সঙ্কেত

লেখক - ডঃ শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়



একটু যেন বিরক্ত হয়েই কম্যান্ডার আভা জিজ্ঞেস করলেন, "তার মানে আপনি বলতে চান যে এই বিরাট মহাবিশ্বে আমরা একা? সম্পূর্ণ একা?"

বিজ্ঞানী নাবিগ এমনি এমনি রাজবিজ্ঞানী হন নি। রাজা বা যে কোনো রাজকর্মচারীর সঙ্গে ঠিক কী ভাষায় আলাপ আলোচনা চালাতে হয়, তার ট্রেনিং নেয়া আছে তাঁর। সুতরাং কম্যান্ডারের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, "না। আমি কখন‌ই সে কথা বলতে পারব না। ওটা বাণী হয়ে গেল, মহান উপাসকদের মত! কম্যান্ডার, এটা অবশ্যই জানবেন যে বিজ্ঞান কখনো চরম সত্য বলে কোনো কিছু ঘোষণা করতে পারে না। বিজ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তি বারবার পরীক্ষা করে যাচাই করে নিতে হয়। আমরা সঙ্কেত পাঠাতে সবে শুরু করেছি।"

এটা শুনেই আভার ভ্রু কুঁচকে গেল। মহাবিস্ময়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "সবে! তিন লক্ষ বছর ধরে সঙ্কেত পাঠাচ্ছি মহাবিশ্বের আনাচেকানাচে আর আপনি বলছেন, সবে! আশ্চর্য!"

মৃদুমন্দ হেসে নাবিগ বললেন, "মহাশয়, মহাবিশ্বের পরিধির কাছে তো তিন লক্ষ বছর সবেই হবে। আর তাছাড়া সে পরিধিও ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। আপনি তো জানেন‌ই যে গ্যালাক্সিগুলো একটা আরেকটার থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে। এমনভাবে সরতে থাকলে একসময় গোটা অন্ধকার ঘরে হয়ত এক একটা গ্যালাক্সি আলাদা হয়ে একা একা পড়ে থাকবে। সেজন্যই প্রথমে বলছিলাম যে হয়ত আমাদের সঙ্কেত প্রেরণ এবং তার উত্তর এসে পৌঁছানোর মধ্যেই আমাদের গ্যালাক্সি পুরো একা হয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারে। আর এই সরণের কারণেই হয়ত আমাদের সঙ্কেত অভিপ্রেত জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।"

"হুঁ, শুনেছিলাম", একটু ভেবে নিয়ে আভা আবার বলতে থাকেন, "শুনেছিলাম মাত্র সাড়ে তিন কোটি আলোকবর্ষ দূরে নাকি আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের মত এমন একটা পুঞ্জ আছে, যেটায় পরিস্থিতি এখানকার মত‌ই। ওখানে এমন কোনো গ্রহ থাকতেই পারে যাতে প্রাণ দানা বাঁধছে বা বেঁধেছে! আমাদের তরফ থেকে নাকি সেখানে সঙ্কেত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে?"

"ঠিক‌ই শুনেছেন কম্যান্ডার, তবে দূরত্ব মাত্র সাড়ে তিন কোটি নয়। মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এর কারণে আগে আমাদের এই ভুল হয়েছিল। ওটা প্রায় সাড়ে পাঁচশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি। ঐ গ্যালাক্সির আকার আমাদের মত ডিম্বাকার চাকতি নয়। স্পাইরাল এই গ্যালাক্সি আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় কিছুটা নবীন। আপনি এই স্ক্রিনে দেখলে ওটার চারটে হাত লক্ষ্য করবেন। আমার হিসাবে এর এই মোটামুটি তিন নম্বর বাহুর এইপাশটায় একটা কচি নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে বেশ কিছুকাল হল। আপাতত আমার লক্ষ্য ওইটা।"

এতক্ষণ আভা যেন একটু সন্তুষ্ট হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে নাবিগের কথা শুনছিলেন। তিনি ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন, সদ্যোজাত নক্ষত্রটাকে ঘিরে ধুলো আর গ্যাসের আস্তরণ এখনো মেলায় নি। আভা বলে উঠলেন, "এই গ্যাস আর ধুলো জমে কি আপনি আশা করেন গ্রহ তৈরি হতে পারে?"

নাবিগ মুচকি হেসে বললেন, "আমি ন‌ই, আমার হিসাব তাই বলছে। এক‌ই মাপের অন্তত কুড়িটা গ্রহ তৈরি হবে ঐ ধুলো জমে। মাঝবয়সে ঐ নক্ষত্রের ভর এবং আকার যা দাঁড়াবে, তাতে করে আনুমানিক তিন কি চার নম্বর গ্রহ বা খুব বেশি হলে ছয় সাত নম্বর গ্রহে প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এরপর আমাদের যেমন বিবর্তন ঘটেছে তেমনটা ওখানে হবে বলে আশা করা যায়। এবং এখান থেকে সঙ্কেত পাঠালে ওখানে যতদিনে পৌঁছবে, ততদিনে সে সঙ্কেত দেখে বোঝার মত উন্নত জাত তৈরি হয়েও যেতে পারে। মানে, এই অনুমান মহামতি ফার্বির সূত্র অনুযায়ী আর বাকি সিদ্ধান্ত টানা হচ্ছে কোয়ার্ক কম্পিউটিং মেশিনের গণনা থেকে। শুধু ব্যাপারটা আরেকটু তাড়াতাড়ি করা যেতে পারে যদি…"

"কী হল? থামলেন কেন?" অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠেন কম্যান্ডার আভা, "যা বলছেন নির্ভয়ে বলুন, কথার মাঝে ওরকম বিশ্রী দুম করে থেমে যাবেন না!"

বিজ্ঞানী নাবিগ আবার মুচকি হেসে বললেন, "মহাশয় জানেন সব‌ই। যদি ঐ মাঝরাস্তায় থামিয়ে দেয়া স্টেলার ফিউশন প্রোজেক্টটা আপনি কোনভাবে শুরু করার অনুমতিটা আদায় করতে পারেন চ্যান্সেলরের কাছ থেকে, তবে সঙ্কেত পাঠানোর ব্যাপারটা আরেকটু সহজ হয়ে উঠতে পারে। হয়ত, হয়ত আমাদের জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে পারব সঙ্কেতের প্রত্যুত্তর এল কি না!"

কম্যান্ডারের ভ্রু কুঁচকে গেছে। নক্ষত্রের ফিউশন প্রোজেক্টটা বন্ধ হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। বিজ্ঞানের যে স্তরে তাঁদের জাত বিদ্যমান, তাতে করে সভ্যতার নিকটবর্তী কোনো নক্ষত্রকে ম্যাগনেটারে, অর্থাৎ প্রবল চৌম্বকক্ষেত্রবিশিষ্ট নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত করার জন্য খুব বেশি খাটতে হত না। নিউট্রন নক্ষত্র আসলে নক্ষত্র নয়, নক্ষত্রের শব। ঠিক মত নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সেই শবের পৃষ্ঠদেশে দামী ধাতুর ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলা যায়। তারপর সেখান থেকে ধাতু আহরণ করার বিশেষ প্রযুক্তি আছে। এত ভালো একটা কাজে বাদ সেধেছিল একমাত্র বিরোধী দল সেগ্রেগাঞ্জ। সেগ্রিরা মহাকাশের পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে একটা সুস্থ তারাকে মৃত তারায় পরিণত করার পক্ষে ভোট দেয় নি। তাদের বক্তব্য, ওভাবে কৃত্রিম উপায়ে নিউট্রন নক্ষত্র বানালে তার আকর্ষণে হিতে বিপরীত হতে পারে। তরঙ্গের মাধ্যমে গড়ে তোলা সুবিশাল যোগাযোগ ব্যবস্থা আচমকা ভেঙে গিয়ে একটা বিশ্রী বিপর্যয় ঘটবে। এইসব শুনে চ্যান্সেলর আর ঐ প্রোজেক্ট চালানোর অনুমতি দেন নি। কাজ বন্ধ করে সম্পূর্ণ অঞ্চল এনট্যাঙ্গল করে সীল অর্থাৎ এনক্রিপশন করে দেয়া হয়েছে।

"আপনি বিশেষ আবেদনপত্র লিখুন মহাশয় আভা", বলে চললেন নাবিগ, "চ্যান্সেলরকে, বলুন, ধাতু আহরণ নয়, প্রোজেক্ট ফার্ব, অর্থাৎ এই সঙ্কেত প্রেরণের কাজের জন্য স্টেলার ফিউশন প্রোজেক্টটা আবার শুরু করা দরকার। লিখবেন, সঙ্কেত পাঠানো ছাড়া বর্তমানে ব্রহ্মাণ্ড জয়ের আর কোনো রাস্তা আমাদের জানা নেই। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে ঘটাতে আমরা আমাদের সভ্যতার চরম ধাপে উন্নীত হয়েছি। এবার আমাদের সভ্যতার একমাত্র উদ্দেশ্য হ‌ওয়া উচিত অন্য গ্যালাক্সিতে উন্নত সভ্যতার খোঁজ করে তাকে জিতে নেয়া। আর তার জন্য এই আদ্যিকালের সঙ্কেত প্রেরণ ব্যবস্থা দিয়ে কাজ চলবে না। সিগন্যালের বহুগুণ অ্যাম্প্লিফিকেশন প্রয়োজন এবং তার আগমন যেন সেই দূরবর্তী সভ্যতার বিজ্ঞানীদের মধ্যে চাঞ্চল্য ফেলে দেয়!"

আভা বললেন, "অনেকটা পার্বত্য অরণ্যের পতঙ্গভুক উদ্ভিদদের মত? রঙচঙে দলমণ্ডল আর মনকাড়া গন্ধবিস্তার করে, মধুভাণ্ডের লোভ দেখিয়ে যেভাবে পতঙ্গদের ওরা আকর্ষণ করে, আমাদের ঠিক সেই পন্থা অবলম্বন করতে হবে, বলছেন? চ্যান্সেলর কি রাজি হবেন?"

নাবিগ মুখ নামিয়ে খুব নীচুগলায় ষড়যন্ত্র রচনার ধাঁচে বললেন, "আপনি চ্যান্সেলরের জিগীষা কতটা তার খোঁজ রাখেন না! টোরামস চ্যান্সেলর হবার বহু আগে থেকেই আমি তাঁকে চিনি। তখন আমরা এক‌ই কলেজিয়ামে এক‌ই পাঠ্যক্রমে পড়তাম। তাঁর রাজনীতির দাবার চাল কোনদিকে যেতে সক্ষম, সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে কি, কম্যান্ডার আভা?"

আভা অবগত আছেন যে এই নাবিগ আর টোরামস এক‌ই কলেজিয়ামের ছাত্র ছিলেন। পরিস্থিতির ফেরে একজন আজ চ্যান্সেলর, আরেকজন তাঁর মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। এখন আভা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে‌ রাজনীতির মারপ্যাঁচ এই নাবিগ‌ও কম কিছু জানেন না! মুখে পরিবেশের রক্ষার কথা সেগ্রিরা যত‌ই বলুক না কেন, জিগীষার প্রশ্নে এরা কিন্তু চ্যান্সেলরকে সমর্থন‌ই জোগাবে। কে বলতে পারে, নতুন দুনিয়ায় নতুন উপনিবেশ স্থাপনের পর চ্যান্সেলরের ইচ্ছায় সেগ্রেগাঞ্জরাই সেখানে শাসনভার পাবে কিনা! এই ব্যাপারটা চ্যান্সেলরকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে বললে প্রোজেক্ট নিউট্রন নক্ষত্র শুরু করার অনুমতি আদায় করে নেয়া যাবে নিশ্চিত, ভাবলেন আভা। তারপর একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলেন, "একটা প্রশ্ন। না করে থাকতে পারছি না। ঠিক কী উপায়ে আপনি নিউট্রন নক্ষত্র মারফৎ বহুগুণ বিবর্ধিত বেতার সঙ্কেত পাঠাবেন স্পাইরাল গ্যালাক্সিটায়?"

নাবিগ একটা বড় স্ক্রিন হাতের সামনে নামিয়ে আনলেন। কিছু বোঝাবেন নিশ্চয়ই। একটু একটু করে বিষয়টা স্পষ্ট হতে শুরু করল কম্যান্ডারের কাছে। খুব‌ই সহজ ব্যাপার: নাবিগ একটা মাঝবয়সী তারা পছন্দ করেছেন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের পৈত্রিক নক্ষত্রের তল থেকে সেটার দূরত্ব এমনি যে ওটাকে তিনি ম্যাগনেটারে রূপান্তরিত করলে সেই ম্যাগনেটারের তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণকে পৈত্রিক নক্ষত্রের চৌম্বকক্ষেত্র বহুগুণ বিবর্ধিত করে দেয়। শুধু তাই নয়, বিবর্ধিত বিকিরিত তরঙ্গের পোলারাইজেশনের অভিমুখ পরিবর্তন এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যে তা দিয়ে অনায়াসে নতুন ধরনের এক বেতার-ভাষ্য নির্মাণ করা সম্ভব। নতুন দুনিয়ায় এই বেতার-ভাষ্যের সাহায্যেই সাঙ্কেতিক আলাপ শুরু করতে চান নাবিগ।

"ব্যাপারটা চমকপ্রদ সন্দেহ নেই", বলেন কম্যান্ডার, "এবং সেই সঙ্গে একটা বিপদ থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। আমাদের পৈত্রিক নক্ষত্র, মানে যাকে কেন্দ্র করে আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতা শুরু হয়েছিল, তার চৌম্বকক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন আনেন, তবে এখানে জলবায়ুতে বা সমুদ্রতলের উচ্চতায় কোনো গণ্ডগোল দেখা দেবে না তো?"

প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বিজ্ঞানী বললেন, "একদমই না! আমরা পৈত্রিক নক্ষত্রের যে তল আর যতটা দূরত্ব নির্বাচন করেছি, তাতে এ গ্রহের জলবায়ু বা সমুদ্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। হ্যাঁ, অবশ্য পোলার রেডিয়েশনে একটু গোলযোগ দেখা দেবে, সেটা আমরা এনট্যাঙ্গলিং প্রয়োগ করে ধ্রুবক রেখে দিতে পারি। আপনারা ভবিষ্যতে লাভের পাল্লাটা দেখুন, ওটা কিন্তু ইতোমধ্যেই বেশ ভারী বলে মনে হচ্ছে, হেঁঃ হেঁঃ!"

আভা এবং নাবিগ এরপর আরো কিছুক্ষণ আলোচনা চালাবেন পাঠক-পাঠিকা, তবে আমরা এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে এটা নিশ্চিত যে চ্যান্সেলর টোরামসের অনুমতি পেতে কম্যান্ডারকে খুব একটা বেশি বেগ পেতে হয়নি। জিগীষা বিষয়টা হয়ত এমন‌ই। জাত হিসাবে এদের হয়ত আর কোনোকিছু আয়ত্ত করতে বাকি নেই। তাই সভ্যতার বাকিটা, আমাদের পরিচিত আরো অনেক সভ্যতার মত‌ই, নিজেকে প্রতিস্পর্ধা জানানো এবং তার দ্বারা নিজের ক্ষমতা যাচাই করে নেয়া। তা টোরামসের জাতি নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে থাকুন নিউট্রন নক্ষত্র বানিয়ে তার দ্বারা পাঁচশো কোটি আলোকবর্ষ দূরে বেতার সঙ্কেত প্রেরণ করে। ততক্ষণে আমরা বরং বর্তমান সময়ে আরেকটা জায়গায় ঘুরে আসি। আসুন, জায়গাটা আমাদের খুব চেনা জায়গা সন্দেহ নেই। ঠিক এখানেই নাবিগ সঙ্কেত পাঠাতে চাইছিলেন তাঁর স্থানকাল থেকে।

এখানে ফাস্ট রেডিও বার্স্ট, সংক্ষেপে এফ.আর.বি নিয়ে এই মুহূর্তে জোর আলোচনা চলছে। এখানে অর্থাৎ আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সির অন্তর্গত মাঝারি মাপের একটা তারার আওতায় থাকা আটটা গ্রহের মধ্যে তিন নম্বর গ্রহে, রঙ যার নীলাভ-সবুজ। এ গ্রহে এখন যে যুগ চলছে তাকে বলা যায় অ্যানথ্রোপোসিন। জাতের নাম মানুষ। কয়েকশো কোটি  আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা বেতার তরঙ্গ, যার প্রাবল্য বা বিস্তার কোনোটাই খুব বেশি হ‌ওয়া সম্ভব নয়, আচমকা দেখা যাচ্ছে তারা পাঁচ হাজার লক্ষ সূর্যের তেজ নিয়ে হাজির হচ্ছে বেতার টেলিস্কোপের গ্রাহকযন্ত্রের আওতায়! কয়েক দশক ধরে এই আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী বিভিন্ন দেশের মহাকাশবিজ্ঞানীরা। মহাবিশ্বের শীতলতম গভীরতা থেকে কারা পাঠায় এই শক্তিশালী ক্ষণপ্রভ বেতারতরঙ্গ তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা চালাচ্ছেন। পাঁচশো মিটার উন্মেষের রেডিও টেলিস্কোপে (ফাইভ হান্ড্রেড মিটার অ্যাপার্চার স্ফেরিক্যাল রেডিও টেলিস্কোপ, সংক্ষেপে, এফ.এ.এস.টি বা ফাস্ট) তার সঙ্কেত পেয়ে চৈনিক বিজ্ঞানী জুয়ান ঝ্যাং-এর মাথা খারাপ হবার জোগাড়! মার্কিন মুলুকের সাংবাদিক মার্টিনকে তিনি জানাচ্ছেন, "দেখুন মশাই! ২০০৭ সাল থেকে যখন এমন বেতার-বিস্ফোরণের কথা শুনে আসছি, তখন থেকেই বিষয়টা নিয়ে আমরা গবেষণা চালাচ্ছিলাম। এই দু'হাজার কুড়ি সালে এসে দেখছি, এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! ঝাড়া একানব্বইটি ঘন্টা ধরে পর্যবেক্ষণ চলাকালীন আমাদের এফ.এ.এস.টি বিরাশি ঘন্টার মোট আঠারোশো কুড়িটা এফ.আর.বি রেকর্ড করেছে। এটার নাম দেয়া হয়েছে এফ.আর.বি.২০২০XXXXA।

এ জিনিসের, ইয়ে, তরঙ্গের শক্তি আপনি কল্পনাও করতে পারবেননা!"

লাইভ টেলিভিশন সম্প্রচার চলছিল। চোখ কপালে তুলে মার্টিন বললেন, "বলেন কি মশাই! ভিনগ্রহের প্রাণী নাকি? নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে?"

"আরে নাঃ", সাংবাদিকের সন্দেহ মূহুর্তে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞানী বললেন, "আপনারা জোরালো বেতার সঙ্কেত মানেই ভাবেন ভিনগ্রহীদের কাণ্ডকারখানা! আমরা ভাবছি অন্য বিষয়। অস্বাভাবিক জোরালো এই তড়িচ্চুম্বকীয় সঙ্কেত আসছে বেশ কয়েকশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটা ম্যাগনেটার থেকে। সে আসুক, ক্ষতি নেই, কিন্তু ফ্যারাডে রোটেশন হচ্ছে কেন?"

মার্টিন বললেন, "ওই খটোমটো কীসব বললেন, তার সারমর্ম কী একটু খোলসা করে বললে ভালো হতো! মানে, বুঝতেই পারছেন, এই চ্যানেল দেখা সব লোকরা তো আর আপনার মত বিজ্ঞানী নন!"

খুব বিরক্তি দেখিয়ে ঝ্যাং বললেন, "একে আমার কাজ করার সময় নেই। তারপর আপনারা একবার এদেশ, একবার ওদেশ থেকে এসে সহজ করে সব কিছু বোঝাতে বলেন! ঠিক আছে, বলছি। নক্ষত্র মরে গেলে, মানে তার মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটার মুরোদ যদি আর না থাকে, তবে সেটা নিউট্রন নক্ষত্র হতে পারে, আবার নাও পারে। যদি হয়, তবে তার একটা প্রকারভেদ হচ্ছে এই ম্যাগনেটার। এদের থাকে বিকট বিপুল চৌম্বকক্ষেত্র যা কল্পনাও করতে পারবেন না। যেমন এই বেতার সঙ্কেতটা আসছে যে ম্যাগনেটার থেকে তার ব্যাস কত বলুন তো? মাত্র কিমি দুয়েক! আর ভর কত বলুন তো দিকি? দুটো সূর্যের মোট ভরের সমান। চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য কল্পনা করতে পারেন? সূর্যের চাইতে পাঁচশো মিলিয়ন গুণ বেশি!"

মার্টিন জানতে চাইলেন, "প্রোফেসর, হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক, ইস দিস পসিবল ন্যাচারেলি?"

প্রবল আপত্তি জানিয়ে ঝ্যাং বললেন, "অ্যাবসোলিউটলি! এটাই তো নিউট্রন স্টারের খেলা! এখানে কোনো ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব নেই, আমি নিশ্চিত। তবে আশ্চর্যের দুটো ব্যাপার আমাদের গবেষণায় উঠে আসছে। এবার সেটার ভবিষ্যতে কী ব্যাখ্যা হবে, তা জানি না। আপনি তো জানেনই, বিজ্ঞান একটা পরিবর্তনশীল 'ধ্রুব' সত্য। বারবার পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হয় এর, ওর, তার ফলাফল।"

মার্টিন জিজ্ঞেস করলেন, "তা আপনার বর্তমান ফলাফল অনুযায়ী আপনি কি সিদ্ধান্তে এসেছেন?"

"ঘটনা দুটি: এক, চৌম্বকক্ষেত্রের অস্বাভাবিক জোরালো সঙ্কেত-তরঙ্গের পোলারাইজেশন তলের পরিবর্তন ঘটছে একটা নির্দিষ্ট তালে। এমনটা আমরা আগে কখনো অন্য এফ.আর.বি-এর ক্ষেত্রে দেখিনি। আর দুই, এতদিন পর্যন্ত যত ম্যাগনেটার থেকে এফ.আর.বি আসতে দেখেছি, ততগুলো কিন্তু গ্যালাক্সির অপেক্ষাকৃত নবীন অঞ্চলের বাসিন্দা, অর্থাৎ যেসব জায়গাকে বলা চলে নক্ষত্রদের আঁতুড়ঘর। এবার এই যে ম্যাগনেটারের কথা বলছি, এটার অবস্থান কয়েকশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্যালাক্সির এমন অঞ্চলে, যেখানে নক্ষত্রের জন্ম বর্তমানে আর হচ্ছে না। পরিণত অংশ এই জায়গাটা। এইখানেই আমাদের খটকা লাগছে। সব হিসাব করে আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এই নিউট্রন স্টারের একটা সঙ্গী তারা নির্ঘাত আছে, যার সঙ্গে এর কক্ষতলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। বিকিরণের অঙ্কে এই সঙ্গী তারাটা বামার তরঙ্গের হাইড্রোজেন বর্ণালী ছড়াচ্ছে। এটাই ম্যাগনেটার থেকে আগত এফ.আর.বি-এর শক্তি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে, ভিনগ্রহী-ট্রহী কিছু নয়!"

মার্টিনের একবার মনে হল যে বেতার-তরঙ্গের পোলারাইজেশন-তলের নির্দিষ্ট তালে পরিবর্তনটা ভিনগ্রহীদের কোনো সঙ্কেত হতে পারে কিনা, তা জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু বিজ্ঞানী রেগে যেতে পারেন বলে আর কিছু বললেন না। আর আমরা? আমরাও কিছু বলব না পাঠক-পাঠিকা, বরং অপেক্ষা করতে থাকি একে অপরের থেকে ক্রমাগত দূরে সরতে থাকা দুটো গ্যালাক্সির মধ্যে এই সঙ্কেত আদান-প্রদান ঠিক কবে ফলপ্রসূ হয়। মহাবিশ্ব আর মহাকাল কার জন্য কোথায় হারজিতের কী ব্যবস্থা করে রেখেছেন, একটা কাহিনীর মাধ্যমে তা বোঝা কী করে সম্ভব? আপনারাই বলুন।

                        

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb