পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মেঘ

লেখক - তপন কুমার বিশ্বাস

                                                 

পারমাণবিক বোমা  বিস্ফোরণের পর উর্দ্ধাকাশে দেখা দেয় ব্যাঙের ছাতার মত দেখতে মেঘপুঞ্জ। সব বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেই যে এমন দেখা যায়, এমন নয়। তবে আমরা ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ বলতেই বেশী অভ্যস্ত। এরকম মেঘ শুধু যে পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে দেখা যায় এমনও নয়। খুব শক্তিশালী রাসায়নিক বোমা বিস্ফোরণ হলে বা আগ্নেয়গিরির শক্তিশালী লাভা ও ধূম উদগীরণজনিত কারণেও এমন মেঘপুঞ্জ দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির ঘন ধূমপুঞ্জ আকাশে অনেকদূর পর্যন্ত উঠে যায়; তার  ভষ্মরাশি নেমে আসে আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি এলাকায়। তাহলেও এসবের সঙ্গে পারমাণবিক বোমার তীব্রতার, তার ভয়ঙ্কর ধ্বংসক্ষমতার কোনো তুলনাই হয় না। ঠিক এই কারণে, ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ দেখলেই পারমাণবিক বিস্ফোরণ হয়েছে বলে অনুমান করা যায় না।  

পারমাণবিক বিস্ফোরণে মুহূর্তের মধ্যে উৎপন্ন হয় বিপুল তাপ। সেই তাপ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে; সেইসঙ্গে প্রাণঘাতী তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ। দেখা দেয় মারাত্মক ঝটিকাপ্রবাহ, বাড়ীঘর লুটিয়ে মিশে যায় মাটিতে। চারদিকে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা অগ্নিসাগর ও তার সঙ্গে রাশি রাশি ধূম্রপুঞ্জ। দুটি দমকে (পালস)   প্রচন্ড শক্তি নির্গত হয় – প্রথমটি বহন করে মাত্র প্রায় এক শতাংশ শক্তি, স্থায়ীত্বকাল মোটামুটি ভাবে এক সেকেন্ডের দশমাংশ ; দ্বিতীয় দমকে কয়েক  সেকেন্ড ধরে নির্গত হয় মোট প্রায় নিরানব্বই (৯৯) শতাংশ শক্তি। অ্যাটমিক আর্কাইভের তথ্য অনুয়ায়ী, বিস্ফোরণ মুহূর্তের  এক সেকেন্ডের   দশলক্ষ ভাগের একভাগ  সময়ের মধ্যে  উৎপন্ন হয় এক অত্যুজ্জ্বল ও অতিতপ্ত অগ্নিগোলক; যা আসলে অতিতপ্ত বায়ু ও বিস্ফোরণের তাপে বাস্পে পরিণত হয়ে যাওয়া বোমাটির অধিকাংশ অবশেষের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। সঙ্গে সঙ্গেই এই অগ্নিকুন্ড অতিদ্রুত আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রাস করে নিতে থাকে চারপাশের বায়ু। তাকেও অতিতপ্ত করে তোলে।   

শুরুতে অগ্নিবলয়টি  উজ্জ্বল লাল বা বাদামী-লাল বর্ণের হয়ে থাকে। এক মেগাটন শক্তির বোমা বিস্ফোরণের পর এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের সাতভাগ সময়ের মধ্যে অগ্নিগোলকটি প্রায় ৪৪০ ফুট ব্যাসের এক বৃহৎ অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়; মাত্র ১০ (দশ)  সেকেন্ডে যা হয়ে যায় প্রায় ৫৭০০ ফুট ব্যাসবিশিষ্ট এক সুবৃহৎ অগ্নিগোলক । অর্থাৎ দশ সেকেন্ডের মধ্যে পূর্ণ অগ্নিগ্রাসে চলে যায় চারপাশের অন্তত এক কিলোমিটার এলাকা।  এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, মাত্র এক মেগাটনের একটি বোমা বিস্ফোরণের পর চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে,  নড়াচড়া শুরু করতে না করতেই, অগ্নিগ্রাসে অসহায় মৃত্যু একেবারে অবধারিত। তারপর অগ্নিগোলক সেকেন্ডে ২৫০ফুট থেকে ৩৫০ ফুট প্রচন্ড গতিতে উপরে উঠে যেতে থাকে, সেইসঙ্গে তাপমাত্রাও হ্রাস পেতে থাকে।

জ্বলন্ত বায়ু ধোঁয়া ও গ্যাসপুঞ্জ আশপাশের বায়ুর চাইতে অনেক অনেক লঘু ও হালকা হয় বলে, অত্যন্ত দ্রুত উপরে উঠে যেতে শুরু করে। চারপাশের বায়ু তুলনামূলকভাবে বেশ শীতল; তার প্রবল চাপে, বিশেষ করে অগ্নিগোলকের মাথার দিক একটু চ্যাপ্টা হয়ে যেতে থাকে। ঊর্ধগমনের পথে অগ্নিগোলকের গোলক আকৃতি আর বজায় থাকে না। একটু চ্যাপ্টা গোলকের  আকারে (টরাস) পরিণত হয়ে যায়, যার মাঝখানটা সবচাইতে তপ্ত, লোহিততপ্ত। দেখা দেয় টারবুল্যান্স।  গ্যাসীয় স্তম্ভের তলদেশ ও চারপাশ দিয়ে, আশপাশের অপেক্ষাকৃত শীতল ও বেশী ঘনত্বের বায়ু প্রচন্ড বেগে প্রবেশ করতে থাকে। সেইসঙ্গে বোমাটির টুকরো টুকরো অবশেষ, ধূমপুঞ্জ ও আশপাশের খন্ডবিখন্ড হয়ে যাওয়া নানা আকারের জঞ্জাল। এখন অগ্নিগোলকটি যেন  স্তম্ভটির মাথার উপর ভর করে উপরে উঠে যেতে থাকে। তলদেশ থেকে প্রবলবেগে প্রবিষ্ট চারপাশের জলীয় বাষ্পসহ বায়ুও স্তম্ভটির মাঝখান দিয়ে অগ্নিগোলকটির শীর্ষে  পৌঁছে যায় ও   স্তম্ভশীর্ষের মাঝখান থেকে কিনারার দিকে  আংটার মত বক্রপথে বার হয়ে আবার স্তম্ভের ভিতরে ফিরে যেতে  থাকে। এর ফলে টরাসের ভিতরের তপ্ত গ্যাসপুঞ্জে স্তম্ভশীর্ষের  মাঝখান থেকে বাইরের দিকে প্রবলবেগে ঘূর্ণণ হতে থাকে। যেন এক প্রচন্ড ঘূর্ণি। এই ঘুর্ণি স্তম্ভটিকে টেনে উপরে তুলতে থাকে।

ঘূর্ণায়মান তপ্ত গ্যাসপুঞ্জ যখন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এমন উচ্চতায়  পৌঁছায়, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব অগ্নিগোলকের গ্যাসপুঞ্জের সমান বা তার কম, সেইরকম উচ্চতায় পৌঁছাবার পর অগ্নিস্তম্ভটির ঊর্ধগতি বন্ধ হয়ে যায়। চারপাশের শীতল বায়ুতে তাপ   হারাবার ফলে, স্তম্ভের বর্ণও পালটিয়ে বাইরের দিকে ধূসর  বর্ণ ধারণ করে। অগ্নিগোলকের ভিতরের গ্যাসরাশির তাপমাত্রা তখন অনেক কমে গেলেও, তা তখনো যথেষ্ট বেশী।  ভিতরের অণুগুলি পরষ্পরকে দ্রুত ধাক্কা দিতে দিতে দূরে সরিয়ে  দিতে থাকে। দ্রুত বাড়তে থাকে আকার ও আয়তন। তলদেশ ও চারপাশ থেকে বাতাসের সঙ্গে যে জলীয় বাষ্প উঠে এসেছিল, তা  ঘনীভূত হয়ে জলকণায় পরিণত হয়, এমনকি বরফকুচিতে। স্তম্ভের  চারপাশে মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ে বিস্তারলাভ করতে থাকে এই সবকিছু।  পারমাণবিক বিস্ফোরণের মেঘ। পারমাণবিক বিস্ফোরণজনিত তেজষ্ক্রিয় কণিকার অধিকাংশই (৯০%) থাকে এই মেঘপুঞ্জে অর্থাৎ মেঘপুঞ্জটি দারুণ  তেজস্ক্রিয় । বাকী প্রায় দশ শতাংশ তেজস্ক্রিয় কণিকা থাকে স্তম্ভটিতে। এখন এটির আকার  অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মত দেখতে। ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে, পরমাণু বিস্ফোরণের মেঘের মাথায় জলকণা, এমনকি বরফকুচি !

 ৯ এপ্রিল ১৯৪৫ সকাল এগারোটা নাগাদ, নাগাসাকিতে ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১৬০০ ফুট (৫০০মিটার) উপরে, ২১ কিলোটন টিএনটি-র সমতুল শক্তির যে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল, তাতে দেখা দিয়েছিল দুটি মেঘ। প্রথমটি স্তম্ভশীর্ষের উপরে  চারপাশে , দ্বিতীয়টি স্তম্ভশীর্ষের অনেকটা নীচে। ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সকাল ৮টা ১৬ মিনিটে, ১৪ কিলোটনের প্রথম যে বোমাটি হিরোশিমাতে ভূপৃষ্ঠের,  ১৯০০ ফুট উপরে ( ৫৮০মিটার)  যে বিস্ফোরণ হয়েছিল, তাতে এতোসব দেখা যায়নি। ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী  ১৫ মেগাটনের  হাইড্রোজেন বোমা ক্যাসল ব্রাভো বিস্ফোরণের পরীক্ষায়  মেঘরাশির চারপাশে দেখা দিয়েছিল ৪টি ঘনীভবনজনিত রিং, মাথায় ৩টি বরফটুপি (আইসক্যাপ), ২টি স্কার্ট। ১৯৬১ সালের ৩১ অক্টোবর,  পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার ৫৮ কিলোটনের মহাশক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর, আবার ভিন্ন আকারের স্তম্ভ ও পারমাণবিক মেঘ দেখা দিয়েছিল।  

সব বিস্ফোরণে ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ দেখতে পাওয়া যায় না। ভূগর্ভের গভীরে বা সমুদ্রজলের গভীরে  পারমাণবিক বিষ্ফোরণ হলে, ব্যঙের ছাতার মত মেঘ উৎপন্ন হয় না। সমুদ্রতলের অল্প গভীরতায় বিস্ফোরণ হলে জলস্তম্ভের সৃষ্টি হয়,  তার মাথায় ছাতার মত বাষ্পমিশ্রিত স্বল্পস্থায়ী জলরাশি। ভূগর্ভের অল্প গভীরতায় বিষ্ফোরণ হলে, কখনো কখনো  বিষ্ফোরণের অভিঘাতে ভূপৃষ্ঠের উপরে নীচু টিলা সৃষ্টি হয়। বেশী গভীরতায় বিস্ফোরণ হলে, ভূপৃষ্ঠের নীচে গহ্বর (ক্রেটার) সৃষ্টি হয়। ভারতের পোখরাণে  ও পাকিস্তানের  কাহুটায়  পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ফলে যেমনটা দেখা গিয়েছিল। দেখা যায়নি পারমাণবিক মেঘ।।

                                                   

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb