প্ল্যানেট এক্স

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়



-হ্যালো, আই অ্যাম অগাস্টিন মুরিয়ার। আয়াম ওয়েটিং অ্যাট ওর ডোর।

সাতসকালে নীলমাধব সেনের মোবাইলে এই মেসেজ। মেসেজ মানে টেক্সট। হাঁ করে আছে নীলমাধব। কিছু বুঝতেই পারছে না। এই যে লিখেছে অ্যাট ওর ডোর তার মানে তার দোরগোড়ায়। তা দোরগোড়ায় এসে মানুষ কী করে? হয় কলিং বেল বাজায় আর নয় তো নক করে। অথবা মোবাইল নম্বরে রিং করে। মোবাইল নম্বর জানে যখন তখন রিং না করে টেক্সট কেন? টেক্সট আমরা করি হয় কেউ ফোন না ধরলে অথবা যেখানে রিং করা হচ্ছে সেখানে কোনও অসুবিধার জন্যে হয়ত কল রিসিভ করেও কেউ শুনতে পারছে না। কিন্তু এই লোকটা মানে কোনও অপরিচিত এক মিঃ অগাস্টিন নাকি নাম সে একেবারে টেক্সট করে দিয়েছে। ভারি অদ্ভুত লোক তো। সে যদি এখন মেসেজ না খুলত? কিংবা আজকেই না খুলত? কিংবা আগামী এক সপ্তাহ বা মাস না খুলত অদরকারী মেসেজ বলে? তাহলে কি মাসখানেক ধরে বা অনন্ত কাল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত?

প্রথমেই লোকটার চরিত্রের একটা পরিচয় পাওয়া গেল সে পাগল। কিন্তু পাগল হোক বা যাই হোক এই অগাস্টিন নামটা বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করল তার মনে। লোকটা বাঙ্গালি বা ভারতীয় নয় মনে হচ্ছে। ইউরোপিয়ান কোনও দেশের হতে পারে। অথবা আফ্রিকান। কী আমেরিকান। কিন্তু এমন অবাক করা নামের মালিক এই সাতসকালে তার কাছে কেন?

মোবাইল নম্বর তো ছিলই এখন নিজেই রিং করল নীলমাধব।

-হ্যালো। হু আর ইউ?

ওপ্রান্ত গোদা বাংলায় বলল, নাম তো বলেছি স্যার।

-বাঙ্গালি নাকি?

-প্লিজ-

নীলমাধব দরজা খুলে বাইরে এল। বাইরে এক অদ্ভুত পোশাক পরা অদ্ভুত লোক দাঁড়িয়ে।

-হাই! আমি অগাস্টিন-

বাধা দিয়ে নীলমাধব বলল, আমি নীলমাধব সেন। প্লিজ কাম ইন।

-বাংলায় বলতে পারেন।

-আপনি বাঙ্গালি নাকি? কথাটা দ্বিতীয়বারের জন্যে বলল নীলমাধব, কিন্তু পোশাক আশাক তো-

অগাস্টিন হেসে বলল, ঠিক আন্দাজ। আমি আপনার দেশের তো নইই এমন কি এই পৃথিবীরও নই।

--এলিয়েন। কথাটা নীলমাধবের মনের মধ্যে থেকে কেউ বলল।

-তবে আপনি বাংলায় বলতে পারেন এই জন্যে কারণ এতে একটা ইন্টার-ইউনিভার্স ইন্টারপ্রিটার লাগানো আছে। যেকোনো ভাষাকে যেকোনো ভাষায় রূপান্তরিত করে দেবে। তাই ভাষা নিয়ে আমাদের লড়াই করতে হয় না।

-কিন্তু আপনি স্যার-

-হ্যাঁ একটা দরকারে এসেছি। খুব ভালো করে দেখলে দরকারটা অবশ্য আমার থেকে আপনার বেশি।

-কেন?

-কারণ আপনি একবার খুব মুশকিলে পড়েছিলেন। তিনদিন ব্যাংক স্ট্রাইক ছিল। এমন কী এটিএম পর্যন্ত। আপনার জামাই এসে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে আপনার ক্যাশ টাকার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। আপনি চূড়ন্ত নাকাল অবস্থায় পড়েছিলেন। সত্যিই তো। তার ব্যাংকের সেভিংস একাউন্টে মোটা টাকা। পকেটে এটিএম কার্ড। অথচ আপনি অর্থহীন অবস্থায় অর্থপূর্ণ এক বিপদে পড়ে গেলেন। সেবার অবশ্য এক প্রতিবেশির কৃপায় রক্ষা পেয়েছিলেন তাই। নাহলে-

লোকটা মানে অগাস্টিনের কথা তখন কানে যাচ্ছিল কিনা নীলমাধব জানে না। কারণ সে নিজেই তখন অতীতের এক বিশ্রী দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। দৃশ্যটা যখনই মনে পড়ে তখনই গা যেন রি রি করে ওঠে। পরিতোষের বাড়িতে ছুটে যেতে হয়েছিল সেই দুপুর বেলায়। যে পরিতোষ আর তার বৌ মণিমালাকে প্রচন্ড অপমান করেছিল কিছুদিন আগেই।

তবু পরিতোষ তাকে সাহায্য করেছিল আর সে বেঁচেছিল অপদস্থ হওয়ার হাত থেকে।

কিন্তু এই লোকটা জানল কী করে? এই লোকটা কি উকিল নাকি? পরিতোষ কি তার বিরুদ্ধে মান হানিটানি কিছু করার ষড়যন্ত্র করছে নাকি?

-আরে না না তা করবে কেন? পরিতোষবাবু অমন লোকই নন। আপনি মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। তিনি সত্যি একটা খাঁটি মানুষ। একেবারে আপনাদের ভাষায় জাস্ট হীরের টুকরো।

বার বার এই লোকটা আপনাদের আপনাদের করছে কেন? সে কি সত্যি এ পৃথিবীর কেউ নয়? অন্য জগত থেকে এসেছে? যা অদ্ভুত জবড়জং পোশাকে সেজেছে তাতে তার সে দাবী মানতেই হয়। কিন্তু নীলমাধবের সব কথা সে আগে থেকে জেনে যাচ্ছে কী করে? আবার তার মনের ভেতরে যেটা আছে তাও?   

মাথাটা ঘুরছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে যা দেখছে সেগুলো সত্য নয়। অলীক স্বপ্ন।

-স্বপ্ন নয় স্যার। একেবারে ঘোর বাস্তব। অগাস্টিন বলল, আমি জেনেছি আপনি আজ ছুটিতে আছেন আর আপনার স্ত্রীও আপনার কাজ থেকে ছুটিতে আছেন মানে ওনার বাপের বাড়ি আছেন। তাই আপনি ফ্রি আছেন।

এটাও জানে? ভ্রূ কুঁচকে কপালে খুব পুরু কটা রেখা পড়ল নীলমাধবের।

লোকটি আবার বলল, স্যার আপনার জন্যে গাড়ি এনেছি। আমার সঙ্গে আউটিং যেতে আপত্তি নেই তো?

তা নেই। কী আর করা যাবে ছুটির দিনে বসে বোর হতে হবে। এমন সময় আউটিং খারাপ লাগবে না। কিন্তু লোকটা যে বলল গাড়ি সেটা কোথায়?

লোকটা তার মনের ভেতরে থাকা প্রশ্ন টের পেল। আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে স্যার। দ্যাট ইজ আওয়ার কার।

নীলমাধবের মনে হল একটু বেড়িয়ে আসাই যাক না। সময় বেশ কাটবে এই আজব লোকটার সঙ্গে গল্প করে। তবে লোকটার ক্ষমতা বেশ আছে বোঝা যাচ্ছে। তার সম্পর্কে তাকে কিছু বলতে হচ্ছে না লোকটাই সব বলে দিচ্ছে।

কিন্তু গাড়িটা তো আকাশের সেই টঙে। উঠবে কী করে? এটাও বুঝে গেল লোকটা। বলল, তুমি চিন্তা করবে না নীলমাধব।  গাড়ি আমাদের কাছে না আসে তো আমরা গাড়ির কাছে যাব।

গাড়ির ঠিক নিচে এসে তারা দাঁড়াল। অমনি সবুজ একটা আলো এসে পৌঁছে গেল তাদের ঠিক মাথার ওপর আর তারা সোঁ করে আকাশে উঠতে লাগল। প্রচন্ড গতিতে যাবার জন্যে অবশ্য নীলমাধবের একটুও লাগল না। তারা ঢুকতেই সেই আলোর রেখাটাও সোঁ করে গুটিয়ে ওপরে উঠে গেল।

ভেবেছিল ভেতরটা ভারি সুন্দর একটা প্লেনের মত হবে। কিন্তু তাকে অবাক হতে হল কারণ সেটা যেন আর একটা পৃথিবী। তবে পৃথিবী না বলে বলা উচিৎ আর একটা গ্রহ। পৃথিবীর যেমন ভৌগোলিক আকার, আয়তন বা পরিবেশ আছে তেমন কিছু নেই। বরং চাঁদের পৃষ্ঠতলের মত মনে হয় তবে অতটা এবড়োখেবড়ো নয়। গাছপালা যা চোখে পড়ল দেখে মনে হল সেগুলো সিন্থেটিক। জল-জঙ্গল পশু-পাখি কিছুই নেই মনে হয়।  

কিন্তু সেখানে যে এই অগাস্টিন মুরিয়ারের মত আরও কিছু অদ্ভুত পোশাক পরা লোক বাস করে তা ঠিক। কারণ তারাও এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নীলবাবু (নামটা একটু ছোট করেই নেওয়া গেল) বলল, আরে এটা তো দেখছি একটা-

আগেই বুঝে যাওয়া লোকটা বলল, গ্রহ- এর নাম প্ল্যানেট এক্স।

চমকে চ হয়ে যাওয়া নীল বলল, কিন্তু এটা কোথা থেকে কেমন করে এল? গ্রহ কি চলতে পারে?

-চালাতে জানলেই চলতে পারবে। অগাস্টিন বলল, এই যে আমি একটা-

বলেই আচমকা সে নীলের মানে নীলমাধবের হাতের মুঠো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে করমর্দন করল আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল নীল। যেমন ঠান্ডা তেমন শক্ত।

মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, একি! এত ঠান্ডা কেন?

মনে হয় দেহটা বরফ দিয়ে তৈরি। ভূত নাকি? কিন্তু ভয়ে বলতে পারল না।

-তাই বলে ডেডবডি নয়। অগাস্টিন মুরিয়ার বলল, আসলে আমি জিংক, টাইটেনিয়াম, ক্রোমিয়াম আর স্টিল এই চারটে ধাতু দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি। কিছুটা আছে আবার সিন্থেটিক। আমাদের গ্রহের স্টীল তোমাদের মত শক্ত নয়। এটা বেশ পেলব। কারণ আমাদের গ্রহে কার্বন তেমন পাওয়া যায় না। তাই লোহায় যতটা পরিমাণ কার্বন দিয়ে শক্ত স্টীল কর তোমরা আমরা ততটা পারি না। কিন্তু এগুলো খুব মেলিয়েবল মানে মোলায়েম হয়। রোবটের দেহ তো একটু মোলায়েম না করলে হয় না বোঝোই তো?

আবার নীলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তার মানে রোবট?

অগাস্টিন শুধু হাসল। এটা একটা বাগানের মত। সিন্থেটিক সবুজ গাছে ভরা। নীল আগেই দেখেছে তাতে বসে আছে আরও অনেক অগাস্টিন মানে তার মত দেখতে কিছু মানুষ। তারাও হাসল। এই অগাস্টিন মুরিয়ার লোকটা রোবটের ফেরিওলা নয় তো? গ্রহে গ্রহে ঘুরছে আর রোবট বিক্রি করছে?

-কিন্তু রোবট তো আমার কাছে কেন? আমি তো রোবটের অর্ডার দিই নি? আর আমার কোনও ফ্যাক্টরিও নেই যে তাতে রোবট মজুর লাগবে?

-আরে না না তা কেন? দরকার তো আমাদের।

কিন্তু তার মত একটা কম্পিউটার কি-বোর্ডে খট খট করা অফিস কর্মচারির কাছে এর আবার কী দরকার থাকতে পারে? অফিসে আলোচনায় শুনেছে একটা রোবটের নাকি অনেক দাম। কাতর হয়ে বলল, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। আমি সাধারণ মানুষ। অফিসের সামান্য মাইনের এসিস্ট্যান্ট। মুক্তিপণ চাইলে আমার বৌ দিতে পারবে না। বৌ চাকরি করে না শুধু সাজগোজ করে মাত্র।

আবার সবাই মানে বসে থাকা বা ঘুরে বেড়ানো অন্য অগাস্টিনের দল হো হো করে হাসি উঠল সমস্বরে। সে কী হাসির ধূম!

নীল বলল, এরা হাসছে কেন? আমি কি কোনও রম্যকাহিনি বলছি?

-না না, আশ্বস্ত করল অগাস্টিন, আসলে ওদের মেমারিতে হাসির প্রোগ্রামিং করা আছে। যে যে মুহূর্তে যে যে কথা ভাসবে সেই সেই শব্দ ধরে নিয়ে ওরা হাসবে, কাঁদবে বা অন্যান্য ইমোশন ফুটিয়ে তুলবে। এই যেমন ধর তুমি হাসির গল্পের লেখক। মানে অফিসের কাজ সেরে তুমি হাসির গল্প লেখো আর কী। তোমাকে শুধু অনুগল্প পাঠ করার জন্যে স্টেজে তোলা হয়। কারণ তাতে সময় কম লাগে। একটা ছোটগল্পের লেখকের জায়গায় দশ বিশটা অনুগল্পের লেখককে অনায়াসে স্টেজে তোলা যায়।

মাথামুন্ডু কিছুই বুঝল না নীল। রোবটেরা আবার অনুগল্পটল্পও বোঝে নাকি?

-বোঝে সব বোঝে। মুরিয়ার বলল, যেমন করে মানুষ কিছু বলার আগেই রোবট সেটা বুঝে ফেলে ঠিক তেমন করে বোঝে।

বাবারে বাবারে এরা তো সাংঘাতিক লোক। এদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।

-সে যাই হোক। যেটা বলছিলুম। ধর তুমি স্টেজে হাসির গল্প পড়ছ। কিন্তু কিছু শ্রোতার ঘুম পাচ্ছে আবার কিছু শ্রোতার কান্না পাচ্ছে।

হাসির অনুগল্প তো লেখে নীল। অফিসের কাজের ফাঁকেই লেখে। তবে পড়ার সুযোগ হয় নি কোনও মঞ্চে। অফিসেই পড়ে। সহকর্মীদের শোনায় বা কখনও অফিসে কাজে আসা লোকেদের। কিন্তু তারা কাজের ছুতোয় ঠিকরে গেলেও কেউ তো কাঁদে না। তার মানে তার গল্পের অপমান করা হচ্ছে। আর করছে কে? না মানুষের তৈরি করা একটা রোবট।

খুব রেগে গিয়ে বলল, অগামারা তোমার এত সাহস! সামান্য রোবট হয়ে মানুষের কাজের সমালোচনা করছ?

নির্লজ্জের মত হেসে লোকটা বলল, অগামারা নয়। অগাস্টিন মুরিয়ার। এ থেকে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তোমার রসবোধ আছে। এই দেখ আমাদের এই গ্রহের সব লোক হেসে উঠছে।

সত্যি তাই হল। একেবারে অট্টহাসিতে ফেটে যায় আর কী চারিদিক।

অগাস্টিন আবার বলতে শুরু করল, তাহলে বুঝতেই পারছ এদের মেমারিতে কেমন ভাবে আর কোথায় হাসতে হবে তার সূক্ষ্ম প্রোগ্রামিং করা আছে? শুধু হাসির নয় কান্না বা অন্য অভিব্যক্তি সেটা তো আগেই বলেছি। ধর তুমি শুনলে কেউ মারা গেছে। কিন্তু তুমি তো ইঁদুর দৌড়ের অভিনেতা। তোমার অত সময় কোথায়। তাছাড়াও বিষয়টা যে শোকের না আনন্দের সেটাও তো বোঝা চাই আর বুঝতে সময় লাগে। ততক্ষণে তো সংবাদ দাতা যা বোঝার তা বুঝে নেয়। হয় তোমাকে পাগল ভাবে আর নয় আহাম্মক।

দাঁত চেপে কড়মড় করে নীল বলল, তা সেখানে কে কী করবে?

-বলছি। তুমি কিছু ডিজিট্যাল রোবো মানে রোবট ভাড়া করে রাখতে পার। এরা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকবে কিন্তু ডিজিট্যাল ভাবে মানে অলীক ভাবে। কিন্তু যখন তুমি সিগন্যাল দেবে বা এরা বুঝবে তখন এদের থ্রি ডি ছায়া তোমার নির্দেশ মত জায়গায় এসে যাবে আর দরকার বুঝে হাসবে বা শোক প্রকাশ করবে। ধর তোমার হাসির গল্পের বই রিলিজ হচ্ছে। নমুনা হিসেবে তোমার গল্পের একটা অংশ যেখানে খুব বেশি হাসির কথা আছে সেটা পড়ছ। কিন্তু পাঠক তখন হয় ঘুমোচ্ছে আর নয় মোবাইল ঠেলছে আর নয় বসে বসে ভাবছে তোমার লেখায় প্রতিক্রিয়া জানানোটা তাদের সঠিক হবে কিনা। এই জানতে জানতে হাসির সিকোয়েন্স পার হয়ে যায়। আর জানো তো লোহা গরম থাকতেই তাকে পিটতে হয়? ঠাণ্ডা হলে আর কাজ হয় না। তাই ঠিক এই মুহূর্তেই হাসিটা তোমার খুব দরকার। হাসির সঙ্গে ক্ল্যাপ মানে হাততালি। তোমার বই থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা পাঠকও তোমার বই পড়বে তখন।

বেশ একটু মজা লাগল নীলের। এ তো বেশ ভালো। আসলে তার বই লোকে পড়েই না। পড়লে তবেই তো জানবে এর মধ্যে কী আছে? তবে এবারে রোবট দিয়ে বইয়ের কাটতি বাড়ানো যাবে। বলল, আর?

আবার ধর কেউ একটা দুঃখের গল্পের বই লিখেছে। তার রিলিজ হচ্ছে। বই বিন্দুমাত্র পাতা না উল্টেই আমার রোবোপাঠক ঠিক বুঝে যাবে বইয়ের কোন জায়গায় কত দুঃখ আছে। তারা সেই সব জায়গা ধরে কান্না বা স্যাড ইমোশন দেবে। আর শুধু বই বিক্রি কেন যত কমোডিটি বা ভোগ্যপণ্য আছে সব কিছুর এই রোবট বিজ্ঞাপনে অনেক বেশি সেল হবে।

চুপ করে ভাবছিল নীল। সত্যি রোবটের কত ব্যবহার। আর আমরা তাকে মিছেই খারাপ ভাবছি। তবে এই হাসি কান্নার ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না। মানুষের মনের অনুভূতির ব্যাপারে সে কেন হাত বাড়াবে।

মুখ ফুটে বলতে হল না। বুঝে গেল সেই অগামারা রোবট মানে অগাস্টিন মুরিয়ার। হেসে বলল, আসলে মানুষ এখন তার মনের ভাব ভুলে গেছে গো। অনুভূতি আর অনুভূতির প্রকাশ সে ঠিকমত করা তো দূর সে ভাবতেই পারছে না। আমরা সেই সেই ব্যাপারে তাদের শিক্ষিত করব আর দরকার মত তাদের রোবট সরবরাহ করব।

একটা ব্যাপারে সন্দেহ হল নীলের।

-তুমি বলতে চাইছ তোমার পাশের লোকটা তোমার হয়ে হাসলে বাকি লোকে তোমাকে বোকা ভাববে? আরে না না। বলেছি না আমার এই রোবট একেবারে ডিজিট্যাল হবে। সে ফিজিক্যালি মানে শরীর ধরে তোমার পাশে পাশে যাবে না। যাবে শুধু অস্তিত্ব হিসেবে। সেই হাসবে, কাঁদবে বা শোক আনন্দ এসব প্রকাশ করবে কিন্তু সেটা প্রকাশ পাবে তোমার মুখে আর শরীরে।

এতক্ষণে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল নীলের। বলল, তা আমাকে এখন কী করতে হবে?

-ট্রেনিং নিতে হবে আর কী, হেসে বলল অগাস্টিন, এই গ্রহটা আমরা বানিয়েছি সেই উদ্দেশ্যেই। আমরা মানুষের সমস্যা শুনব তার পরে তার ব্যবস্থা করব।

-ব্যাবস্থা করবে মানে?

-মানে ধর একটা খুব খারাপ লোকের সঙ্গে রাস্তায় তোমার দেখা হয়ে গেল। তোমার তাকে খুব পেটাতে ইচ্ছে করছে। তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারছ না ঠিক ভাবে। রাগ প্রকাশ হয়ে গেলেও ব্যাপারটা গাড়ু হয়ে যাবে। মানে সেই হয়ত পিটিয়ে দেবে তোমাকে। তখন তোমার সঙ্গে থাকা ডিজিট্যাল রোবট ঠিক বুঝে যাবে কী করতে হবে। করতে হবে মানে কিছুই সে করবে না। কিন্তু সে তোমার মুখের ভাব আর শরীরের যাকে বলে বডি ল্যাংগুয়েজ আর কী সেটা বানিয়ে দেবে তাতে সেই লোকটি সুড় সুড় করে চলে যাবে।

চুপ করে ব্যাপারটা ভাবতে লাগল নীল। অগাস্টিন বলে যেতে থাকে, আবার যদি তুমি কারোর কাছ অনেক টাকা ধার করে শোধ দেওয়ার নাম কর না। মানে এক কথায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে চাও তবে সে তোমার ঠিক ঠাক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করে দেবে।

-আর আমার পাবলিশার-

কথা শেষ হল না নীলের। মুরিয়ার বলে উঠল। ধর তোমার প্রকাশক অনুগল্প লিখিয়ে কি অনুবাদ করিয়ে হাত উল্টে বসে আছে-

নীল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ব্যাপারটা-

অগাস্টিন হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ তার সমাধান আছে। আমার ডিজিট্যাল রোবো তোমার পাশে থেকে তোমার হাত দিয়ে ই-মেল লিখিয়ে নেবে। দেখবে প্রকাশকের বন্ধ মুঠোর জিনিস তোমার খোলা মুঠোয় এসে পড়বে। কিন্তু একি, কথায় কথায় যে অনেক লাইট ইয়ার পার করে এসেছি।

-এই রে আমি তবে-

-ভয় নেই ভয় নেই। তোমার এই রোবো বন্ধু নামে অগামারা হলেও কাজে তা নয়। তোমাকে আমরা টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডে তোমার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। নিজের বিছানাতেই নিজেকে পেয়ে যাবে তুমি। বিদায়- প্ল্যানেট এক্স কিন্তু আবার আসবে মনে রেখ। আর মনে রেখ প্ল্যানেট এক্স- যে গ্রহ শুধু নিজের হুকুমে চলে। নক্ষত্রের হুকুমে নয়।

নিজের বিছানায় শুয়ে নীল ভাবতে লাগল এই যা টেলিপোর্টেশন জিনিসটা খায় না গায়ে মাখে সেটা তো জানা হল না। অমনি অগাস্টিনের গলা ভেসে এল, বস্তুকে শক্তিতে পরিবর্তন করে রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে আবার তাকে বস্তুতে পরিণত করা গো। হা হা হা।

আরে অগাস্টিন সত্যিই তার মনের কথা বোঝে। ঠিক এমন একটা রোবো তার চাইই চাই।

চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট এবং তার সহায়তায় তৈরি চিত্র

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb