বিশ্বভরা প্রাণ

লেখক - মোহাম্মদ কাজী মামুন

                                                          ১

গাছটার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল ওয়ালি। ডালপালাগুলো এমন করে নড়ছে যেন মনে হচ্ছে কোন মানুষ হাত-পা ছুঁড়ছে। বিশাল বয়েসি কান্ডটাও যেন মনে হচ্ছে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর পাতাগুলোর সে কি আলোড়ন! পতপত করে উড়ছে উন্মাদের মত! যেন বাতাসের বিশাল পুকুরে নেমেছে একদল দুরন্ত কিশোরকিশোরী। আর রয়েছে তাদের অন্তর্ভেদী ফিসফিসানি! মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে থেকে কোটি কোটি বছর ধরে জমানো কথারা একে একে বেরিয়ে পড়ছে!

রাতের খাবার খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল ওয়ালি। ডরমেটরিটা অত বড় নয়।  আজ দুপুরে কলেজটিতে জয়েন করে এখানেই এসে উঠেছে। প্রবল একটা শংকা কাজ করছিল তার মধ্যে; সুদূর উত্তরের দেশ থেকে বাস, লঞ্চ, আর ভ্যানগাড়ির ধাক্কা সয়ে সয়ে দক্ষিনের এই গহীন জনপদে তার আগমন, প্রথমবারের মত। এই এলাকার পরিবেশ, ভাব আর ভাষা কিছুই জানা নেই তার।   কিন্তু কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকতেই ভয়টা ধুপ্‌ করে কমে এসেছিল। সবুজের বিশাল সমারোহ তার মন-প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ফলজ, কাষ্ঠ, ঔষধি, ফুলগাছ -  কি ছিল না সেখানে! দুপাশের গাছের দেয়াল ছুঁয়ে দিতে দিতে মাঝ রাস্তা বরাবর হেঁটে  যখন সে মূল প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করেছিল, তখন প্রিন্সিপালের কক্ষ দেখিয়ে দিতে কাউকে ডাকতে হয়নি, অনেক বড় করে দিক নির্দেশক অপেক্ষা করছিল তার জন্য। তবে সাইনবোর্ডটিকে অনুসরণ করে যখন সে পৌঁছেছিল বিশাল রাজকীয় ঘরটির অন্দরে, তখন কেন জানি শংকাটা ফিরে এসেছিল, আর তার হাঁটুতে মৃদু কাঁপন ধরাচ্ছিল।   

প্রিন্সিপাল অবশ্য তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। ষাট পার করা সৌম্য দর্শন ভদ্রলোকটি কলেজের নিয়মাবলী সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি নিজের স্বপ্ন, দর্শন ইত্যাদিও জানিয়েছিলেন  অকপটে। পরপর তিনবার ন্যাশনাল ট্রফি নিয়েছেন তিনি শিক্ষামন্ত্রীর হাত থেকে, ঘরের ছবিগুলো তার সাক্ষ্য ভালমতই দিচ্ছিল। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নন প্রিন্সিপাল; আরো উন্নত করতে চান তার এই প্রাণপ্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে। খুব উৎসাহ নিয়ে তিনি পেছনের জলাশয়টা দেখালেন ওয়ালিকে সনাতন আদলে গড়া জানালাটার ফাঁক দিয়ে।  খুব শীঘ্রই এটি ভরাট করে ফেলবেন আর গড়ে তুলবেন একটি অত্যাধুনিক ভবন, এই উন্মুক্ত বাণিজ্যের যুগে আলাদা একটা বাণিজ্যিক অনুষদ গড়ে না তুলে তিনি ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে চান না। ওয়ালি সব সময়ই মনোযোগী শ্রোতা; এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি, কিন্তু ভরাটের কথাটা শুনে চোখ কপালে উঠে এল তার, আর পরিবেশ পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে জিজ্ঞাস করে ফেলল, “পুকুর ভরাট না করে এ দালানটাই আরো উঁচু করা যায় না?’’ জবাব না দিয়ে যখন প্রিন্সিপাল তাকিয়ে থাকলেন নির্লিপ্ত নয়নে অনেকটা মুহূর্ত ধরে, আর কোন কথা যোগাল না ওয়ালির মুখে, মাথাটা নীচু করে ডরমেটরির দিকে এগোতে শুরু করল। পুকুরের সাথে সাথে এর চারপাশের সবুজ বনানীও যে উধাও হবে, তা জেনে তার মনটা ব্যথায় ছেয়ে গিয়েছিল, সময় গড়ালেও তা চিনচিন করে রয়ে গেল। ব্যাপারটি খুবই আশ্চর্য যে, একদিন দেখেই গাছগুলির প্রতি মায়া পড়ে গেছে, মনে হচ্ছে, যেন জন্মজন্মান্তরের বাঁধন এগুলোর সাথে! তবে ব্যাপারটা আগেও ঘটেছে,  সে যেখানেই যায়, কেমন যেন একটা অলুক্ষনে কান্ড শুরু হয়ে যায়! চিন্তাটা তার বিষাদকে বাড়িয়ে তুললো কয়েক প্রস্থ, আর তার মাথার মটর এরিয়া হঠাৎ করেই লাফাতে শুরু করল প্রবলবেগে!

২.   

দূর থেকে জিনিসটাকে একটা বিশাল বটগাছ বলেই মনে হবে। কিন্তু যতই কাছে এগুবে কেউ, বুঝতে পারবে ভুলটা, আর বিষ্ময়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে যাবে। আধুনিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। গাছটির ডালপালাগুলি আলাদা আলাদা ভবন একেকটি, আর তার পাতারা সেই ভবনেরই একেকটি কক্ষ। বটগাছের আদলে গড়ে তোলা এই কাঠামোটা আসলে কোন স্কাইস্ক্রেপার না, বরং পুরোদস্তুর শহর একটি। এর কোণে কোণে ছড়িয়ে আছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উৎকর্ষ। পরিকল্পনাটা ছিল- একটা শহর গড়ে তোলা হবে, কিন্তু সেখানে কোন বৃক্ষ থাকবে না। এই ব্যস্ত যুগে গাছকে সময় দেয়ার মত কেউ আর নেই। কিন্তু মানুষের জিনে ঢুকে রয়েছে গাছ, তাই গাছের একটা অনুভূতি বইয়ে দিতে হবে শহরটির পুরো পরিমন্ডলে; একটা হলোগ্রাফিক ইমেজ থাকবে গাছের এই শহরের শিরায় শিরায়।  এখানে এমন করে বানানো হয়েছে সব কিছু যে মানুষকে কাজ করতে হবে গাছে, বিশ্রাম বিনোদন, তাও হবে গাছে। বসে বসে ঘুমুনোর ঝিমুনি এসে গেলে একটা গাছ এসে ঠাঁই দেবে তাকে, বুলিয়ে দেবে মাথা তার শাখা-প্রশাখারা। এমনকি মানুষ গোসল সারবে গাছের জলে, মানে, গাছের গুঁড়িগুলোর মুখ সময়মত খুলে যাবে, আর পানির স্রোত বেরিয়ে পড়বে ঝরণাধারার মত।  মানুষের প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারার জন্যও থাকছে গাছের চতুর্মাত্রিক ক্রীড়াকলা। এই পুরো শহরটাতে তাই গাছেদের দেখা না থাকলেও তারাই রয়েছে প্রতিটা ইঞ্চি দখল করে।  

শহরটির সর্বোচ্চ শিখরে রয়েছে একটি সভাকক্ষ, আর সেখানে তৈরী করা হয়েছে গাছতলার মত করে অনেকগুলো সোপান। এমনিতে গাছতলাগুলো মাসের বেশীরভাগ সময়ই ফাঁকা থাকে। কিন্তু আজ সেগুলো পূর্ণ কানায় কানায়! গাছের ছায়া ও শীতলতা সেখানে উপচে উপচে পড়ছে; অথচ তার মধ্যেও কোন এক অজানা কারণে ঘামছে মানুষগুলো, আর দরদর করে পড়ছে জল তাদের শরীর গড়িয়ে! একটি গাছতলায় একজনই বসেছে, আর তলাগুলো একে অপর থেকে এমন দূরত্বে নির্মিত হয়েছে, যেন একজনের জল ও নিঃশ্বাস অপরকে স্পর্শ করতে না পারে। এই দূরত্ব সৃষ্টি সন্মার্থেই করা হয়েছে, এরা যেনতেন কেউ না, এরা শহরটির সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করা নাগরিকবৃন্দ, এদের মাঝে তারকারাজীর গ্যাপ থাকা বাঞ্ছনীয় । মেয়রের নেতৃত্বে এই আসরে হাজির হয়েছেন নামকরা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, স্থাপত্যবিদ, আবহাওয়াবিদ, ভূতাত্ত্বিক, পুরাতাত্ত্বিক, রাজনীতিক। তাঁদের আলোচনার বিষয় পৃথিবীর সামনে আবির্ভূত হওয়া এক অভূতপূর্ব বিপদ। এক মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে মানব জাতির উপর, এমন অস্তিত্ব সংকটে স্বরণকালে আর পড়তে দেখা যায়নি তাঁদের!    

লোকগুলোর মধ্যে উস্কোখুস্কো চেহারার একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, “ এত চিন্তাভাবনার কি আছে? একটা নিউক্লিয়ার বোম ছেড়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার আগে সব মানুষ ইনসুলেটেড হাবে ঢুকে যাবে।  বজ্জাতগুলি নির্মূল হোক সবংশে ।“

পাশে থেকে গোলগাল মুখের একজন বলে উঠলেন, “যত সব আহাম্মকি চিন্তা! মানুষ তাহলে কী খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবে?”

একজন মাথা নেড়ে সায় দিলেন তাকে। তারপর গোঁফের উপর হাত বুলাতে বুলাতে  বললেন, “একদম ঠিক, গাছগুলোকে মেরে ফেললে চলবে না। ওদেরকে বশ্যতায় আনতে হবে। মানুষ আদিম কাল থেকেই সংগ্রাম করে এসেছে, আর টিকে থাকার যুদ্ধে সবসময়ই জয়ী হয়েছে। এবারও পারবে।“

পাশ থেকে ন্যাড়া মাথা এক লোক ফোড়ন কাটলেন, “এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে, ভায়া? ঈশ্বরের ভরসায়?"

হঠাৎই সভাকক্ষে হাসির মৃদু ঢেউ বয়ে গেল! কিন্তু সেই হাসি থামতে না থামতেই এক কম বয়সি লোক, বোধ করি, সভার তরুণতম আলোচক, উঠে দাঁড়ালেন। মুহূর্তেই সব চোখ তার দিকে ঘুরে গেল। লোকটির চোখে-মুখে খেলে যাচ্ছিল অলৌকিক এক আভা, বিজ্ঞানীরা একে ভাল করেই চেনেন; তাদের ভাষায় এ হচ্ছে ইউরেকা লাইট। আস্তে আস্তে বোমাটা বের করতে শুরু করলেন সেই তরুণ তার শ্মশুমন্ডিত মুখের গোপন দুয়ার থেকে, "একটা চিন্তা  এসেছে আমার মাথায়! জানি না আপনাদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, তবে আমার  মনে হচ্ছে,  কাজে দেবে। ওদেরকে আবার এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতে হবে আমাদের। আবার আগের মত স্থবির, আনত করে দিতে হবে গাছগুলিকে। “   

৩.

একজন বিজ্ঞানীকে একটি রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল, তিনি সারা জীবনই গাছ নিয়ে গবেষণা করেছেন, গাছেদের মনের কথাও নাকি বুঝতে পারতেন। তার রিপোর্টটি সবিস্তারে পাঠ হলে উপস্থিত সভাসদরা ঝিম মেরে রইলেন অনেকটা সময়। আসলে ঘটনাগুলো সব মিলেমিশে অদ্ভুত সব কৌণিক তৈরী করেছিল তাদের মাথার মধ্যে, যতই মুঠোয় পুরতে যাচ্ছিলেন সেগুলোকে, আরো বেশী করে হারাচ্ছিল তারা, ধরাছোঁয়ার একদম বাহিরে! তারা দ্বিতীয়বারের মত বসেছেন বৃক্ষশহরের মগডালে, এক মাসের মধ্যেই। পৃথিবীকে বাঁচাতে করণীয় নিয়ে এক মহাপরিকল্পনা পেশ করা হবে আজ। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন সভাসদরা। সকলের কান তাই উৎকর্ণ হয়েছিল দার্শনিকের অডিও রিপোর্টটিতে।

পৃথিবীর মানুষ একটা সময় গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে মিটিংসিটিং করে যাচ্ছিল দিন-রাত, উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে ধুন্ধুমার তর্ক-বিতর্কে আকাশ বাতাস গরম হচ্ছিল ক্রমাগত, আর ধোঁয়া বেরুচ্ছিল সর্বত্র। কেউ কেউ তো রাজনীতিরও গন্ধ পাচ্ছিল – পেছনে থাকা যে জাতিগুলো উন্নত দেশগুলোকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে, তাদের থামিয়ে দেয়ার জন্যই এই রূপকথা। আসলে কিচ্ছু হবে না পৃথিবীর; তাই চলতে পারে কাঠ-কয়লার কালো ধোঁয়ার বিরতিহীন উদগীরণ। তবে এতসব কিছুর অলক্ষে চলছিল আরেক আলোড়ন, আন্দোলন, আর সভা; আর তা হচ্ছিল গাছেদের মধ্যে। তারা সংকেত পেয়েছে যে, পৃথিবীর দিন আর বেশী নেই, মানুষের ভাবনার থেকেও আগে শেষ হতে চলেছে এই ধরণীর জীবন। মানুষ দেখতে না পেলেও তারা পাচ্ছে,  টের পাচ্ছে অশনির ছায়া,  তাদের মাঝে ঝাপ্টা দিয়ে যাচ্ছে আগুনের হল্কা মুহূর্মূহু। তাদের কাছে রয়েছে স্পষ্ট সংকেত, সেই আদিম পৃথিবীতে যখন তারাই ছিল একমাত্র, তখনকার মত গরম হয়ে উঠেছে চারপাশ। তখন যেমন সব কিছুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের রাজত্ব ছিল, তার লক্ষণ পৌঁছে গেছে। বেশীরভাগ গাছের বিলুপ্তি ঘটবে মানুষের সাথে, এমনিতেও তো তাদের উচ্ছেদ করছে মানুষেরা সব জায়গা থেকে। আবার ফার্ন, ঘাসেরা রাজত্ব করবে পৃথিবী জুড়ে!

বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু গাছেরা যে মানুষের মতই অনুভূতিশীল, সেই কবেই প্রমাণ করে গেছেন। তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়ত গাছেদের ভাষাও আবিষ্কার করে ফেলতেন! মানুষেরা না জানলেও গাছেদের নিজেদের মধ্যে সব সময়ই  যোগাযোগ ছিল, নিজেদের মধ্যে হাওয়ার সংকেতে কথা বলত তারা। কিন্তু এসব ছিল একান্তই নিজেদের মধ্যে, পরাগ ভালবাসার সময়। এছাড়া আর কোন শলাপরামর্শ, মন্ত্রণা তাদের মধ্যে ছিল না মানুষের মত, কোন সভাসমিতিও তাদের পছন্দ ছিল না কোনকালেই। তাদের কাজ তো চিরকালই চুপিচুপি, নিজেদের মত করে তারা খাদ্য সংগ্রহ করে শিকড় দিয়ে রস টেনে, বায়ু থেকে কার্বন নিয়ে আর সূর্য থেকে আলো নিয়ে, আর এসব কিছুই তারা করে একটুও আওয়াজ না তুলে। তাদের কোনকিছুতেই লোক দেখানো কিছু নেই, তাই তো তাদের বেশীরভাগ কাজই চলে মাটির নীচে। তাদের অযুত নিযুত শিকড় চলতে থাকে মাটির নীচ দিয়ে, কই তারা টু শব্দ করে কখনো? মানুষের মত হাত দিয়ে হাপুস হুপুস করে আদেখলেপনার মত লোক জড়ো করে খায় না তারা। পা দিয়ে জল টেনে নিয়েই তারা জীবনধারণ করে, আর বংশবিস্তার করে, শুধু নিজেদের জন্য না, এই ধরণীর সব প্রাণের জন্যও। কেউ কেউ তাদের বিদ্রুপ করে বন্দী নির্জীব-নিথর বলে খোটা দিতে পারে; হ্যাঁ, জীব হয়েও তারা বন্দী ছিল। তবে কিনা, প্রাণীর দল বীরদর্পে যখন পদচারণ করত মাটির উপর দিয়ে, তাদের খারাপ লাগতো না। মানুষের দল একটু আওয়াজ পছন্দ করে, তা করুক, তারা তো মেনেই নিয়েছিল। কিন্তু এক সময় যে মাত্রাজ্ঞানহীন হয়ে পড়লো তারা! সব কিছু ধ্বংসের দোড় গোড়ায় নিয়ে এল!

গাছেদের উপর তো অত্যাচার ছিলই আগাগোড়া, সঙ্গে সঙ্গে মাটির তল থেকে সবকিছু টেনে নিয়ে আসতে হল, তাও তাদের খাই শেষ হল না! পাতাল, ভূতলের পর এখন তাদের আকাশতলে উপনিবেশ গড়তে ইচ্ছে জাগলো! তাদের এই অনর্গল আর নির্নিমেষ ছুটে চলার দাম দিতে হচ্ছে এখন পৃথিবীকে! মাটির তল ফুটো করেও তাদের সাধ মেটেনি। অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জগতের স্বাভাবিক নিয়মনীতি সব তছনছ করে,  সূত্র লঙ্ঘন করে যথেচ্ছ ব্যবহার করে তারা বারোটা দিয়েছে গ্রহটার। তাই সময় হয়েছে রুখে দাড়ানোর। গাছেরা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিল তাদের শেকড়কে আরো খানিকটা শক্ত করে শেকড়ের টানে শরীরটাকে ইচ্ছেমত নাড়াতে। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিল না তারা। কিন্তু এখন যখন পৃথিবীর বিপদ, তখন যেন আপনাআপনি তাদের শেকড় অর্জন করেছে ঐশ্বরিক শক্তি, গাছেরা এখন দিব্যি হাঁটতে পারে মানুষের মত, শরীরটা বেশি ভারি থাকায় অলিম্পিক বিজয়ীর মত দৌঁড়ুতে না পারলেও তাদের হাঁটার গতি নেহায়েত মন্দ নয়। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় জগতের থার্মোডাইনামিক্সের সূত্রগুলো উল্টেপাল্টে গেছে, হয়ত এরই প্রভাব পড়েছে তাদের শেকড়ে, আর তাতেই তারা অলৌকিকভাবে অর্জন করেছে দানবীয় শক্তি!

৪.

পৃথিবী জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ড্রোন, আকাশের রাস্তায় তারাই একমাত্র বাসিন্দা, কারণ পাখিদের দেখা এখন মেলেই না। ড্রোনগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে কোটি কোটি গ্যালন জল, জল না বলে  ঔষুধ বলাই শ্রেয়, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বায়োলজিস্টরা মিলে তৈরী করেছে এক অভিনব বটিকা, আর অন্য বিজ্ঞানীরা দিয়ে গেছে যথাযথ সাপোর্ট। এক কালে কলচিচিন নামক বিষাক্ত ভেষজ প্রয়োগে গাছগুলোর ক্রোমোজমকে পুরো এলোমেলো করে দেয়া হত, গাছেরা হয়ে পড়ত উন্মত্ত, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত তেজ পাখা মেলত। আজ তারই যেন রিভার্সাল কৌশল প্রয়োগ করা হল, তাদেরকে পুরো নিস্তেজ করে দেয়ার জন্য। অনেক রকম রসায়নের মিক্সচার ছিল এই সিরাপগুলোতে। এছাড়া, এক প্রকার জীবাণু তৈরী করা হল ল্যাবরেটোরিতে, গাছেদের উপর তারা বসে পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে, আর গাছেরা তাদের থেকে নাইট্রোজেন ভেবে গ্রহণ করবে এক প্রকার বিষ সিম্বায়োসিস পদ্ধতিতে। মাটির পরিবর্তে বায়ু থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারার খুশিতে ডগমগ থাকবে গাছগুলো, হালুম হালুম করে গিলতে শুরু করবে আর মাটির মধ্যে বসে যাবে দলে দলে, আর নড়বে চড়তে হবে না বেয়াড়াগুলোকে। গাছগুলোর সংবেদনযন্ত্রকে পুরো বশ করে ফেলার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কষেছিল বিজ্ঞানীরা।  

কিছু গাছের অবস্থা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেল, তারা আবার অনড় অথর্ব জীবে পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু অধিকাংশ গাছ আগে থেকেই যেন সতর্ক ছিল, তারা আকাশ থেকে ফুঁড়ে আসা কোন ধরণের বায়ু-জলই স্পর্শ করলো না, শেকড়ভিত্তিক আদিম খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতে থাকলো তারা। সেই বেঁচে যাওয়া গাছগুলি যুদ্ধ করল, গুঁড়িয়ে দিল সামনে যত স্থাপনা। তাদের সব থেকে বেশী ক্ষোভ ছিল কলকারখানাগুলির উপর, যত চিমনি দেখলো সব চোখের নিমিষে ধুলোয় মিশিয়ে দিল! যখন হামলা করছিল, তখন তাদেরকে এক একটা অতিকায় বুলডোজারের মত দেখাচ্ছিল। সে এক দেখার দৃশ্য বটে! তাদের ডালগুলো যখন মুহুর্মুহু আক্রমণ শানাচ্ছিল আর ধ্বংসস্তুপের পরিণত করছিল শহর, বন্দর, গ্রাম, হাট-বাজার, তখন মানুষের দল তাদের লেলানো সৈন্য দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করছিল। অবশ্য সন্মুখ যুদ্ধে আসার সাহস তাদের ছিল না; দূর থেকে, আড়াল-আবডাল থেকে গুলি ছুঁড়ছিল তারা, কখনো নিক্ষেপ করছিল বোমা। যে যা পারছিল তাই দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছিল গাছেদের। কিন্তু গাছেদের মনে হয় প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল, তাদের মগডালেরা অনেক উঁচু থেকে আইডেন্টিফাই করে নিয়েছিল বোমা ও গুলিবাজদের, তাই আগ্নেয়াস্ত্র তাক করার আগেই সাঁড়াশির মত করে পেঁচিয়ে ধরেছিল তারা মানুষগুলিকে, আর তাদের বারুদ আকাশেই থেকে গিয়েছিল গাছেদের একটুও ছুঁতে না পেরে। আর যাদেরকে আটকাতে পারেনি, তাদের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল তাদের ডালপালাগুলোর মধ্যে যেগুলো রোগা সেগুলো। কারণ গাছেদের তো মানুষের মত আর একটাই শরীর না। ফলে গাছেদের খুব কম ক্ষতিই করতে পেরেছিল মানুষেরা।

৫.

ঘটনাটার শুরু হয়েছিল সেই পুকুরটি থেকে। ভোরের আলো ভাল করে না ফুটতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল গাছ নিধন। মাঝ রাতে ওয়ালির দুচোখ বুঁজে এসেছিল ব্যথাটা বুকে নিয়েই। কিন্তু সূর্যোদয়ের মূহুর্তের সময় একটা তুমুল হট্টগোলে তার ঘুম ভেঙে যায়। কলেজটির প্রিন্সিপালের নির্দেশে পুকুর পাড়ের গাছগুলির পাশে জড়ো হয়েছিল একদল কাঠুরে। কিন্তু প্রথম গাছটায় কোপ লাগাতেই একটি অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটল। কয়েকটা ডাল একযোগে হুড়মুড় করে পড়ল কাঠুরিয়াদের মাথার উপর। আশপাশ থেকে অনেক মানুষ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিল সাহায্যের জন্য;  কিন্তু একটা দৃশ্য তাদের সবাইকে থমকে দিল, তাদের পা স্থির হয়ে গেল মাটিতে,  আর চোখ ঝুলে পড়ল ঝোলা গুড়ের মত। যে ডালগুলি ভেঙে পড়েছিল বলে মনে হয়েছিল, তারা আবার জায়গামত অবস্থান নিয়েছে। আর গাছগুলির কেমন একটা রাক্ষুসে ভৌতিক চেহারা হয়েছে! যদিও ঠিক আগের দিনের মতই ছিল তাদের আকার আকৃতি বেশভূষা, কিন্তু কোথাও কোন সেন্সর কাজ করছিল মনে হয়, আর তার সাহায্যে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল প্রাণীদের মত! সামনে দাড়ানো মানুষগুলির মনে হচ্ছিল, ঐ ডালগুলি কথা কইছে, আর কি যেন এক অজানা ক্রোধে তারা ফুঁসছে; শুনতে না পেয়েও মানুষগুলি কোন এক অলৌকিক সেন্সরের দৌলতে তা বুঝল।

ওয়ালি কোনমতে শার্টটা গায়ে গলিয়ে দিয়ে নেমে এসেছিল তার ডর্ম থেকে। কিন্তু ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে একটি দৃশ্য তাকেও থামিয়ে দিল, আর পিলে চমকে দিল!  তার মেরুদন্ড দিয়ে হিমশীতল  স্রোত বয়ে গেল! তার ডর্মেটরি আর পেছনের ঐ পুকুরটির ঠিক মধ্যস্থলেই ছিল একটা বিশাল তালগাছ। কিন্তু আজ ঐখানে নেই গাছটা, সে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার ডর্মের বিশাল হলরুমটির গা ঘেঁষে। কাঁপতে কাঁপতে ওয়ালি মাথাটা খানিক উঁচু করেছিল। দেখতে পেল, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটা মনে হল তার দিকেই চেয়ে রয়েছে, আর খিলখিল করে হাসছে। এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি ওয়ালি, মুহুর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়েছিল!

৬.

রৌদ্র করোজ্জল আকাশ। মৃদু হেমন্তের বায়ু বয়ে চলেছে সর্বত্র। ওয়ালি হেঁটে চলেছে সবুজ বনানীর মধ্য দিয়ে। ‘ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছে, বনের পথে যেতে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে, ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান, বিষ্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান, কান পেতেছি, চোখে মেলেছি ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি…” গাইছে সে আর বিষ্মিত নয়নে তাকাচ্ছে চতুর্দিকে। কে বলবে যে, মাত্রই কিছুদিন আগে একটা মহা প্রলয় ঘটে গেছে দুনিয়ায়! যা কেউ ভাবেনি তাই হয়েছে। এই তার মত গাছেরাও হেঁটে বেরিয়েছে দলে দলে, তবে তারা তার মত মনের আনন্দে হাটেনি, তাদের একটা যুদ্ধ ছিল, অনেক গাছকে শহীদ হতে হয়েছে সেই যুদ্ধে। যুদ্ধজয় করে গাছেরা আবার ফিরে গেছে তাদের আস্তানায়, আবার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বন্দীবেশে।  আর এতে লজ্জা নেই তাদের। মানুষের জন্য বন্দী হয়ে তো তারা থাকছে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। এক প্রকার তারা তো মানুষকে রক্ষা করতেই এসেছিল! 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb