আমি মানব একাকি ভ্রমি বিষ্ময়ে

লেখক - ডঃ শংকর ঘটক

১৮৯৫ সালে প্রকাশিত এইচ জি ওয়েলসের লেখা “দা টাইম মেশিন” গল্পের মেশিনটি ব্যবহার করে অতীত এবং ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা যায়। টাইম মেশিন ছিল কল্পনার,নেহাতই কল্পবিজ্ঞানের গল্প। গল্পের টাইম মেশিন সময়কে চতুর্থ মাত্রায় ( 4thdimension) রেখে চলাফেরা করেছে ঠিকই কিন্তু তা পৃথিবীর বুকেই। বাস্তবের বিজ্ঞানীরা প্রস্তুত করেছেন আসল টাইম মেশিন যা মানুষকে নিয়ে যায় সেই কোন অতীতে যেখানে মহাবিস্ফোরণর পরে সৃষ্টি হচ্ছে মহাবিশ্বের,জন্ম হচ্ছে নক্ষত্র মণ্ডলীর,নীহারিকার। মেশিনটির নাম টেলিস্কোপ। সময়ের উল্টোদিকে শুধু যে ধেয়ে যায় তাই নয়,সেই অতীত কালের ছবিও তুলে নিয়ে আসে। হাজার কোটি বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তবতা। এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার নায়কের নাম জেমস ই ওয়েব টেলিস্কোপ।

ছায়াপথ (galaxy) নিয়েই শুরু করা যাক। এখনো পর্যন্ত মোটামুটি ১৭০০০ কোটি ছায়াপথের সন্ধান মিলেছে। এই ছায়াপথগুলির অবস্থান ৪৫৭০ আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের অতি বিশাল এলাকায়।এই ছায়াপথগুলির কোনটি তুলনায় ছোট আবার কোনটি তুলনায় বিশালাকার,অনেকটা ঘোরানো সিঁড়ির মত(spiral) অথবা দৈত্যাকার উপবৃত্তকার ( elliptical)। সব মিলিয়ে জ্যোতিষ্কের সংখ্যা কম-বেশি ১০২৪ । এই বিশালত্বের মাঝে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুতে ততোধিক ক্ষুদ্র এই বিশ্বের  মানুষ মাথা তুলে খালি চোখে কটি তারা দেখতে পায়? মাত্র ২৫০০ টি। বিপরীত পৃষ্ঠের আরও ২৫০০ টি ধরলে মোট ৫০০০ টি। অর্থাৎ খালি চোখে পৃথিবীর চারদিকের দৃশ্যমান তারার সংখ্যা সমগ্রের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলেই তা অতিক্রম করা। দৃশ্যমানতার এই বাধা অতিক্রমের চেষ্টারই ফসল দূরবীনের আবিষ্কার।

অতি সরল করে বলা যায় দূরের বস্তু দেখার যন্ত্রের নামই দূরবীন। দূরবীনের বিবর্ধন ক্ষমতা (magnification)  বেশি হলে বস্তুকে বেশি স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। আলোর ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত দূরবীন দু রকমের হয়, প্রতিসরণ দূরবীন এবং  প্রতিফলন দূরবীন। প্রতিসরণ দূরবীন প্রস্তুত করা হয় কাচের লেন্স দিয়ে আর প্রতিফলন দূরবীন প্রস্তুত করা হয় আয়না বা দর্পণ ব্যবহার করে।

 চিন দেশের দার্শনিক মোজি (Mozi) খ্রীঃপূঃ ৪৭০-৩৯০ নাগাদ অবতল দর্পণের সূর্য রশ্মি-গুচ্ছকে একটি বিন্দুতে নিবিস্ঠ করার ক্ষমতার কথা লিপিবদ্ধ করেন । এর সঙ্গে যুক্ত হল গ্রিক নাট্যকার-নির্দেশক অ্যারিস্টোফেনের ( Aristophanes ) পর্যবেক্ষণ- জল ভরা বিভিন্ন আকারের কাচের পাত্র সূর্য রশ্মির দিক পরিবর্তন ঘটায় (খ্রীঃপূঃ ৪২৪)। পদার্থের এই দুটি প্রাথমিক ধর্মের ওপর ভিত্তি করে জন্ম হল টেলিস্কোপের। অসংখ্য চেষ্টার মধ্য থেকে কিছু বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য প্রচেষ্টার  উদাহরণ দেওয়া হল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রিসের গণিতজ্ঞ ইউক্লিড ( Euclid) সূর্যরশ্মি এবং আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ নিয়ে আলোচনা করেন। দশম-দ্বাদশ শতকে আরব বিজ্ঞানীদের আলোক সংক্রান্ত গবেষণা ভিত্তিক গ্রন্থ ইয়োরোপ পারি দিল। ল্যাটিনে অনুবাদ হল। লেন্স সংক্রান্ত গবেষনায় আকর গ্রন্থের পরিচিতি লাভ করল এই গ্রন্থ। ত্রয়োদশ শতকের শেষ পাদে চশমা আবিষ্কার হল। দূরের বস্তুকে কাছে দেখার জন্য লেন্সের ব্যবহার শুরু ১৫৭০-এর দশকে।  ১৬০৮ সালে জার্মান-ডাচ চশমা প্রস্তুতকারী হ্যান্স লিপরসে টেলিস্কোপ জাতীয় যন্ত্রের ওপর পেটেন্ট নিলেন। ১৬০৯ সালে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। গ্যালেলিও হ্যান্স লিপরসের টেলিস্কোপ জাতীয় যন্ত্রের উন্নতি সাধন করে তাঁর নিজস্ব টেলিস্কোপ “পার্সপিসিলাম-(perspicillum)”প্রস্তুত করে নেন। ১৬১১ সালে টেলিস্কোপের কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত আলোচনা করেন জোহানেস কেপলার। জোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহারের জন্য দুটি উত্তল লেন্সের সমবায়ে প্রথম টেলিস্কোপটি নির্মাণ করেন তিনি। ১৮৯৭ সালে ইয়ার্কস মানমন্দির ১০১.৬ সেমি ব্যাসের প্রতিসরণ টেলিস্কোপ নির্মাণ করে।  শুধু মাত্র X-Ray জোতির্বিজ্ঞান গবেষণার উদ্দেশ্যে উহুরু ( Uhuru ) উপগ্রহর মাধ্যমে প্রথম এক্স-রে টেলিস্কোপ মহাকাশে স্থাপিত হল ১৯৭০ সালে।

১৯৯০: পৃথিবীর কক্ষপথে হাবল টেলিস্কোপ স্থাপিত হল। ২০০৯: আমাদের প্রতিবেশী নক্ষত্রদের আবর্তন করা গ্রহের সন্ধানে ২.৪ মিটার ব্যাসের দর্পণ সমৃদ্ধ কেপলার টেলিস্কোপ প্রেরণ করা হল মহাকাশে।

জেমস-ওয়েভ স্পেস টেলিস্কোপ:

 ২০১১ সালে নাসা তাদের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহাকাশ টেলিস্কোপের নির্মানের প্রস্তাব পেশ করল। জেমস-ওয়েভ স্পেস টেলিস্কোপ নামের এই টেলিস্কোপ মহাকাশের অপেক্ষাকৃত গভীর অঞ্চলে স্থাপনের প্রস্তাব করা হল। বিশালাকার ৬.৫মিটার ব্যাসের দর্পণ থাকবে সেই টেলিস্কোপে। সেই ঘোষণাকে মান্যতা দিয়ে ২৫ সে ডিসেম্বর,২০২১  জেমস-ওয়েভ স্পেস টেলিস্কোপ নিয়ে রকেট উৎক্ষিপ্ত হল। ১২ ই জুলাই,২০২২ জেমস-ওয়েভ স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীতে পাঠাল প্রথম ছবি ।

হাবল এবং ওয়েব টেলিস্কোপ নিয়েই বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহল প্রবল উৎসাহী। পরের প্রজন্মের রোমানের জন্য আরো কিছু বছর অপেক্ষা করতে হবে।

হাবলের সঙ্গে ওয়েব এবং রোমানের মধ্যে প্রধান তফাৎ,হাবল পৃথিবীকে প্রদক্ষীণ করে কিন্তু ওয়েব (এবং রোমান)  প্রদক্ষীণ করবে সূর্যকে (চিত্র-১)। এর ফলে  ওয়েব (এবং রোমান) পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন মুক্ত হয়ে মহাবিশ্বের অন্দরে প্রবেশের ক্ষমতা অর্জন করছে।

চিত্র-১ : হাবল এবং ওয়েবের মহাকাশে তুলনামূলক অবস্থান

টেলিস্কোপের লেন্সে অথবা দর্পণে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আপতিত হলে লেন্সে অথবা দর্পণ সেই রশ্মি-গুচ্ছকে ঘনীভূত করে। যে উৎস থেকে তরঙ্গ বিকিরিত হয়েছে তার একটি প্রতিবিম্বের সৃষ্টি হয়। লেন্স অথবা দর্পণের আয়তন যত বেশি হয় আপতিত তরঙ্গের পরিমাণ ততই বেশি হয় ফলে প্রতিবিম্বের প্রকৃতিও ততই নির্ভুল হয়। সমস্যা হল তরঙ্গের প্রকৃতি নিয়ে।  তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ গামা-রশ্মি থেকে রেডিও তরঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ,নক্ষত্র হোক অথবা গ্রহ,বেশি সংখ্যককে সনাক্ত করতে হলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের যতদূর সম্ভব বিস্তৃত অংশ নথিভুক্ত করতে হবে। এই নথিভুক্তির কাজটি করে বিশাল মাপের দর্পণ (চিত্র-২)।

চিত্র-২:   হাবল এবং ওয়েবের প্রাথমিক দর্পণের তুলনা

(ওয়েব দর্পণের আয়তন প্রায় একটি টেনিস কোর্টের সমান)

নাসার হাবল টেলিস্কোপ সনাক্ত করেছে বিগব্যাঙের ৯০ কোটি বছর পরে জন্মান এয়ারেন্ডেল ( Earendel)যা পৃথিবী থেকে ১২৯০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ওয়েব টেলিস্কোপের হাত আরও লম্বা। মহাবিশ্বের এমন সব অঞ্চল  ওয়েব টেলিস্কোপের চোখে ধরা পড়বে যা আগে কোন দিন দেখা সম্ভব হয়নি। ওয়েব এমন একটা সময়ে আমাদের নিয়ে যাবে যখন প্রথম নক্ষত্র অথবা ছায়াপথ জন্ম নিয়েছিল। আজ থেকে ১৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ আগে। তাদের মধ্যে আনেকেই আজ মৃত কিন্তু তাদের বিকিরিত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবহমান। হাবল এবং জেমস ওয়েবের উৎসাহ প্রবাহিত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ থেকে তথ্য নির্মাণ।  

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb