শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর

লেখক - দীপঙ্কর বসু

                                                                                       ১

দিনটা ছিল ছুটির দিন। তা সত্ত্বেও অবিনাশকে আসতে হয়েছিল মানমন্দিরে। একে তো সে শিক্ষানবিস তায় অস্থায়ী। তাই ছুটির দিনে কিছু কাজ থাকলে তাকেই আসতে হত। সেই দিন অবশ্য রুটিন কাজের বাইরেও অন্য একটি কাজের ব্যাপারে দারুণ কৌতূহল ছিল তার। দুদিন আগে মাইক্রোলেন্সিং পদ্ধতির সাহায্যে খুঁজে পাওয়া মাত্র ২০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা নতুন একটি বহির্গ্রহকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার বিষয়ে খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করতে হবে। এমন বিষয় অন্য জ্যোতির্বিদদের কাছে  দারুণ চাঞ্চল্যকর কিছু না হলেও অবিনাশের কাছে এই বহির্গ্রহকে খুঁজে পাওয়া ছিল বিরাট এক উত্তেজনার ঘটনা। তাই সকাল থেকেই এসে ও একমনে নজর করছিল নতুন দেখা গ্রহটির প্রভাবে পিছনের তারা থেকে আসা আলোর বেঁকে যাওয়া। লক্ষ্য করছিল এই গ্রহের প্রতিটি নড়নচড়ন। হঠাৎই দুটোদিন শেষ হওয়ার আগেই হারিয়ে গেল গ্রহটি। ব্যাপারটা দেখে অবিনাশ তো একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমনটা যে স্বপ্নেরও অতীত তার কাছে। তবে কি সে আবিষ্কার করে ফেলল এক তারা হীন গ্রহ! তাও আবার এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকা অনাথ গ্রহ! তাড়াতাড়ি ফোন করল তার বিভাগীয় প্রধানকে। একবার, দুবার নয় তিনবার। না, ফোন বেজেই গেলেও ওপার থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবিনাশ যখন কম্পিউটারে সমস্ত পর্যবেক্ষণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখা শেষ করল তখন রাত এগারোটা বাজে। আরও বার কতক চেষ্টা করল বিভাগীয় প্রধানকে যোগাযোগ করার। ফোন বেজে গেলেও ও প্রান্ত থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় অবশেষে হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

উত্তেজনায় ভালো ঘুম হল না। পূবের আকাশের লাল রবির কিরণ আকাশকে সামান্য আলোকিত করতেই প্রস্তুত হয়ে চলল মানমন্দিরের দিকে। মানমন্দিরের গেটে যাওয়ার পর অবিনাশের সমস্ত আনন্দ বেলুনের মত চুপসে গেল। গেটে একটা নোটিশ ঝোলানো। তাতে লেখা “আজ থেকে অস্থায়ী কর্মীদের আর প্রয়োজন নেই। তাই তাদের কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হল।“ অন্ধকার নেমে এল অবিনাশের জীবনে। এই ঘটনার পরে অবিনাশকে আর কেউ কখনও দেখতে পায় নি।

                                             ২

এরপর কেটে গেছে প্রায় একবছর। কিছুদিন ধরে আকাশে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অত্যাশ্চর্য মেরুজ্যোতির এক গ্রহ। জ্যোতির্বিদদের মনে এই গ্রহ তৈরি করল এক দারুণ কৌতূহল। বিশালাকার এই গ্রহ পৃথিবীর থেকে প্রায় সতেরো হাজার গুণ বড় আকৃতির।  বিস্ময়কর এই আভার পিছনে আছে এই গ্রহের  শক্তিশালী এক চৌম্বক ক্ষেত্র। মজার কথা এই গ্রহের আভা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে অল্প অল্প করে। কোথা থেকে এল এই গ্রহ, এই জিজ্ঞাসা আলোড়ন তুলল সারা পৃথিবী জুড়ে। এটি কি সৌরমণ্ডলের অনাবিষ্কৃত নতুন কোন গ্রহ? বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্যার ওয়াল্টার র‍্যালের টিমও লেগে আছেন এই রহস্যের সমাধানে।

সেদিন স্যার ওয়াল্টার পুরানো একটি তথ্যের জন্য কম্পিউটার ঘাটছিলেন। হঠাৎই অবিনাশের ফাইলে  তাঁর চোখ পড়ে গেল এক বছর আগে ওর লেখা একটি নোটের দিকে। হাঁ হয়ে গেলেন তিনি। এমন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা তাঁকে না জানিয়ে কি করে চলে যেতে পারে অবিনাশ! তারপরেই মনে পড়ল মানব সম্পদ বিভাগের হঠকারী সিদ্ধান্তের কথা। বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা না করেই সমস্ত অস্থায়ী শিক্ষানবিসদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা। মনে মনে মানব সম্পদ বিভাগকে একপ্রস্থ গালাগালি দিয়ে তাড়াতাড়ি সারা পৃথিবীর সমস্ত নামী জ্যোতির্বিদদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা করলেন। স্যার ওয়াল্টার এক বছর আগে অবিনাশের পর্যবেক্ষণের কথা বিশদে জানানোর পরে সকলেই একমত হলেন যে কয়েকদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা গ্রহটি একটি ভবঘুরে গ্রহ এবং এই গ্রহ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে সৌরমণ্ডলের দিকে। কয়েক দিন বাদে  চীনা জ্যোতির্বিদ লীন বিয়াও তাঁদের কাছে থাকা সর্বাধুনিক টেলিস্কোপের সাহায্যে অনাথ গ্রহের ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করার পর ঠিক হল পরের দিনই জরুরি ভিত্তিতে আবার ভিডিও কনফারেন্স করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

                                             ৩

পরের দিন মিটিং এ লীন বিয়াও যখন বললেন যে গ্রহটি দুর্বৃত্তের মত সৌরমণ্ডলের দিকে ধেয়ে আসছে অবিশ্বাস্য গতিতে তখন ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত সব বিজ্ঞানীদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হল যেন কোন ভ্যাম্পায়ার সকলের মুখাবয়ব থেকে মুহূর্তের মধ্যে শুষে নিয়েছে সমস্ত রক্ত।                                                                                     স্যার ওয়াল্টার তাঁর শান্ত গমগমে গলায় বললেন, “আমাদের এখন ঘাবড়ে গেলে চলবে না। নিঃসন্দেহে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। পৃথিবী আগে কখনও এমন মহাজাগতিক অবস্থার সম্মুখীন হয় নি। শান্ত মাথায় ঠিক করতে হবে কি ভাবে এই সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে।”                                                                                         জুরিখের রিচার্ড ওয়ার্নার স্যার ওয়াল্টারের সঙ্গে কথা না বলেই তরুণ জ্যোতির্বিদ অবিনাশকে বরখাস্ত করার জন্য মানব সম্পদ বিভাগের লোকদের বিরুদ্ধে একপ্রস্থ কটূক্তি করে তারপরে তাঁর আশংকার কথা জানালেন- “ যদি এই দুর্বৃত্ত গ্রহ হানা দেয় আমাদের সৌর মন্ডলে আর প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার কিলোমিটার গতিবেগে ধাক্কা মারে পৃথিবীকে, তা হলে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের এই পৃথিবী। এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই আমাদের কাছে।”                                                                                                     ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানী প্রভা মৈত্র তাঁর মিষ্টি গলায় বললেন, “ আমার মনে হয়, এতটা আশংকার এখনই দরকার নেই। আমাদের সৌরমন্ডল আকারে বেশ বড়। তাই কোনোরকম মারাত্মক সংঘর্ষ ছাড়াই সৌর মন্ডলকে বাইপাস করে এই গ্রহের বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।”                                                                                                 “তা ঠিক। তবে তেমনটি হলেও বৃহস্পতির থেকে ১৩ গুণ বড় এই গ্রহ তার অভিকর্ষীয় বলের দ্বারা সৌরমন্ডলকে বিশৃঙ্খল করে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই”, বললেন নরওয়ের মহিলা জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টেন ওয়েন।                                                                                    ওয়েনের কথা শুনে ডঃ মৈত্র বললেন, “হ্যাঁ, তেমনটা হতে পারে, তবে তেমনটা হলে, পৃথিবীসহ সৌরমন্ডলের অন্যান্য গ্রহদের আরও উপবৃত্তাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর তেমনটা হলে পৃথিবীর প্রাণের পক্ষে তা অত্যন্ত খারাপ ঘটনা হবে।”                                                 চিন্তিত মুখে আমেরিকান সৃষ্টিতত্ত্বের বিজ্ঞানী কেভিন কুন বললেন, “ বিষয়টি খুবই চিন্তার। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী যে অঞ্চলটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে বাসযোগ্য সেই অঞ্চলটি অত্যন্ত সংকীর্ণ।  ‘গোল্ডিলকস’ নামের এই বাসযোগ্য অঞ্চলে থাকার জন্যই এখানকার সমস্ত জল বরফে পরিণত হয়ে যায় নি কিংবা বাষ্পীভূত হয়ে যায় নি। এই কারণেই এখানে প্রাণ টিকে আছে। হয়ত দুর্বৃত্ত গ্রহটি পৃথিবীকে ‘গোল্ডিলকস’ অঞ্চল থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে না, তবে সামান্য......... ” , কুনের কথার খেই ধরে রাশিয়ান আবহ বিজ্ঞানী আন্দ্রেই পাভলভ বললেন, “সামান্য ধাক্কা যদি পৃথিবীকে সূর্যের একটু কাছে বা দূরে নিয়ে যায় তবে পৃথিবীর আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন হতে পারে যা পৃথিবীর প্রাণের পক্ষে অতীব  বিপজ্জনক হবে।”                                                                                                  নানা জন নানা কথা বললেও এর থেকে বাঁচার উপায় যে কি সে বিষয়ে তেমন যুতসই প্রস্তাব কেউ দিতে পারলেন না। তবে এক বছর আগে জানা গেলে যে ব্যাপারটা আরও গভীরভাবে ভাবা যেত এ বিষয়ে সকলেই একমত হলেন। বিভিন্ন বিষয়ের কুড়িজন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি দল তৈরি করে তাঁদের নিয়ে স্যার ওয়াল্টারকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বিষয়টিকে দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করা হল।

                                                ৪

পরেরদিন স্যার ওয়াল্টারের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধিত্বকারী দলের সঙ্গে পরিষদের সদস্যদের বিশেষ বৈঠকে সকলকে পৃথিবীর দারুণ বিপদ সম্বন্ধে অবহিত করা হল। সমস্ত সম্ভাবনার কথা শুনে রাষ্ট্র নায়কদের একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ঠিক হল বিষয়টি এখন গোপন রাখা হবে। সমস্ত মানমন্দির, এমন কি মহাকাশের মানমন্দিরগুলি থেকে চব্বিশ ঘন্টা বিষয়টির উপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত হল। স্যার ওয়াল্টার সব বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলকে বললেন, “ দুর্বৃত্ত গ্রহের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে ভয়াল সেদিনের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কারো কিছু করার নেই। আবার মহাজাগতিক কোন অজানা কারণে যদি অনাথ গ্রহটি গতিপথ পরিবর্তন করে সৌরমণ্ডলে প্রবেশ না করে মহাকাশের অন্য দিকে চলে যায় তবে পৃথিবী এক দারুণ সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু যদি এসব না হয়ে অনাথ গ্রহের আকর্ষণে পৃথিবী তার অক্ষ থেকে সামান্য বিচ্যুত হয়ে সৌরমণ্ডলে প্রাণের বাসযোগ্য যে অঞ্চলটুকু আছে তার থেকে সামান্য বাইরে চলে যায় কিংবা সূর্যের সামান্য বিচ্যুতির কারণে পৃথিবীর অক্ষ আরও উপবৃত্তাকার হয়ে যায়, তা হলে কিন্তু পৃথিবীতে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হবে। পৃথিবীর আবহাওয়া কিছু সময়ের জন্য প্রচন্ড উষ্ণ হয়ে যাবে। তারপরে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে এক ভয়াবহ দীর্ঘস্থায়ী তুষার যুগ।”

“তাহলে তো ভবিষ্যৎ মানব প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছু মানুষকে আমাদের চাঁদের উপনিবেশে পাঠিয়ে দিতে হবে”, একসঙ্গে বললেন আমেরিকা ও চীনের প্রতিনিধি।                   স্যার ওয়াল্টার বললেন, “সে গুড়ে বালি। দুর্বৃত্ত গ্রহের প্রভাবে পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্থ হলে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ একই রকম থাকবে এমনটা আশা করা বোধহয় ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকা দেখার মত ব্যাপার।”                                                                                                    ডঃ ওয়ার্নার তখন বললেন, “যদিও আশা কম, তবু চেষ্টা করতে হবে যদি কোনভাবে এই ভবঘুরে গ্রহের গতির অভিমুখ সৌরমণ্ডলে প্রবেশের আগে পরিবর্তন করে দেওয়া যায়।”                                 বিভিন্ন দেশের এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং রাষ্ট্রনায়কদের কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হল এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।                                                                        ডঃ মৈত্র একটি নতুন প্রস্তাব দিলেন। “যদি পৃথিবীতে প্রচন্ড উষ্ণ অবস্থা  কিংবা তুষার যুগ আসে তবে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হল সমুদ্রের গভীরে অবস্থিত ‘থার্মাল ভেন্ট’ অর্থাৎ তাপের ফোকরের নীচে থাকা সমুদ্রের তলদেশ। গবেষণার কাজে ওখানে কয়েক বছর ধরে ওখানকার উপযোগী বাসস্থান বানানো হয়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আমাদের এখানে অন্তত পাঁচ হাজার লোকের উপযোগী বাসস্থান বানাতে হবে এবং পৃথিবী থেকে বেছে বেছে পাঁচ হাজার মানুষকে পাঠাতে হবে। এর ফলে যদি পৃথিবী জুড়ে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমেও আসে তা হলেও মনুষ্য প্রজাতি বেঁচে যাবে।”                                                                 প্রস্তাবটি সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়ায় কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হল এই কাজে নেমে পড়ার জন্য। তবে সবাইকে বার বার বলা হল ব্যাপারটিকে গোপন রাখতে।

                                            ৫

একমাসের মধ্যেই বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের অমানুষিক তৎপরতায় সমুদ্রের তলদেশে ছোটখাট একটি বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা হয়ে গেল। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গোপনে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন কর্মকান্ডের বুদ্ধিমান, সৃজনশীল এবং জ্ঞানী কয়েক হাজার মানুষকে নির্বাচন করে এই বসতিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল কয়েক হাজার শক্ত পোক্ত চেহারার অতীব কাজপাগল মানুষকে। বিভিন্ন স্থায়ী জিনপুলের কথা বিবেচনা করে এই মানুষদের নির্বাচিত করা হল। তরুণ জ্যোতির্বিদ অবিনাশকে ইতিমধ্যে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তাকেও এই বসতিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল এই আবিষ্কারের জন্য।

                                           ৬    

এরমধ্যে কি ভাবে যেন কতিপয় সাংবাদিক জেনে গেলেন দুর্বৃত্ত গ্রহের ব্যাপারটি। সংবাদ মাধ্যমে জানাজানি হওয়ার পরে সারা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে গেল। বিশৃঙ্খলা রোখার জন্য রাজনৈতিক নেতারা মানুষদের মধ্যে ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা করলেও, অনেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ব্যবসায়ী ধর্মীয় নেতারা প্রার্থনা ও পূজা পাঠ এবং যজ্ঞের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলে এই ফাঁকে দুপয়সা কামাতে নেমে পড়ল। চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল দাবানলের গতিতে। কাগজওয়ালারা কাগজ ভরিয়ে ফেলল হরেকরকম ভবিষ্যৎ বক্তার নানা লেখায়। বহু মানুষ রাত নামতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলো দুর্বৃত্ত গ্রহটা সত্যি সত্যি পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছে কি না!

অবশেষে এরই মাঝে সমস্ত রাষ্ট্র প্রধানদের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব এক বক্তৃতা দিলেন। তিনি জানালেন, “পৃথিবী আজ এক ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন। এক বিশাল তারাহীন অনাথ গ্রহ ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর প্রাণের পক্ষে এই ধ্বংস রোখা অসম্ভব। মানুষদের শেষের সে দিন বোধহয় আর বেশী দূরে নয়। যদিও আমরা এখনও হাল ছেড়ে দিই নি, বিজ্ঞানীরাও অবিরাম চেষ্টা করছেন।”

ঘটনাটি প্রচারের কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব দেশেই রাজনৈতিক নেতা, সামরিক বাহিনীর লোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ, দোকানের মালিক, শ্রমিক, বড় ব্যবসায়ী সকলেরই মধ্যে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেরই মনে হতে লাগলো কোনো কিছুরই বোধহয় আর কোন মূল্য নেই। সকলেই এগিয়ে চলেছেন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। সম্পত্তি, টাকা পয়সা, টাকা জমানো, ক্ষমতা সব ক্ষণিকের মোহ। সবাই দৈনন্দিন কাজ শুরু করলো শুধুমাত্র অভ্যাসের বশে। উচ্চ কর্তৃপক্ষকে স্যালুট করার আর কোন দরকার নেই। সোনা, হীরা জহরত কোন কিছুতেই আর কোন আকর্ষণ নেই মানুষের।

যে যা ভালবাসে মনপ্রাণ দিয়ে শুরু করল সে কাজ। কেউ শুরু করল বেশী বেশী গান করতে কেউ বা শুরু করল তা শুনতে। কেউ বা এই দু মাসে পৃথিবীকে দু চোখ ভরে উপভোগ করার জন্য ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পরল। প্রেমিক প্রেমিকেরা অনেক বেশী সময় দিতে শুরু করল পরস্পরকে। পরিবারের প্রতি ভালবাসা এবং সময় দেওয়া বেড়ে গেল গুণোত্তর ভাবে। রাগ, ঘৃণা কমে গেল নাটকীয় ভাবে। এমন কি মারামারি, অপরাধও কমে গেল অনেকটাই। যখন আয়ু আর মাত্র ২ মাস আর তার থেকে পালাবার কোন পথ নেই তখন এসব করে লাভ কি! কিছু কিছু মানুষ সব আশা ছেড়ে দিলেও বেশ কিছু মানুষ বিশেষ করে ধনকুবেররা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করতে লাগলো সমুদ্রের তলদেশের বসতিতে যাবার। কিন্তু ধনসম্পত্তির গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এব্যাপারে বিশেষ সুবিধা হল না। তখন তারা বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর মাটির নীচে যে বাঙ্কার আছে তাতে আশ্রয়ের জন্য বাহিনীর উচ্চপদস্থদের তদ্বির শুরু করল। কিন্তু কেউ তাদের আর বিশেষ পাত্তা দিল না। বাহিনীর উচ্চপদস্থরা তখন ব্যস্ত নিজেদের পরিবার ও পরিচিতদের বাঙ্কারে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে। এর মধ্যে আফ্রিকার কিছু ধর্মান্ধ মূর্খ ভাবলো তাদের ধর্মকে জোর করে ছড়িয়ে দেওয়ার এই সময়। তারা শুরু করল নিরীহদের উপর অত্যাচার। বিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর লোকেরা মরিয়ার মত বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে ভবঘুরে গ্রহটিকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা কার্যকরী হল না। মন্দির, মসজি্‌দ, গীর্জায় প্রার্থনা চলল, আশা, যদি সর্বশক্তিমানের কৃপায় এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। কোনো কোনো জায়গা থেকে হতাশায় আর ভয়ে গণ আত্মহত্যার খবরও আসতে আরম্ভ করল।    

এমনভাবেই চলে গেল আরও এক মাস। এর মধ্যে আরও উজ্জ্বল হয়েছে দুর্বৃত্ত গ্রহ। চাঁদের মত বড় দেখাচ্ছে এখন তাকে। অবিরাম গ্রহটিকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে যদিও ভবঘুরে গ্রহটি সৌরমণ্ডলের কাছ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে কিন্তু এর প্রবল আকর্ষণে পৃথিবী নিশ্চিতভাবেই ‘গোল্ডিলক’ বাসযোগ্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে না গেলেও সূর্য থেকে সামান্য দূরে চলে যাবে। এর ফলে কিছু সময়ের জন্য তাপমাত্রা ও গরম অত্যন্ত অসহ্যকর ভাবে বেড়ে যাবে আর এর পরে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে এক ভয়ঙ্কর তুষার যুগ। গুহা, বাঙ্কারে গরমের সময় কোনমতে কিছু মানুষ ও প্রাণী বেঁচে গেলেও খাদ্যের অভাবে এবং কিছুদিন পরের তুষার যুগের আগমন হলে সমস্ত মানুষ এবং অধিকাংশ প্রাণের মৃত্যু নিশ্চিত। যেহেতু এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই, তাই বিজ্ঞানীদের তরফে আবেদন - সকলে যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত হন সেই ভয়ঙ্কর অন্তিম দিনের জন্য।

যেহেতু সকলেই এবার বুঝতে আরম্ভ করল যে যবনিকা পতনের দিন আর বেশী দূরে নয়,  অনেকেই এমনকি অপরিচিত মানুষদের দেখলেও হেসে কথাবার্তা বলতে লাগলো। সামরিক বাহিনীর লোকেরা সীমান্ত পাহারা শিকেয় তুলে শেষের কদিন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে থাকার জন্য বাড়ির পথে রওনা দিল। সীমান্তে কোন পাহারা না থাকায় আলাদা আলাদা দেশের ধারণা এক অতীতের সংস্কারে পরিণত হল। দূরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরাও হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। হঠাৎ মানুষের মন থেকে উধাও হয়ে গেল হিংসাদ্বেষ। সকলেই যা অবশ্যম্ভাবী তার ভাবনা ছেড়ে কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেল।

প্রতিদিন বাড়তে লাগলো মহাকাশের দুর্বৃত্তের উজ্জ্বলতা। তার আকারের বাড় দেখে সকলেই মনে মনে বুঝতে পারছিল যে পৃথিবী এগিয়ে চলেছে শেষ পরিণতির দিকে।

                                              ৭

স্যার ওয়াল্টার বিজ্ঞানীদের পরিবারদের নিয়ে একটি বহুতল বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। সকলেই আগামী ভবিষ্যৎ কে মেনে নিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন ভয়াবহ সেই অন্তিম দিনটির জন্য। তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো লাফিয়ে লাফিয়ে। জরুরি কাজের জায়গাগুলির লোক চলে যাওয়ায় সব জায়গায় দারুণ বিশৃংখলার সৃষ্টি হল। বন্দর এবং সমুদ্রে জাহাজদের চালনা করার লোক না থাকায় অবিন্যস্তভাবে সমুদ্রে ভাসতে থাকলো জাহাজগুলি। তেলের রিগ থেকে তেল উপচে পড়ে বিশ্রী অবস্থা হল সমুদ্রের। রাসায়নিক তৈরির অনেক কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস বেরোতে শুরু করল। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ফুয়েল রড গলে গিয়ে বিস্ফোরণ হয়ে শুরু হল বিকিরণ। আকাশ ভরে গেল বিভিন্ন বর্ণের ধোঁয়ায়। বিজ্ঞানীরা দেখতে থাকলেন আকাশচুম্বী বাড়িগুলিকে পরপর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাপে তাঁদের বাড়ির কাঁচের জানলা গুলিও টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। ভাঙ্গা জানালার মধ্য দিয়ে তাঁরা দেখলেন নিজেদের প্রিয় মানুষদের সঙ্গে শেষবার মিলিত হবার চেষ্টায় বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালেন অনেক মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যে বিজ্ঞানীরা যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়িতেও উত্তাপে আগুন ধরে গেল। তাঁরা সকলে হাত ধরাধরি করে গাইতে থাকলেন অনাগত মহাবিশ্বের শাশ্বত সংগীত আর অপেক্ষা করতে থাকলেন ভয়ংকর অন্তিম মুহূর্তের জন্য।                

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb