জীবন সঙ্গী

লেখক - রাজকুমার রায়চৌধুরী


 

নীরোদ বাবু, পুরো নাম নীরোদ পুরোকায়স্থ, শর্মিলার মুখের দিকে ভালো ক’রে চেয়ে দেখলেন ৷

যাট বছরের বেশি মনে হয়না ৷ শর্মিলা যখন মারা যায় তখন বয়স ছিল ছেষষ্ঠি ৷ উনি জানেন প্রমেথিউস এজেন্সী সব সময় বয়স কমিয়ে দেয় ৷ শর্মিলা বলল –  “কি ভাবছ ৷" – “ কিছু না তোমাকে বেশ লাগছে।" 

– " আচ্ছা তুমি শেষ কবে আমায় দেখেছ?  

– " তা সাতদিন হল "।

– "আমার কি হয়েছিল?"

– “তুমি মারা গিয়েছিলে৷ সাতদিন আগে।"

– “আমাকে ভয় দেখিওনা আমি নিশ্চয় কোমায় ছিলাম। "

– “না তুমি মারা গিয়েছিলে৷ তুমি যদি তোমার গায়ে হাত দিতে পারতে, বুঝতে তোমার শরীর কৃত্রিম।”  

শর্মিলা এখনও নিশ্চল৷ তবে ডাঃ অরিজিত বর্মন আশ্বাস দিয়েছেন শর্মিলাকে সচল করবেন ৷

– “কেন আমার শরীর কি প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি?

– “ প্ল্যাস্টিক নয় রাবার৷ একটা বিশেষ ধরনের রাবার ৷ এর রং টা তোমার গায়ের চামড়ার রং এর মতো।"

– “এর মানে আমি একটা রোবট।" 

– “ না,  তুমি রোবট নও ৷ রোবটের ক্ষমতা তোমার নেই ৷ এর জটিল নাম একটা আছে ৷ তবে  আমি একটা নাম দিয়েছি। "

– “কী নাম?"

– “জীবন সঙ্গী ৷ আসলে তুমি একটি স্মৃতির অয়বব বলতে পার ৷ তোমার মাথায় মৃত্যুর আগে তোমার যা স্মৃতি ছিল সব থাকবে ৷ তুমি আগের মতোই কথা বলতে পারবে ৷ এমন কি তুমি  বেঁচে থাকলে ঠিক যে ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে সেরকমই কথা বলতে পারবে, পুরোটা না হলেও তোমার মস্তিষ্কের অনেকটাই তোমার অবয়বের মাথায় আছে ৷

– “কিন্তু এই যে আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি, তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি, এটা কী ক’রে হচ্ছে।"

– “আমরা তো যা দেখি শুনি সব উপলব্ধি করি মস্তিস্কের সাহায্যে৷ তোমার চোখের সঙ্গে মস্তিস্কের যোগাযোগ করা গেছে৷ তবে তোমার শ্রবনেন্দ্রিয় কৃত্রিম ৷ আর তুমি রোবট নও। তোমার স্মৃতিতে রয়েছে রান্না করার পদ্ধতি কিন্তু এখন তুমি আমার জন্য এক কাপ চা-ও বানাতে পারবেনা"

– “কিন্তু কেন? রোবটেরা তো শুনেছি এ সমস্ত কাজই করতে পারে ৷"

- "ঠিক । কিন্তু তুমি তো ঠিক রোবট নও ৷ মৃত ব্যক্তিকে কোনো টেকনোলজিই ফিরিয়ে আনতে পারে না ৷ হয়ত কিছুদিন পরে কৃত্রিম হাত পা লাগিয়ে মোটরের সাহায্যে তুমি চলা ফেরা করতে পারবে ৷ কিন্তু সেটা রোবটের মতোই যান্ত্রিক হবে ৷ অবশ্য কিছু দিনের মধ্যেই তুমি সেটা করতে পারবে। ডাঃ অরিজিত বর্মন, যিনি তোমাকে জীবন-সঙ্গী বানিয়েছেন,  বলেছেন যে স্পর্শানুভূতিও তোমার থাকবে৷ তবে যে সব জিনিসের স্পর্শানুভুতি তোমার স্মৃতিতে ছিল শুধু সেগুলি তুমি স্পর্শ করলে বুঝতে পারবে কী জিনিস স্পর্শ করছ।"

- "আচ্ছা তোমার মনে আছে ইন্দিরার মায়ের শ্রাদ্ধে আমরা দেখলাম ইন্দিরার মা আমাদের সামনে বসে আছেন ৷ কথাও বলছেন আমার তো বেশ ভৌতিক লাগছিল ৷ তুমি বললে এখন পয়সা খরচ করলে যে কেউ এই জিনিসটা দেখাতে পারবে"।

- "ওটা পুরোনো টেকনোলজি ৷ হলোগ্রাম ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক ছবি করা হয়েছিল আর ওনার গলা নকল করে একটি ছোটো স্পিকারে রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর শুনেছিলে ৷ দেখ মানুষ মরলে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না ৷ কিন্তু এখন জীবন-সঙ্গীর যে মডেল করেছে তারও অনেক উন্নতি হবে ।  হয়তো আমি মারা যাবার পর আমি তোমার আরো উন্নত জীবন-সঙ্গী হব  ৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স যে কতদূর যেতে পারে আমরা এখন কল্পনাও করতে পারিনা। ৷ক্লোনিং এর প্রযুক্তি প্রায় লাফ দিয়ে বাড়ছে ৷ তবে আমি কিন্তু জীবন-সঙ্গী পেয়েই খুশি।"

- "আমার মনে আছে, তুমি বলতে আমি মারা গেলেও তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনবে ৷ আমি ভাবতাম তুমি তান্ত্রিকদের তুক তাকের কথা বলছ ৷ আসলে আমি ইতিহাসের ছাত্রী ৷ তুমি যে ভারচুয়াল রিয়েলিটির কথা বলতে সব বুঝতে পারতাম না ৷ আচ্ছা সুমিত কি জানে যে আমি মারা যাওয়ার পরেও তোমার সঙ্গে গল্প করছি? " 

সুমিত নীরোদ বাবু ও শর্মিলার একমাত্র সন্তান ৷ পুনেতে একটি নামকরা ডাচ কোম্সানীতে কাজ করে ৷

শর্মিলার প্রশ্ন শুনে নীরোদ বাবু বলেন -  " সুমিত  তোমার মারা যাওয়ার পর সাতদিন ছুটি নিয়ে এসেছিল ৷ তখনও তোমার এই ভারচুয়াল জীবন-সঙ্গী মডেল আমি পাই নি ৷ তবে ডাঃ বর্মন বলেছেন তুমি ওর সঙ্গে ত্রিমাত্রিক ভিডিও চ্যাট করতে পার ৷"

 দু সপ্তাহের মধ্যেই শর্মিলার কৃত্রিম শরীর চলা ফেরা করতে পারছে ৷ ডাঃ বর্মন ও ডাঃ সরকারের চেষ্টায় শর্মিলা এখন প্রায় জীবন্ত মানুষের মতো চলা ফেরা করে ৷ চা-ও বানাতে পারে ৷ তবে ডাঃ বর্মন বলেছেন – “যা ওঁনার স্মৃতিতে নেই এরকম জিনিস নতুন করে শিখতে পারবেন না ৷ তবে বেঁচে থাকলে যেরকম ভাবে কথা বলতেন স্মৃতি একস্ট্রাপোলেট করে ওরকমই কথা বলতে পারবেন”৷ কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব কথা শর্মিলা বলে যা নীরোদ বাবু 

শর্মিলাকে কোনোদিন বলেননি ৷ এই স্মৃতি শর্মিলার যখন মনে আছে নীরোদ বাবুর মনে হল হয়ত তিনি বলেছিলেন সে কথা ৷ কিন্তু শর্মিলার স্মৃতি শক্তি প্রবল হয়েছে ৷ একটা কথা ওনার মধ্যে ঘুর পাক খাচ্ছে ৷ শর্মিলার সঙ্গে কথা বলে উনি নিজেকে আর নিঃসঙ্গ মনে করছেন না। উনি জানেন যাকে আমরা চেতনা মনে করি তা শর্মিলার থাকতে পারে না ৷ শর্মিলা শুধুই ভারচুয়াল রিয়েলিটি ৷ কিন্তু শর্মিলার  স্মৃতিশক্তি এত প্রবল হবে উনি ভাবতে পারেন নি ৷

গত কালই হঠাৎ শর্মিলা জিজ্ঞেস করল - " অমিতার খবর কী?” 

নীরোদ বাবু মনে করতে পারলেন না উনি আদৌ অমিতার কথা শর্মিলাকে বলেছেন কিনা ৷”  - তুমি অমিতার নাম জানলে কি করে?”

- "বা! তুমিই তো বলেছ ৷ তোমরা একসঙ্গে ইকনমিক্স নিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ৷ তখন কী সম্পর্ক ছিল জানিনা। "

- "তোমাকে বলেছিলাম বুঝি ৷ এখন জানিনা ও কোথায় আছে ৷ শেষ খবর পেয়েছিলাম ও কানাডায় আছে ৷ ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে।"

- " বিয়ে করেনি? প্রশ্ন করে শর্মিলা মনে হল হাসল ৷ কিন্তু তা কি করে হবে?  নীরোদ বাবুর চোখের ভুল ৷ আসলে শর্মিলা বেঁচে থাকলে যেরকম হাসত সেটাই ওনার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। তবে ওর মুখের বা শরীরের কৃত্রিম মাসল তৈরি করার প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার হয়নি। যদিও নীরোদ বাবুর দৃঢ় বিশ্বাস অচিরেই এটা আবিষ্কৃত হবে ৷ তবে নীরোদ বাবুর মনে হল শর্মিলা সব হয়ত জানে ৷

অমিতা যে এখনও ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে তাও কি শর্মিলা জানে! ! তা কি করে হবে? শর্মিলা বা তার প্রাণহীন রোবট কী ক’রে নীরোদ বাবুর মনের খবর জানবে? ওনার কি স্মৃতি ভ্রম হচ্ছে ! অমিতার কথা কোনোদিন শর্মিলাকে উনি বলেছেন বলে ওনার মনে হয় না ৷

- " কী ভাবছ? একটা প্রাণহীন রাবারের মডেল কী ক’রে এত কথা জানল ? তুমি ভুলে গেছ কিন্তু আমার স্মৃতিতে রয়েছে ৷ আর অমিতার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ছিল আমি জানব কী ক’রে ! আর এখন কিছু ম্যাটার করে না ৷ এস আমরা অন্য গল্প করি ৷ তারপর নীরোদ বাবু আর শর্মিলা শিমলা বেড়ানোর গল্প করলেন ৷ সুমিতের হিল ডায়েরিয়া হয়েছিল ভুল চিকিৎসার জন্য সুমিত প্রায় মরতে বসেছিল ৷ শর্মিলা তো ধরেই নিয়েছিল ছেলে বাঁচবে না ৷ নীরোদ বাবু দিল্লিতে এক হসপিটালে সুমিতকে ভর্তি করান ৷ সুমিত একটু সুস্থ হলে প্লেনে করে সবাই কলকাতা ফেরেন ৷ শর্মিলার সব মনে আছে ৷ এমনকি যে ডাক্তার সুমিতের চিকিৎসা করেছিলেন তার নাম পর্যন্ত ৷

নীরোদ বাবুর মনে হচ্ছে শর্মিলার স্মৃতি যত প্রখর হচ্ছে ওনার নিজের স্মৃতি তত কমছে । এমনিতেই নীরোদ বাবু একটু ভুলো মানুষ ৷ চশমা মোবাইল  ওয়ালেট কোথায় রেখেছেন মাঝে মাঝেই ভুলে যান ৷ আজই সকালে ওনার একটা বই খুঁজে পাচ্ছিলেন না ৷ রাত্রে ঘুমোবার আগে বই পড়ার অভ্যেস ৷ ঘুম এলে বিছানাতেই বই রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন ৷ ঘুম ভেঙে উঠে দেখেন বই বিছানায় নেই ৷ তাকেও নেই ৷ শর্মিলাকে আজ একটু সকালেই ‘অন’ করলেন ৷ ওর পায়ের নিচে যে ব্যাটারি আছে ওটাকে রিচার্জ করতে হবে ৷ শর্মিলা রোবটের মতো চলা ফেরা করলেও নিজেকে অন অফ করতে পারে না ৷ নীরোদ বাবুর বা ডাঃ বর্মনের আঙুলের ছাপ না থাকলে ওই সুইচটা সাড়া দেয় না ৷ অবশ্য  ডাঃ বর্মন বলেছেন যে ওই সুইচটা বদলে নতুন একটা সুইচ লাগালে শর্মিলা নিজেকে নিজেই অফ অন করতে পারবে ৷ শর্মিলা বলল -  “কি হল? আজকে সকালেই অন করলে?"

– “আমার সেই বই টা যেটার গল্প তোমার সঙ্গে করছিলাম'৷ খুঁজে পাচ্ছিনা। "

- "ছোটো ঘরটাতে দেখ"।  নীরোদ বাবুর শোবার ঘরের লাগোয়া এক চিলতে ঘর আছে ৷ দরজা লাগিয়ে নিলেই একটা ছোটো ঘর হয় ৷ অবশ্য ক্যাম্প খাট ছাড়া আর কোনো ফার্নিচার ঢুকবে না ৷ ওই ঘরে একটা চেয়ারের উপর স্তুপীকৃত পুরোনো বাংলা ম্যাগাজিন আছে ৷ কিছু ম্যাগাজিন নীরোদ বাবুর ঠাকুমা পড়তেন ৷ এখন সেই সব ম্যাগাজিনের কপি নাকি লোকে বেশ ভালো টাকায় কিনে নতুন সংস্করণ বার করছে ৷ হয়তো বাংলায় বেশ কয়েকটা পি এইচ ডি ডিগ্রি হবে ওই পত্র পত্রিকার লেখা গুলির উপর ৷ প্রবাসী ও ভারতবর্ষে তো তখনকার দিনের নাম করা লেখকরা লিখতেন ৷ শর্মিলা বেশির ভাগ লেখা পড়েছে ৷ তখনকার দিনের এক সাহিত্যিকের লেখার উপর ওর রিসার্চ করার ইচ্ছে ছিল ৷ তবে নানান কারণে হয়ে উঠেনি ৷ নীরোদ বাবু নিজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন ৷ তবে ওনার নিজেরও সাহিত্য ও ইতিহাসে ঝোঁক আছে ৷ শর্মিলা নীরোদ বাবুর বাবার এক বন্ধুর মেয়ে ৷ সেই সুত্রেই ওনার সঙ্গে শর্মিলার আলাপ এবং পরে বিয়ে হয় ৷

অমিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও সেটা বন্ধুত্বের গন্ডী পেরোয়নি ৷ তা ছাড়া নীরোদ বাবুর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল শর্মিলার সঙ্গে ওনার একমাত্র পুত্রের বিয়ে দিতে ৷ নীরোদ বাবুও আপত্তি করেন নি ৷

কিন্তু নীরোদ বাবু ভাবলেন উনি অমিতার সম্পর্কে যেসব কথা শর্মিলাকে কোনোদিন  বলেননি সেই সব কথার স্মৃতি শর্মিলার স্মৃতিতে কি ভাবে রেকর্ড হয়ে গেছে ৷

নীরোদ বাবুর সন্দেহটা আরো দানা বাঁধল ৷ শর্মিলার সঙ্গে ওনার বিয়ের পর শর্মিলার মৃত্যু পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তার সব স্মৃতি যেন কেমন ধূসর হয়ে যাচ্ছে ৷

ভাবলেন ওনার হয়ত  অ্য৷লজাইমার বা ডিমেন্সিয়া এই জাতীয় কিছু অসুখ হয়েছে ৷ ডাঃ অনির্বান মল্পিক এ সব অসুখের চিকিৎসা করেন ৷ নীরোদ বাবু ডাঃ  মল্লিকের কাছে একবার চিকিৎসা করিয়েছিলেন ৷ নীরোদ বাবুর ধারণা ওনার অন্যমনস্কতা ও একটা রোগ। অবশ্য ডাঃ মল্লিক ওনাকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে উনি নিজেও খুব অন্যমনস্ক ৷ যাঁরা কোনো বিষয় নিয়ে খুব ভাবেন তাঁরা বেশির ভাগই অন্যমনস্ক প্রফেসর ৷ কিন্তু এখন নীরোদ বাবুর স্মৃতি যে ভাবে নস্ট হচ্ছে সেটাকে তো অন্যমনস্কতা বলা যাবে না ৷

আজই নীরোদ বাবুর ডাঃ মল্লিকের কাছে যাবার কথা ৷ শর্মিলাকে উনি বললেন যে একজন বন্ধুর কাছে যাবেন ।  শর্মিলা বলল - "আমাকে এখন অফ করে দাও ৷ তুমি এসে অন করে দিও।"

নীরোদ বাবুকে ডাঃ মল্রিকের চেম্বারে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি ৷ ফোন করে কখন যেতে পারেন জেনেই এসেছিলেন ৷

ডাঃ মল্লিক শর্মিলার ব্যাপারটা জানতেন৷ ডাঃ বর্মন মাঝে ডঃ মল্লিকের সঙ্গে আলোচনা করেন 

যাদের স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে তাদের মৃত্যুর পর রোবট বা জীবন-সঙ্গী করা যায় কিনা ৷ নীরোদ বাবুর দেওয়া নামটাই বেশি চালু হয়েছে ৷  এজেন্সি নীরোদ বাবুকে দু’লাখ টাকা দিয়েছে এই নামটার পেটেন্ট নেবার জন্য৷

ডাঃ মল্লিক খুব ধৈর্যের সঙ্গে নীরোদ বাবুর সমস্ত কথা শুনলেন ৷ উনি  কয়েকটা টেস্ট করাতে বললেন ৷ টেস্টের রেসাল্ট দেখে বোঝা যাবে কতখানি স্মৃতিভ্রংশ নীরোদ বাবুর হয়েছে ৷ তবে যেহেতু দৈনন্দিন জীবন যাপনে নীরোদ বাবুর কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তখন ভয় পাবার কিছু নেই ৷ কিন্তু নীরোদ বাবুর সন্দেহের কথা শুনে ডাঃ মল্লিক বললেন - "স্ট্রেন্জ ৷ জীবন-সঙ্গীর স্মৃতিতে মরার আগে পর্যন্ত যেসব ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি সেগুলি থাকার কথা । আফটার অল জীবন-সঙ্গী তো কোনো মানুষ নয় ৷ আর জীবিত লোকেরও ক্ষমতা নেই অন্যের স্মৃতিতে কী আছে তা জানা ৷ আমি একবার  ডাঃ বর্মনের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলব ৷ আমাকে উনি বলছিলেন ওনার এজেন্সি একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছে যা সফল হলে সায়েন্স ফিকশনের মতোই অনেক কিছু ঘটছে বলে মনে হবে ৷ তবে এটা তো এখনও এক্সপেরিমেন্টাল স্টেজেই আছে ৷ "

নীরোদ বাবু খানিকটা আশ্বস্ত হলেন ৷ কিন্তু মনের সন্দেহটা  দূর হল না ৷ শর্মিলাই কি  ডাঃ বর্মনের নতুন প্রজেক্টের একটা স্যাম্পল ?

 নীরোদ বাবু হঠাৎই মারা গেলেন ৷ ডঃ মল্লিক যে টেস্ট গুলো করতে বলেছিলেন সেগুলো করার আগেই ওনার মৃত্যু হল ৷ সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ছিলেন ৷ খবর পেয়েই সেই রাতেই সুমিত কোলকাতায় এল ৷ বাড়ির কাছেই একটা প্রাইভেট হসপিটালে নীরোদ বাবুকে  নিয়ে যান ওনার কয়েক জন প্রতিবেশী ৷ নীরোদ বাবু একটা হাউসিং সোসাইটির ফ্ল্যাটে থাকতেন ৷ সুমিত হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে নীরোদ বাবু কোমায় আছেন ৷ অনেক রাত পর্যন্ত সুমিত হাসপাতালেই বসেছিল ৷ পরের দিন সকালে হসপিটালের নিউরোলজির হেড এসে সুমিত কে জানান যে নীরোদ বাবুর ব্রেণ ডেথ হয়েছে ৷ ভেন্টিলেশনে হয়ত রাখা যেতে পারে কিন্তু উনি নামে মাত্র জীবিত থাকবেন ৷ চোখ ও খুলতে পারবেন না। নীরোদ বাবু হাইপার টেনশনের রুগি ছিলেন ৷ এটা ওঁনার বংশগত রোগ ৷ ওনার বাবা কাকা দুজনেই সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা গেছেন ৷ নীরোদ বাবু সুমিত কে বলেছিলেন ওনার ব্রেন ডেথ হলে যেন কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা না হয় ৷ সুমিতের লিখিত সম্মতি নিয়ে যে ডাক্তার ওনার চিকিৎসা করছিলেন তিনি নীরোদ বাবুর ভেন্টিলেশন বন্ধ করে দেন ৷ সুমিত বাবা মা দুজনকে হারিয়ে প্রচন্ড শক পেলেও নীরোদ বাবুর মৃত্যুর পর ডাঃ বর্মন কে ফোন করল ৷ নীরোদ বাবুর ইন্সিওরেন্স করা ছিল যাতে ওনাকেও জীবন-সঙ্গী করা যায় ৷ ডাঃ বর্মন সুমিতের ফোন পেয়ে তখনই হসপিটিলে হাজির হলেন ৷ নীরোদ বাবুকে দাহ করার আগে ওনার মস্তিস্কের স্মৃতি দিয়ে শর্মিলার মতই জীবন-সঙ্গী বানানোর কথা ৷ এর জন্য এজেন্সির আলাদা নার্সিং হোম আছে ৷ কিন্তু ডাঃ বর্মন বললেন যে নীরোদ বাবু কখনোই শর্মিলার মতো জীবন সঙ্গী হতে পারবে না ব্রেন ডেথের কারণে ৷ শুধু একটা পুতুল হয়ে থাকবেন ৷ হয়তো সামান্য কিছু স্মৃতি এখনো থাকতে পারে ৷ সুমিত বলল " পুতুল হলেও তাই তৈরি করুন ৷ ও তো রোবট ৷" -  "তা ঠিক ৷ কিন্তু তোমার মাকে যে প্রযুক্তি দিয়ে বানানো হয়েছে সেটা নীরোদ বাবুর ক্ষেত্রেও আমরা প্রয়োগ করব ৷ যদি ওনার ছেলে বেলার সামান্য কিছু স্মৃতিও মস্তিস্কে থেকে যায় সেটুকুও যদি নীরোদবাবুর রোবট মনে রাখতে পারে  সেটাও বিরাট ব্যাপার হবে । এ একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট হবে ৷ এর আগে এজেন্সি ব্রেন ডেথ হয়েছে এরকম কোনো লোককে জীবন-সঙ্গী বানায়নি৷"

- "কিন্তু মা মানে এখন মায়ের যে রোবট আপনারা বানিয়েছেন তাকে কি করে বোঝাবো যে বাবা আর জীবিত নেই”। সুমিতের কথা শুনে ডাঃ বর্মন বলেন – “এ ব্যাপারেও উনি ভেবেছেন।  শর্মিলার স্মৃতিতে নীরোদ বাবুর যে রক্তমাংসের স্মৃতি আছে সেটা দিয়েও ও বুঝতে পারবে যে জীবিত নীরোদ বাবুকে ও দেখছে কিনা” ৷ সুমিত অফিসকে বলে দশ দিন ছুটি নিয়েছিল ।  ততদিনে নীরোদ বাবুর জীবন-সঙ্গীর মডেল হয়ে যাওয়ার কথা ৷ ততদিন ডাঃ বর্মন শর্মিলাকে  অফ করে দিয়েছিলেন ৷ যেহেতু নীরোদ বাবু জীবিত নেই ডাঃ বর্মন বলেছেন - এর পর শর্মিলা যাতে নিজেই নিজেকে অফ অন করতে পারে সে ব্যবস্থা উনি করে দেবেন ৷

শুধু সপ্তাহে একদিন ব্যাটারী চার্জ করতে হবে ৷ সুমিত একজন কাজের লোক যোগাড় করেছে ৷ রোজ এসে বাড়ি ঘর পরিষ্কার রাখবে ৷ এখন আর রাঁধুনির দরকার নেই ৷ এখানে যে কদিন সুমিত আছে খাবার আনিয়ে খাবে ৷ সুমিত নিজেও রান্না করতে পারে ৷ এজেন্সি থেকে লোক এসে সপ্তাহে একদিন নীরোদ বাবু ও শর্মিলার ব্যাটারী চার্জ করবে ৷ এজেন্সির লোক এসে শর্মিলাকে  নিয়ে গেল আর একটা রোবটের পার্টস লাগাবে যা তে শর্মিলা  নিজেই সুইচের সাহায্যে নিজেকে অফ অন করতে পারে ৷

নীরোদ বাবুর জীবন-সঙ্গী মডেল বা রোবট তৈরি হয়েছে ৷ শর্মিলার রোবট বা জীবন-সঙ্গী রোবট এখন ডান হাত দিয়ে নিজেকে অফ অন করতে পারে ৷

সুমিতের মা আর বাবা মৃত হলেও ভারচুয়াল জীবন-সঙ্গী ৷

ডঃ বর্মন এজেন্সির লোকেদের সঙ্গে এসেছেন ৷ উনি সুমিতকে বললেন শর্মিলাকে বলতে যে  নীরোদ বাবুর মৃত্যু হয়েছে কিন্তু উনি এখন জীবন-সঙ্গী হিসেবে শর্মিলার সঙ্গে গল্প করতে পারবেন ৷ নীরোদ বাবুর স্মৃতির খুব  অল্প অংশই ওনার জীবন-সঙ্গী মডেলের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা গেছে ৷ উনি সুমিতকে দেখে চিনতে পেরেছেন ৷ কিন্তু শুধু - "সুমিত তুই এসেছিস "  বলার পর আর কিছু বললেন না ৷ শর্মিলাকে সুমিত বলল - " মা, বাবা মারা গেছেন ৷ কিন্তু  ওনার জীবন-সঙ্গীর সঙ্গে তুমি গল্প করতে পারবে। শর্মিলা শুধু সুমিতের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ৷ সুমিতের মনে হল ওর মায়ের  মুখে যেন মৃদু হাসির আভাস ৷ না এটা ওর দৃষ্টিভ্রম ৷

ডাঃ বর্মন বুঝতে পারলেন ওনার গোপন এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে ৷ শর্মিলার আর নীরোদ বাবুকে দরকার নেই ৷ ওর মস্তিষ্কে নীরোদ বাবুর প্রায় চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনের সব স্মৃতি চলে এসেছে ৷ ওর এখন নিজের দুটো সত্বা ৷ প্রায় পুতুলের মতো। নীরোদ বাবুকে এখন আর দরকার নেই ৷

শুধু আর একটা যন্ত্র বসালেই নীরোদ বাবুর কন্ঠস্বরও উনি  আয়ত্ব করতে পারবেন ৷ উনি নিজেই নিজের জীবন-সঙ্গী হবেন ৷ সামনে থাকবে নীরোদ বাবুর পুতুল ৷

অবশ্য এর পর ডাঃ বর্মনের গবেষণার বিষয় হবে স্মৃতির রিভার্স ট্র্যান্সফার ৷ কেউ ব্রেন ডেথে মারা গেলে তার জীবন সঙ্গীর স্মৃতি থেকে তার রোবট মডেল এভাবে তার পুরানো স্মৃতি ফিরে পাবে ৷ এই এক্সপেরিমেন্টে নীরোদ বাবুই হলেন প্রথম গিনিপিগ ৷

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb