বীতসত্য

লেখক - যশোধরা রায়চৌধুরী

                                                                                       ১

মালবী ওর নিজের ব্যাকপ্যাক পেছন থেকে সামনে নিয়ে এল। পেছনে যতক্ষণ ছিল যেন বোঝা ছিল। যেন একটা পিঁপড়ে চিনির ডেলা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন ওটা বর্মের মত। নিজের পকেটে ঢোকানো মালবীর হাত, হাতের ভেতরে শক্ত করে চেপে ধরা
মরিচ স্প্রে।

না অন্ধকার নয়। বাঁধানো পথ তীব্র আলোকোজ্জ্বল। আলোকিত হলেও এই নির্জন পথ যেন ওকে গিলে খেতে আসছিল। গভীর রাত নয়। এমনকি এমন কিছু বেশি সন্ধেও নয়। কিন্তু সদ্যই সূর্যাস্তের পর আঁধার নামছে। ২০৫০ দশকের  স্নায়ু জ্বালিয়ে দেওয়া  একটা গোধূলিবেলা। কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার । আকাশে সূর্যডোবার ম্লান কমলা-গোলাপি ছায়া ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ ঝুপ করে কালিঢালা। এই চির হেমন্তের দেশে সন্ধেটা ভীষণ বিষণ্ণ। তার ভেতরেই ঝুঁকিপূর্ণ এই হেঁটে যাওয়া মালবীর। দুপাশে কোন গাছপালা নেই। প্রাণহীন ইঁটকাঠের জঙ্গল।

কেন হেঁটে যাচ্ছে তবে, মালবী? কাজে না অকাজে? না কি কাজ থেকে ফিরছে? গন্তব্য কোথায়? যদি বাড়ি হয়, বাড়িতে কি কেউ নেই? বাড়িতে অপেক্ষমান মা বাবা ভাই বোন স্বামী সন্তান নেই? থাকলে তার হাঁটা এত ক্লান্ত বিষণ্ণ বিরক্ত কেন?

মালবীর কাজ আসলে শহরের এদিকে ওদিকে ঘুরে বেওয়ারিশ পথপশুদের উদ্ধার করা। জীবিত গৃহপালিত জন্তু এখন প্রায় অবলুপ্ত। রাখতে গেলে উঁচু দরের লাইসেন্স ফি দিতে হয়। এইভাবে জন্তু উদ্ধার  আপাতত সরকারের চোখে বে আইনি শুধু নয়, বিপজ্জনক। তবু মালবী করে। একটা গোপন গোষ্ঠীর একজন সে। কাজটা করে সে আনন্দ পায়। আজ একটা এলাকায় যেতে হয়েছিল।  এলাকাটা শহরের ১২৩ নং চিহ্নিত পুর অঞ্চল। ওখানে এক বাড়ির অন্ধ পঙ্গু মালকিন মারা গিয়েছেন। তাঁর উনিশটি পুষ্যি বেড়ালকে মালবী উদ্ধার করে ওদের নির্দিষ্ট পশুচিকিৎসাশালায় দিয়ে এসেছে। প্রায় সারাদিন লেগে গিয়েছে কাজটা করতে। ভীষণ ক্লান্তি এখন মালবীর গাঁটে গাঁটে।

১২৩ নং থেকে ২৩৪ নং এ ফিরতে হবে। একা থাকে।  এক বহুতলের খুপরির মত  একটা ছোট্ট ঘর তার বাসস্থান। পথটা ঝুঁকিতে ভরা। আর এই অঞ্চল এমনিতেও জনবিরল। বিশেষত গত কয়েকটি অতিমারীর পর।

মালবী অভ্যাসবশত বুকে ঝোলানো ডিভাইস চেপে ধরল। এই ডিভাইস ছাড়া দেশের কোন নাগরিকের হাঁটাচলা , পুর এলাকায় ঘোরাফেরা নিরাপদ নয়। ডিভাইসেই স্টোর করা আছে বিগত আটটি অতিমারীর ভ্যাক্সিনেশনের সার্টিফিকেট। আরো অন্যান্য অনেক পরিচয় পত্র এবং প্রশংসাপত্রের পাশাপাশি। যেকোন সময়ে ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রীয় পুলিশ তাকে ধরে প্রশ্ন করতে পারে। সব প্রশ্নের উত্তর আছে ডিভাইসে। প্রমাণ ছাড়া মৌখিক উত্তরে কাজ হবে না কিছু। কপালে জুটবে পুলিশের "সংশোধনকেন্দ্রে" রাত্রিবাস ও অবধারিত অত্যাচার।

সত্যিই ঝুঁকি আর অসুবিধে এটা । এখন এ ‘পুরুষের’ পৃথিবীতে নারীর সংখ্যা খুব খুব কম। জীবিত মনুষ্য নারী , যাকে বলে। অ্যান্ড্রয়েড নারীরা আছে। তারা নানা কাজে ব্যাপৃত । ঘরে ঘরে উষ্ণ কড়াইয়ের ওপর ঝুঁকে জিলিপি কচুরি ভাজছে রাঁধুনি অ্যান্ড্রয়েড 'রসনা'। মোটোর মুভমেন্টে যা কিছু অসুবিধা ২০২০ নাগাদ দেখা গিয়েছিল, এই ২০৫০ এ এসে তার অনেকটাই মিলিয়ে গেছে। নিখুঁত হাত পা সঞ্চালনে কয়েকটি লাল নীল বোতাম টেপার বিনিময়ে টাটকা খিচুড়ি থেকে পাস্তা বা কেক থেকে পুডিং সবকিছু বানিয়ে তুলতে পারে রসনা। অনেকগুলো ভারশানের পর রসনার এখন ১০৫ তম অবতার ঘরে ঘরে রন্ধনকর্মে রত। এছাড়া  বিছানায় বিছানায় শয্যাসংগিনী হচ্ছে যৌন অ্যান্ড্রয়েড রমণী-১, রমণী-২। আপগ্রেডেড রমণী -৩ নাকি বাজারে আসছে শিগগিরি আরো দশ রকমের মুদ্রা ও চুম্বনের তরিকা সমেত । আর হাসপাতালে হাসপাতালে অ্যান্ড্রয়েড সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, সন্তান লালন পালন করছে পালিকা-১ পালিকা-২ রা।

কিন্তু মালবী এইসব কিছু না। সে এক রক্তমাংসের মানবী। আর তাইই, আজকাল তার নারীবিহীন ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে ভয় করে। ২০৪১ এর জনগণনায় দেখা গেছে মাত্র অল্প কয়েকটি নারী রয়েছে এই দেশে। পুরুষ নারীর অনুপাত এখন ২৫-১।  ১৯৪১ থেকে ২০৪১ এই একশ বছরে ভারতে নারীর সংখ্যা কমেছে রেকর্ড হারে। মুহূর্মুহূ ভ্রূণহত্যা তো ছিলই, তাছাড়া নারীজীবনের অসুরক্ষিত অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে ২০২৬ সাল থেকে চলেছে নারীমুক্তি প্রকল্প। জিনগতভাবে প্রচেষ্টা আছে পরবর্তী প্রজন্মকে নারীহীন করে তোলার। নারী না থাকলে নারীর প্রতি জিঘাংসার ঘটনাও থাকবে না। সহজ সমাধান।

মালবী  কালো বালিশের মত একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটছে । আপাতত সেটা তার বুকের কাছে । মালবীর ব্যায়াম করা শরীরটি আপাদমস্তক প্যারাসুট কাপড়ে তৈরি  একটা কালো পোশাকে ঢাকা। মাথায় হুড দেওয়া আছে, মুখ মুখোশের আড়ালে ঢাকা।

তবু মালবীর ভয় করছে। উদ্ভট কোন অতর্কিত মোলাকাত প্রতিটি বাঁকের মুখে রয়েছে যেন। গা ছমছম করছে তার। শূন্য জনবিরল রাস্তায় শুধু পিচ্ছিল আলো। সেইসব আলোরাও যেন  কৌতূহলী চোখ দিয়ে  বিঁধিয়ে দিচ্ছে ওকে।

একাকী নারী, রাস্তায় । "তোমার একমাত্র প্রতিরোধ তোমার প্রতিরোধহীনতাই।" এই কথাটা বলতেন ওর ইশকুলের দিদিমণি।

অনেক গুলো মহল্লা পেরনোর পর এক একটি মেয়েদের ইশকুল এখন। কেননা ক্লাসরুম ভরাবার যথেষ্ট মেয়ে নেই আর। তাছাড়া কো এডুকেশন বলে এখন আর কিছু নেই। কেননা মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়লে মেয়েরাও যথেষ্ট সুরক্ষিত থাকবে না আর।

উন্নত পুরুষের জীবনে অনেক সুখ আছে এখন। উন্নত হতে হবে অবিশ্যি। তবেই পাবে নানা বেছে নেবার স্বাধীনতা। টাকা দিলেই নানান মডেলের অ্যান্ড্রয়েড নারী পাওয়া যায়। তবু যা কিছু দুর্লভ তাকেই তো মানুষ চাইবে। তাই সত্যিকার নারী দেখলে পুরুষ কামুক হয়ে ওঠে। কাছে চায়। যে কোন মূল্যে এগিয়ে এসে দখল করতে চায়। হয়ত ভাব করতেও চায়। কে জানে!। মালবী কোন পুরুষকে করে নেয়নি তার বান্ধব। অর্থাৎ ক্রাচ, মানসিকভাবে  ভর দেবার জন্য। মালবী তার  ইস্কুলে শেখা শারীরিক কসরত, যোগা-ফাইটিং, জাপানি মার্শাল আর্ট, ইস্রায়েলের ক্রাভমাগা সব নিয়মিত অভ্যাস করে। সে ভর দিলে বরং দেবে একটা কোন জীবনশৈলীতেই। আজকের দিনে লেখাপড়া শেখার চেয়ে জীবনশৈলীই গুরুত্বপূর্ণ তা কে না জানে। লেখাপড়ার কাজ সব গড়ামেধাই করে। যন্ত্রমেধা।

পুরুষকেও বেঁচে থাকতে হয় লড়াই করে। লড়াইশিক্ষা ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার অতি গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। একে তো জাত পাত, আর টাকাপয়সা ভারতের বুকে জন্ম দিয়েছে দুটো শ্রেণীর। একদলের কাছে অন্য দল অচ্ছুৎ।আছে বিধর্মীদের আলাদা এলাকা। তার ওপর স্থানিক কালিক দাঙ্গা আছে। খাবারের জন্য, খাদ্য শস্যের জন্য, রান্নার তেলের জন্য , সর্বোপরি জলের জন্য দাঙ্গা।

আরো আছে। তথ্যের জন্য দাঙ্গা। তথ্য চুরি। আপাতত গড়ামেধার অ্যান্ড্রয়েডরা তুমুলভাবে চুরি করছে তথ্য। আর, তাদের চিনে আলাদা করা যাচ্ছেনা মানুষের থেকে। উপরন্তু, তাদের হাতে আছে একটা বাড়তি সুবিধা। গড়ামেধার মেয়েদের কোন ভয় নেই। কিন্তু সত্য আর মিথ্যা। আলাদা করা যায়না। প্রায়শ ভুল হয়।

মানুষের অনেক বিপদ। অনেক ব্যথা। একজন পুরুষ কখনো ততটা একা হয়না, যতটা এক একা নারী। তার সামনে যেন গোধূলিই এক একটা দরজা বন্ধ করে দেয়। সূর্য ডুবতে ডুবতে তালা হয়ে ওঠে সে দরজার। গোল একটা পিতলের তালা।

পেছনে একটা  ছায়াচ্ছন্ন মূর্তি  আসছে না? মালবী চোখের কোণ দিয়ে দেখছে। আর তার  প্রতি পেশীতে পেশীতে জমে উঠছে আত্মরক্ষার প্রতিজ্ঞা। শরীর শক্ত হয়ে উঠছে। আবার শ্বাস দীর্ঘায়িত করে ও নিজেকে শিথিল করে দিচ্ছে, যাতে ভয় মাথায় না চড়ে বসে। তবু, যার ভয় ওরা ওকে বহুদিন দেখিয়ে এসেছে, মাথায় হাতুড়ি মেরে বসিয়ে দিয়েছে যে ভয়ের পেরেক...  যে জন্যে ও এত কসরত শিখেছে, আজ বুঝি সেই ভয় সশরীরে ওর কাছে এসে পৌঁছবে বলে পণ করেছে?

রাস্তার পাথরে ওর পায়ের শব্দ ওঠে। একাকী মালবী , রাস্তায় আজ যেন সবচেয়ে পেলব লঘু পায়ে হাঁটছে। যেন পা টিপে টিপে। আর সবচেয়ে সাহসী পাও  ফেলছে সে একইসঙ্গে। কারণ আজ যদি সেই ভয়টা তার ঘাড়ে চাপতে চেষ্টা করে, তাকে আর ছেড়ে দেওয়াদেওয়ি নেই একেবারেই। ঘাপ করে ঘুরে দাঁড়াবে মালবী আর এক আঘাতে ধরাশায়ী করবে মূর্তিটাকে। ক্রাভ মাগা তো এমনি এমনি শেখেনি! অভ্যাস করেনি অকারণে, কালারি পায়াত্তু বা আইকিদো!

                                                                                     ২

পুরুষটি  সন্তর্পণেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। শেরদিল এক সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের এই সমাজে কোন স্থান নেই। যারা বাঁ দিকে সিঁথে কেটে চুল আঁচড়ায়, ব্যায়াম করে কোমর ও পেট ছিপছিপে রাখে না, যারা নিজের ইচ্ছেমত খাবার খায়, যারা প্রতি ইশকুলের সংখ্যাগুরুদের জন্য লিখিত বিশ্বাস অবিশ্বাস ইত্যাদিতে ঢালাও সম্মতি দেয়না, বা চিরজীবন মেনে চলবে বলে খৎ লিখে দেয়না, সংখ্যালঘু বলে  এ দেশ তাকে দাগিয়ে দেয়।  দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখে।  

এই সবকটাই শেরদিল করেছে। শেরদিলের পরিবার ও করত। বাবা মা নাকি সমাজের বিধিনিষেধ না মেনে দুই জাতের মধ্যে  পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তাই ওদের বিবাহের শংসাপত্র ছিল না। ফলে শেরদিলের ঠাঁই হয়েছিল এতিমখানায় আর বাবা মা চালান হয়েছিল নীতিপুলিশ ক্যাম্পে। পরে শেরদিলের কেবল একটাই রুজিরুটি । অন্ধকার জগতে লুকিয়ে ঘোরাফেরা।  চোরাচালান করা, মানুষ, বা অ্যান্ড্রয়েড চালান থেকে পশু, খাদ্য বা দামি যে কোন  উপকরণ যা খোলাবাজারে বেচাকেনা নিষিদ্ধ। এই তো সেদিন সে এক কিলো আলু বিক্রি করেছে। আলুভাজা খেতে চেয়েছিল এক অতি ধনী ব্যক্তি। কিন্তু আলু এখন অন্যতম মহার্ঘ সব্জি। মধ্যের কুড়ি বছর মধ্যপ্রদেশ স্ফীত করে বলে আলুর চাষ বন্ধ ছিল। হারিয়ে গিয়েছে আলুর বীজের প্রায় সব প্রজাতিই ।

যদি তোমার জীবন জীবিকা হয় বে আইনি চোরাচালানির জগতে, তাহলে তোমাকে সাবধান হতেই হবে। এভাবেই শেরদিলও সাবধানে মাথা নামিয়ে হাঁটতে চলতে শিখেছে। নখর গোপন করতে শিখেছে। হাতে যদিও সে একটা ডিভাইস চেপে ধরে আছে। যে কোন নাগরিকের যা যা শংসাপত্র নিয়ে চলতে হয়, যেমন ওই আটটা সাম্প্রতিক  অতিমারীর জন্য  আটটা টিকার শংসাপত্র, তারপর ইশকুল পাশ, রক্তপরীক্ষা, নানা ধরনের আইনি শংসাপত্র, সব আছে তো বটেই। সঙ্গে আছে কিছু আলাদা নথি। যা শুধু তার মত সংখ্যালঘু লোকেদের বইতে হয়। বানানো  ফর্জি শংসাপত্রে লেখা আছে সে আসলে ব্যবসায়ী। নিরীহ একটি জিনিস নিয়ে ব্যবসা করে, বলা আছে। মেধা।

সামনে বেশ কিছুটা দূরে আরেকটি মূর্তি চলেছে। দূর থেকে দেখলে সহসা বোঝা যায়না মেয়ে না পুরুষ। বোঝা যায়না অন্য কোন পরিচয়ও। কিন্তু মানুষ এখন মানুষমাত্রকেই সন্দেহের চোখে দেখে। তাই যথেষ্ট দূরত্ব রক্ষা করেই শেরদিল হাঁটছিল।

কিন্তু নিজের ভাবনার সঙ্গে সমঝোতা করে হাঁটা খুব সুবিধের নয়। বিশেষত যেখানে পেটে টান।

আজ অন্য কারুকে খুব মহার্ঘ নিষিদ্ধ খাবার দিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজের জন্য খাবার পাওয়া যায়নি। ভাল রুটি, ভাল চাল বেমিল। আপাতত ঘাটিয়া , পচা রুটি খেতে হবে কিছুদিন। সে রুটি এক অতি প্রাচীন বেকারির তৈরি। টাকার অভাবে বেকারিটির যন্ত্রপাতি কিছুই নবীকরণ হয়নি। পুরনো, ভাঙা যন্ত্রে , এক বিশাল বড় অগ্নিময় তন্দুরের ভেতরে রাশি রাশি কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনা আটাময়দা দিয়ে তোইরি এই রুটিগুলি গরিব মানুষের খাদ্য। অন্তত দোকানে পয়সা ফেললে এই অল্পদামি রুটি পাওয়া তো যায়। দেশে যে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় অনেকটাই ত রপ্তানি হয়। দেশের মানুষের জন্য পড়ে থাকে কতটাই বা। তারপরে আছে গরিব বড়লোক খাড়াখাড়ি বিভেদ। খাদ্যশস্যের ভাঁড়ার কমছে। গোটা পৃথিবীতে এখন খাদ্য সমস্যার কাড়ানাকাড়া বাজছে।

ইস তার ভেতরেও শেরদিল  কতদিন স্বপ্ন দেখেছে বাসমতী চালের ভুরভুরে গন্ধ বেরুনো ভাতের। সেই কবে খেয়েছিল।  হাতে কিছু টাকা এলেই শেরদিল একদিন বাসমতী চালের খোঁজে যাবে।

বে আইনি চোরাচালানির নানা ধরণের খুচরো কাজ করে শেরদিল। শহরের অন্ধকার তলপেটের মত , এই রাষ্ট্রনির্মিত ঝকঝকে সমাজকাঠামোর একটা বে আইনি দিক আছে। সেখানে সে কাজ পায়। অনেক দিনই  পায়না। ফলত খাবার সে সবসময় জোগাড় করে উঠতে পারেনা।

বিষণ্ণ শেরদিল হয়ত অন্যমনস্কভাবেই একটু বেশিই এগিয়ে এসেছিল । তার চটকা ভেঙে যায় একটা তীক্ষ্ণ কন্ঠের হুঙ্কারে। সামনের কালো পোশাকের মূর্তিটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবং একটি হুংকার দিয়ে সে তেড়ে আসছে শেরদিলের দিকেই। মুখ দেখা যাচ্ছেনা আচ্ছাদনের জন্য। কিন্তু পলকের জন্য বুঝতে পারল শেরদিল - আরিব্বাস, ও একটা মেয়ে। প্রায় যুগ যুগ শেরদিল কোন মেয়ে দেখেনি। সে আরো হতচকিত হয়ে গেল।

এক মুহূর্তে শেরদিল মাটিতে, আর মূর্তি তার ওপরে রণ রঙ্গিনী ভঙ্গিতে  দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মেয়েটি এবার শেরদিলের হতভম্ব মুখ দেখে চুপ করে গেল। একটা চূড়ান্ত আঘাতের জন্য সে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত নামিয়ে আনতে যাচ্ছিল শেরদিলের চোয়াল লক্ষ করে, সেই আঘাতটা করার আগে থমকে গিয়ে, থেমে, সরে দাঁড়াল মেয়েটি। মুঠোর ভেতরে পোরা ছিল মরিচ স্প্রে। সেটার বোতাম টিপতে গিয়েও টিপল না ও।

শেরদিল হতভম্বভাব কিছুটা কাটিয়েছে এতক্ষণে। শরীর থেকে অদৃশ্য ধুলো ঝেড়ে উঠে বসেছে এবার। দু পা দূরে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে মালবী। নিজের মাথার পেছনে একবার হাত বুলিয়ে দেখল ছেলেটি।  তার মাথায় একটু লেগেছে তাছাড়া আর বিশেষ কিছুই হয়নি।

চোখে এখনো ঘোর লেগে আছে। পতনের হঠাৎ আঘাত তার স্নায়ুতন্ত্রকে যেন নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল সাময়িকভাবে।

এইবার সে দেখে মেয়েটি একটা হাত বাড়িয়েছে তার দিকে। উঠতে সাহায্য করছে ওকে। কে এই নারীমূর্তি? শেরদিলের মনে হল ছোটবেলার রূপকথায় শোনা হুরিপরি বুঝি।

মেয়েটি অনেকক্ষণ শেরদিলের শরীরী ভাষা পড়তে চেষ্টা করল। শেরদিল এখনো নেতিয়ে আছে যেন। এবার কোনমতে মেয়েটির হাত ধরে উঠে দাঁড়াল সে। মালবী  কটমট করে তার দিকে চেয়ে বলল, আপনার ব্যাপারখানা কী? আর কাজ ছিল না, আমার পিছু নেওয়া ছাড়া?

আমি ... আমি তো কারুর পিছু নিইনি! আমি আপনমনে হাঁটছিলাম। তবে হ্যাঁ আপনাকে দূর থেকে দেখে বুঝতে পারিনি পুরুষ না নাহ- নাহ- নারী।

হঠাৎ বুক চেপে আবার রাস্তার ওপরেই বসে পড়ল শেরদিল। তার মুখ নীলচে, গলার শিরা দপদপ করছে। সমস্ত শরীরে খিঁচুনি। চোখ বিস্ফারিত।

একী! একী! কী হয়েছে আপনার! মালবী আবার তাকে  টেনে তুলতে গিয়েও এই অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঝোলানো যন্ত্র টেনে 'এস ও এস' জানিয়ে কোন চিকিৎসক দলকে ডাকবে কিনা ভাবে। কিন্তু তার হাত চেপে ধরে শেরদিল আর্তকন্ঠে বলে ওঠে, হাসপাতালে দেবেন না আমাকে। মরে যাব তাহলে...খাবার আছে? কিছু খাবার দিন দয়া করে। দুতিন দিন পেটে কিছু পড়েনি আমার...

মালবী পাগলের মত নিজের ব্যাকপ্যাক খুলে হাতড়ায়। খোঁজে। ন্যাতানো বিস্কুটের প্যাকেট আর কয়েকটা এনার্জি বড়ি  বার করে ছোট জলের বোতল খুলে জল এগিয়ে দেয়। কয়েকটা বিস্কুট চিবিয়ে এক ঢোঁক জল খেয়ে আবার নেতিয়ে পড়ে ছেলেটি।

মিনিট পাঁচেক পরে আবার চোখ মেলে, তাকায় মালবীর দিকে। আমার ব্যাগে পাঁউরুটি আছে। একটু বার করে দেবেন?

থাক না, আমার থেকেই না হয় খেলেন। এবার একটু ভাল লাগছে কি? হাসপাতালে যেতে চাইলেন না কেন?

দেখছেন না, আমি বাঁদিকে সিঁথে কাটি? আমার বাবা মাকে বিবাহের নথি না থাকার জন্য ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল তো। আমাকে এতিমখানায়? এই সমাজ আমাদের মেনে নেয়নি। ছোটবেলা থেকে আমি জেনেছি যে এই সংস্থাগুলো কেমন হয়।

মালবীর শিরদাঁড়া অব্দি ঠান্ডা হয়ে আসে। এইসব সংস্থা কেমন হয় সে তো জানেনা। সে শুধু জানে তার নিজের মেয়ে ইশকুলকে আর দিদিমণিদের।

শেরদিল বলে চলে। মাথার একটা আঘাতের জন্য অনেকগুলো দিন হাসপাতালেই কেটেছে আমার। আমি জানি কী হয় ওখানে...আর যাইহোক, আমার কোন চিকিৎসা হবে না।

মাথার আঘাত?

চারবছর আগে ওই যে দাঙ্গা হয়ে গেল? আমি ওই একবারই ভাড়াটে খুনি হিসেবে খুন করতে গেছিলাম বেপাড়ায়। বাঁচার কথাই না আমার। বরাতজোরে বেঁচে ছিলাম।

ওহ!

হয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে বলেই বেঁচে ছিলাম। কে বলতে পারে। হা হা। নাহলে নিষিদ্ধ আলুভাজার প্যাকেট আর দুষ্প্রাপ্য আলুর থলি দেওয়া নেওয়া করতে করতেই মরে যেতাম একদিন খিদে না চাপতে পেরে।

 আবার সর্বাঙ্গ শক্ত, মালবীর। যেন হঠাৎ সে অনুভব করে শেরদিল একে তো পুরুষ, তায় অপরাধী। চোরাচালানকারী। সমাজের চোখে বিশ্বাসঘাতকও। জারজ সন্তান কারণ তার বাবা মার বিয়ে সিদ্ধ নয়। তাছাড়া সব সংখ্যালঘুর মত এর চুলের সিঁথি উল্টোদিকে। এও ব্যায়াম করেনা, জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। হয়ত ইশকুলেও যেত না। শ্যাওলার মত ভেসে ভেসে বেড়ায়। ...

এটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে কাজ করে গেছে এক ভীষণ পরিবর্তন। আজন্মের শিক্ষা, সমানে মাথার মধ্যে একের পর এক স্তূপীকৃত ধ্যানধারণায় , হাতুড়ি দিয়ে দিয়ে বসানো পেরেকগুলোতে কেউ যেন আবার ঠোকাঠুকি করল। বা, তার মগজের বন্দুকে কেউ যেন টেনে দিয়েছে ট্রিগার।

কিন্তু কেন? মালবী নিজেও ত আসলে বে আইনি কাজই করে। হ্যাঁ হতে পারে সে পশুদের বাঁচায়। আর শেরদিল লুঠপাট করে, বা মানুষ খুন অব্দিও করে। রাষ্ট্রের চোখে দুজনেই ত আসলে পালিয়েবাঁচা অপরাধী। সম্ভাব্য আসামি!

হঠাৎ শেরদিলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে দিল, কী যেন একটা তরংগ ভাসছে বাতাসে। হাল্লাগাড়ি আসছে!

তড়াক করে সে লাফিয়ে উঠল। দুর্বল শরীরেও। আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি তাকে চনমনে করে তুলেছে। 

আর দেরি নয়। সন্ধে সাতটায়  টহলগাড়ি বেরুবে।

চোখের তারা বিস্ফারিত হল মালবীর। এই অল্প দিনের জীবনে অনেকগুলো ছোটবড় ঘটনাই ঘটেছে। আক্রামক ভেবে নিরীহ একটা লোককে মারতে ওঠা এই প্রথম। তা বাদে, নিগ্রহ আর মন্দলোকের বদ স্পর্শ তো জলভাত... টহলগাড়ির ব্যাপারটাও হৃদয়ঙ্গম করতে এক মুহূর্ত দেরি হল না তার।

পোঁ পোঁ পোঁ।

দুজনেই উচ্চকিত হয়ে উঠল , মুখ তুলে দূরে তাকাল। ওই যে, টহল গাড়ির সাইরেন! আসছে ওরা। পুলিশ। অথবা পুলিশবেশী নীতিপুলিশ।

এক মুহূর্তে শরীর টানটান, তারপরই দুজনে দুজনের হাত ধরে দে দৌড়। অন্ধকার গলিপথে, রাজপথ থেকে যতটা দূরে সম্ভব, পালিয়ে যেতেই হবে। না হলে বিপদ। ঘোর বিপদ!

 ৩

গামলা লাগেনা আর। অজস্র গাছের মেলা এই হট হাউজে। শুধু হটহাউজই নয়। এই পলিমারে  তৈরি চালাঘরের আকার চাঁদের মত। সাদা ধবধবে জ্যোৎস্নার মত এর সমস্তটা। অপূর্ব এই পলিমার। প্লাস্টিক বলে চল্লিশ বছর আগে ডাকা হলেও , এখন এটি কিঞ্চিৎ বায়োডিগ্রেডেবল... অর্থাৎ পরিবেশদূষণে এর ভূমিকা ত্রিশ শতাংশ কমেছে। এখানেই পরীক্ষাগার এখানেই সব কাজ বুনো রামনাথের।

গাছও বসানো আছে পলিমারের কিছু থলিতে। মাটি আছে, মাটির বিকল্প কিছু গুঁড়ো আছে... উদ্ভিদের প্রাণধারণের উপযোগী।

কৃত্রিম মলয়সলিল মানে দক্ষিণাবায়ের ব্যবস্থাও করেছেন বুনো রামনাথ।

আম জাম তেঁতুল নিম ঝাড় হয়ে আছে , আছে ছোটবড় অসংখ্য ফল ও শস্যের উদ্ভিদ। আছে কলা কমলালেবু, লেবু ও জামরুলের গাছ। আছে পটল ও পেঁপে, শাঁকালু ও সিম।

সুগন্ধে আমোদিত বাতাসে ঘন্টাদুই কাটিয়ে ফিরে যান নিজের কাজের ঘরে বুনো রামনাথ। আজ বুনোদের কনফারেন্স কিনা!

"দশ বিলিয়ন, মানে দশের পরে নটা শূন্য বসালে যত নম্বর হয় পৃথিবীতে ততগুলো মানুষ ছিল পয়ঁতাল্লিশ সালে। তিনটে আঞ্চলিক যুদ্ধ আর একটা বিশ্বযুদ্ধ না হলে এতগুলো লোককে খাওয়াবার খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে দুটো পৃথিবী দরকার হত।

ভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হার এখন জন্মের হারের চেয়ে বেশি। খাদ্যশস্যের বিশাল ভান্ডারের দেশগুলো যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ২০২২ সালে আমেরিকায় বসে একদল বৈজ্ঞানিক অংক কষে দেখিয়েছিলেন ঠিক সাতাশ বছর পরে পৃথিবীতে খাদ্য থাকবে না। সেই সময় থেকে আজ অব্দি ছটা বড় দেশ যুদ্ধের কবলে গেছে। ব্রেডবাস্কেট ইউরোপ এখন মরুভূমি। ধ্বংসস্তূপ।

এ মুহূর্তে আমাদের জল নিয়ে দাঙ্গা বন্ধ করতে হবে, বন্ধ করতে হবে খাদ্য নিয়ে লড়াই। উৎপাদন করতে হবে নিজের খাবার। নিজের বাগান তৈরি করব আমরা। বন তৈরি করব নিজেদের জন্য। বুনোর দল গড়ে তুলব। তবেই পারব বেঁচে থাকতে। "

বক্তৃতা শেষ করে নিজের যন্ত্রটির দূরসঞ্চারণ বন্ধ করলেন কৃষিতাত্ত্বিক বুনো রামনাথ। কলকাতার উপকন্ঠ থেকে বুনো চালান তাঁর "বুনো" গোষ্ঠীর কাজকর্ম। একাদিক্রমে যখন বড় মিডিয়া হাউজের মৃত্যুঘন্টা বেজে যাচ্ছিল, অথবা মিডিয়া হাউজগুলো মারাত্মক দ্রুতগতিতে দেশের রাজনৈতিক দলের হাত ধরে দুটো মেরুর মধ্যে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছিল, তখন থেকেই বুনো আন্তর্জালে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের সব কাজ, লেখাপড়া, নিজের ধ্যানধারণাকে। এখন তাইই দস্তুর। কে আর মিডিয়াকে বিশ্বাস করে। নিজের মত সবাই আন্তর্জাল থেকে বেছে নেয় নিজের পছন্দসই খবর, বা খবরের ওপর টীকাটিপ্পনী।

সত্য আর মিথ্যাও অনেকটা ঘেঁটে গেছে তাই। মানুষ নিজের মত জানাচ্ছে, তথ্যের মধ্যে মিশে যাচ্ছে মনোভঙ্গির রং... অনেকটা জলমেশানো দুধ থেকে সবাইকে তাই হাঁসের মত বেছে নিতে হয় সারাৎসারটুকুই।

যন্ত্রের ভেতরে ক্যামেরায় এতক্ষণ তিনি কথা বলছিলেন। শুনছিল গোটা বিশ্বে তাঁর অজস্র অনুসারী। এবার তাঁর বন্ধু রিক পিটারসন কথা বলছেন। রিক আপাতত একটি দূর দ্বীপে আছেন। দ্বীপটা গ্রীসের অন্তর্ভুক্ত। ওখানকার জমিতে নতুন করে চাষবাস করছেন রিক। উন্নততর প্রক্রিয়ায়। মানব সভ্যতার খাদ্যসংকট বন্ধ করতেই এই চাষের আয়োজন। নতুন দুনিয়ার নতুন চাষ। ক্ষুদ্রবট দিয়ে চাষ। ক্ষুদ্রবটই ভবিষ্যৎ। বুনো রামনাথ জানেন। বড় বড় সব যন্ত্রপাতি, ফসল কাটার মেশিন থেকে শুরু করে, ট্র্যাক্টর ট্রেলার নানা রকমের কৃষিসংক্রান্ত বৃহৎ রোবটের ব্যবহার, সব ফেল পড়েছে। সব পুরনো এখন। কেননা  গড়া মেধা, যাকে ইংরেজিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে, তা তো বড় রোবট দিয়েও কাজ করায়, ক্ষুদ্রবট দিয়েও। গড়ামেধা নাম বুনো রামনাথের পিতৃস্থানীয় সুমিত বর্ধনের দেওয়া। আর ক্ষুদ্রবট নামখানা রামনাথ নিজেই দিয়েছেন। তা, বড় বড় যন্ত্র চালাতে যে অনেক জমি লাগে, অনেক বিদ্যুৎ খরচ হয়, মানুষ লাগে তবুও কিছুটা, সেসব ক্ষুদ্রবট চালাতে লাগেনা। নিবিড় কৃষি, ক্ষুদ্র অঞ্চলে কৃষ্টি। এই এখনকার মন্ত্র।

-আমার কাজ, আপনারা জানেন, স্মল রোবট নিয়ে। তিন রোবটের সমাহারে গত কুড়ি বছর আমি ছোট ক্ষেতে চাষ করার একটা মডেল বানিয়েছি। সেখানে টম ডিক আর হ্যারি কাজ করে। টম প্রথমে মাটি আলগা করে, ঝুরঝুরে করে, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে , নিউট্রিয়েন্ট দেখে, নাইট্রোজেন অক্সিজেনের পরিমাণ দেখে। তারপর  বীজ পুঁতে দেয় নির্দিষ্ট দূরত্বে। ডিক এরপর টমের গড়ামেধার তথ্য মানে ডেটা নিয়ে কাজে নামে। সে জল সার ও কীট নাশক দেয়। একেবারে মেপে মেপে অল্প করে। ঠিক যতটুকু দরকার। এতে না নষ্ট হয় মূল্যবান জল সার , না হয় কীটনাশকের আকছার ব্যবহারে অন্য প্রাণীর ক্ষতি।

দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া বীজ ব্যবহার করি আমি। বায়ো টেকনোলজি করে বানানো বীজ। ফসল এই বায়ো টেকনোলজির ফলেই সহজে নষ্ট হয়না। বিশ বিশ সাল নাগাদ পৃথিবীর সব সভ্য দেশে প্রচুর খাবার পচে নষ্ট হত। একটা কাঁদির কলার একটা কালো হয়ে গেলে দ্রুত সবকটাকে কালো করে দেয়। বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয় মূল্যবান খাদ্য। এইসব এড়ানো গেছে টেকনোলজি ব্যবহার করে। প্রযুক্তিকে সূক্ষ্ম ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে।

এইবার হ্যারির কাজ। একেবারে শেষে হ্যারি এসে ফসল তোলে, টম আর ডিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।

প্রীত মুখে বুনো রামনাথ যন্ত্রটির পর্দায় রিককে দেখছিলেন। ক্ষুদ্রবট জিন্দাবাদ!

হঠাৎ বুনো রামনাথের যন্ত্র দারোয়ান হুঁশিয়ার সিং -এর পিঁ পিঁ করে আর্তনাদে চমকে উঠলেন রামনাথ। কী হল আবার। হুঁশিয়ার সিং কে রাখা হয়েছে চালাঘরে । চালাঘরটি একাধারে গ্রিন হাউজ, একাধারে পরীক্ষণাগার।

ছুট দিয়ে বেরুলেন নিজের পড়ার ঘর থেকে রামনাথ। গ্রিন হাউজে গিয়ে দেখলেন অদ্ভুত এক দৃশ্য। দুটি মানুষ হাতে হাত ধরে এক কোণে কুঁজো হয়ে বসে আছে। গ্রিন হাউজের একটা কাচের দরজা কিছুদিন ধরে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছিল। সারানোর কথা ভেবেও, এইসব কাজের হ্যান্ডিম্যান যন্ত্রমানব দস্তুর মিস্ত্রিকে তাকের ওপর থেকে নামিয়ে চালু করতে কুঁড়েমি হয়েছিল। ফাঁকফোকর তাই থেকেই গেছিল। সেই অঞ্চল দিয়েই এরা ঢুকেছে নিশ্চিত।

চোর নয়, কারণ ওভাবে চোর বসে না। ভয়ে কাঁপতে থাকা দুই পুরুষ নারীকে দেখে বিপদের বোধই এল না বুনো রামনাথের । বরং পরিত্রাণের ইচ্ছা জাগল।

রামনাথ মনে মনে ভাবলেন, এখনো আমি মানুষ আর হুঁশিয়ার সিং অ্যান্ড্রয়েড। যন্ত্রমানব কি আর চোর আর শরণার্থীর তফাৎ বুঝতে পারে? ঐ দরজা ঠেলে যেই ঢুকবে পাসওয়ার্ড ছাড়া, তার শরীরের উষ্ণতা মেপে মানুষ বা প্রাণী বলে চিনবে হুঁশিয়ার। সেদিক থেকে সে হুঁশিয়ার বটে। অনুপ্রবেশ যে হয়েছে তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী যে আক্রমণকারী না আশ্রয়প্রার্থী তা বোঝার মত গড়ামেধা আমি এখনো হুঁশিয়ারকে তো দিতে পারিনি। এখানেই মানুষ জিতে আছে আজো। আমাদের আবেগ আছে। ভালবাসা আছে।

প্রথমেই বুনো রামনাথ হুঁশিয়ারের প্রতি একটি কমান্ড পাঠান। "শান্ত হও । সবকিছু নিরাপদ"। হুঁশিয়ারের চোখের দপদপ করা আলো আর মাথা থেকে বেরনো পিঁ পিঁ শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।

রামনাথ তারপর ওদের দিকে ফেরেন।

-ভয় পেওনা, বল কে তোমরা। এখানে ঢুকেছ কেন?

-আমাদের... আমাদের রক্ষা করুন। এই চালাঘরটায় আজ রাতের মত আশ্রয় দিন। পেছনে হাল্লাগাড়ি লেগেছিল।

-কী করেছ তোমরা?

-কিচ্ছুনা। মেয়েটি অপেক্ষাকৃত সাহসী। সে উঠে দাঁড়ায়। ছিপছিপে কালো পোশাকের মেয়ে। মুখে অসহ্য দুশ্চিন্তার ছাপ। আমি পশু -ত্রাতা। তবে কাজটা তো বে আইনি। তাই ভয়।

ওহ!!! বুঝেছি। বেওয়ারিশ জন্তুদের ত্রাণ করা কাজ তোমার!  হুম। সব জায়গায় যাওয়াটা আইনের পক্ষে বিশেষ সুবিধের না। তবে, আরো কিছু কারণ আছে তোমাদের পালানোর...

ওর জন্য। ও তো সংখ্যালঘু।

নাম কি ওর?

শেরদিল। ও আমার ... বন্ধু...। ও ক্ষুধার্ত। ওর কাজটা আমিও সমর্থন করিনা। চোরাচালানির কাজ করে ও। আর... মানে... হাল্লাগাড়ি এসে পড়ল কিনা। তাই ...

দু ঘন্টা ছুটে আসার পথে কখন যেন মালবীর বন্ধু হয়ে গেছিল শেরদিল... । আশৈশবের হাতুড়িপেটা মাথায়, পুরুষ এবং চোরাচালানকারী ... তার মানেই শত্রু... এই সমীকরণটা হঠাৎ যেন হারিয়ে গিয়েছে মালবীর মাথার মধ্যে। 

বুনো রামনাথ অল্প হাসেন।

এসো  ঘরে এসো। খাদ্য আছে এখানে।

ঘরে লম্বা টেবিলের এক ধারে তাঁর যন্ত্রপাতি। টেবিল তৈরি হয়েছে পুরনো কাগজ আর পিচবোর্ড জুড়ে জুড়ে। তৈরি করেছে গড়ামেধার দস্তুর মিস্ত্রি। যন্ত্রপাতির পাশেই আছে ছোট এক রেফ্রিজারেটর। মাটির তৈরি। বুনো রামনাথের নিজের প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি সংরক্ষণ যন্ত্র ।

ভেতর থেকে এক কাঁদি টকটকে হলুদ কলা বের করে তিনি ভীত যুবকের সামনে রাখেন।

হাউমাউ করে খেতে শুরু করে ভীত যুবক। মালবী খায়না।

মালবী চারধারে তাকিয়ে দেখতে থাকে। আবার তার হটহাউজের দিকেই ফিরতে ইচ্ছে করছে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সবুজের সমারোহ। দেখতে খুব ভাল লাগছে তার।

শেরদিলকে এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক তো এখানেই রেখে দিতে পারেন। এইসব গাছপালার ভেতরে। কোনদিন ওকে লড়াই করে খাবার জোগাড় করতে হবে না তাহলে আর...

ভাবতে ভাবতেই ও আবার হট হাউজটার দিকে চলে যায়। হুঁশিয়ার সিং প্যাট প্যাট করে তার দিকে তাকায়।

সবুজ সবুজ পাতা বার করে গাছগুলো যেন তার দিকে দুহাত মেলছে। হাত মেলাতে ইচ্ছে করে। সবুজ পাতাগুলোকে ছুঁতে ইচ্ছে করে।

বুনো রামনাথ বেরিয়ে আসেন তারই খোঁজে।

আচ্ছা , তুমি কি জানো এই শেরদিলকে চাষের কাজ দিলে ও করবে কিনা?

বলতে তো পারছি না তা। তবে ও তো অন্ধকার মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বে আইনি চোরাচালানির কাজ করে শুনলাম। সেটা তো নিরাপদ নয় একেবারেই। আপনি ওকে নেবেন আপনার এখানে?

হ্যাঁ আমার বুনোদের দলে নিতেই পারি। কিন্তু তার আগে একটা পরীক্ষা নেব ওর।

পরীক্ষা? কিসের?

উল্টোবাগে চুল আঁচড়ায় যারা, তাদের মধ্যে একদল কিন্তু মিথ্যে সংখ্যালঘু। আসলে ভালবাসে বে আইনি কাজ করতে তাই করে।

মালবী ভেতরে ভেতরে রেগে ওঠে।

ওকে দেখে তাইই মনে হল বুঝি আপনার? ও ইচ্ছে করে সংখ্যালঘু সেজে আছে? এতিমখানায় থাকার কথাটা শুনেছেন?

ওটা যদি গল্প হয়? এমনও ত হতে পারে আমার এখানে ও এসেছে দুর্মূল্য ফল বা সব্জির ফরমুলা জেনে নিয়ে সেই সব তথ্যের ব্যবসা করতে। ওর যন্ত্রে কিন্তু লেখা আছে ও তথ্য ব্যবসায়ী!

ওহো! ওটাই তো মিথ্যে। সে তো আমার যন্ত্রেও লেখা আছে আমি তথ্য ব্যবসায়ী। আমিও তো  বেআইনি ভাবে পশু ত্রাতার কাজ করি। আমিও তাহলে কি মিথ্যে করে আপনার বিষয়ে খবর নিয়ে রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছতে এসেছি?

আরে  তুমি যে চটে উঠছ। আর, আমি কিন্তু বে আইনি নই মোটেই। এই দেখ। একদিকের দেওয়াল থেকে একটা পাতলা রঙিন পর্দা সরিয়ে দেন বুনো রামনাথ। হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে দেখে মালবী।

রাষ্ট্র নিয়োজিত কৃষি সংস্থানের উচ্চপদে কাজ করেছেন রামনাথ।

এখানে লেখা আছে রামনাথ। শুধু রামনাথ। কিন্তু আপনি বললেন আপনার নাম বুনো রামনাথ।

এটা আমার বুনো হবার আগের পর্বের জীবন। আপাতত আমি বুনো। রাষ্ট্র আমাকে তাও ঘাঁটায় না। আর সেজন্যেই বলছি, তোমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটু বাজিয়ে দেখে নিয়ে, তবেই তোমাদের দুজনকেই আমার বুনোদের দলে নিয়ে নেব ।

মিথ্যে মিথ্যে আপনি এইসব করছেন স্যার!

মিথ্যে আর সত্যির ভেতরে তফাৎ করতে পারিনা বলেই ত আজ আমাদের এই দশা! বুনো রামনাথ হো হো করে হেসে ওঠেন। তারপর ভেতরে তাকিয়ে দেখেন, কলার কাঁদি শেষ করে হৃষ্ট মনে তাঁর কম্পিউটারের সামনে বসে তাঁর শেষ বক্তৃতাটি শুনছে শেরদিল।

বুনো রামনাথ এবার বলেন, তোমার নাকি এই শেরদিলের সঙ্গে আলাপই ছিল না। কিন্তু আপাতত তো দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের বন্ধুত্বটি একশো শতাংশ সত্যি! সেটা অন্তত পরখ করে নিয়েছি , তাই না?

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb