কল্পবিজ্ঞান স্রষ্টা মেরি শেলী

লেখক - শতাব্দী দাশ

কল্পবিজ্ঞান পুরোপুরি বিজ্ঞান না হলেও অনেক সময়  কল্পবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা বিজ্ঞানের জগতে নতুন কিছু ভাবনা -চিন্তার জন্ম দেয়।  বিজ্ঞানীদের নানারকম নতুন নতুন গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে। যেমন - চাঁদের মাটিতে মানুষের পদার্পণ,  আকাশ যানে  চড়ে আকাশে ওড়া, এই ভাবনাগুলি কল্পনার জগৎ থেকে ই  বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে।  এই কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের শুরু কবে থেকে?  যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়,  তাতে দেখা যায় যে ইংরেজি ভাষায় লিখিত "ফ্রাঙ্কেনস্টাইন" গল্পটিই কল্পবিজ্ঞানের প্রথম গল্প।  গল্প টি বোধহয় সবারই স্মরণে আছে।  সেই যে, এক বিজ্ঞানী তৈরি করলেন এক 'অতিমানব' বা   demon কে, যার আয়তন মানবদেহের থেকে বড়। সেই অতিকায় মানবের স্রষ্টার নামানুসারে তার নাম হল 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'। কিন্তু সেই মনুষ্যসৃষ্ট   demon  হয়ে উঠল অত্যন্ত ভয়ংকর ও ধ্বংসকারী। শেষ পর্যন্ত,  ঐ demon     তার স্রষ্টাকে ও তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে হত্যা করে।  শেষে নিজেও ধ্বংস হয়ে যায়। এই গল্পটিই কল্পবিজ্ঞানের প্রথম গল্প হিসেবে ধরা হয় যা প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ২০০ বছরের ও বেশি আগে। সে সময় ইয়োরোপে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মৃত মানুষের দেহাংশ দিয়ে নতুন মানুষ তৈরি করা যায় কিনা তাই নিয়ে গবেষণা ও চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মৃত শরীরে প্রাণসঞ্চারে সক্ষম হননি তাঁরা। 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' এর স্রষ্টা বোধহয় তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনির রসদ এইসব সমসাময়িক ঘটনা থেকেই পেয়েছিলেন। কে লিখেছিলেন এই গল্প? 

এই গল্পের লেখিকা হলেন মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট শেলী ( Mary Wollstonecraft Shelley),   যাঁর জন্ম হয়েছিল ২২৫ বছর আগে ১৭৯৭ সালের ৩০ আগস্ট লন্ডনে। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম গডউইন। মা মেরি উইলস্টোন ক্রাফ্ট। তাঁর জন্মের কয়েকদিন পরেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। বাবা তাঁকে বড় করে তুলেছিলেন অত্যন্ত যত্ন নিয়ে। তাঁর চার বছর বয়সে তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করলেন, নতুন মায়ের নাম মেরি জেন ক্লেয়ারমন্ট, যাঁর সঙ্গে মেরি শেলীর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। 

১৮১৪ সালে মেরি শেলী তাঁর বাবার রাজনৈতিক অনুগামী পার্শী বিশে শেলী ( Percy Bysshe Shelley)  র সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।   পার্শী শেলী আগে থেকেই বিবাহিত ছিলেন। পরবর্তী দুবছর তাঁরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করেন। ক্রমবর্ধমান ঋণ, সামাজিক বয়কট এবং সন্তানের মৃত্যু তাঁদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।  অবশেষে,  ১৮১৬ সালের শেষের দিকে পার্শী শেলীর প্রথমা স্ত্রী আত্মহত্যা করেন এবং মেরি ও শেলী বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

ওই বছরেই তাঁরা এবং মেরি শেলীর সৎ বোন ক্লেয়ার ক্লেয়ারমন্ট লর্ড বায়রনের সঙ্গে বেশ কিছুদিন সুইজারল্যান্ডে অতিবাহিত করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন জন উইলিয়াম পলিডোরি। এই সময়েই লর্ড বায়রন একদিন বলেন যে তাঁরা চারজনেই চার টি ভয়ের গল্প লিখবেন। ওই গল্প লেখার জন্যই মেরি শেলী চিন্তা করতে লাগলেন, যার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হল বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞান (  Science Fiction) এর গল্প 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'। 

১৮১৮ সালে তাঁরা ব্রিটেন থেকে ইটালিতে আসেন। এই সময় তাঁদের আরও দুই সন্তানের মৃত্যু হয়। জন্ম হয় তাঁর চতুর্থ সন্তান পার্শী ফ্লোরেন্স শেলীর। ১৮২২ সালে তাঁর স্বামী বিশিষ্ট ইংরেজ কবি পার্শী বিশে শেলীর মৃত্যু হয় এক নৌকা দুর্ঘটনায়। 

 পরের বছর মেরি শেলী ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন। তখন থেকে তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ হল তাঁর একমাত্র পুত্রকে বড় করে তোলা।  এই কারণেই তিনি সাহিত্যিক হওয়ার পেশাকেই বেছে নিলেন। তবে তাঁর জীবন খুবই স্বল্পস্থায়ী ছিল।  মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৮৫১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ব্রেন টিউমারের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।

 মেরি শেলীর শিক্ষা জীবন বা বেড়ে ওঠা কীভাবে হয়েছিল?  তাঁর বাবা তাঁকে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার শিক্ষা দিতেন। তাঁর বাবার লেখা ছোটদের বই 'রোমান ও গ্রীক ইতিহাস 'এর ওপর,  এবং তার পান্ডুলিপি ও ছোটবেলায় পড়ে ফেলেছিলেন মেরি। ১৫ বছর বয়সেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং খুব সচেতন মনের মেয়ে।  জ্ঞানের স্পৃহা ছিল তাঁর অপরিসীম।  তাঁর বাবা চেয়েছিলেন,  কন্যা তাঁরই মত   'radical politics ' এ যুক্ত হন। মেরি ছোটবেলা থেকেই গল্প লিখতেন। কিন্তু সেইসব পান্ডুলিপি হারিয়ে যায় যখন তিনি পি. বি.  শেলীর সঙ্গে চলে আসেন ১৮১৪ সালে। মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়  তাঁর বাবার প্রকাশিত 'জুভেনাইল লাইব্রেরি ' তে, যেগুলি ছিল হাসির ছড়া।  স্বামী পার্শী বিশে শেলীও তাঁকে লেখার ব্যাপারে  খুবই উৎসাহ দিতেন। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল ' The Last Man '(১৮২৬)। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলি অনেক সময়েই তাঁর দেখা মানুষের জীবন থেকে নেওয়া হত। তাঁর রচিত অপর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হল 'Valperga'  ( ১৮২৩)।

 ১৮৩২ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে শেলী বেশ কিছু 

 জীবনীও লিখেছেন বিখ্যাত ইটালিয়ান, স্প্যানিশ,  পর্তুগীজ এবং ফরাসি ব্যক্তিদের নিয়ে (Lives of the most eminent Literary and Scientific Men)। ১৮২৪ সালে তিনি পি. বি. শেলীর অপ্রকাশিত কবিতাগুলি প্রকাশনার ব্যবস্থা করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি স্বামীর কবিতাগুলির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন। 

 মেরি শেলী চেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর জীবনী লিখতে।  কিন্তু তাঁর শ্বশুর স্যার টিমোথী শেলী তাঁকে ঐ কাজ করতে দিলেন না। তাই সেই কাজটি মেরি করতে পারেন নি। তবে,  পি.বি. শেলীর অন্য গ্রন্থ প্রকাশের সময় তিনি তাঁর স্বামীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব্য ও টীকা লিখেছিলেন। তিনি কবি শেলীকে একজন রোমান্টিক ও  'lyrical '  কবি হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। 

 মেরি শেলী মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন প্রধানত কবি শেলীর পত্নী হিসেবে এবং 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' এর স্রষ্টা হিসেবে। তবে,  সারা জীবনব্যাপী সাহিত্য সৃষ্টিতেও তাঁর পরিচিতি একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে, যার মধ্যে অবশ্যই 'প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা'র শিরোপাটিরও অধিকারিনী তিনি।  

   

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb