিস্ট ছিলেন ৷ আমার ভাই ওনার পেশেন্ট ছিল । কিন্তু আমি শুনেছিলাম উনি মারা গেছেন"

" আরে সেই কথাই তো বলতে এসেছি ৷ কাল আমি যে হাসপাতালে কাজ করতাম ওখানে গিয়েছিলাম ৷ আমার কিছু টাকা এখনো পাওনা আছে ৷ ফেরবার সময় দেখলাম হাসপাতালের সামনে ডাঃ দেবরায় একটা ট্যাক্সিতে উঠছেন ৷”

এত কাছ থেকে দেখেছি ভুল হবার কথা নয় ৷ আর এবার বলবেন না যে ডাঃ দেবরায়ের মতন লোক কোলকাতায় শ খানেক রয়েছে "

আমি সত্যি ই হতবাক হলাম ৷ ভাওয়াল বানিয়ে কিছু বলবেন না ৷ উনি সিরিয়াস প্রকৃতির লোক৷

আর এটাও সত্য ডাঃ দেবরায় আর পাঁচটা বাঙ্গালির মত ছিলেন না ৷ ছ ফুটের  উপর লম্বা ,সাহেবদের  মত গায়ের রং ৷ ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ৷ ছিপ ছিপে চেহারা ৷ অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সেই বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ৷

 " আপনি তো আমায় বলেছিলেন আপনি ওনার স্মরণ সভায় গিয়েছিলেন "আমার কথা শুনে ভাওয়াল একটু ঘাড় নাড়লেন ৷

" আরে সেই জন্যই তো বলছি ৷ উনি তো বেশ সুস্থ সবল ছিলেন ৷ মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবেন কেউ ভাবতে পারেন নি ৷ " 

এরপর একটু চাপা গলায় প্রায় conspiracy  ভঙ্গিতে বললেন " আমি ওনার শ্রাদ্ধে  গিয়েছিলাম ৷ যা শুনলাম তাতে চমকে গেলাম। "

"কি শুনলেন " আমার এই প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন " ওনার পোস্টমর্টেম করার

পর তবে ওনার ডেডবডি পুলিশ আত্মীয় স্বজনকে দিয়েছে "

" সন্দেহ জনক কিছু পুলিস পেয়েছে?"

আমার এই প্রশ্নের উত্তরে ভাওয়াল বললেন যে হাসপাতালে ডাঃ দেব রায় মারা যান ওখান    থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পুনেতে পাঠানো হয়েছে ইমেলে। পরে একটা হার্ড কপি ও পাঠানো হয়েছে।"

খানিকক্ষণ থেমে এদিক ওদিক থাকিয়ে ভাওয়াল যা বললেন তাতে আমি একটু অবাক হলাম। হার্ড কপি নাকি হাসপাতালের এক কর্মচারী পুনেতে গিয়ে দিয়ে এসেছে ৷ প্লেন ভাড়া কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে। "

আমি বললাম " কিন্তু মোকামির ব্যাপারে যতদুর জানি কোন পোস্টমর্টেম হয়নি "

আমার কথা শুনে ভাওয়াল বললেন " মোকামীর মৃত্যু তো ওনার নিজের বাড়িতে হয়েছে আর ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন মোকামির শালার এক বন্ধু যিনি একটা নার্সিং হোমের ডাক্তার ৷"

আমি অবশ্য  মোকামির পোস্টমর্টেম হয়নি অথচ ডাঃ দেবরায়ের ডেড বডির হয়েছে এটাতে  অবাক হবার মত কিছু  পেলাম না ৷ নিশ্চয়ই ডাক্তাররা কিছু ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। টিভি তে যেসব ক্রাইম সিরিয়াল দেখানো হয় সেসব দেখে এখন স্কুলের ছেলেরাও জানে এমন ড্রাগ আছে যা প্রয়োগ করে কাউকে মারলে মনে হবে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে।

                                              ৩

 এরপর যা ঘটল তা কাকতালীয় কিনা বলতে পারব না ৷ আমাদের পাশের গলিতে শ্যামল নস্কর বলে একটি ছেলে থাকত ৷ বিয়ে থা করেনি ৷ বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকত ৷

তার এক ভাই ছিল ৷ আসানসোলে থাকে ৷ কোন একটা কারখানায় কাজ করে ৷ তার সংসার বলতে স্ত্রী ও একটি ছ বছরের ছেলে আছে ৷ শ্যামল কাশীপুর  গান এন্ড শেল ফ্যাকটরিতে কাজ করতো। একদিন অফিস থেকে ফিরে জলখাবার খেতে খেতে হার্ট  অ্যাটাক হল ৷ হাসপাতালে যখন নিয়ে গেল তখন কিছু করার ছিলনা ৷ শ্যামলের গায়ের রং শ্যামল ই ছিল। একটু মোটার দিকে হলেও ভাল স্বাস্থ্যই ছিল ৷ শ্যামলেরও ডেড বডির পোস্টমর্টেম হয়েছিলা ৷ এ খবরটা আমি ভাওয়ালের কাছ থেকে পেয়েছি ৷ শ্যামলের বয়সও ছিল পঞ্চান্ন ছুইঁ ছুই।

                                                 ৪

আমি একটু নেট ঘাঁটাঘাটি করলাম ৷ বিশেষ কিছু পেলাম না। আমেরিকায় কিছু চেনা বন্ধু আছে  যারা মেডিক্যাল ক্রাইম নিয়ে গবেষণা করে ৷ তাদের ইমেলে পত্রাঘাত করলাম ৷ রাত্রেই মেল পেলাম একজনের কাছ থেকে ৷ ও বলল আমেরিকায়ও এরকম ঘটনা ঘটেছে ৷ আমি যা  আন্দাজ করেছিলাম সেটাই হয়েছে ৷ যাদের এরকম আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে তারা সকলেই সুস্থ সবল ছিল। কোন রকম হার্টের প্রবলেম ছিল না ৷ এরকম ফ্যামিলি হিস্ট্রিও ছিল না ৷

প্রত্যেকেরই বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি ৷

শুধু আমেরিকায় নয় অন্যান্য দেশেও এরকম বেশ কয়েকটি  ঘটনা ঘটেছে ৷ কিন্তু তারা সব সময়ে টেররিস্টের ভূত দেখতে পায়  বলে পাত্তা দেয়নি ৷

কিন্তু আমেরিকা বলে কথা! FBI পুরো তদন্তের ভার নিয়েছে ৷ আমার আর একটা প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেলাম ৷ এই সব মৃত ব্যক্তিদের ডুপ্নিকেটও অনেকে দেখেছেন ৷ কিন্তু আলাপ করতে গিয়ে দেখেছেন সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্র। তাই পিশাচ বা এলিয়েন এই সব নিয়ে মাথা ঘামায় নি ৷

ভাওয়াল এসব ব্যাপারে খুব সাহসী নন ৷ ভরসা হয় নি যাদের ডুপ্লিকেট দেখেছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করতে ৷

এই ভাবে যারা মারা গেছেন তাদের কমন ফ্যাক্টর কি এসব বার করার জন্য শার্লক হোমস বা ফেলুদার দরকার হয়না ৷ প্রত্যেকেরই বয়স পঞ্চান্ন বা তার খুব কাছাকাছি ! কারুরি হার্টের প্রবলেম ছিল না ৷

কিন্তু আর কিছু কমন ফ্যাক্টর ? কেউ ব্যবসায়ী ', কেউ ডাক্তার ৷ বেশীর ভাগই সাধারণ মধ্যবিত্ত  বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ৷ আর আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এদের পোস্টমর্টেন রিপোর্টে কেন আগ্রহী? সব পঞ্চান্ন বছরে লোককে কি সাবধান করে দেওয়া উচিৎ ৷ কিন্তু এ ব্যাপারে প্যানিক ছড়ানো উচিৎ নয় আমিও জানি।

                                                    ৫

এবার আমার পরিচয়টা দিয়ে রাখি।

আমার পিতৃদত্ত নাম অমিতেশ পালোধী। সবাই আমাকে অমি বা অমিদা বলে ডাকে। একটি নামকরা সরকারী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলাম। এখন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ডীনের পদে আছি।  আমি সেটির ( Search for extra terrestrial intelligence ) এর সদস্য। স্পেস রিসার্চ , এলিয়েন ও কসমোলজি নিয়ে এখনো গবেষণা ও চর্চা করি ও লেখা লিখিও করি। এই সূত্রে আমার আলাপ হয় ডঃ অরুপরতন গুপ্তরায়ের সঙ্গে। আমি যে কলেছ থেকে স্নাতক হই ডঃ গুপ্ত রায়ও ওই কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন। খুবই কৃতী  ছাত্র ছিলেন ৷

পরে ডাক্তার হন। আমেরিকার এক নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে নিউরোলজি তে MD করেন। এখন কোয়ান্টাম মেকানিকস আর কনসাসনেস এই নিয়ে আমেরিকা ও জার্মানীর দুই বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণা করছেন ৷  নাসাতে ও কয়েকবার গিয়েছিলেন। আমি জানতাম না ওরাও গবেষণা করছে এলিয়েনরা যদি সত্যি পৃথিবীতে আসে তাদের চেতনা বা মস্তিস্ক আমাদের থেকে কত উন্নত হবে নাকি তারা শুধু মেশিন এ ব্যাপারে ৷

ডঃ গুপ্তরায় এখন কোলকাতায় আছেন। বাইপাসের ধারে একটি নামী দামী হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগে কনসাল্টান্ট হিসেবে। আমি ডঃ গুপ্ত রায় কে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলাম রবিবারে বিকেলের জন্য। উনি বললেন কোন অসুবিধে নেই। চারটে থেকে ছটা উনি ফ্রী আছেন ৷

রবিবার ঠিক চারটেতেই আমি হাজির। ডঃ গুপ্তরায় তখন প্যান্ট শার্ট ও একটা হাফ হাতা সোয়েটার পরে বসে ছিলেন ড্রয়িং রুমে ৷

উনি আপাদমস্তক ভদ্রলোক। আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বসতে বললেন। এর পরে যা  বললেন আমি একটু আশ্চর্ষ হলাম। "আপনি নিশ্চয় কয়েক জন পঞ্চান্ন বয়সী সুস্থ লোকদের হঠাৎ হার্ট অ্য৷টাকে মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছেন।"

 আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে উনি বললেন, " আপনার এ বিষয়ে একটা লেখা আমি পড়েছি। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে ইলেকশন চলছে বলে সাংবাদিকরা এ ব্যাপারটার যে কোন  নিউস ভ্যালু আছে বলে মনে করেনি ৷ আর আমরাও চাইনি এ ব্যাপারে প্যানিক ছড়াক ৷  অনেকে হয়ত এটা দ্বিতীয় কোভিডের আক্রমণ হিসেবে  আতঙ্ক ছড়াতে পারে ৷ তবে একটা জিনিস আমি কাকতালীয় মনে করিনা”। " পঞ্চান্ন বয়সের ব্যাপার টা কি "

" ঠিক ই ধরেছেন। দেখুন মেডিক্যাল সায়েন্স এখনো পদার্থ বিদ্যা হয়ে উঠেনি। তা ছাড়া এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দৌলতে আমরা জানতে পারি অতি ক্ষুদ্র বস্তুর জগৎ একটা সম্ভাবনার জগত ৷ দেখুন লোকে যে কোন বয়সেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি গড় হিসেব ধরেন তবে বেশীর ভাগ লোকেরই হার্টের প্রবলেম শুরু হয় পঞ্চান্নের পর। এর পর অনেকেই হার্টের ওষুধ খেতে শুরু করেন ৷ তবে খুব অল্প লোকই সত্তরের গন্ডী পেরুতে পারেন। " আমি বললাম " আমি ও তাই দেখছি। আমার অনেক পরিচিত লোক ঠিক আটাত্তর, উনসত্তরে এসেই মারা গেছেন। হয় ক্যানসার বা কিডনির অসুখে ভুগে।"

" আপনি গিলগামেশ প্রজেক্টের নাম শুনেছেন "

আমি ডঃ গুপ্তরায়ের কথা শুনে অবাক হলাম। এই প্রজেক্টের নাম শুনেছি। এটাতো মানুষ কে অমর করার প্রজেক্ট। ডঃ গুপ্তরায় কে এটা বলাতে উনি হেসে বললেন " এখন এটাকে সায়েন্স ফিকশন মনে হয়। তবে আপাততঃ এর উদ্দেশ্য হল মানুষের জীবন কে দীর্ঘায়িত করা। শুধু তাই নয় যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে তত দিন যৌবন না ফিরে পেলেও বার্ধক্যে  এলেও শেষ জীবন ঠিক পঞ্চান্ন বয়স লোকেদের মতনই সবল ও কর্মক্ষম থাকবে ৷"

আমি বললাম "তাহলে কি …"

আমার মুখের কথা শেষ না হতেই ডঃ গুপ্ত রায় বললেন " আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি ৷ পঞ্চান্ন বছর বয়স অথচ সম্সূর্ণ সুস্থ লোকদের হঠাৎ হার্ট ফেল করে মারা যাওয়া , তাও আবার বিভিন্ন দেশে ,এর মধ্যে কি কোন রহস্য বা বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে এই প্রজেক্টের সঙ্গে। দেখুন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরী হয়েছে। প্রায় একশ জন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এর সদস্য। নাসার প্রতিনিধিরা ও ভারত থেকে চারজন বিজ্ঞানী এর সদস্য। আমি এই চারজনের মধ্যে আছি। "

পরশু  প্রাগে একটা মিটিং আছে। আমি কালই প্রাগ যাচ্ছি। আপনাকে অনুরোধ করছি এখনই এবিষয়ে কিছু লিখবেন না। নাসা থেকে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত করা হবে ৷"নাসার কথাা শুনে আমার মনে যে সন্দেহ দানা বাঁধছিল সেটা আরো দৃঢ হচ্ছে। একটা সম্বন্ধ থাকতে পারে যদি এটা মহাকাশচারীদের সমস্যা হয় ৷ কিন্তু আমি যতদূর জেনেছি যেসব লোক পঞ্চান্ন বছরে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছেন তাঁদের কেউই মহাকাশচারী তো দূরের কথা নাসা , ইসরো বা এরকম কোন স্পেস প্রোগামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অবশ্য কোন মহাকাশচারী বা স্পেস এজেন্সীতে এরকম মৃত্যু ঘটলেও নিশ্চয় তারা এটা প্রেস কনফারেনন্স করে ঘোষণা করবে না। আর হ্যাঁ এই সব ভিক্টিমদের ( আমি ভিক্টিম ই বলছি কারণ আমার মনে হয় কোন না কোন ভাবে এরা ভিক্টিমই ) মধ্যে কোন মহিলা নেই। অন্তত ডঃ গুপ্তরায় এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি। আর ওই ডুপ্লিকেটের ব্যাপারটা?

                                                           ৬

আমি ডঃ গুপ্তরায়ের বাড়িতে এসেছি উনি প্রাগ থেকে ফেরার দুদিন পরেই। সকালে ফোন করেই এসেছি। উনি দুদিন পরেই টেক্সাস চলে  যাবেন। আমায় বললেন একটা জরুরী মিটিং আছে ৷

ওনারা পঞ্চান্ন রহস্যর সবটা না হলেও অনেকখানি সমাধান করেছেন। তবে পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে প্যানিক না ছড়ায় এবং এই ব্যাপারে যাতে কোন বিশেষ দেশকে যাতে দোষারোপ না করা হয় সে বিষয়ে সব বিজ্ঞানী সহমত। বিশেষ করে বার্ড ফ্লু ও কোভিডের ব্যাপারে যেটা হয়েছিল। বার্ড ফ্লু তে কিন্তু একজনও ভারতীয় মারা যান নি। এটিও রহস্য থেকে গেছে।

আমি যখন ডঃ গুপ্তরায়ের ড্রয়িং রুমে ঢুকি তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল পড়ছিলেন৷ আমাকে দেখে ফাইল বন্ধ করে বসতে বললেন। " আপনি  পারসোনালাইজড মেডিসিনের কথা শুনেছেন" ওনার কথা শুনে বুঝতে পারলাম পঞ্চান্ন রহস্যের সঙ্গে নিশ্চয় এর সম্পর্ক আছে। “আমি একটু পড়াশুনা করেছিলাম এ ব্যাপারে। মনে হয়েছিল আমাদের কবিরাজী চিকিৎসার সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে।” " খুব একটা ভুল বলেন নি।" আমার কথার উত্তরে উনি যা বললেন তাতে আমি খুব আশ্চর্য হলাম না।

" তাহলে নিশ্চয় জানেন Allopathy তেও এখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন বিশেষ অসুখের জন্য সব লোককে একই ওষুধ দেওয়া হচ্ছেনা। তার সমস্ত মেডিক্যাল চেক আপের পরও ডি এন এ টেস্ট করে তবে একজন রোগীকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। এখনও সমস্ত ডাক্তাররা তা করেন না তবে অদূর ভবিষ্যতে এটা একটা must হবে বলতে পারেন।"

"কিন্তু এর সঙ্গে পঞ্চান্ন…… " আমার কথা শেষ না হতেই উনি বললেন “কোন বিশেষ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ওটা সত্যি "     

" তার মানে এই পঞ্চান্ন রহস্যের পিছনে ও একই কারণ "

" ঠিক তাই। আপনি তো জানেন যত দিন আমরা বেঁচে থাকি আমাদের শরীরে ডি এন এর মিউটেশন হয়। অনেক মিউটেশন ই শরীরের পক্ষে খারাপ। যেমন এর ফলে ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ হয়। কিন্তু কিছু মিউটেশনে শরীরের কোন ক্ষতি হয়না বরং শরীরে পক্ষে এই সব মিউটেশন   উপকারী।"

" তাহলে পঞ্চান্ন রহস্যের পিছনে কি এই ডি এন এ মিউটেশনের কোন যোগ আছে"

 

আমার প্রশ্ন শুনে ডঃ গুপ্তরায় যে ফাইলটা পড়ছিলেন সেটা দেখিয়ে বললেন " আপনার প্রশ্নের উত্তর এই ফাইলটাতেই আছে। যারা আপনার এই পঞ্চান্ন রহস্যের ভিক্টিম তাদের শরীরের ডি এন এ তে হুবহু একই রকমের মিউটেশন হয়েছিল। এটার সম্ভাবনা এত কম যে আমরা কেউ ভাবতে পারিনি যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। তবে পৃথিবীর জন সংখ্যা এখন প্রায় আটশো কোটির কাছাকাছি। তার মধ্যে একশ বা দুশ লোকের ক্ষেত্রে এটা ঘটা অসম্ভব নয় ৷ যদিও আপনার পাড়ায় তিনটে লোকের মধ্যে এটা কি করে ঘটল তা আমি জানি না। "

"কিন্তু এদের মৃত্যু হল কি ভাবে? "

" ভাইরাসে "

" ভাইরাস "

আমার কথা শুনে ডঃ গুপ্ত রায় বললেন " পারসোনালাইজড মেডিসিন যেরকম পারসোনালাইজড ভাইরাস"

" কিন্তু এই ভাইরাস এল কোথা থেকে? আবার চায়না থেকে নয় তো? "

" না! তার সম্ভাবনা খুব কম। চায়না তে মোটে দশ জন আপনার এই পঞ্চান্ন রহস্যের ভিকটিম। আমরা জানতে পেরেছি কোন একটি দেশের মহাকাশচারী পৃথিবীতে ফিরলে হঠাৎ তার মৃত্যু হয়। হার্ট ফেলিওর। বয়স পঞ্চান্ন। কোন হার্ট প্রমলেম ছিল না। কোন ওষুধ খেত না" আমি কিছু বলবার আগেই ডঃ গুপ্ত রায় বললেন " না দেশটির নাম এখন জানতে চাইবেন না " আমি বললাম " তার মানে এই ভাইরাস অন্য গ্রহ বা অন্য গ্যালাক্সি থেকে আসতে পারে?"

" দেখুন এব্যাপারে এখনো কিছু নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না। নাসা থেকে আগামী সপ্তাহে একটা বিবৃতি দেওয়া হবে। ওটার খসড়া লেখার ভার আমাকেই দেওয়া হয়েছে।”

                                                        ৭

নাসার বিবৃতি  পৃথিবীর সব টিভি চ্যানেলেই দেখানো হয়েছিল। অবশ্য আমি গুপ্তরায়কে দেখলাম না। নেদারল্যান্ডের একটি মেয়ে বিবৃতিটা পাঠ করল। যে ভাইরাস কিছু পঞ্চান্ন বয়স্ক লোকদের মৃত্যু ঘটাচ্ছে সেটি এলিয়েন ভাইরাস। সমস্ত পঞ্চান্ন বয়স্ক লোকদের ভয় পাবার কিছু নেই। তবে প্রত্যেককে ডি এন টেস্ট করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। যাঁদের এই টেস্ট করার মত আর্থিক সামর্থ নেই ইউনেস্কো থেকে তাদের টেস্টের পয়সা দেওয়া হবে। আর এই ভাইরাসের যে  antidote  তা সমস্ত দেশের  বিজ্ঞানীদে  যৌথ প্রচেস্টায়  তৈরী করা সম্ভব হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের ডুপ্লিকেট দেখার যে সব খবর এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা নিয়ে সবরকম তথ্য ও সম্ভাবনা আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্সের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখন ও এরা এলিয়েন মনে করে ভয় পাবার কিছু নেই ৷

এই বিবৃতি শুনে লোকেরা আশ্বস্ত হবে না আরো আতঙ্কিত হবে তা বুঝতে পারলাম না। 

                                       ৮

নাসার বিবৃতি দেবার পর প্রায় দশ দিন কেটে গেছে ৷

ডঃ গুপ্তরায়ের কোন খবর নেই। বাড়িতে,চেম্বারে ও হাসপাতাল সমস্ত জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। কেউ কিছু  জানে না। ডঃ গুপ্তরায় অকৃতদার। ওনার ভাইজি পুলিসকে জানিয়েছে, কিন্তু তারাও ক্লু লেস। ভারত সরকার থেকে নাকি নাসাকে অনুরোধ করা হয়েছে ডঃ গুপ্তরায়ের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে ,আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে ওঁর অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করার জন্য। আমার মনে যে সন্দেহটা আগেই এসেছিল তা এখন দানা বাঁধছে। ওরা আসতে শুরু করেছে, আমাদের বিকল্প  হিসেবে ৷ 

চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট এবং তার সহায়তায় তৈরি চিত্র

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb