কার্ল সাগান – কল্পবিজ্ঞান গল্পবিজ্ঞান

লেখক - তপন কুমার বিশ্বাস

আকাশের দিকে তাকালে বিষ্ময়ের ঘোর লাগে মনে। আবহমান কাল ধরে, আকাশের বুকে দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে আলোর বিন্দুরা, তাদের মাঝখানে ঘোর কৃষ্ণ অন্ধকার। মানুষ একসময়ে আলোর বিন্দুগুলিকে মনে করতো গণনাতীত, কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আলোর বিন্দু নক্ষত্রগুলিকে  গণনা করে ফেলেছে মানুষ। নক্ষত্রদের মধ্যবর্তী স্থানেও দৃশ্যমান হয়েছে নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, বিশালকায় গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘরাশি। নবজন্মলাভে উন্মুখ নবীন নক্ষত্র, শিশু নক্ষত্র, বয়স্ক নক্ষত্র, বিলুপ্তির সীমায় পৌঁছানো নক্ষত্র, এমনকি নতুন নতুন নক্ষত্রজগত (গ্যলাক্সি)। যন্ত্র আমাদের দেখবার ক্ষমতা যত বাড়িয়ে দিয়ে চলেছে, ততই সীমারেখা দূরে সরে যাচ্ছে , ততই নতুন নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে আমাদের চোখে, আমাদের মনে। সূচনা থেকেই বিষ্ময়ের ঘোর লাগা মানুষ, নিজেকে এই সব কিছুর অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে এসেছে।  কার্ল সাগানের মতে, অজ্ঞেয় বলে মেনে নিয়ে এই মহাবিশ্বের বিশালতা,  গভীরতা ও রহস্যময়তার কাছে শুরুতে আত্মসমর্পণ করলেও, পরে এসবের রহস্যভেদ করবার পদ্ধতি করায়ত্ত  করে ফেলেছে মানুষ। সে পদ্ধতির নাম বিজ্ঞান। তথ্য আহরণ তুলনা ও বিশ্লেষণ, তত্ত্ব ও তথ্য যাচাই যার মূলভিত্তি। মহাবিশ্ব সম্পর্কে যত বেশী জ্ঞান অর্জন করে চলেছে মানুষ, ততই আমরা উপলব্ধি করছি যে, এই মহাবিশ্বের সঙ্গে আমরা এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। মহাবিশ্ব থেকেই আমাদের উৎপত্তি ও  বিকাশ, মহাবিশ্বেই আমাদের বিলুপ্তি।

মহাবিশ্বে নক্ষত্রদের ঝাঁক বেঁধে থাকবার প্রবণতা দেখা যায়।  অল্পসংখ্যক তারকা একা একা বিচরণ করে। মোটামুটি এক একটি নক্ষত্রদের ঝাঁকে (গ্যালাক্সি) কমবেশী ১০ হাজার কোটি (এক সংখ্যার পরে এগারোটা শূন্য বা ১০^১১) নক্ষত্র থাকে। আনুমানিক ১০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে, এটা ধরে নিলে,  মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০ কোটি কোটি কোটি নক্ষত্র আছে ( এক সংখ্যার পর  বাইশটি শূন্য) । গ্যালাক্সির এরকম বিশাল সংখ্যা ধরে নেওয়াটা কষ্টকল্পনা নয়, অল স্কাই সার্ভে থেকে সেরকমই অনুমান করা হয়েছে। সাগান কথায়  কথায় বলতেন ' বিলিয়নস অ্যান্ড বিলিয়নস '।  একটি তারার থেকে অপরটির দূরত্ব গড়ে ৫ আলোকবর্ষ।  আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সি থেকে কাছাকাছি অ্যান্ড্রোমেডা (এম৩১) গ্যলাক্সি ২৩ লক্ষ, ট্রাঙ্গুলাম  (এম৩৩) গ্যলাক্সি ২৭ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। ছায়াপথ গ্যালাক্সি এতোটাই বিশাল যে, এর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে প্রায় এক লক্ষ আলোকবর্ষ (তিরিশ হাজার কিলো-পারসেক) পথ অতিক্রম করতে হবে। কোটি কোটি গ্যলাক্সির মিলিত আয়তনের  মহাবিশ্ব  সুবিশাল। যেন সীমাহীন। ১৩টি পর্বের টেলিভিশন সিরিয়াল ' কসমস ‘ ও তার সঙ্গী একই নামের পুস্তক কসমসে এসব বিষয় সম্পর্কে  বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন সাগান। দেখিয়েছেন একই বিষয়ের উপর টেলিফিল্ম ও পৃথক পুস্তক কেমন হওয়া উচিত। একই কথা তাঁর কনট্যাক্ট পুস্তক ও সিনেমা সম্পর্কেও প্রযোজ্য।

অনুমান, এতো কোটি কোটি তারকাদের চারপাশে রয়েছে বিপুল সংখ্যায় গ্রহ, কোটি কোটি। সেগুলি এক একটি  নক্ষত্রকে  প্রদক্ষিণ করে চলেছে।  সেসবের কোথাও কোথাও উন্নত প্রাণী উন্নত সভ্যতা থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বহুবছর  ধরে কিছু বিজ্ঞানী এমন অনুমান করছিলেন, সাগান তাদের অন্যতম। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে সৌরজগতের বাইরে প্রথম গ্রহ ৫১-পেগাসাস বি সনাক্ত হওয়ার পর সব সন্দেহের অবসান হয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত নাসার তথ্য অনুযায়ী  ৩৯২৪টি গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে। (এখনো পর্যন্ত ৫০০০ এর বেশী) এদের মধ্যে ১৫৬টি গ্রহকে পৃথিবীর মত বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর মত বলতে পাথুরে জমি,  আকার প্রায় পৃথিবীর মত ; সম্ভবত বায়ুমন্ডল আছে, মহাসাগর আছে। হয়তো সেইসব মহাসাগরে জলের পরিবর্তে তরল মিথেনের মত তরল আছে। কার্ল সাগান ও তাঁর মত বহু বিজ্ঞানী মনে করেন মহাবিশ্বে কোটি  কোটি গ্রহদের ভিতর প্রাণের অস্তিত্ব খুবই সম্ভব। কার্ল সাগানের স্পষ্ট মত,  এই মহাবিশ্ব প্রাণসম্পদের সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ।

প্রাণকে পৃথিবীর মতোই কার্বণভিত্তিক জলভিত্তিক ভাবতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বোরণভিত্তিক মিথেনভিত্তিক প্রাণ কি হতে পারে না?  অথবা অন্য কোনো পদার্থভিত্তিক ?  সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যতই তা কল্পনার রঙে রাঙানো হোক না কেন। কিছু ব্যাকটেরিয়া সমুদ্রের তলদেশের থার্মাল ভেন্টের (তাপ নিঃসরণ মুখ) কাছে, সমুদ্র তলদেশের অনেক নীচে, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের অদূরে, ঊর্ধাকাশে দিব্যি বেঁচে থাকে; সাধারণ প্রাণীদের কাছে যে খাবার বিষাক্ত প্রাণঘাতী,  সেসব চেটেপুটে পরিতৃপ্তি সহকারে খেয়ে জীবনধারণ করে, এরকম কত কি! এমনও হতে পারে, বহির্জগতের কোনো গ্রহে নানারকম প্রাণিদের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ঢের বেশী উন্নত প্রাণী রয়েছে মহাবিশ্বের কোথাও; যাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে পৃথিবী ও তার প্রাণসম্পদ উন্নততর হয়ে উঠবে, অথবা এমন কোনো প্রাণী, যারা পৃথিবীকে কব্জা করে, দখল করে শাসন করতে চায়, তাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সাধারণভাবে প্রচলিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনীগুলিতে ভিনগ্রহবাসীদেরকে (অ্যালিয়েন) আমরা শত্রুভাবাপন্ন বলে দেখতে ও দেখাতে অভ্যস্ত।

তবে এসবের বাধা অবশ্যই দূরত্ব ও মহাকাশযানের গতিবেগ, জীবনসীমার বাধা। বর্তমান গতিবেগে এক জীবনে কোনো কাছের নক্ষত্রে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কিন্তু যদি গতির সর্বোচ্চ সীমা আলোর গতিবেগের  কাছাকাছি ইছামতো গতিতে চলতে পারা যায়, যদি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে স্তিমিত বা স্তব্ধ করে দেওয়া যায় এবং পরে ইচ্ছামত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, যদি বিশৃঙ্খলা (ডিসঅর্ডার) থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়, যদি ওয়র্মহোলের মতো কোনো শর্টকাট রাস্তা দিয়ে দূরের নক্ষত্রের গ্রহে উপস্থিত হয়ে আবার সুস্থদেহে ফিরে আসা যায়, তাহলে তা সম্ভব। কিন্তু এসবতো কল্পনার কথা। বাস্তব যতদিন না করায়ত্ত হচ্ছে ততদিন, বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পনাই ভরসা। সেসব কল্পনার  কোনো এক বা একাধিক হয়তো  একদিন বাস্তবে রূপ পাবে, জুলে ভার্ণে কল্পিত সাবমেরিনের মত বা এইচ জি ওয়েলসের চন্দ্রযাত্রার কাহিনীর মত।

কার্ল সাগানের ' কনট্যাক্ট ' পুরোদস্তুর এক আধুনিক কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। বিষয়বস্তু,    বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সমস্ত বিষয়ে বহুগুণ উন্নত ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে, পৃথিবীতে মানুষের সাক্ষাত ও তার প্রতিক্রিয়া।  গল্পের মুখ্য চরিত্র এলিয়নর অ্যারোওয়ে; ডাকনাম এলি। পিতা থিওডর (টেড) অ্যারোওয়ের কাছে অপার কৌতুহল ও অসংখ্য জিজ্ঞাসা মেধাবী ছাত্রী এলির। পিতা তার অত্যন্ত প্রিয় ও কাছের মানুষ। স্কুলে পড়তে পড়তে মৌলিক সংখ্যা সম্পর্কে এলি  নিবিড়ভাবে অনুশীলন শুরু করে। পাই(π), ই(e) এর মত বিশেষ সংখ্যার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। দুর্ভাগ্যবশত প্রথম কৈশোরেই পিতাকে হারায় এলি। এর কিছুদিনের মধ্যেই তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন জন স্টাউটন নামে এক ব্যক্তিকে। পিতা টেডের অভাব দারুণভাবে অনুভব করতে শুরু করে এলি।

 বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড ড্রামলিনের অধীনে গবেষণা করে ডক্টরেট লাভ করবার পর, কালক্রমে এলি রেডিও ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে, ' প্রোজেক্ট আরগাস ' প্রকল্পে ডিরেক্টরের দায়িত্ব লাভ করলেন। ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী অনুসন্ধানের (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) জন্য এই প্রোজেক্ট। নিউ মেক্সিকোতে তার জন্য বিশাল বেতার দূরবীন (রেডিও টেলিস্কোপ) ব্যবস্থা। কিন্তু এলির এই দায়িত্বপ্রাপ্তিতে মোটেই খুশী হতে পারলেন না  পুরুষপ্রধান বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনীয়ার মহলের একাংশ। তাঁরা প্রতি পদক্ষেপে এলির অসুবিধা সৃস্টি করতে থাকলেন। চেষ্টা করতে থাকলেন যাতে এলি সাফল্যলাভ করতে না পারেন। তাঁর প্রোজেক্টে অর্থমঞ্জুরী বন্ধের লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন ডেভিড ড্রামলিন। তবে ড্রামলিন ঠিক ঈর্ষপ্রসূত হয়ে নয়, তিনি মনে করেন, প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে যেসব গবেষণায়, শুধু সেগুলিকে সহায়তা করা উচিত। একেবারে বিশুদ্ধ গবেষণাকে  উৎসাহিত করবার পক্ষপাতী  নন ড্রামলিন। প্রতিকূলতার মুখে এলির লড়াই মনে পড়িয়ে দেয় ভেরা রুবিন, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, জোসলিন বেল প্রমুখ বিজ্ঞানীদের কথা। এলি সমস্তরকম প্রতিকূলতার মুখে অদম্য। এলিকে সবরকমভাবে সহায়তা করেন তাঁর রুশ সহবিজ্ঞানী ভ্যায়গ্যায় লুনাচারস্কি।

আরগাস প্রোজেক্টের বেতার দূরবীনের সাহায্যে মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্ত অনুসন্ধানের কাজ করতে করতে, একরাত্রে হঠাৎ করে এলির টেলিস্কোপে গুচ্ছ গুচ্ছ মৌলিক সংখ্যা সমেত, এক বেতার সঙ্কেত  ধরা পড়ল। বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল,  এই বেতার সংকেত আসছে পৃথিবী থেকে ২৬ আলোকবর্ষ দুরের, ভেগা নক্ষত্রের এক গ্রহ থেকে। তার অর্থ উদ্ধার করা গেল না। ভেগার গ্রহ থেকে আরো দুটি বেতারসংকেত বার্তা পেলেন এলি। একটিতে ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অ্যাডলফ হিটলারের  ভাষণ, যেটি প্রথম পৃথিবীব্যাপী প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠান। এর থেকে এলি বুঝতে পারলেন, ভেগা নক্ষত্রের গ্রহটির অধিবাসীরা, পৃথিবী থেকে ১৯৩৬ সালের টেলিভিশন বার্তাটি শুধু গ্রহণই (রিসিভ) করেনি, তারা প্রযুক্তিতে এতোটাই উন্নত যে, সেই বার্তা তারা পৃথিবীবাসীর কাছে ফেরত পাঠিয়ে তাদের অস্তিত্ত্ব,অবস্থান ও আগ্রহ জানিয়ে দিয়েছেন। মৌলিক সংখ্যা দিয়ে ঠাসা তৃতীয় সাংকেতিক বেতারবার্তায় পাওয়া গেল, পাঁচজন মহাকাশচারীকে পরিবহন করবার উপযোগী,এক আন্তর্নাক্ষত্রিক মহাকাশযানের নক্সা ও বিস্তারিত  বিবরণ। কিন্তু তারও পাঠোদ্ধার করা গেল না।

বেতারবার্তাটিকে কেউ বললেন ঈশ্বরের বার্তা, এর থেকে পৃথিবীর মঙ্গল হবে, ঈশ্বর যে আছেন এ তারই প্রমাণ; কেউবা বললেন এটি শয়তানের বার্তা, সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে পৃথিবীতে। শাসনক্ষমতায় আসীন ও বিরোধী  রাজনৈতিক শক্তি, নিজেদের  মত করে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে থাকলেন। মার্কিণ প্রেসিডেন্টের পরামর্শে, তাঁর প্রতিনিধি কেন ডার হির ও দুজন ধর্মতাত্ত্বিকের সঙ্গে আলোচনায়, বলা ভালো, বিতর্কে বসলেন এলি। প্রথমজন কট্টর ধর্মতাত্ত্বিক রেভারেন্ড বিলি জে র‍্যাঙ্কিন; তাঁর অভিযোগ, বিজ্ঞানে বিশ্বাসীরা সংশয়বাদী, ধর্মতত্ত্ব যা কিছু বলে সবকিছুতেই তারা সন্দেহ প্রকাশ করে নাকচ করে দেন, ধর্মতত্ত্বের পথেই সত্যকে পাওয়া যাবে। এলির অবস্থান বিজ্ঞানের সপক্ষে,  এলির মতে, বিজ্ঞানের পথেই যে সত্যকে পাওয়া যাবে সে-সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত। বার্তাটি স্বয়ং ঈশ্বর পাঠিয়েছেন বলে তিনি মানতে রাজী নন। এলির কথায়, ঈশ্বর গণিতের ভাষায় বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন, এমন দাবী একেবারেই উদ্ভট। এলি নাস্তিক, ঘোর যুক্তিবাদী, প্রমাণ ছাড়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানেন না। র‍্যাঙ্কিন দাবী করলেন, ভিনগ্রহবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া বার্তার পাঠোদ্ধার ও রূপায়নের দায়িত্ব, তাঁদের হাতে অর্পণ করা হোক, এলি তাতে সম্পূর্ণভাবে অসম্মত। র‍্যাঙ্কিনের সঙ্গে এলির আলোচনা যখন উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর্যায়ে, তখন কেন ডার হির ও পামার জস হস্তক্ষেপ করলেন। দ্বিতীয় ধর্মতাত্ত্বিক নেতা পামার জস, ঈশ্বরবিশ্বাসী নরমপন্থী; যুক্তিতর্ককে মান্যতা দেন। জস বললেন, উভয় পথেই সাধারন লক্ষ্য সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। কালক্রমে জসের সঙ্গে গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠলো এলির। কিন্তু একসময়ে এলি বুঝলেন, তিনি যখন ভেগা নক্ষত্রের  গ্রহ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, ততদিনে হয়তো পামার জস বেঁচে থাকবেন না; তাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো তাঁকেই চিনতে পারবে না। এই উপলব্ধি থেকে পামার জসের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে সরে এলেন এলি।

শেষ পর্যন্ত আন্তর্নাক্ষত্র অভিযানের উপযোগী মহাকাশযান তৈরি হয়ে গেল।  মহাকাশচারীরাও প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলেন। মার্কিণ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা চূড়ান্ত নির্বাচন পর্বে এলিকে প্রশ্ন করে বুঝলেন, এলি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না।  এরপর এলির দুর্ভাগ্য, তিনি প্রথম তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেলেন; তাঁর জায়গায় অন্তর্ভুক্ত হলেন ড্রামলিন। নক্ষত্রযান তৈরীর অগ্রগতি একদিন দেখতে গেলেন, চূড়ান্ত নির্বাচিত মহাকাশচারীরা। সেখানে হঠাৎ করে ঘটলো এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ; সেই বিস্ফোরণে মারা গেলেন ড্রামলিন, যানটিরও প্রচন্ড ক্ষতি হল। নক্ষত্রযানটিতে চেপে ভেগা নক্ষত্রের গ্রহটির উদ্দেশ্যে যাত্রা, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। এই দুর্ঘটনার পর পাঁচজন নক্ষত্রযাত্রীর দলে এলি পুনর্নিবাচিত হলেন।  পাঁচজন নক্ষত্রযাত্রীরা হলেন,  ১) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এলিয়নর অ্যারোওয়ে, ২) রাশিয়ার ভ্যায়গ্যায় লুনাচারস্কি, ৩) ভারতের ডাক্তার দেবী সুখবতী, ৪) থিয়োরি অব এভরিথিং আবিষ্কর্তা নাইজেরিয়ার অ্যাবোননেমা এডা, ৫) চীনের পুরাতত্ত্ববিশারদ জি কুইয়াওমু। কার্ল সাগানের নক্ষত্রযাত্রীরা রীতিমতো আন্তর্জাতিক।  এরকম অভিযানে তাই তো হওয়া উচিত।

মার্কিণ ধনকুবের এস আর হেডডেন, একদিন টেলিফোনে তাঁর ব্যক্তিগত মহাকাশস্টেশন থেকে এলিকে জানালেন, এই নক্ষত্রযাত্রার জন্য তিনি জাপানের হোক্কাইডোতে, গোপনে ঐ নক্ষত্রযানের অবিকল এক নক্ষত্রযান তৈরি করেছেন; এলি সেটিকে নক্ষত্রযাত্রার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। একদিন এই নক্ষত্রযানে চেপে এলি ও অন্য চার নক্ষত্রযাত্রী রওনা হয়ে গেলেন। ছায়াপথ গ্যালাক্সির ভিতর দিয়ে, ওয়র্মহোলের মধ্য দিয়ে, প্রায় আলোর সমান গতিবেগে ছুটতে ছুটতে, একসময়ে এলিদের  নক্ষত্রযানটি ছায়াপথের কেন্দ্রের কাছাকাছি গন্তব্যে, এক ডকিং স্টেশনে উপস্থিত হল। স্থানটি যেন পৃথিবীর কোনো সমুদ্রসৈকতের মত। সেখানে সাক্ষাত হল ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে। সব অভিযাত্রীই ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এলির সঙ্গে সাক্ষাত হল, তার প্রয়াত পিতার চেহারার হুবহু অনুরূপ এক ভিনগ্রহবাসীর সঙ্গে।  কোন পথে কিভাবে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, তারা আজ এরকম উন্নত অবস্থায় পৌঁছেছে, তা এলির কাছে তারা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল। তারা বলল, কে তাদের মহাকাশ স্টেশনের ও নক্ষত্রযানের নকসা ইত্যাদি তৈরী করেছিলেন, তা তারা জানে না। বহুদিন ধরেই তারা এসব দেখে ও জেনে আসছে। যারা এসব তৈরী করেছিলেন, তারা বহুদিন আগে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।  এলির পিতার মত দেখতে ভিনগ্রহের প্রাণী, সঙ্কেতবার্তার অর্থোদ্ধার করবাব বিষয়ে এলিকে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, পৃথিবীতে ফিরে সঙ্কেতবার্তার অর্থোদ্ধার করতে এলি যদি অসুবিধায় পড়ে, তবে যেন পাই(π) অসীমমানের সংখ্যার ভিতর খুঁজে দেখেন। সমস্তকিছুর প্রমাণ হিসাবে, এলি নিরবচ্ছিন্ন  ভিডিও রেকর্ড করে রেখে দিলেন।

একসময় পাঁচ অভিযত্রী আবার একত্রিত হলেন। ওয়র্মহোলের ভিতর দিয়ে এলিসহ সবাই পৃথিবীতে ফিরে এলেন। কিন্তু এবার পড়ে গেলেন কঠিন সমস্যায়। এলির সঙ্গে ভিনগ্রহবাসীদেরর সাক্ষাতের কথা কেউ বিগ্বাস করল না। তাদের ধারণায় এলির নক্ষত্রযান কোথাও যায় নি; একই স্থানে সেই একই সময়ে রয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে এলিও ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কোন প্রমাণ দেখাতে পারলেন না, তাঁর সমস্ত ভিডিও মুছে গিয়েছে। বেশ কয়েক সেকেন্ড সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবার সময়, এলি ও তাঁর সঙ্গীরা কি করছিলেন, তার ব্যাখ্যা প্রমাণসহ দাখিল করতে পারলেন না তাঁরা। তাঁরা আইনের চোখে অভিযুক্ত হয়ে গেলেন। পামার জস ও অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ অবশ্য এলির কথা বিশ্বাস করলেন।  এলি ভাবলেন,  সম্ভবত ওয়র্মহোলের ভিতর দিয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের পথে তার  চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এরকম ঘটেছে। এরকম অবস্থায় প্রয়াত পিতার মত দেখতে ভিনগ্রহবাসীর উপদেশমত এলি আবার মৌলিক সংখ্যার ভিতর সঙ্কেতের অনুসন্ধান করতে থাকলেন। একদিন অজস্র মৌলিক সংখ্যার  ভিতর ১১কে ভিত্তি ধরে নিয়ে প্রস্তুত সংখ্যার দ্বারা  এক বৃত্তের সঙ্কেত পাওয়া গেল। এর দ্বারা বোঝানো গেল এলিদের  সঙ্গে সত্যিই ভিনগ্রহবাসীদের সাক্ষাত হয়েছিল।

বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান প্রায় দুই ডজন বই লিখেছেন, যেগুলির মধ্যে  ' কসমস ' ও ' কনট্যাক্ট '  অন্যতম।   এছাড়াও রয়েছে ' দ্য ড্রাগনস অব ইডেন ',  ' ব্রোকাস ব্রেন ',  ' শ্যাডো অব ফরগটন অ্যানসেসটরস ' ও অন্যান্য পুস্তক, অজস্র প্রবন্ধ, বহু বিজ্ঞান গবেষণাপত্র।।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb