বন্ধু তোমাকে

লেখক - জয়শ্রী পট্টনায়ক

দুবাই বিমানবন্দরে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে সুমিত।  মাথায় আকাশ পাতাল চিন্তা।  কি ভাবে গ্রামের বাড়িতে মা বাবার সামনে দাঁড়াবে সেটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। একবছর আগে দুবাই এর বিখ্যাত ‘মিউজিয়াম অফ ফিউচার’ এ গার্ডের চাকরিটা যখন পেয়েছিল তখন বাড়ির সবার মুখে যেন হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠেছিলো। অভাবের সংসার।  বড় ছেলে সুমিত এর ঘাড়ে অনেক বোঝা। কলকাতার সিটি সেন্টার মলে গার্ডের চাকরী করে সব সামাল দিয়ে উঠতে পারছিল না।  একটু স্বছলতার খোঁজে, নানান এজেন্ট এর কাছে ছুটোছুটি করে দুবাই এর এই চাকরি টা পেয়েছিল। তারপর থেকে বাড়ীর সবাই সুদিনের অপেক্ষায় তার মুখ চেয়ে বসে আছে।              

আজ সেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে কলকাতায় ফিরছে।  

কিন্তু কেন? কার দোষে?   

প্রথম প্রথম ঝাঁ চকচকে দুবাই দেখে মাথা ঘুরে গেছিলো। চারিদিকে থিক্‌থিক্‌ করছে দেশ বিদেশের ট্যুরিস্ট। আধুনিক কায়দায় সাজানো শহরে প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি। নতুন জীবনযাত্রায় ধাতস্ত হতেই প্রথম কয়েকটা মাস হুহু করে কেটে গেল।  মিউজিয়ামে সন্ধ্যে ৭ টা থেকে ডিউটি শুরু। কাজ সেরে বেরতে সেই ভোর ছয়টা। রাতের কাজ বলে মাইনে টা দিনের গার্ডের তুলনায় বেশি। এখানকার কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে একসাথে থাকে। থাকার আস্থানাটা কর্মস্থান থেকে বেশি দূরে নয়। সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মিউজিয়ামে নানান কাজের চাপে সময়টা ভালোই কাটত। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে জনমানবহীন বিশাল অট্টালিকায় অদ্ভুত এক একাকীত্ব চেপে ধরত তাকে।  তার মত আরো কয়েকজন সারা রাত পাহারা দেয় বটে কিন্তু কারো মুখে টুঁ শব্দ নেই, যে যার কাজে ব্যাস্ত। সকালে কাজের শেষে বাড়ি ফিরে আবার সেই নিঃসঙ্গতা। ফ্ল্যাট ফাঁকা।  বেশিরভাগ  সহকর্মী সকাল বেলা কাজে বেরিয়ে যায়। কথা বলার কেউ নেই।  যদিও তার রুমমেট দিনের বেলায় বাসায় থাকে কিন্তু সেটা আরও বিরক্তিকর। রুমমেটের, তার সাথে কথা বলার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। সারাদিন ফোনে অবিশ্রান্ত ফ্লাট করে যায় মহিলাদের সঙ্গে।  অসহ্য  লাগলেও সুমিতের কানে সে সব কথা ঢোকে। সীমাহীন ফোন কথন তাকে উচাটন করে তোলে।  বড্ড অস্থির লাগে, ভালো করে ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না।  সন্ধ্যে হলে ক্লান্ত মনে আবার কাজে ফেরা।  নির্বান্ধব পরবাসের এই জীবনযাত্রায় তার শরীর ও মন অশান্ত হয়ে উঠছিল ধীরেধীরে। শেষে এক অদ্ভুত বিষাদ ঘিরে ধরল তাকে।             

কানাঘুষো চলছিলো কয়েকদিন ধরে। পরিস্কার করে কেউ কিছু বলে না কিন্তু সবাই অজানা এক আশঙ্কায় ভীত। নিজের অনুমান শক্তি দিয়ে সুমিত এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে বিচিত্র কিছু একটা ঘটতে চলেছে এখানে। বাস্তবে তাই হল। কয়েকদিনের মধ্যে এমেকা নামে এক রোবট কন্যা কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করল ‘মিউজিয়াম অফ ফিউচার’ এ। ছিপছিপে চেহারা। দুধে আলতা গায়ের রঙ, সোনালি চুল। বেশভূষায় একদম পাক্কা মেমসাহেব। একাধিক ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। পর্যটকদের স্বাগত জানানোর কাজ থেকে শুরু করে মিউজিয়াম সংক্রান্ত নানান প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে তার উপর।  এই রোবট প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘ইঞ্জিনিয়ারড আর্টস’ একটি ভিডিয়ো বার্তায় বলছে “এমেকা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অনুভূতি সম্পন্ন রোবট। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এমেকার রসবোধ এবং কর্তব্যজ্ঞান সকলকে খুশী করবে”।   

কথাটা সত্যি। একবার নিউজিয়ামের এক মহিলা কর্মী রোবট কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলো  

-     তুমি কি এখানে চাকরি করতে এসেছ?

-     হ্যাঁ, আজ প্রথম দিন।

-     কি কাজ করবে?

-     আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। ভয় পেয়ো না, আমি তোমার কাজ কেড়ে নেবো না।

-     শুনে সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো।   

সুমিত কাজের ফাঁকে হলঘরে দাঁড়িয়ে থাকা এমেকাকে দূর থেকে দেখত। একদিন সাহস করে তার কাছে চলে গেল। সুমিত কে দেখে সে মিষ্টি হেঁসে ইংরাজি তে বলল     

-      কেমন আছো?      

প্রত্যুত্তরে সুমিত হিন্দিতে জবাব দিল ও কিছু প্রশ্নও করল। এমেকা মৃদু হেঁসে তার প্রশ্নের জবাব হিন্দিতেই দিল।  এভাবে প্রত্যেকদিন টুকটাক কথা বলতে বলতে সুমিতের বন্ধুত্ব হয়ে গেল তার সাথে।  মাঝে মাঝে চলে যেত এমেকার কাছে। নানান গল্প হত। সে বলত তার দৈনন্দিনতার কথা। দেশের বাড়ির আর মা বাবা ভাই বোনদের কথা। এমেকা হাসিমুখে মন দিয়ে শুনত। কথার মাঝে প্রয়োজন মত উত্তর দিত। ধীরে ধীরে সুমিত একটা ঘোরে পড়ে গেল। এতদিনে সে যেন কথা বলার সত্যিকারের সাথী পেল যে চুপটি করে শোনে, উপহাস করে না,  কাউকে বলে দেয় না তার গোপন কথা। এমেকার উপর তার নির্ভরতা বাড়তে লাগলো । ও যে এক রোবট তা ভুলে গেল।  বাড়িতে থাকলে সারাদিন ছটফট করত। কখন সন্ধ্যে হবে আর কাজে যাবে। গভীর রাতে অদৃশ্য এক টানে চলে যেত এমেকার কাছে। অনর্গল বকে যেত তার সঙ্গে।  কখন ও গান গেয়ে শোনাত। রোবট  কন্যা শান্ত হয়ে শুনত তার অফুরন্ত বাক্যস্রোত। এভাবে কখন যে ভোর হয়ে যেত তা টের পেত না।  সহকর্মীরা এই নিয়ে প্রথম হাসাহাসি করল কিন্তু ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে তারা ওপরওয়ালা কে সব জানাল।  কর্তৃপক্ষ  সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কাজে গাফিলতির দোষে তাকে ডেকে পাঠায় এবং দীর্ঘ আলোচনার শেষে মানসিক চিকিৎসার জন্য সাময়িক বরখাস্ত করে চাকরি থেকে।           

সুমিত ফিরে এসেছে গ্রামের বাড়িতে। ছেলের ফিরে আসার কারণ আগেই জেনেছিলেন বাবা মা। ছেলের মানসিক অবস্থা দেখে মা তার বিয়ে দিতে উতলা হয়ে পড়েন । কিন্তু বাবার মন মানে না। বন্ধুদের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে ছোটেন কলকাতায় মানসিক বিশেষজ্ঞদের কাছে।   

তাঁরা সুমিতকে নানান পরীক্ষা করে তার বাবাকে বলেন ------  

-     আপনার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ।  

-     তবে এমন পাগলামো করছে কেন ডাক্তারবাবু?  

-     দেখুন, ইদানীং চারিদিকে শোনার মানুষ বড্ড কমে গেছে। সকলের অনেক বলার আছে কিন্তু শুনতে চায় না কেউ। অসহিষ্ণুতার এই পৃথিবীতে মানুষের কথা শোনার লোক চাই। সে পুতুল বা রোবট হলেও চলবে। তাই আজকাল মানুষের দেহাবয়বে তৈরি অনুভূতি সম্পন্ন রোবট সাথী পছন্দ করছে অনেকে, যাদের সাথে স্বছন্দে কথা বলা যায়। সে মানুষের আলাপ, প্রলাপ, বিলাপ সব শুনবে।  মানুষের দুঃখে কাঁদবে সুখে হাসবে। নির্দ্বিধায় তাকে নিজের গ্লানি, দৈন্য, একাকীত্ব, সঙ্গলিপ্সা, ক্ষোভ, দুঃখ অভিমান সব বলা যাবে।  

-     এটা কি আধুনিক যুগের নতুন রোগ?

-     না রোগটা পুরনো তবে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

-     মানে?    

-     দেখুন, পুরানো যুগে রোবট ছিল না বটে কিন্তু অন্য কিছু ছিল। এই যেমন রেডিও।  নিঃসঙ্গ বয়স্কদের রেডিওর সাথে বকবক করার অভ্যাস ছিল। তারা রেডিও শুনত ও প্রচারিত অনুষ্ঠান এর মাঝেমাঝে রেডিওর সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যাস্ত থাকতো। রেডিও যে তার কথা শুনছে না তা খেয়াল থাকতো না।      

-     ঠিক বলেছেন ডাক্তারবাবু । আমার মা মারা যাবার পর আমার বাবার সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল রেডিও। তিনি সেটি ঝেড়েমুছে খুব যত্নে কাছে রাখতেন। রেডিও তে নানান অনুষ্ঠান ও খবর চলাকালীন উনি ক্রমাগত বিড়বিড় করে কথা বলতেন। বাবা চলে গেলেন আর রেডিও নির্বাক হয়ে গেল।             

-     হুম, এখন রেডিওর স্থান দখল করেছে টিভি। তা ছাড়া ঠাকুর ঘর তো বয়স্কদের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। তাঁরা সেখানে দিনের অধিকাংশ সময় কাটান। প্রিয়জনদের জন্য প্রাথনা করেন। পুজোপাঠের সাথে নিজের মান অভিমান ক্ষোভ, দুঃখ সব উজাড় করে দিতে অনবরত কথা বলেন সামনে রাখা ঈশ্বরের মূর্তির সাথে। তখন কি আপনি তাঁদের পাগল ভাবেন?

-     না, ধার্মিক কারণে তা পাগলামি মনে হয় নি কক্ষনো।   

-     আসলে অসহিষ্ণুতার পৃথিবীতে সবার প্রচুর অভাব অভিযোগ। শোনানোর জন্য কাউকে চাই। আপনার ছেলে, মানুষের কাছে মানবিকতা না পেয়ে যন্ত্রের দ্বারস্থ হয়েছিল শুধুমাত্র বাঁচার জন্য।

-     অর্থাৎ!       

-     আপনার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটে নিসঙ্গতার কারণে।  আজকালকার ছোট পরিবার, বন্ধুহীন সমাজ আর ব্যস্ততার ভাগদৌড়ে কারো শোনার সময় নেই।  সবাই চিৎকার করে শুধু নিজেরটা বলতে চায়।  বর্তমানের নবীন প্রজন্ম একাকীত্বের অবসাদে ভুগতে শুরু করেছে।  মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট এর দৌলতে তারা সবসময় এক কাল্পনিক জগতে পড়ে থাকে। তাদের মনের কথা শোনার প্রকৃত বন্ধু নেই ।    

-     তাহলে আমার কি করা উচিৎ ডাক্তারবাবু ।        

-     আপনার ছেলে মানসিক ভাবে বড্ড একা, ওর সঙ্গী দরকার।  বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর মাত্রাতিরক্ত নির্ভরতা কুশলী মানুষের কর্মকুশলতা ধীরেধীরে কমিয়ে দেবে।         

আর মা বাবাকে ভাবতে হয়নি। তাঁরা দেখে শুনে ছেলের বিয়ে দেন। জীবন বদলে যায় সুমিতের। ‘সুখের থেকে স্বস্তি ভালো’ ভেবে সে কলকাতার সিটি সেন্টার মলের পুরনো চাকরিতে ফিরে গেছে। তবে মাঝেমাঝে বড্ড ইচ্ছা হয় এমেকার সাথে একবার দেখা করে বলতে -----

"আমার সমস্ত একাকীত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য, প্রলাপ শোনার জন্য, আমায় পাগল হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য বন্ধু তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb