বেগুনি-হলুদ বন্ধু

লেখক - স্বর্ণেন্দু সাহা

নিয়মিত রুটিন মেনে আজ সকালেও দৌড়তে বেরিয়েছিল রাজশ্রী। শরীর সুস্থ রাখার জন্য হালকা চালে ছোটার অভ্যাস তার বহুদিনের। বিশ্রাম নিয়ে-নিয়ে সব মিলিয়ে মাইল-তিনেক দৌড়নো। হাঁফিয়ে গেছিল। আস্তে-আস্তে হেঁটে ফিরছিল বাড়ির দিকে। দৌড়ের রাস্তাটায় এমনিতে সারাদিন গাড়ি চললেও, সংখ্যায় অনেক কম। সাতসকালে গাড়ি একেবারেই থাকে না। দু’দিকে প্রচুর রকমারি গাছ। সে প্রতিদিন ফেরার পথে গাছ দেখতে-দেখতে হাঁটে। নতুন কিছু গজিয়ে উঠলে তার নজর এড়াতে পারে না। আজকে লক্ষ করল একটা ঝোপের মধ্যে থাকা ভিন্ন একটা নতুন আদল।

 ঝোপ নামেই, সবই শুকনো, ম্যাড়মেড়ে। কেবল এটাই যা শক্তিশালী। ঠিক আগাছা বলে মনে হচ্ছে না তো! চট করে সে এগিয়ে গেল। পরখ করে একটু টানতেই খুব ছোট্ট গাছটা উঠে এল হাতে। মূলে মাটি লেগে নেই। ঝকঝকে গাছ। কান্ড, ডালের রঙ গাঢ় বেগুনি। পাতাও সবুজ নয়, হলুদ। হলুদের মধ্যে লাল-লাল ছিটে। একঝলক দেখলে, নকল প্লাস্টিকের জিনিস বলে মনে হয়। কৌতূহলের সঙ্গেই সে হাত বোলাল। না, কৃত্রিম উদ্ভিদ নয়।

কিন্তু সে খেয়াল করেনি, মূলে সত্যিই সামান্যও মাটি লেগে নেই। পারদ যেভাবে হাতে লেগে থাকে না, তেমনিভাবে, একতিলও মাটি লেগে নেই মূলে। গুঁড়ো-গুঁড়ো মাটি আলতো করে লেপে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তা হয়নি এ-ক্ষেত্রে।

রাজশ্রী অনেকটা খুশির সঙ্গে হাসল। হয়ত বিরল কোনও গাছ ওর হাতে এসেছে। দারুণ ব্যাপার। এতে কী রঙের ফুল হবে কে জানে! গাছটা সযত্নে হাতে ধরে সে হাঁটতে থাকল। মন অনেক প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। সমস্ত গাছকে সে তার বন্ধু ভাবে। তার নতুন একজন বন্ধু হল। তা-ও আবার বিরল বন্ধু, সোজা কথা!

 

বাড়িতে বস্তায় মাটি তৈরি করেই রাখা থাকে, নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি, বালি, গোবর সার, নিমখোল, ফাঙ্গিসাইড মিশিয়ে। সেটা টবে ভরে, ও গাছটা রোপন করে ফেলল। এখন কয়েকদিন রোদে না-রাখাই নিয়ম। তরতরিয়ে বেড়ে চলল গাছটা। ছায়ায় থাকা অবস্থাতেই তার বাড় দেখে বিস্মিত হল রাজশ্রী। দিন-চারেকের মধ্যেই প্রায় আধ-ফুট বড় হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ইন্টারনেট সার্চ করে এই গাছের সম্বন্ধে জানবার প্রাণপাত চেষ্টা করেছে সে। কোনও সন্ধান মেলেনি। এ-রকম বর্ণনার কোনও গাছের অস্তিত্ব নেই।

নেই বললেই হল? আস্ত গাছটা ওর বাড়ির ছাদে লকলকিয়ে বাড়ছে, আর সেটা নাকি নেই? তবে কিছু না-জেনে এটার সঠিক পরিচর্যা করা মুশকিল। এরকম অদ্ভুত গাছের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিও আলাদা গোত্রের হওয়ার কথা। আপাতত জল দিচ্ছে নিয়ম করে, রোদেও রেখে দিয়েছে। গাছ বাড়ছে দুর্দান্ত।

মাস খানেক পর গাছে ফুল ফুটল। সে-দিন বিকেলে ছাদে এসেই সে চমকে উঠল। গাঢ় সবুজ রঙের ফুল, চকচকে। ডালপালা ভর্তি করে ফুলের সৌজন্যে ঝিকমিকিয়ে উঠল ছাদটা। ছাদে গাছ আছে অনেক। টবে টবে ছয়লাপ। নানান ধরণের ফুলের গাছ। সামান্য কিছু সবজির, ফলের; বেগুন, ডালিম, পেয়ারা, মুলো। কিন্তু এর মতো সুন্দর গাছ আর নেই। এর মতো সুন্দর ফুল আর নেই। ছাদের চেহারাই আমূল বদলে গেছে।

ফুলসমেত গাছের অনেক ছবি তুলল সে। সেলফিও তুলল। রাত্রে ঘুম হল অনেক তৃপ্তির, শান্তির। পরেরদিন সকাল হতেই কোনোমতে চোখে-মুখে জল দিয়ে দৌড়ে গেল ছাদে। সকালের আলোয়, ঝকঝকে রোদের মধ্যে তার বেগুনি-হলুদ বন্ধুর ফুলে-সজ্জ্বিত রূপ কতটা খুলেছে, দেখতে হবে না?

গাছ তার নিজের গর্বে গর্বিত হয়ে, মাথা উঁচু করে সবুজ ফুল, বেগুনি ডাল, হলুদ পাতার পোশাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে, হৃদয়-ভর্তি আনন্দ নিয়ে, হাতে মাটি খোঁচানোর নিড়ানি হাতে করে সে ছুট্টে গেল টবের সামনে। টবের মাটি নিয়মিত খুঁচিয়ে আলগা করে দেওয়া গাছের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। এই কাজটা সে দু’সপ্তাহে একদিন করে থাকে। হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু খোঁচাতে পারল না। বরং ছিটকে সরে এল কিছুটা। গা ঘিনঘিন করে উঠল। বমি পেল।

টবে আর মাটির চিহ্ন নেই। গতকাল বিকেলেও ছিল। আজ কেঁচোর মতো অসংখ্য কিলবিলে ছোট-ছোট সরীসৃপ ঘুরে বেড়াচ্ছে টবে। নীচে যাচ্ছে, উপরে উঠছে। একে অপরের গায়ে পেঁচিয়ে থাকছে।

চোখ বন্ধ করে সে নিজেকে খানিক ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। টব ভর্তি মাটি কোন জাদুতে পোকার পিন্ড হয়ে যাবে?

চোখ খুলেও পরিস্থিতির বদল ঘটল না। দিশাহারা হয়ে সে এবার চারদিকে তাকাল। তখনই আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল।

তার বাকি সমস্ত গাছ শুকিয়ে গেছে!

শুকিয়ে গেছে?

সে পাগলের মতো ছুটে-ছুটে যেতে লাগল, তার এক একটা গাছের কাছে। সব, সব গাছ মরে কাঠ হয়ে গেছে। কারও মধ্যে আর সবুজের কোনও চিহ্ন নেই। শুকনো ফ্যাকাসে কান্ড-রা নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঝরে গেছে সমস্ত পাতা। আর প্রত্যেকটা টবের মাটি ধারণ করেছে এক বিষণ্ণ ঘিয়ে রঙ।

কী হল! এক রাতের মধ্যে!

কী করবে বুঝে পাচ্ছে না রাজশ্রী। হতচকিত হয়েই, কতকটা উন্মাদের মতোই ঘিয়ে রঙের মাটি নিড়ানি দিয়ে খোঁচাতে আরম্ভ করল সে। কোথাও কি স্বাভাবিক মাটি এখনও আছে? নিড়ানির আক্রমণে সে তুলে আনছে এক-এক দলা ঝুরঝুরে মাটি। ভীষণ শুকনো। গত কাল বিকেলেও সে যথেষ্ট জল দিয়ে ধুইয়ে দিয়েছিল প্রতিটা গাছ, মাটি। রাতারাতি এতটা শুকিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে নিজের উপরেই। সমস্যাটা কী, সে কেন ধরতে পারছে না!

এক হ্যাঁচকা টানে শুকনো একটা গাছ উপড়ে আনল মাটি থেকে। উঠে এল নিমেষে। মূল দুর্বল। আর সেই মূলের গোড়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে দুটো ছোট্ট সরীসৃপ।

যে সরীসৃপের দঙ্গল ওই অদ্ভুত গাছের মাটি হয়ে অবস্থান করছে।

যেন পলকে ও বুঝে ফেলল রহস্যটা। আর তখনই ঘিনঘিনে একটা বায়ুস্তর যেন তার দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকল, নিরবচ্ছিন্নভাবে। ওই গাছ আসলে হয়ত এই দুনিয়ার নয়! উপলব্ধিটা তার অন্তরের একেবারে শেষবিন্ধুতে একটা রুক্ষ কাঁপুনির সৃষ্টি করল।  গুগল দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও এই গাছের কোনও হদিস পায়নি সে। ইন্টারনেট ঢুঁড়ে একটা ইমেইল আইডি পেয়েছিল, সারা পৃথিবীর গাছের ক্যাটালগ মেইনটেইন করে এমন একটা সংস্থার। তাদের কাছে সে বিশদভাবে বর্ণনা জানিয়ে মেইল করে, ছবিও এটাচ করে দেয়।

প্রত্যুত্তরে তাঁরা বলেছিলেন, এরকম কোনও গাছ হয় না। এটা নকল গাছ। তাঁরা রাজশ্রীর ই-মেইল হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল বলা যায়। সে তাদের জবাবে কোনও গুরুত্ব দেয়নি। নিজেরা জানে না বলেই সব কি মিথ্যে হয়? দরকার নেই আর কাউকে কিছু বলে। আমার গাছ আমার মতো থাকুক।

তাঁরা তার মানে ঠিকই বলেছিল। রাজশ্রী বোবার মতো চেয়ে রইল, কয়েক মিনিটের মধ্যে তার দেহটা যেন কাকতাড়ুয়ার মতো রুগ্ন হয়ে গেছে। মনের ভেতরে বাসা বেধেছে অবসাদগ্রস্ত এক-শহর ঝিমোনো কণিকা-রা। এই গাছ এই পৃথিবীর নয়। ওই সরীসৃপগুলো ওর সাঙ্গপাঙ্গ। কোনোরকমের অপার্থিব এক মিথোজিবি সম্পর্ক বর্তমান এই গাছ আর ছোট সরীসৃপগুলোর মধ্যে!

 এই গাছ কি সমস্ত গাছের শত্রু? ঝকঝকে রোদ থাকা সত্ত্বেও কুয়াশার মতো একটা সিক্ত, পরিবেশ আবছা করে দেওয়া একটা বাস্তবের অবস্থান তাকে জাপটে ধরে ফেলল। ছাড়ছে না। সব গাছ মরে গেল! এত যত্ন করে, কষ্ট করে বড় করে তোলা সব গাছকে মেরে দিল?

গায়ে কাঁটা দিল রাজশ্রীর। বিধ্বস্ত লাগছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি করছে ভয়। কোত্থেকে এল এই কালান্তক? উদ্দেশ্য কী এর? রেহাই পাওয়ার উপায় কী? এই গাছ কি সে তা হলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে? হ্যাঁ, সেটাই উচিত হবে। নয়ত পৃথিবীর সব গাছ মেরে ফেলবে এটা। এমনটা হতে দেওয়া চলবে না। কিছুতেই না।

রঙচঙে ডাল, পাতা আস্তে আস্তে দুলছে হাওয়ায়। লম্বায় ফুট-তিনেক। কী চমৎকার গাছ একটা! অন্তত এতদিন তা-ই ভাবত রাজশ্রী। কিন্তু এখন সারি-সারি মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে, লাশদের মধ্যে আনন্দে বেঁচে থাকা খুনিটাকে কী অশ্লীলই না দেখাচ্ছে! না, এর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। খুন করে ফেলবে সে এটাকে। এক্ষুনি। চোখের জল তার গাল বেয়ে ঠোঁটের পাশে পৌঁছে গেছে। নিজের বে-খেয়ালেই সে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল কখন যেন। অশ্রু মুছে নিল। শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল নিড়ানির হাতল। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল।

বেশ হাওয়া দিচ্ছে আজ সকালে। আজকের দিনটা, এই চমৎকার ভোরটা গাছদের পরিচর্যা করে, তাদের ভালবাসা নিজের মধ্যে অনুভব করে, কতই না সুন্দরভাবে কেটে যেতে পারত! তা হল না। হতে দিল না এই শয়তান গাছ! কেমন করে নিশ্চিন্তে, জাঁকালো আনন্দ চেহারায় ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো!

দাঁতে দাঁত চেপে ধরল রাজশ্রী। হাত সমেত নিড়ানিটা পিছিয়ে নিল অনেকটা, এইভাবে তৈরি হবে যথেষ্ট ভরবেগ। এই ভরবেগ সমেত আছড়ে পড়লে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে গাছের ডাল, কান্ড।

বাতাস কেটে সাঁই-সাঁই শব্দে এগিয়ে গেল নিড়ানি। লক্ষ্যস্থল মোটা কাণ্ডের মাঝখান। পড়ল প্রথম কোপ। ভেদ করতে পারল না। উলটে দুর্দান্ত অভিঘাতের কম্পন ছড়িয়ে পড়ল তার কবজিতে। ক্ষতি দূরের কথা, এতটুকু দাগও পড়ল না কাণ্ডে। বরং পিছলে গেল নিড়ানি। মসৃণ শক্ত কাণ্ডের গায়ে আঁচড়ও ফেলতে পারেনি।

মরিয়া হয়ে উঠল রাজশ্রী। গাছের যত্ন করার জিনিস দিয়ে গাছকে মারার তার অভিজ্ঞতা নেই, অভ্যাস নেই। তাই হয়ত প্রথমবার চালাতে ভুল হয়েছে। এইবার কোনও ভুল করবে না সে। ধকধক করে কাঁপতে থাকা হৃৎপিন্ডকে পাত্তা না দিয়ে ‘অস্ত্র’টা একবার বাঁক খাইয়ে বাড়ি মারল কাণ্ডে। ধারালো ফলা এই গতিবেগে ছুটলে, অনায়াসে এই পর্যায়ের কান্ডকে দু-টুকরো করে দিতে সক্ষম। কাঁধ অবধি ঝনঝনিয়ে উঠল তার। ধাক্কায় গাছ এবার কিছুটা নড়ে উঠেছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাটতে পারেনি একটুও। তারপর একটু প্রতিক্রিয়া দেখা গেল গাছের তরফে। মার খাওয়ার অব্যবহিত পরেই।

টব ছেড়ে লাফিয়ে উঠল গাছ। তার মূল জড়িয়ে ধরে রেখেছে সরীসৃপরা। পুরো টব খালি করে, টবের আদল নিয়ে সরীসৃপরা লাফিয়ে উঠল। ঠিক যেন লাফ নয়, বরং ভেসে ওঠা।

পড়িমরি করে পিছিয়ে এল রাজশ্রী। চমকানোর মতো আর কিছু বিস্ময় সে অনুভব করতে পারছে না। গাছ লাফাচ্ছে, এই ঘটনা হজম করা যায় না। কিন্তু খুব অবাক হওয়ার আর সাধ্য নেই। বরং সে হতাশ হল। ভয় পেল। যে গাছ লাফাতে পারে, সে আরও অনেককিছু করতে পারে নিশ্চয়ই! এ কোন সাপকে ঘরে এনে সে লালন-পালন করেছে! সে কি পালিয়ে যাবে? না। সে পালালে, এই গাছ এবার চলে যাবে অন্য কোথাও। সবাই প্রথমে একে আদর করেই রাখবে। যখন স্বরূপ বোঝার সময় হাজির হবে, তখন দেরি.. এখন তো গাছটা বড়ও হয়েছে। আগে যতটা সহজে একে মারা যেত, এখন যাবে না। আরও একমাস পর, আরোই কঠিন হয়ে যাবে। পৃথিবীকে উদ্ভিদ-শূন্য করে দেবে এই গাছ। সে ভাবতেও পারে না তেমন জগতের কথা। গাছ না থাকলে আর কিছুই তো বেঁচে থাকবে না, মানুষও থাকবে না! 

গাছটা আবার টবে নিজের জায়গায় বসে পড়েছে। সব কিছু শান্ত। প্রবল সূর্যালোকে আচ্ছন্ন দিনটার দিকে তাকালে আন্দাজই করা যাচ্ছে না যে এক ভয়াল জীব এসে পড়েছে, তার কেরামতির ক্যালাইডোস্কোপ সমেত, ধ্বংসাত্মক দক্ষতা সমেত।

নিড়ানি রেখে দিল রাজশ্রী। তার চোয়াল শক্ত। ধারালো কিছু কাটতে পারছে না একে, না পারুক। চিলেকোঠার ঘরে বাঁশ রাখা ছিল কিছু। সে একটা নিয়ে এল। ভারী, মোটা বাঁশ। জোরে মারলে, এর ভরবেগ অনেক। কাটবার দরকার নেই। ধাক্কায় ভেঙে দেওয়া যাবে। ফাঁকা জায়গায় তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘুরিয়ে এনে তীব্র বেগ অর্জন করে আঘাত করল গাছটাকে। লক্ষ্যে পৌঁছল না। সেটা লাফিয়ে উঠেছে ঠিক আগেই। এড়িয়ে গেল বাঁশের স্পর্শও। শূন্যে থাকা অবস্থাতেই বেশ কয়েকটা সরীসৃপ নির্ভুল লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজশ্রীর মুখের দিকে। বাঁশ বাতাস হাতড়ে অন্য দিকে ঘুরে গেছে। এখনও টাল ও বিস্ময় দুই-ই সামলে ওঠেনি সে, তার মধ্যেই মুখের দিকে ধেয়ে এল সরীসৃপরা। প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার মুখ বন্ধ হয়ে গেল, চোখও।

ওরা তার দেহে ঢুকে পড়ল কান আর নাক দিয়ে। সে ছটফট করল কিছুক্ষণ পাগলের মতো। তারপর নিথর হয়ে পড়ে গেল তার টবেদের পাশেই।

গাছটা খানিকক্ষণ টবের মধ্যে বসে রইল। সে অপেক্ষা করছিল, তার অধীনস্থ তিন-চারটে অনুচরের ফেরত আসার। ওরা লড়তে গেছে আক্রমণকারীর সঙ্গে। ফলাফল নিয়ে সে চিন্তিত নয়। তার প্রবল উন্নত মস্তিস্ক তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আর এখানে অবস্থান করা নিরাপদ নয়। যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, তার সুযোগ-সুবিধার প্রতি যথাসম্ভব নজর রাখছিল, নিয়মিত পানীয় সরবরাহ করছিল, সেই তাকে আজ মারার চেষ্টা করেছে। তাকে রক্ষা করেছে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এখানে, এই গ্রহের অন্যান্য প্রাণীরা ছিল, যারা রকমসকমে তার মতো হলেও অনেকটা নিচু স্তরের। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ওদের থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে হয়েছে তাকে। এটাই তো স্বাভাবিক। হ্যাঁ, ওরা মরে গেছে, তাতে তার কি দোষ?

কিন্তু কেউ তাকে বুঝবে না। এখানে কারও সামর্থ্য নেই তাকে বোঝার। যাইহোক, চলে যেতে হবে এই প্রাঙ্গন থেকে। সবাই গাছ ভালবাসে তা নয়। একাধিক লোক তাকে উপড়ে ফেলতে এলে, সে যুঝতে সক্ষম হবে না এখন। পরে, সে যখন বড় হয়ে যাবে, তখন পুরো গ্রহ তার সর্বশক্তি নিয়ে তেড়ে এলেও, সেই যুদ্ধে সে জিতবে অবলীলায়। আপাতত একটু সতর্ক থাকা দরকার।

সে লাফিয়ে উঠল। প্রতিটা ডাল তার ইন্দ্রিয়ের কাজ করে। সে যত বড় হবে, ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা ততই বাড়বে। শক্তিশালী ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সে এখনই বাতাসের অধিকাংশ কম্পন টের পায়। চোখ জাতীয় কিছু না-থাকলেও যে-কোনও প্রাণী বা বস্তুর অবস্থান ও অবয়ব অনুধাবন করতে সামান্যও অসুবিধা হয় না। দোতলা ছাদ থেকে সে লাফিয়ে নেমে গেল নীচে। অনুভব করতে পারছে, মাটি উপস্থিত একটু দূরেই। নিম্ন স্তরের উদ্ভিদও আছে অনেক। তার খাদ্যের অভাব হবে না।

অনুচরদের অগুনতি পায়ের মতো ব্যবহার করে সে এগিয়ে গেল পাশের বাড়ির লাগোয়া মস্ত বাগানের দিকে। সরীসৃপরা মাটি খুঁড়ে ফেলল। সে ঢুকে গেল মাটির মধ্যে। আহ! শান্তি। সরাসরি গ্রহের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে, কারও উপর নির্ভর করতে হয় না জল সরবরাহের জন্য। এই দুনিয়ায় গ্রহের মাটির মধ্যেই জল থাকে। খুব ভাল ব্যবস্থা। সে এইভাবে একদিন বড় হবে তার জন্মদাতার মতো। প্রকান্ড হবে।

পোকা বা সরীসৃপরা মাটির ভেতর দিয়ে চলে গেল ঠিক পাশেই দাঁড়ানো বৃহৎ আমগাছের মধ্যে। শুষে নিতে থাকল পুষ্টি ও প্রাণশক্তি। এইসকল পুষ্টি ওরা ভরে দেবে তাদের প্রভুর মধ্যে। প্রভু বড় হবে। অনেক, অ-নে-ক বড়। বড় হবে ওরাও। অনেক।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb