জিনবাহিত

লেখক - ড. জয়শ্রী পট্টনায়ক

                                                 

লাজে রাঙ্গা হল কনে বউ গো

মালা বদল হবে এ রাতে …………………           

বিয়েবাড়ির হৈ চৈ………আনন্দে মুখরিত ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশ পেরুর এক ছোট্ট গ্রাম প্যারান।    

আজ সবার আদরের রোজা মারিয়ার বিয়ে। বর আসবে পেরুর লিমা শহর থেকে। শিক্ষিত সুশীল লরেঞ্জো, রোজা মারিয়া কে পছন্দ করেছিলো পাশের গ্রামের কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। মন দেওয়া নেওয়ার পালা শেষ পর্যন্ত গড়াল বিয়েতে। এমন বিয়ে এই গ্রামে হয় না কারণ এখানকার লোকজন সবার কাছে ব্রাত্য। তাই এই রূপকথার বিয়েতে আজ গোটা গ্রাম আনন্দে মাতোয়ারা। উৎসব পার্বণে সবাই একজোট হয়ে হৈ চৈ করা এই গ্রামের রীতি। হবে নাই বা কেন? গ্রামের জনসংখ্যা তো মাত্র ৪০০। ঘরের দাওয়ায় উদগ্রীব অপেক্ষায় রোজার বাবা জুয়ান। আর একটু পরে বর এসে পড়বে। ক্ষীণ দৃষ্টিতে শেষবারের মত বিয়েবাড়ির সমস্ত আয়োজন পরখ করে নিচ্ছে। বিয়ের পর মা মরা একমাত্র মেয়েটা বরের সাথে চলে যাবে লিমা শহরে। বড্ড একা হয়ে যাবে জুয়ান। তাই এত আনন্দের মাঝেও মনটা খুব খারাপ।                

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ছবির মত সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম প্যারান। শোনা যায় বহুকাল আগে   কয়েকটি কৃষক পরিবার তিন হাজার ফুট উচ্চতায় সবুজে ঘেরা এই পাহাড়ি সমতলের প্রাকৃতিক সম্পদে মুগ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে এখানে। নানান প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে ধীরেধীরে তারা গড়ে তোলে আস্ত এক গ্রাম।  পরবর্তী প্রজন্ম মিষ্টি ফলের চাষবাস করে প্যরান কে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এখানকার সুমিষ্ট পীচফল খুব বিখ্যাত।  এ বছর প্যারান-এ  পীচফল-এর ফলন খুব ভাল হয়েছে। দাওয়ায় বসে ছোট ভাই এগাপিত- র সাথে সেই নিয়ে আলোচনা চলছে জুয়ানের। মেয়েকে ছেড়ে থাকার কষ্ট ভুলতে ভাইয়ের সাথে চাষবাসে মন দিয়েছে সে। রোজা মারিয়া বিয়ের পর সুখেই ঘর সংসার করছে। খুব শীঘ্র মা হবে। 

দুই ভাইয়ের কথা বার্তার মাঝে সদর দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে জুয়ান ক্ষীণ দৃষ্টিতে দেখতে পেল ব্যাগ হাতে কেউ বাড়িতে ঢুকছে। কাছে আসতেই ------

  • আরে রোজা! তুই?  
  • হ্যাঁ বাবা, চলে এলাম
  • বেশ করেছিস। কিন্তু জামাই কোথায়?
  • পরে আসবে আমায় নিয়ে যেতে ………

আনন্দে আটখানা বাবা কাকার মাঝে থমথমে মুখে বসে পড়লো রোজা।

  • কি রে মা, কি হয়েছে?
  • বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মেয়ে। কান্নার শব্দে অন্ধ কাকা এগাপিত উঠে এসে রোজার পিঠে হাত রেখে নিশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। হয়ত অঘটন আন্দাজ করতে পারছে। বারবার বাবার ব্যাকুল প্রশ্নে মেয়ে কাঁদতে কোন রকমে জানাতে পারলো যে সে ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। তাই আর শ্বশুরবাড়ি ফিরতে চায় না ।   

গভীর রাত। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রোজাকে পাশের ঘরে ঘুমোতে পাঠিয়ে দাওয়ায় বসে আছে   জুয়ান।  চোখে ঘুম নেই। আকাশ পাতাল ভেবেই চলেছে। চারিদিক সবুজে ঘেরা এই সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে সেই জন্ম লগ্ন থেকে।  গ্রামে মোটামুটি ৭৫ শতাংশ অধিবাসী অন্ধ। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই পুরুষ। কারো জুয়ানের মত শৈশব থেকে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ আবার কেউ পঞ্চাশ পেরোলেই অন্ধ হয়ে যায়। প্রাচীন কালে এই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কোন চিকিৎসক পাওয়া যেত না, তাই এই অদ্ভুত রোগের কোন কারণ বা চিকিৎসা খুঁজে পাওয়া যায় নি। পরে পাহাড়ে সোনা রুপোর খোঁজে আসা এক খনন সংস্থা নিজেদের প্রয়োজনে রাস্তা তৈরি করে সমতলের মুল ভূখণ্ডের সাথে জুড়ে ফেলে গ্রামটিকে।  সেই খনন সংস্থার দৌলতে গ্রামের মানুষরা চোখের চিকিৎসার সুযোগ পায়। প্রথমে সবাই ভেবেছিল যে চোখে চশমা পরলে  আবার দেখতে পাবে। কিন্তু তা হলনা। চিকিৎসকরা ওদের চোখ পরীক্ষা করে জানালেন -----           

  • এই রোগ জন্মগত। আসল কারণ সেই জিন। যে মায়ের জিনগত (অর্থাৎ এক্স- ক্রমোজোমের) সমস্যা আছে তাদের সন্তান জন্ম নেয় ভবিষ্যৎ অন্ধত্বের নিয়তি নিয়ে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ‘রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা’। মানুষের চোখের ভিতরে রেটিনার গুরুত্বপূর্ণ দুই অংশ হল রড ও কোণ। এরা ‘ফটো রিসেপটারের’ কাজ করে। চোখে ‘রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা’ হলে রড কোষ ধীরেধীরে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ও চোখের ‘টানেল ভিসন’ নষ্ট করে দেয়। তাতে দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।  

গ্রামবাসী ডাক্তারি ভাষা বোঝে না। তাই বারবার একই প্রশ্ন,     

  • এই রোগের চিকিৎসা হবে তো ডাক্তারবাবু?   

মলিন মুখে ডাক্তারবাবু মাথা নাড়েন--    

- এর কোন চিকিৎসা নেই। রোগের বীজ তোমরা প্রায় পাঁচপুরুষ ধরে বংশানুক্রমে শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছ ।

গ্রামবাসীদের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু আর একটু বিশদে বলেন--------     

- বহুকাল আগে তোমাদের পূর্বপুরুষ যারা এই গ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তারাই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন অন্ধত্বের রোগ । তবে এই রোগে মহিলাদের থেকে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়। মানে মেয়েদের শরীরে এই রোগ থাকলেও তা সাধারণত প্রকাশ পায় না। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে উলটো। রোগের দাপটে কোন পুরুষ শৈশব থেকেই ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জীবন কাটায় আবার কেউ পঞ্চাশ পেরলেই সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়।    

- আমাদের মধ্যে অনেকে দিনে ভালো দেখতে পায় কিন্তু রাতে চোখে একবারেই দেখে না কেন?  

-হুম্‌, এটা রেটিনাইটিস পিগমেনটোসার প্রাথমিক রূপ। আগে রাতের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়। অর্থাৎ মানুষ প্রথমে রাতকাণা হয়ে যায়। তারপর সম্পূর্ণ অন্ধ হয়।                     

নিজেদের পরিণতি জেনে সবাই বাকরুদ্ধ।      

এখন প্যারান অন্ধ বা দৃষ্টিহীনদের গ্রাম নামে পরিচিত। খনন সংস্থা ফিরে গেছে অনেকদিন আগে। গ্রামবাসী মেনে নিয়েছে তাদের নিয়তি। শহরের ডাক্তারের কাছে কেউ আর ছুটোছুটি করে না। সম্পূর্ণ অন্ধ হবার আগেই ওরা অন্ধকার জগতে সচল থাকার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এই তো, জুয়ানের ছোট দু ভাই সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কি তাদের চাষবাসের কাজে কোন খামতি রয়ে গেছে? এমনকি তাদের গ্রামবুড়ো, অন্ধ মাতাও দাদু শতাধিক বয়সে প্রত্যেক দিন পাহাড়ি পথে দু তিন ক্রোশ ওঠা নামা করে। তবে এটা বাস্তব যে আশেপাশের গ্রামের অনেকে এই রোগ কে ছোঁয়াচে ভেবে এদের পরিত্যাগ করেছে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে এদের সাথে কোন বৈবাহিক সম্পর্ক রাখতেও চায় না কেউ। এই পরিস্তিথিতে শিক্ষিত উদার লরেঞ্জো ভালবেসে বিয়ে করেছে রোজা কে। তাই তো এটা রূপকথার বিয়ে ওদের কাছে।       

অন্ধ গ্রামের তরুণী অন্ধ হয়ে যাবে? লরেঞ্জো এটা মানতে পারেনি। সে অভিমানী রোজা কে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেছে । তার চোখের চিকিৎসা চলছে । লরেঞ্জোর দৃঢ় বিশ্বাস, আধুনিক বিজ্ঞান এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না করতে পারলেও খানিকটা পারবে। রোজার আতঙ্কিত শ্বশুরবাড়ির লোকজনের শুধু একটাই প্রশ্ন-------------- রোজার সন্তান ও কি তবে?     

যথা সময়ে রোজার কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। না তার সন্তান অন্ধ হয় নি। সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলো ----- যাক বাবা বেঁচে গিয়েছে! পুরুষ সন্তান হলে ভবিষ্যত হত অন্ধকার--------।

                                                      

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb