অ্যাম্বেরার বীজমন্ত্র

লেখক - অবন্তী পাল

আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপরেই আমাকে ফের পাড়ি দিতে হবে এক ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ডের সন্ধানে। অনন্ত বিশ্বলোকে আজ গৃহহারা আমরা, মানবসভ্যতার শেষ আটজন।

ডীপ চেম্বারে দাঁড়িয়ে শায়িত বাকি দশজনের মুখের ওপর এসে পড়া রোদ্দুরের নক্সা দেখতে দেখতে অজান্তেই আমার ভেতর থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নরম আলোর খেলায় কী মায়াবী লাগছে ঘুমন্ত সারা, মিলি, শিরিনদের মুখ। এরা কি আর কোনদিনও ঘুম থেকে উঠবে না? এই কি তবে আমাদের সকলের অপরিহার্য নিয়তি? না, এত সহজে হার মানলে চলবে না, তাই তো ফের বেরিয়ে পড়তে হবে ভিন্ন নক্ষত্রলোকের খোঁজে। কিন্তু আমার মন যে গেঁথে আছে এখানে, কি করে যাই আমি?

 

আমারই এই দশা। শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত বাকিরা। কারুর দম ফেলার অবসর নেই। হবে নাই বা কেন? গত তিন বছরে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি এই উজ্জ্বল হলুদ গ্রহকে আপন করে নিতে। মাটিতে ফসল ফলাতে। একটা গাছের বীজ রোপণ করতে পারলে, এক কণা শস্যদানা ফলাতে সক্ষম হলে আজ আর অন্য ঠিকানা খোঁজার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু নাহ্, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কাছাকাছি, বিবিধ গুণে বাসযোগ্য হয়েও অ্যাম্বেরল্যুসেন্টাস নামক এই গ্রহ প্রাণ ফলাতে পারে না। নিষ্ফলা, নির্বাক, নিরুত্তাপ এক গোলক মাত্র। 

৳ প্রাক-কথা ৳

আমাদের নীল পৃথিবী ধ্বংস-লগ্নের বছর কয়েক আগে আমরা তাকে পরিত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছিলাম আমাদের সৌরজগৎ থেকে ৩৩ কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক সৌরজগতে। সেই মুহুর্তে সম্বল ছিল হলুদ গ্রহ অ্যাম্বেরা জন্মানোর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা মাত্র। আমাদের বিশেষ মহাকাশযান ক্যাপসুল রোভার-৯০৯এক্স-এ চেপে আমরা ১৮ জন প্রত্যেকে নিজস্ব স্ট্যাসিস চেম্বারে ক্রাইওস্লিপের শরণাপন্ন হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম নিজেদের, আর কোনও উপায় ছিল না যে। ওহ্, বলা হয়নি, কেন এই পদক্ষেপ?

কয়েক দশক ধরেই দ্রুতগতিতে আমাদের নীল পৃথিবী নিঃশেষ হচ্ছিল। ২৪০০'র গোড়ার দিকে যখন নভোচরী ল্যাভেন্ডারদের টিম গ্রহান্তরের সন্ধানে বেরিয়েছিল, তখনই ওরা অনতিদূরের মহাকাশ থেকে বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিল, আমাদের  পৃথিবী আর নীল নেই, কালো ধোঁয়াটে একটা গোলোকে রূপান্তরিত হচ্ছে। কথা দিয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি এক অন্য বাসযোগ্য পৃথিবীর সন্ধান নিয়ে ওরা ফিরে আসবে, টিকে থাকা সকলকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। ল্যাভেন্ডারেরা চলে যাওয়ার বছর দশেক আগে গ্রহাণু নোভা এসে ধাক্কা মেরে চূর্ন-বিচূর্ণ হয়ে যায় প্যাসিফিক মহাসাগরে। এক ধাক্কায় পৃথিবীকে ধ্বংস করতে না পারলেও, সেই তখন থেকেই ক্রমে ক্রমে নষ্ট হতে থাকে পৃথিবীর অন্তঃস্থল। বাড়তে থাকে আগ্নেয়গিরি, জোরালো ভূমিকম্প গ্রাস করে নিতে থাকে একের পর এক দেশ, উপমহাদেশ। আমরা বুঝেছিলাম আমাদের বাঁচতে হলে এই মহাকর্ষের মায়া কাটাতে হবে। কিন্তু আমরা যাব কোথায়? জনসংখ্যা কমতে কমতে যখন বিলুপ্তির কাঁটায় এসে নেমেছে, যখন প্রায় সমস্ত আশাই শেষ, তখনই আমরা খোঁজ পেয়ে গেলাম ক্যাসিওপেয়া নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত এক সম্ভাব্য সৌরজগৎ যেখানে দূর ভবিষ্যতে প্রাণের সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের হিসেব অনুযায়ী, আমাদের উন্নতমানের ক্যাপসুলের সাহায্যে আর মহাকাশপথের বিভিন্ন সময় সঙ্কোচনকারী সুড়ঙ্গপথের অবলম্বনে সেখানে পৌঁছতে যে সময় লাগবে, তাতে সেই গ্রহের জন্মলগ্ন পেরিয়ে কয়েক লক্ষ বছর পেরিয়ে গিয়ে থাকবে। ততদিনে হয়ত গ্রহ বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

 তবে, ক্রাইওস্লিপের মহিমায় আমরা বেঁচে থাকব কি না এতটা দীর্ঘমেয়াদী যাত্রায়, এই নিয়ে ছিল ঘোর সংশয়। কিন্তু আর অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। ল্যাভেন্ডারের টিমের সাথে বহুদিন আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওরা এই মহাকাশের কোথায় হারিয়েছে অথবা ঠিকানা গড়েছে, সেটা আমাদের আর কোনোদিনও জানা হবে না। অগত্যা, আমাদের গণনা আর ক্যাপসুলকে ভরসা করে আমরা অবশিষ্ট আঠারোজন মানুষ নিয়েছিলাম এক অনন্ত লিপ অফ ফেথ।

হ্যাঁ, আমাদের বিশ্বাসের জয় হয়েছিল। আমরা বারোজন পূর্ণবয়স্ক আর ছয়জন শিশু এসে পৌঁছেছিলাম এই অদ্ভুত সুন্দর ঝলমলে হলুদ গ্রহে, যা দূর মহাকাশ থেকে এক দ্যুতিময় তারা বলে ভ্রম হয়। অ্যাম্বেরার মাটিতে কারনোটাইট নামক এক বিশেষ খনিজ পদার্থের আধিক্যের কারণে এই রং আর রূপের বাহার। বায়ুমণ্ডল যথাযথ। পাথুরে ভূমি ভেদ করে পেয়েছি জলের সন্ধান! আর কি চাই? এই তো দ্বিতীয় পৃথিবী। কায়-মন দিয়ে আমরা এখানেই লেগে পড়েছিলাম আমাদের ভবিষ্যত গড়ার পরিকল্পনায় বুঁদ হয়ে।

এরপরের পদক্ষেপ উর্বর জমি পাওয়া। কতদিন ক্যাপসুলের সংরক্ষিত খাদ্যভান্ডারের ওপর ভরসা করে থাকব? ফের কোন কারণে গ্রহান্তরের প্রয়োজন হলে কিছু পুঁজি তো রাখতেই হবে। আমাদের সাথে আনা পৃথিবীর মাটির নমুনা থাকলেও, আমাদের গড়ে তোলা ল্যাবরেটরিতে তার ওপর ফসল ফলানো যায়নি। গ্রহের মাটিতে কিছুতেই বৃক্ষবীজের প্রাণ ধরে রাখা যায় না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলে? একে একে সব চেষ্টাই বিফলে যেতে থাকে, বাকি পড়ে থাকে একটাই মাত্র উপায় - ফের কোনও সুফলা গ্রহের সন্ধান। 

এবারের সফর সকলকে নিয়ে সম্ভব নয়। আমাদের ক্যাপসুল এখন সর্বোচ্চ চারজন মানুষকে নিয়ে যাত্রা করতে পারবে। সেই বিশিষ্ট চারের মধ্যে আমি একজন। বাকিদের রেখে যেতে হবে এই গ্রহেই। তবে কি বাকিদের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে? না, এখানে অঙ্কটা একটু জটিল। কে শেষ পর্যন্ত বাঁচবে আর কে ফুরিয়ে যাবে, সে গণনা আজ প্রায় অসম্ভব। কারণ গ্রহ সন্ধান এবারে আরও অনিশ্চিত। আমরা চিন্তিত, এবারের ৮৯ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের সৌরজগতে আমাদের ক্যাপসুল আদৌ আমাদের পৌঁছে দিতে পারবে কি না। এবারের সম্ভাব্য যাত্রা যে টাইম ওয়ার্পের মধ্যে দিয়ে ছকা আছে, সেটি আমাদের চূড়ান্ত বেগে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে। কিন্তু তার হদিস সম্পর্কে আমরা স্রেফ অনুমান করতে পারছি, এখনও নিশ্চিত নই তার অবস্থান ঠিক কোথায়। ভিন্ন গ্রহে পৌঁছে অনুকূল অবস্থা পেলে তবেই আমরা বার্তা পাঠাব অ্যাম্বেরায়। এই এতগুলো সম্ভাবনা যদি সত্যিই ফলপ্রসূ হয়, তবেই আমাদের আসল জয়, মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে পারার জয়। আর তা না হলে, নীরবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব আমরা...

যদি আমাদের জয় আসে, তাহলে সুফলা গ্রহে আমাদের সাথে বয়ে নিয়ে চলা ক্রায়ওপ্রিসার্ভড এমব্রিও ফের সংস্থাপন করার চেষ্টা করব। বিলুপ্তির শেষ সীমানায় এসে এইটুকু ত্যাগ তো অপরিহার্য, তাই না? কী, ত্যাগ কেন বললাম? এখানেই তো আমার মস্তিষ্কের সাথে মনের তুমুল দ্বন্দ্ব। আমার মন কিছুতেই এই যাত্রায় সায় দিচ্ছে না। আর ঘন্টাকয়েক পর আমি চিরতরে আমার সন্তানের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চলেছি। আমার নয় বছরের একমাত্র কন্যারত্ন জ্যাসমিনকে এই মৃত গ্রহে নির্মম নিয়তির হাতে রেখে আমি যাব কিভাবে? বিশেষত যখন জানি, আর হয়তো কোনদিনও আমাদের দেখা হবে না? মনেপ্রাণে এখনও চাইছি কোনও চমৎকার ঘটে যাক। আটকে যাক আমার এই চলে যাওয়া। কিন্তু... গত একবছরে আমার সামনে শায়িত দশজনের শরীরে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া এনেছে বিষাক্ত অ্যাম্বেরার পরিবেশ। প্রত্যেকের গায়ের মসৃণ ত্বক রুক্ষ হয়েছে, ঘোলাটে হয়েছে চামড়ার রঙ। অজস্র সরু আঁশের মতন লম্বা সুতো বেরিয়ে এসেছে কারুর কান, কারুর মাথা, কারুর বা নখ থেকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই সুতোগুলো জীবন্ত। এদের মধ্যে রক্ত সঞ্ছালনা হয়। সরু হলেও শক্তপোক্ত, টেনে ছেঁড়া একরকম অসম্ভব। কোন অজানা জীব কি তাহলে এদের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করে চলেছে? শিরিনদের জীবন্ত শব বানিয়ে আপাত-অদৃশ্য এই ভীনগ্রহীরা কি তাদের উপনিবেশ তৈরি করতে চলেছে? এই মূহুর্তে এর কোন সঠিক উত্তর জানা নেই। প্রয়োজন অন্য রাস্তা খোঁজা আর সতর্কতা অবলম্বন করা। 

এলোমেলো ভাবনা সরিয়ে মুখ তুলে তাকালাম ডীপ চেম্বারের বিশালাকার ডিম্বাকৃতি জানলার দিকে। এই হিমঘরে ঘুমন্ত দশজনকে বরফশীতল তাপমাত্রায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে ইনভার উপদেশ অনুযায়ী। আমাদের ক্যাপ্সুলের অভ্যন্তরীন সহকারী এ.আই. বট ইনভা জানিয়েছে, এদের বাঁচিয়ে রাখার মূলমন্ত্র সূর্যের আলো আর হলুদ গ্রহের স্পর্শ। ইনভার নির্ভুল পথপ্রদর্শনের কারণেই আমরা সুদূর নক্ষত্রলোক পেরিয়ে পৃথিবী থেকে এই গ্রহ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পেরেছি। এবারেও তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। তাই এমন পরস্পরবিরোধী ঘরের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে বরফাচ্ছাদিত পরিবেশের মধ্যেও থাকবে আলতো তাপের আচ্ছাদন। যতক্ষণ সূর্য জেগে থাকে অ্যাম্বেরার আকাশে, ততক্ষণ সূর্যকিরণ এসে পড়ে এদের গায়ে। একমনে বাইরের সোনালি আকাশ দেখতে দেখতে জ্বালা করে উঠল আমার চোখ দুটো। চোখ নামিয়ে নিয়ে পূব আকাশের জানলায় ফের চোখ রাখলাম। রুক্ষ হলুদ মাটি দেখতে দেখতে চোখ পড়ল ওই দূরে। আরে, ওটা ইসা না? এই গনগনে গরমে ও ফের মাঠের মধ্যে স্পেস-স্যুট ছাড়া কি করছে? মেয়েটাকে বলে বলে পারা যায় না, যখন তখন খালি পায়ে এমনিই বেরিয়ে পড়ে। একেই অসাবধানতার কারণে আমাদের এতজন সদস্য অনিশ্চিত ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে। তাও হুঁশ নেই ইসার। ওখানে থমকে দাঁড়িয়ে একমনে কী যে দেখছে, কে জানে? 

ইসা আমার মেয়ের মতনই। যেমন আমার সামনে থাকা এরা দশজন। বড্ড বেশি উচ্ছল ছিল এরা। বহুবার সতর্ক করার পরেও, রক্ষা-জ্যাকেট ছাড়াই এই গ্রহের মাটির নমুনা নিয়ে কাজ করেছে, দিনের পর দিন। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এই গ্রহের গর্ভে প্রাণ আনতে। কিন্তু আজ এদেরই এই পরিণতি। তবে ইসা কিন্তু আর সকলের থেকে আলাদা। যেখানে আমরা মরিয়া হয়ে থাকি প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে, সেখানে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হেসেখেলে বেড়ায়। যেখানে আমরা বেপরোয়া একটা শস্যদানা পাওয়ার আশায়, সেখানে ওকে দেখলে মনে হয় এই শুষ্ক জমিতেও চেটেপুটে আস্বাদন করে নিচ্ছে উজ্জ্বল রৌদ্র। যেখানে আমরা সতর্ক এই ভিনগ্রহী বায়ুমণ্ডলে এসে, সেখানে ও অবলীলায় একে আপন করে নিয়ে এর মাটিতে নাচতে নাচতে ঘুরে বেড়ায়। বিপদের মাত্রা এতটুকু বোঝে না, সেটা মোটেও নয়। ভবিষ্যতের আশায় আজকের দামী মুহুর্তগুলো হারাতে নারাজ। ইসার কথা অনুযায়ী, মানবসভ্যতার বিদায়লগ্ন আসুক আনন্দে, নিরাশায় নয়। তো এই ইসা প্রতিদিন আমার আর একাধিকজনের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও দিব্যি গত দুই বছরে চাষের মাটিতে নিজের হাত লাগিয়েছে, যন্ত্র ব্যবহার না করে। যেখানে আমরা সুরক্ষাকবচ হিসেবে স্পেস-স্যুটের ওপর বাড়তি গ্লাভস পরে কাজ করতাম, সেখানে ও বিনা জুতোয় নিজের খালি পায়ে বালির ওপর আঁকিবুকি কেটে গেছে। জলের মতন হাল্কা, মসৃণ না কি এখানকার বালিয়াড়ি ভূমি। কে জানে? 

জানার কৌতূহল যে আমার হয় না, তা নয়। তবে ভয় হয়, বাকি দশজনের মতন আমাদেরও ভবিতব্য না হয় এই ঘুমন্ত ক্যাবিনে। তাহলে কি এই বাড়তি নিরাপত্তা পাপ? গ্রহান্তরের প্রয়োজন অনুভব করা অন্যায়? কিন্তু সে কথা বোঝায় কে ইসাকে? তার অভিমতে, দশজনের কেউই তো মৃত নয়। কোন না কোন সময়ে এদের প্রত্যেকেই দীর্ঘক্ষণ সরাসরি সংস্পর্শে এসেছে অ্যাম্বেরার জল হাওয়া মাটির সাথে। হিমশীতল গ্রহের মাটিতে এদের দেহ আজও পচনহীন। ইসার মতে, ওদের দেহে ক্ষয় নেই কারণ ওরা নাকি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনছে সঠিক সময়ে এই পরিবেশের উপযোগী হয়ে জেগে ওঠার জন্য। এই মনগড়া বৃত্তান্ত গ্রহণযোগ্য হলে ওরা কি বিগত এক বছরে একটুও প্রাণের স্পন্দন দেখাত না? স্থবির হয়ে কী এমন সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে? উন্মাদের প্রলাপ, মিথ্যে, সব মিথ্যে! আর কয়েক ঘণ্টা পরে তো সব শেষ হয়ে যাব, অন্তত আমার জন্য। অনেক দূরে চলে যেতে হবে আমার মেয়ের থেকে। আর হয়তো কোলের মধ্যে কোনদিনও ওর নরম পরশ পাবো না, নিজের ওম দিয়ে ওকে আগলাতে পারব না, ওর আর আমার সম্পূর্ন নিজস্ব জগৎকে উপভোগ করতে পারব না, মা বলে ডাকবে না কেউ শত সহস্র আলোকবর্ষ পেরিয়ে... সময় যে বড় বধির, শূন্য বড় মূক!

নিজের ভেতরে তোলপাড় চলছে, ওদিকে নিরুদ্বিগ্ন ইসা একেবারে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চিন্তিত হয়ে পড়লাম, ও অসুস্থ বোধ করছে না তো? ইসাকে কিন্তু আমি কয়েকদিন ধরেই চুপচাপ দেখছিলাম। এত প্রাণবন্ত মেয়ে, অথচ কেমন যেমন ঝিমিয়ে পড়ছে যখন তখন। ইদানিং, ওর সারা গায়ে লম্বা হলদে ছোপ ছোপ দাগ আমার চোখ এড়ায়নি। দেখে মনে হবে, কেমন দগদগে ঘা হচ্ছে শরীর জুড়ে। চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হবে, স্পষ্ট সেই হলুদ ঘায়ের ভেতরে পুঞ্জীভূত কত রস চলাফেরা করছে উথাল পাথাল! আমাদের মধ্যে মহুয়া ডাক্তার। সে বেশ কিছু পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে জানাল যে এই ধরনের কোনও অসুখের সাথে পৃথিবীর ধ্বংসমুহুর্তেও আমরা সম্মুখীন হইনি। ইসার রক্তে এমন এক জিনিসের উৎপাদন হয়েছে, যেটা ওর সমস্ত শরীরকে বিষিয়ে তুলছে, ওর মধ্যেকার সমস্ত কোষকে পাল্টে ফেলছে। আগের দশজনের ওপর এই পরিবেশের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অনুরূপ কিন্তু তাড়াতাড়ি, এত সময়সাপেক্ষ ছিল না।

"ইসার ভবিষ্যতও মনে হচ্ছে হিমঘরে হবে" হতাশ সুরে জানিয়েছিল মহুয়া। 

ইসার অসাবধানতার কারণেই যে এই সর্বনাশা সময় এসে উপস্থিত হয়েছে, সে নিয়ে আমাদের কারুর সংশয় ছিল না। অ্যাম্বেরার মাটি, তার বায়ুমণ্ডল, তার ওপর এসে পড়া আলো - কোনোটাই আর নির্ভরযোগ্য নয়। ত্রাস অজানা কিছুর উপস্থিতির, যা জন্মাচ্ছে মানুষের শরীরকে ভীত করে। যে বায়ুমণ্ডল বসবাসের জন্য আপাত ভাবে যথাযথ, সেটা যে অন্তরে এমন বিনষ্টকারী, সেটা ইসাকে দেখে বোঝা যায়। 

ইসা এবার একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু নড়েচড়ে উঠলো। বুঝি মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে নিজেকে কিছুটা দুলিয়ে নিল। এখনও মেয়েটার জেদ সমান। আমরা চাক্ষুষ ওর পরিবর্তন দেখতে পেলেও, ও কিছুতেই মানবে না যে ওর কোনরকম কষ্ট হচ্ছে। এমনকি মহুয়ার দেওয়া সমস্ত পথ্য ও নিজের ক্যাবিনেটে তুলে রেখে দিয়েছে। আর কি চমৎকার আশা করব? 

তাও মায়ের মন বলে কথা। হুহু করে উঠছে ভেতরটা। আমি তো যেতে চাই না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি যেতে বাধ্য। অবশিষ্ট আমাদের মধ্যে সবথেকে অভিজ্ঞ নভোচারী এক আমি, আর একজন হচ্ছে ডোরা। মাস দুয়েক আগে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করতে গিয়ে ডোরার এক অঘটন ঘটে যায়। এখন সে সম্পূর্ন বিশ্রামরত অবস্থায় আছে, সেরে উঠতে কমপক্ষে বছরখানেক। ততদিন দেরী করা চলে না। চারটে বাদে আমাদের ক্যাপসুলের থাকা আর দুটো স্টাসিস চেম্বার এখানকার মূল টাওয়ারে সংস্থাপন করা হয়েছে। বাকিগুলো যে নষ্ট হয়ে গেছে! আমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে আনা সংরক্ষিত কিছু এমব্রিও সমেত দুজন এই চেম্বারে নিজেদের রক্ষা করবে। অবশ্যই যদি না ইতিমধ্যে গ্রহমৃত্যু ঘটে। আর দুজন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এই মাটিতেই চমৎকার ঘটানোর। যতদিন না আমাদের তরফ থেকে কোন সঙ্কেত পাচ্ছে, ততদিন।

জ্যাসমিন হঠাৎ মা, মা করতে করতে এসে পড়ল ঘরের ভেতরে। এই মেয়ের যে স্বভাব বদলালো না। সর্বক্ষণ ছায়ার মতন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। আর কয়েক ঘণ্টা পরে কায়া-ছায়া আমরা টিকে থাকব কি করে? জ্যাসমিন কোনো সাধারণ মানবসন্তান নয়। আমার সন্তান হলেও, ওর মস্তিষ্কে জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার করা ডি.এন. এ. আছে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রদত্ত করা আছে, ধমনীতে বিশিষ্ট কিছু রক্তকোষ আছে, যার ফলে ও খালি চোখে অনেক কিছু দেখতে পায়, তার বিশ্লেষণ করতে পারে ক্ষণিকের মধ্যে। ওর মস্তিষ্ক পরিণত হওয়ার গতি বয়স আন্দাজে অনেক দ্রুত, যদিও ওর শরীর এখনও নয় বছরই বলছে। বলা যেতে পারে, ওর মধ্যে কিছু সুপার-হিউম্যান ক্ষমতা লক্ষণীয়। 

জ্যাসমিন কিন্তু গ্রহে পা দেওয়ার প্রথম মুহুর্ত থেকে বলে চলেছে, এই গ্রহ জীবন্ত, এই গ্রহ নাকি চমৎকার ঘটাতে পারে। অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে চাই ওকে। ওর এই ক্ষুদ্র জীবনে এখনও পর্যন্ত ওর কোন কথা কোনদিন ভুল হতে দেখিনি। কিন্তু সে তো আমাদের চেনা-পরিচিত পৃথিবীর গণ্ডিতে সীমিত। গ্রহান্তরের পরেও সেটা আদৌ সম্ভব নয় বলেই আমার যুক্তিবাদী মনের বিশ্বাস। 

"কী হয়েছে আমার হাসনুহানার?" আদরে সম্ভাষণ করি আমার কন্যাকে।

মিনিটখানেক আমার কোল ঘেঁষে দাঁড়ায় সে, আমার গায়ের গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করে। ভিনগ্রহী আচ্ছাদন ছেড়ে আমি ওকে বুকে টেনে নিই। অনুভব করি ওর কচি আঙ্গুলের স্পর্শ। বুক ভরে ওর ঘ্রাণ নিই। ও খিলখিলিয়ে হাসে। তারপর কোনও সঙ্কেত ছাড়াই আমার হাত ধরে টানতে থাকে। টানতে টানতে বলে,

"চল ইসার কাছে যাই"

আমি প্রাণপণে প্রতিবাদ করে ওকে থামাতে চেষ্টা করি। জ্যাসমিন সম্পূর্ন সাধারণ পোশাকে। এক অসতর্ক আবেগপ্রবণ মূহুর্তে আমিও আমার স্পেস-স্যুট খুলে ফেলেছিলাম জ্যাসমিনকে কোলের মধ্যে টেনে নেওয়ার জন্য। এই অবস্থায় খোলা মাটিতে পদার্পণ করা মনে অনিবার্য মৃত্যু। কী চায় জ্যাসমিন? সবকিছুর সমাপ্তি? না, ও তো এমন মেয়ে নয়! 

খোলা আকাশের নীচে এসে জ্যাসমিন শুধু বলে, 

"মা, বিশ্বাস রাখো"

প্রথমবার এই মাটিতে পা ফেলতেই আমি চমকে উঠি। এ কি শক্ত মাটি না কি চলমান বহমান তরল? স্পর্শে এতটা মসৃণ কি করে হয় আপাত দৃশ্যত পাথুরে জমি? বাতাসেও এক চমৎকার গন্ধ। সেটা ভেসে আসছে ইসার দিক থেকে। মেয়েটা করছে কী? পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই ওর কাছে। কাজের চাপে এই কয়েকদিন নিজের ল্যাবরেটরিতে কাটিয়েছি। গত এক মাস জ্যাসমিন ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করেনি সেখানে। জ্যাসমিনের থেকে জরুরি খবর নিতাম। তাছাড়া ও সবার কথা বলতো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুনতাম। শুনতাম ইসা বহুদিন হলো খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বেঁচে আছে কি করে সেটা একটা রহস্য! জ্যাসমিন আরও রহস্যময় হেসে বলত, ইসা জেগে উঠছে। 

আজ ইসাকে কাছ থেকে দেখছি মাসখানেক পর। দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ইসার খোলা চুলের শেষটুকু পাতলা আঁশের মতন হয়েছে। ঘন বাদামী রঙের প্রলেপ তাতে। রাশি রাশি লম্বা চুল এসে পড়েছে ওর বুকের ওপর। গোছা গোছা চুল কোমর ছাপিয়ে হাঁটুর দিকেও নেমেছে। এই বিপুল কেশরাশির প্রায় সবকটির শেষপ্রান্তে ঝুলছে ফেটে যাওয়া চুলের ডগা। কিন্তু এত ঘন যে সেটা দেখে ভ্রম হয় ফুলের পাপড়ি। বেগুনি, হলুদ, কমলা, গোলাপী বিভিন্ন রঙে রঙ্গীন হয়ে উঠেছে। চুলের শেষভাগে এখন বুঝি রঙের আগুন লেগেছে! আর সেই শেষভাগ থেকে প্রস্ফুটিত হচ্ছে কন্দাকার একেকটা ক্ষুদ্র লাল গোলক। অজস্র এদের সমাহারে মনে হবে বুঝি ফুলের ওপর চেরী ফুটেছে। ঢিপ ঢিপ করে ওঠে বুকটা। 

ইসা খুব যত্নে এক গোছা চুল হাতে তুলে নিয়ে তার শেষভাগ পর্যবেক্ষণ করছে। খেয়াল নেই অপনভোলা মেয়েটার, কী হয়ে চলেছে চারপাশে। জ্যাসমিন হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো, কেঁপে উঠলো আকাশ বাতাস, তারস্বরে বলে উঠল আমার মেয়ে,

"ইউ ডিড ইট ইসা, ইউ ক্র্যাকড্ ইট আফটার অল। ইউ ইম্বাইবড্ ইন উরসেল্ফ দ্যা সিক্রেট কোড অফ্ দিস প্ল্যানেট!"

"কী?" আমার সপ্রশ্ন ইঙ্গিতে জ্যাসমিন কিছু বলতে যায়। কিন্তু তার আগেই, ইসা একটা ছোট্ট লাল গোলক চুলের শেষভাগ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মুহুর্তমধ্যে মাটির ভেতর তলিয়ে গিয়ে ফের উঠে আসে চেরীর মতন দেখতে গোলকটি, তার একভাগ চিরে লতানো পাতার মতন লম্বা সুতো। বিস্ফারিত চোখে ইসা তাকায় জ্যাসমিনের দিকে, বুঝি চমৎকার করেছে জ্যাসমিন, ইসা নিজে নিমিত্ত মাত্র! 

"ফল! আমি আজ আর সাধারণ মানুষ না, মানব-বৃক্ষ! এই গ্রহে ফসল ফলেছে, ফসল!" গলা ফাটিয়ে জানান দেয় ইসা। কাঁপা হাতে আমি সেই ক্ষুদ্র গোলকটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে চিনতে চাই। জীভে স্পর্শ করি সন্তর্পনে। আহা, এই কি অমৃতের আস্বাদন? এর গন্ধেই কি অ্যাম্বেরার মাটি ঈষৎ কেঁপে উঠছে? ডীপ চেম্বারে একটা চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ছুটে যাই আমি সেদিকে।

চেম্বারে ঢুকে ফের স্তম্ভিত হয়ে যাই। একটু আগেও যে দশজন অতলান্ত ঘুমের দেশে তলিয়ে ছিল, তারা একে একে জেগে উঠেছে। মিলি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে বাকিদের, শিরিন এখনও শোয়া অবস্থাতেই নিজের হাত মুখ অনুভব করে দেখছে। প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আন্দাজ করতে পেরে উঠে আসছে ধীর পায়ে। উঠে দাঁড়াতে এবার ওদের দেখে বোঝা গেল, প্রায় প্রত্যেকের মাথায় ঝাঁকড়া হলুদ পল্লবগুচ্ছের মতন বাহার।

এরা প্রত্যেকে নিজেরা গ্রহকে আপন করে স্পর্শ করেছিল, যত্ন করে মাটি ধরেছিল নিজ হাতে। তাই আজ ভূমি উর্বর না করতে পারলেও, অ্যাম্বেরা নিজে এদের একেকজনকে একেকটা আত্ম-নির্ভরশীল, সালোকসংশ্লেষণকারী উৎপন্নমতী মানুষ করে তুলেছে। মানবজাতি এখন মহীরুহ। হলুদ গ্রহের রোদ্দুরে হাত ছড়িয়ে স্বাগত জানাই এই রুপান্তরণ। 

বুঝলাম জ্যাসমিনের বিশ্লেষণ ঠিক। প্রচুর পরিমাণ রসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করার দরুন ঝটিকায় দশজনের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছিল, সেটা তাদের শরীর অত দ্রুত মেনে নিতে না পারায়, তাদের ব্রেন তাদেরকে বিশ্রামের অবস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে শরীর যখন এই পরিবর্তন সইয়ে নিতে পারলো, তখন আবারও জাগিয়ে তুলেতে লাগল ইন্দ্রিয়দের। ইসার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম। ও অন্যদের মতন ল্যাবরেটরি বা ক্ষেতে নিরলস পরিশ্রম করতো না। মাটি, হাওয়া, রোদ্দুরের সাথে ওর সংস্পর্শ অন্যদের থেকে ছিল তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম। তাই ওর আর অন্যদের পরিবর্তনের মধ্যে এই বৈষম্য। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে পরিণতি একটাই।

বেঁচে থাকার এই  বীজমন্ত্র আজ আমাকে মুক্ত করলো মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা থেকে। অ্যাম্বেরা আপন করে নিয়েছে আমাদের। এবার আমাদের পালা। যাই আমি, জ্যাসমিন আবার সুদূর কোথায় থেকে এক অদ্ভুত সঙ্কেত পেয়ে ডাকছে।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb